
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সেনাবাহিনীর ভূমিকা এবং অবস্থান নিয়ে নানা প্রশ্ন ও জল্পনা কল্পনা তৈরি হয়েছে। গতকাল ঢাকা সেনানিবাসের অফিসার্স মেসে এক সংবাদ সম্মেলনে সেনাসদর থেকে যেভাবে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরা হলো, তা এসব প্রশ্নেরই উত্তর দেয়ার একটি প্রচেষ্টা বলে মনে হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজিম-উদ-দৌলা এবং কর্নেল মো. শফিকুল ইসলাম স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছেন, সরকার এবং সেনাবাহিনী বিপরীতমুখী নয় বরং একসঙ্গে কাজ করছে।
সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ‘করিডোর’ ইস্যুতে সেনাবাহিনীর অবস্থান ছিল সাংবাদিকদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। এ নিয়ে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজিম-উদ-দৌলা বলেন, এটি একটি স্পর্শকাতর বিষয় এবং এ বিষয়ে সেনাবাহিনী কোনো এমন কার্যক্রমে যুক্ত হবে না, যা দেশের নিরাপত্তা বা সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি তৈরি করে। তিনি আরও বলেন, করিডোর ইস্যু এবং সীমান্তে আরসা-র উপস্থিতি একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত নয়, বরং ভিন্ন প্রসঙ্গ।
এই সংবাদ সম্মেলন শুধু একটি ব্যাখ্যা নয়, বরং সাম্প্রতিক নানা গুজব, মিডিয়ার আলোচনা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মন্তব্যের প্রেক্ষিতে সেনাবাহিনীর অবস্থান পুনরায় স্পষ্ট করার চেষ্টা। কারণ, উপদেষ্টা পরিষদের সর্বশেষ বৈঠকে যেভাবে সেনাবাহিনীর নাম না নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ পেয়েছে, তাতে ধারণা করা যায় সরকার ও সেনাবাহিনীর মধ্যে পারস্পরিক আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে।
তারও আগে গত ৫ আগস্টের পর থেকেই সেনাবাহিনী কিছু রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে। সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় হলো, তারা প্রথমেই জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে বসে, যেখানে জাতীয় নির্বাচনসহ সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। বিএনপির সঙ্গে এমন কোনো বৈঠক হয়েছে কিনা—সে বিষয়ে নিশ্চিত কোনো তথ্য মেলেনি।
যদিও সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছে সরকার ও সেনাবাহিনী একসঙ্গে কাজ করছে এবং কোনো মতপার্থক্য নেই, তবুও বাস্তবতা কিছুটা ভিন্ন চিত্র দেখায়। সেনাবাহিনী যদি সত্যি একসঙ্গে কাজ করছে, তবে কেন তারা প্রথমে জামায়াতের সঙ্গে বৈঠকে বসল? কেন তারা নিজ উদ্যোগে প্রেস ব্রিফিং শুরু করার সিদ্ধান্ত নিল, যেখানে সরকারের পক্ষ থেকে এখনো তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি?
এখন থেকে প্রতি বৃহস্পতিবার সেনাবাহিনী নিয়মিত প্রেস ব্রিফিং করবে বলে যে ঘোষণা দিয়েছে, তা একদিকে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ইঙ্গিত দেয়, অন্যদিকে এটি সেনাবাহিনীর একটি সক্রিয় রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক বা এমনকি অংশগ্রহণকারীর ভূমিকার সূচনাও হতে পারে—এমন আশঙ্কাও তৈরি করছে।
এই সবকিছু মিলিয়ে মনে হচ্ছে, সরকার ও সেনাবাহিনীর মধ্যে এক ধরনের দূরত্ব তৈরি হয়েছে যা অস্বীকার করা কঠিন। এই দূরত্ব মেটানোর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ এখনো চোখে পড়ছে না। আর সেই শূন্যস্থানে সেনাবাহিনী নিজেই নিজের অবস্থান জনগণের সামনে তুলে ধরছে এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক পক্ষের সঙ্গে আলোচনায় বসছে।
প্রশ্ন হলো—এই আলোচনা কেবল পরিস্থিতি বোঝার জন্য, নাকি কোনো ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক রূপরেখার সম্ভাব্য খসড়া তৈরির প্রক্রিয়া? সময়ই এর উত্তর দেবে। তবে এখন যা দেখা যাচ্ছে, তা হলো—বাংলাদেশের রাজনীতির মঞ্চে সেনাবাহিনী আবারো তাদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে, তবে তা এই মুহূর্তে সরাসরি নয়, বরং আড়ালের কৌশলে।
এ ধরনের সময়ে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বিষয় হলো—জনগণের স্বার্থ ও দেশের স্থিতিশীলতা। সেনাবাহিনী হোক কিংবা সরকার—উভয়ের দিক থেকেই সতর্ক, দায়িত্বশীল ও স্বচ্ছ আচরণই কেবল পরিস্থিতিকে উত্তরণের পথ দেখাতে পারে। এখন দেখার বিষয়, এই উত্তরণ কতটা শান্তিপূর্ণ, নাকি আরেকটি অস্থিরতার অধ্যায় রচিত হচ্ছে আমাদের চোখের সামনেই।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে মে, ২০২৫ সকাল ৮:৪১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





