somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শুভ জন্মদিন মৃণাল সেন

১৪ ই মে, ২০১৪ সকাল ৯:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



বাংলা চলচ্চিত্রের গতিধারা পাল্টে দেওয়া এক চলচ্চিত্রকার মৃণাল সেন। জন্মেছিলেন তিনি বাংলাদেশের ফরিদপুরে ১৯২৩ সালের ‌‌‌১৪ মে। আন্তজার্তিক খ্যাতিসম্পন্ন এ চলচ্চিত্রকারের ৯১তম জন্মবার্ষিকী আজ। শুভ জন্মদিন চলচ্চিত্রকার মৃণাল সেন।

বাংলা চলচ্চিত্রের ট্রিলোজিতে সত্যজিৎ রায় ও ঋত্বিক ঘটকের পাশেই রয়েছেন মৃণাল সেন। আমাদের গর্বের বিষয় হলো এই তিন কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকারেরই অাদিনিবাস বাংলাদেশ।

এ দেশের আলো-হাওয়া গায়ে মেখেই কেটেছে মৃণাল সেনের শৈশব-কৈশোর। ফরিদপুরের কাঁদামাটিতে হেঁটে হেঁটেই পা রাখেন তারুণ্যের চৌকাঠে। কিন্তু দেশ বিভাগের রাজনৈতিক ডামাঢোল তাকে ঠেলে দেয় কলকাতায়।

কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা বিষয়ে পড়াশোনা করেন মৃণাল সেন। পদার্থ বিজ্ঞানের একজন ছাত্র হয়ে শিল্পকলার সেরা মাধ্যম চলচ্চিত্রে প্রতি তিনি কী করে ঝুঁকলেন এ এক বিস্ময়।

অবশ্য ছাত্রজীবনে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের প্রতি ছিল তার আগ্রহ। কমিউনিস্ট পার্টির সাংস্কৃতিক শাখার সঙ্গে যুক্ত থাকলেও সরাসরি কখনও কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হননি। চল্লিশের দশকে গণ নাট্যসংস্থার (ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশন/আইপিটিএ) সঙ্গে যুক্ত হন। এ সংস্থার মাধ্যমে তিনি সমভাবাপন্ন মানুষদের কাছাকাছি আসতে সক্ষম হন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র থাকাকালে তিনি একজন সাংবাদিকতাও করেছেন দীর্ঘদিন। কিছুদিন চলচ্চিত্রের শব্দ কলাকুশলী হিসেবে কাজ করেন।

গণনাট্য সংস্থার হয়ে গ্রামের হাটে-মাঠে-ঘাটে ঘুরে ঘুরে মৃণাল সেন দেখা পান জীবনের শতধারার। মনের ক্যানভাসে গেঁথে রাখা সেইসব ছবি সেলুলয়েডে আকাঁর স্বপ্নে বিভোর হয়ে নির্মাণ করেন প্রথম ছবি 'রাতভোর'। ১৯৫৫ সালে মুক্তি পাওয়া মৃণাল সেন পরিচালিত প্রখম ছবিটি ব্যবসায়িকভাবে সাফল্যের মুখ দেখেনি। চলচ্চিত্রকার হিসেবে এনে দেয়নি পরিচিতি।

প্রথম ছবির মুখ থুবড়ে পড়ায় একটু যেন থমকে যান তরুণ মৃণাল সেন। তবে সংশপ্তক তিনি, শুরুতেই হাল ছেড়ে দেয়ার মতো মানুষ নন। গুছিয়ে নিতে একটু সময় লেগে যায়। প্রথম ছবি মুক্তির চার বছর পর ১৯৫৯ সালে মুক্তি পায় মৃণাল সেন পরিচালিত দ্বিতীয় ছবি 'নীল আকাশের নিচে'। মৃণাল নামে যে একজন চলচ্চিত্রকার আছেন, দ্বিতীয় ছবিটি তাকে সেই পরিচিতি এনে দেয়।

একটুখানি সাফল্যই বাড়িয়ে দেয় পরিচালক মৃণাল সেনের গতি। পরের বছরই অর্থাৎ ১৯৬০ সালে মুক্তি পায় তার তৃতীয় ছবি 'বাইশে শ্রাবণ'। শুরু হয় চলচ্চিত্রকার মৃণাল সেনের জয়যাত্রা। এ ছবিটিই তাকে প্রথম আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দেয়।

বাংলা চলচ্চিত্রে নতুন ধারার সঙ্গে মৃণাল সেন দর্শকদের পরিচয় করিয়ে দেন তার 'ভুবন সোম' ছবিটির মাধ্যমে পরিচয় করিয়ে দেন মৃণাল সেন। ১৯৬৯ সালে মুক্তি পাওয়া এ ছবিটিতে অভিনয় করেন শক্তিমান অভিনেতা উৎপল দত্ত। অনেকের মতে, এটিই মৃণাল সেনের শ্রেষ্ঠ ছবি।

এরপর পরই মৃণাল সেন তার কলকাতা ট্রিলজি 'ইন্টারভিউ' (১৯৭১), 'ক্যালকাটা ৭১' (১৯৭২)এবং 'পদাতিক' (১৯৭৩) ছবি তিনটির মাধ্যমে তিনি তুলে ধরেন তৎকালীন নগরজীবনের অস্থিরতাকে অবস্থাকে তুলে ধরেন।

মধ্যবিত্ত সমাজের নীতিবোধকে মৃণাল সেন তুলে ধরেন তার বহুল প্রশংসিত দুটি ছবি 'একদিন প্রতিদিন' (১৯৭৯) এবং 'খারিজ' (১৯৮২) এর মাধ্যমে। 'খারিজ' ছবিটি ১৯৮৩ সালের কান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বিশেষ জুরি পুরস্কার পেয়েছিল।

১৯৮০ সালে মুক্তি পাওয়া মৃণাল সেনের 'আকালের সন্ধানে' মুক্তি পায় আর রাতারাতি হইচই ফেলে দেয়। এতে দেখানো হয়েছিল একদল চলচ্চিত্র কলাকুশলী একটি গ্রামে গিয়ে ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের উপর একটি চলচ্চিত্র তৈরি করতে যান এবং একসময় দুর্ভিক্ষের কাল্পনিক কাহিনীর সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় সেই গ্রামের সাধারণ মানুষদের সাথে সেটাই ছিল এই চলচ্চিত্রের সারমর্ম। 'আকালের সন্ধানে' ১৯৮১ সালের বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বিশেষ জুরি পুরস্কার হিসাবে রৌপ্যভালুক জয় করে।

এরপর মৃণাল সেনে তৈরি করেন 'মহাপৃথিবী' (১৯৯২) এবং 'অন্তরীণ' (১৯৯৪)। এখনও অবধি তার শেষ ছবি 'আমার ভুবন' মুক্তি পায় ২০০২ সালে।

মৃণাল সেন বাংলা ভাষা ছাড়াও হিন্দি, ওড়িয়া ও তেলেগু ভাষায় চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। ১৯৬৬ সালে ওড়িয়া ভাষায় নির্মাণ করেন মাটির মনীষ, যা কালীন্দিচরণ পাণিগ্রাহীর গল্প অবলম্বনে নির্মিত হয়। ১৯৬৯ এ বনফুলের কাহিনী অবলম্বনে হিন্দি ভাষায় নির্মাণ করে ভুবন সোম। ১৯৭৭ সালে প্রেম চন্দের গল্প অবলম্বনে তেলেগু ভাষায় নির্মাণ করেন ওকা উরি কথা। ১৯৮৫ সালে নির্মাণ করেন জেনেসিস, যা হিন্দি, ফরাসি ও ইংরেজি তিনটি ভাষায় তৈরি হয়।

মৃণাল সেন নিমির্ত চলচ্চিত্র বিশ্বের বড় বড় চলচ্চিত্র উৎসবে প্রশংসা পাওয়ার পাশাপাশি অনেক পুরস্কারও জিতেছে। ১৯৮১ সালে বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে 'আকালের সন্ধানে' চলচ্চিত্রটি বিশেষ জুরি পুরস্কার রৌপ্যভল্লুক জয় করে। ১৯৮৩ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে 'খারিজ' বিশেষ জুরি পুরস্কার পায়। ভারত এবং ভারতের বাইরে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করেছে। তিনি একবার ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব দি ফিল্মেও প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।

১৯৮১ সালে তিনি ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার ‌'পদ্মভূষণ' লাভ করেন। ২০০৫ সালে ভারতীয় চলচ্চিত্রের সর্বোচ্চ পুরস্কার 'দাদাসাহেব ফালকে' পান। ১৯৯৮-২০০৩ সালে তিনি ভারতীয় সংসদের সাম্মানিক সদস্যপদ লাভ করেন। ২০০০ সালে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তাকে অর্ডার অব ফ্রেন্ডশিপ সম্মানে ভূষিত করেন। মৃণাল সেনকে ফরাসি সরকার তাদের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান 'কমান্ডার অব দি আর্টস অ্যান্ড লেটারস'-এ ভূষিত করেন।

বয়সের কারণে দীর্ঘদিন ধরে চলচ্চিত্র নির্মাণ থেকে দূরে আছেন। তবে তাই বলে সিনেমাকে তিনি বিদায় বলতে পারেননি। দক্ষিণ কলকাতার পদ্মপুকুরের কাছে এক বহুতল ভবনের পাঁচতলার ফ্ল্যাটে মৃণাল সেন এখনো চলচ্চিত্রের মধ্যেই দিনের বেশির ভাগ সময় কাটান। সিনেমা হলে গিয়ে ছবি দেখার মতো শারীরিক অবস্থা না থাকায় ঘরে বসেই ভিডিওতে দেখেন নতুন নতুন সিনেমা। বিশেষ করে তরুণ নির্মাতাদের ছবি দেখেন ভীষণ আগ্রহ নিয়ে। কারো কাজ ভালো লেগে গেলে তার সঙ্গে চলচ্চিত্র আড্ডা দিয়ে একটি বিকেল কাটাতে ভুল করেন না মৃণাল সেন।

বাড়ির উঠান থেকে বিশাল ময়দান, কানাগলি থেকে রাজপথ, বস্তি থেকে অট্টালিকার চিত্র মৃণাল সেন এমনই অর্থবহ করে তার ছবিগুলোতে তুলে ধরেছেন যেগুলো শেষ পর্যন্ত শুধু একটি ভূখন্ডের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকেনি, পেয়েছে বৈশ্বিক রূপ। আর এখানেই মৃণাল সেন চলচ্চিত্রকার হিসেবে অনন্য, আর সবার থেকে আলাদা।
লিংক দেখুন


০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বারবাজারে মাটির নিচ থেকে উঠে আসা মসজিদ

লিখেছেন কামরুল ইসলাম মান্না, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৪০

ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার বারবাজার ইউনিয়নে মাটির নিচ থেকে মসজিদ পাওয়া গেছে। এরকম গল্প অনেকের কাছেই শুনেছিলাম। তারপর মনে হলো একদিন যেয়ে দেখি কি ঘটনা। চলে গেলাম বারবাজার। জানলাম আসল... ...বাকিটুকু পড়ুন

সৎ মানুষ দেশে নেই,ব্লগে আছে তো?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮








আশেপাশে সৎ মানুষ কেমন দেখা যায়? উনারা তো নাকি একা থাকে, সময় সুযোগে সৃষ্টিকর্তা নিজের কাছে তুলে নেয় যা আমাদের ডেফিনিশনে তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া বলে। আপনি জীবনে যতগুলো বসন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

পরিবর্তন অপরিহার্য গত দেড়যুগের যন্ত্রণা জাতির ঘাড়ে,ব্যবসায়ীরা কোথায় কোথায় অসহায় জানেন কি?

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:৫৭


রমজানে বেশিরভাগ ব্যবসায়ীকে বেপরোয়া হতে দেখা যায়। সবাই গালমন্দ ব্যবসায়ীকেই করেন। আপনি জানেন কি তাতে কোন ব্যবসায়ীই আপনার মুখের দিকেও তাকায় না? বরং মনে মনে একটা চরম গালিই দেয়! আপনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯

মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা বলতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×