somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিতর্কিত অংশবিশেষ: কী আছে একে খন্দকারের বইতে?

০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ সকাল ৮:৪৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশ বাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ ও আওয়ামী লীগের সাবেক পরিকল্পনা মন্ত্রী এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) একে খন্দকারের লেখা ‌বই '১৯৭১: ভেতরে-বাইরে'। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালের অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণের কথা তিনি বইটিতে তুলে ধরেছেন। এই বইটি নিয়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছে তোলপাড়।

বইটিতে একে খন্দকারের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করার অভিযোগ এনে তীব্র সমালোচনা করেছেন সংসদ সদস্যরা। তাকে ‘কুলাঙ্গার’, ‘অকৃতজ্ঞ’ ও ‘খন্দকার মোশতাকের অনুগত’ আখ্যায়িত করে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে শাস্তি ও বইটি বাজেয়াপ্তের দাবি জানান সরকার, বিরোধী দল ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা। থেমে নেই সংসদের বাইরে বিতর্ক। আওয়ামী লীগের সাবেক এ মন্ত্রীর পক্ষে কথা বলছেন বিএনপির নেতারা। আর ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ থেকে শুরু করে তৃণমুল পর্যায়ের নেতারা ফেটে পড়েছেন ক্ষোভে।

কী লিখেছেন একে খন্দকার '১৯৭১: ভেতরে-বাইরে' বইটিতে? গত ৩ সেপ্টেম্বর প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয় বইটি। এদিন রাজধানীর বেঙ্গল গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত হয়েছে বইটির প্রকাশনা উৎসব। ইতিহাসবিদ সিরাজুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বইটিকে অকপট ও বস্তুনিষ্ঠ বলে উল্লেখ করে বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ডা: সারওয়ার আলী এবং যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আলী রীয়াজ। তবে কী বইয়ের বিতর্কিত বিষয়গুলো না পড়েই বক্তব্য রেখেছেন উল্লেথিত গুনিজনরা। আর যারা বইটির পক্ষে বিপক্ষে বিতর্কে মেতে ওঠেছেন তারা সবাই কী বইটি পড়েছেন? নাকি লোক মুখে শুনে 'চিলে কান নিয়েছে'-এর মতোই হুজুগে মেতে একে খন্দকারের সমালোচনা করছেন!

‘১৯৭১ : ভেতরে বাইরে’ বইয়ে একে খন্দকার মুলত বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের জন্য রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রস্তুতি ছিল না। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের বক্তব্যের কথা বলতে গিয়ে লেখক এ কথাটিই বলার চেষ্টা করেছেন যে, সেদিন বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার বিষয়ে যেসব কথা বলেছেন তা আসলে বাস্তবে পরিণত করার মতো প্রস্তুতি আওয়ামী লীগের নেতাদের ছিল না।

একে খন্দকারের লেখা ‘১৯৭১: ভেতরে বাইরে’ বইয়ের বিতর্কিত কিছু অংশ প্রতিমুহূর্ত ডটকমের পাঠকের কাছে তুলে ধরা হলো-

একে খন্দকার লিখেছেন, ‌‌‘ফেব্রুয়ারি মাসের বিভিন্ন ঘটনা দেখে আমার মনে হয়েছিল, পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বা আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। ইতিমধ্যেই তারা গোপনে পূর্ব পাকিস্তানে সৈন্য নিয়ে আসা শুরু করে। পাকিস্তানিদের এ ধরনের খারাপ মতলব বা কর্মকাণ্ড সাধারণ মানুষ বা রাজনৈতিক নেতাদের পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না। এমনকি বাঙালি সামরিক কর্মকর্তাদের কাছেও বিষয়টা খুব গোপন রাখা হতো। সম্ভবত বাঙালি হিসেবে আমিই প্রথম পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য নিয়ে আসার বিষয়টি বুঝতে পেরেছি।’

বইটির ৩১ ও ৩২ পৃষ্ঠায় এ কে খন্দকার লিখেছেন, “সাতই মার্চের ভাষণের দিন ক্যান্টনমেন্টের ভেতরের পরিস্থিতি বেশ স্বাভাবিক ছিল, সবাই ব্যস্ত ছিল নিজ নিজ কাজে। এদিন বঙ্গবন্ধু যে ভাষণটি দিলেন, তা খুবই তির্যক ছিল। ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে বাঙালিরা ভাবতে আরম্ভ করল, সত্যিই কি যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল, আমরা কি যুদ্ধে নামব, নাকি গ্রামে চলে যাব।

সাতই মার্চের ভাষণটি আমি শুনেছি। এর মধ্যে যে কথাগুলো আমার ভালো লেগেছিল, তা হলো : ‘দুর্গ গড়ে তোলো’, ‘তোমাদের যার যা কিছু আছে, তা-ই নিয়ে প্রস্তুত থাকো’, ‘শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে’, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এ সময় সমগ্র বাংলাদেশের মানুষ তার কাছ থেকে এ ধরনের কথা আশা করছিল। ওই কথাগুলো শক্তিশালী ছিল বটে, তবে তা বাস্তবে রূপ দেওয়ার পরিকল্পনা আওয়ামী লীগের নেতাদের ছিল না। বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি তাৎপর্যপূর্ণ ছিল, কিন্তু আমার মনে হয়েছে, কীভাবে স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে, তা তিনি পরিষ্কার করেননি। তা ছাড়া জনগণকে যুদ্ধ করার জন্য যেভাবে প্রস্তুত করা প্রয়োজন, তা করা হয়নি। ভাষণে চূড়ান্ত কোনো দিকনির্দেশনা পাওয়া গেল না। ভাষণটির পর মানুষজন ভাবতে শুরু করল- এরপর কী হবে? আওয়ামী লীগের পূর্বপ্রস্তুতি না থাকায় যুদ্ধ শুরু করার কথা বলাও একেবারে বোকামি হতো। সম্ভবত এ কারণেই বঙ্গবন্ধু সাতই মার্চ সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা থেকে বিরত থাকেন। তা ছাড়া ইয়াহিয়া খান নিজেও ওই ধরনের ঘোষণা না দেওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধুকে অনুরোধ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু হয়তো ঢাকায় ইয়াহিয়ার উপস্থিতিতে একটি রাজনৈতিক সমাধানের সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছিলেন।”

একে খন্দকার লিখেছেন, “বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণেই যে মুক্তিযুদ্ধ আরম্ভ হয়েছিল, তা আমি মনে করি না। এই ভাষণের শেষ শব্দ ছিল ‘জয় পাকিস্তান’। তিনি যুদ্ধের ডাক দিয়ে বললেন, ‘জয় পাকিস্তান’! এটি যে যুদ্ধের ডাক বা স্বাধীনতার আহ্বান, তা প্রচণ্ডভাবে প্রশ্নবিদ্ধ এবং তর্কাতীতও নয়। যদি আওয়ামী লীগের নেতাদের কোনো যুদ্ধ-পরিকল্পনা থাকত তাহলে মার্চের শুরু থেকে জনগণ এবং সরকারি, বেসরকারি ও সামরিক কর্মকর্তাদের স্বল্প সময়ে সঠিকভাবে সংগঠিত করা যেত। সেটা করা হলে আমার মনে হয় যুদ্ধটি হয়তো-বা খুব অল্প সময়ের মধ্যে শেষ হয়ে যেত এবং আমাদের বিজয় নিশ্চিত হতো। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, সেটা করা হয়নি।”

তিনি বইয়ে আরও লিখেছেন, "২৫ মার্চ রাতে হাজার হাজার মানুষ বেঁচে যেতেন, যদি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আমরা ঠিক সময়ে যুদ্ধ শুরু করতে পারতাম। বারবার মনে প্রশ্ন জাগে, বঙ্গবন্ধু কেন ওই রাতে কাউকে কিছু বলে গেলেন না? আবার ভাবি, উনি কাদের বলবেন? হয় তাজউদ্দীন সাহেব, না হয় নজরুল ইসলাম সাহেবকে।

তিনি হয়তো বাঙালি সামরিক কর্মকর্তাদেরও বলে যেতে পারতেন। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমরা তাঁর (মুজিব সাহেবের) নির্দেশনা জানতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু তিনি কাউকে কিছু বলেননি বা আমরা কিছুই জানতে পারিনি।"

একে খন্দকার তার বইয়ে বলেন, "আমি মনে করি, জাতির এ ধরনের ক্রান্তিকালে রাজনৈতিক পরিকল্পনা ছাড়াও একাধিক বিকল্প পরিকল্পনা থাকা উচিত ছিল, যাতে একটি ব্যর্থ হলে অন্যটি প্রয়োগ করা যায়। আমি এমন কোন তথ্য পাইনি, যাতে মনে করতে পারি যে রাজনৈতিক পন্থা ব্যর্থ হলে আওয়ামী লীগ নেতারা বিকল্প পন্থা হিসেবে অন্য কোন উপায় ভেবে রেখেছিলেন।

সম্ভবত মার্চ মাসের শুরুতে পাকিস্তান থেকে অস্ত্র ও সেনা আনার বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ করেছিলেন বাঙালি বৈমানিক ক্যাপ্টেন নিজাম চৌধুরী। তিনি পিআইএর কো-পাইলট ছিলেন। এক পর্যায়ে তিনি পিআইএর বিমানে সৈনিক পরিবহনে অস্বীকৃতি জানান এবং বিমান থেকে নেমে চলে যান। সামরিক কর্তৃপক্ষ এটাকে সহজভাবে নেয়নি। তারা ক্যাপ্টেন নিজামকে বরখাস্ত এবং অন্তরীণ করে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে।"

তিনি লিখেছেন, "সত্যি কথা বলতে কি, আমরা রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকে কোন নির্দেশ পাইনি। এ বিষয়ে রাজনৈতিক নেতারা আমাদের কিছু জানাননি। যদি কেউ বলেন যে তখন আওয়ামী লীগের নেতারা যুদ্ধের নির্দেশনা দিয়েছিলেন, তবে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলতে হয় যে তা সঠিক নয়।

অন্তত আমি কোন নির্দেশনা পাইনি। শোনা যায়, মার্চ মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলের (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ছাত্ররা নিজ উদ্যোগে পুরনো ৩০৩ রাইফেল দিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করার প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিল।

কিন্তু বর্তমান সময়ের মতো তখন তথ্যপ্রযুক্তি এত উন্নত ছিল না। তাই এ ধরনের কোন তৎপরতার খবর তাৎক্ষণিকভাবে আমি বা অন্য কোন সামরিক কর্মকর্তারা জানতে পারিনি। এর ফলে কর্মরত বাঙালি সামরিক কর্মকর্তাদের ধারণা হয় যে রাজনৈতিক নেতাদের কোন ধরনের যুদ্ধ প্রস্তুতি নেই। ফলে ২৫ মার্চ ঢাকাসহ সারা দেশে যখন পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ করল, তখন এটিকে প্রতিহত করার জন্য বাঙালি সেনাসদস্যদের কোন প্রস্ততি ছিল না। এটাই ছিল বাস্তব সত্য।”

বইয়ের ৫৩ পৃষ্ঠায় এ কে খন্দকার লিখেছেন, “স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে বঙ্গবন্ধু প্রকাশ্যে কাউকে কিছু বলেননি। অনেকে বলেন, ২৫ মার্চ রাতে এক হাবিলদারের মারফত চিরকুট পাঠিয়ে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। আবার বলা হয়, বঙ্গবন্ধু চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগের নেতা জহুর আহমেদ চৌধুরীকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার জন্য সংবাদ পাঠিয়েছিলেন। কোথাও কোথাও এমনও উল্লেখিত হয়েছে যে বঙ্গবন্ধু ইপিআরের বেতার যন্ত্রে বা ডাক ও তার বিভাগের টেলিগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তাটি প্রচার করেন। কিন্তু এগুলোর কোনো যুক্তিসঙ্গত প্রমাণ নেই।”


স্বাধীনতার ঘোষণা প্রসঙ্গে তিনি আরো লিখেছেন, “কোনো মাধ্যমে বা চিরকুটে পাঠিয়ে বঙ্গবন্ধু যে স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে, ২৫ মার্চ রাতে তার ঘনিষ্ঠ নেতা-কর্মীরা প্রায় শেষ সময় পর্যন্ত তার সঙ্গে ছিলেন। অথচ তারা কেউ কিছু আঁচ করতে পারবেন না বা জানতে পারবেন না, এটা তো হয় না। তবে কি তিনি তাদের বিশ্বাস করতে পারেননি? এটা তো আরও অবিশ্বাস্য। বঙ্গবন্ধু যদি স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেনই, তবে তিনি ৩২ নম্বর সড়কের বাসায় থাকবেনই বা কেন।

মুক্তিযুদ্ধকালে আমিও একদিন তাজউদ্দীন আহমদকে ২৫ মার্চের রাতের ঘটনা নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তাজউদ্দীন আহমদ স্বীকার করেছিলেন, সেই খসড়া ঘোষণাটি তার নিজের লেখা ছিল এবং তিনি বঙ্গবন্ধুকে খসড়া ঘোষণাটি পাঠ করার প্রস্তাব করেছিলেন। লেখাটা ছিল সম্ভবত এই রকম : ‘পাকিস্তানি সেনারা আমাদের আক্রমণ করেছে অতর্কিতভাবে। তারা সর্বত্র দমননীতি শুরু করেছে। এই অবস্থায় আমাদের দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সবাইকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে এবং আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করলাম।’ তাজউদ্দীন সাহেব আরও বলেন, এই খসড়া ঘোষণাটা শেখ মুজিবুর রহমানকে দেওয়ার পর সেটা তিনি পড়ে কোনো কিছুই বললেন না, নিরুত্তর রইলেন। অনেকটা এড়িয়ে গেলেন।”

এ প্রসঙ্গে তিনি আরো লিখেছেন, “তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, ‘মুজিব ভাই, এটা আপনাকে বলে যেতেই হবে। কেননা কালকে কী হবে, যদি আমাদের সবাইকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়? তাহলে কেউ জানবে না যে আমাদের কী করতে হবে? এই ঘোষণা কোনো গোপন জায়গায় সংরক্ষিত থাকলে পরে আমরা ঘোষণাটি প্রচার করতে পারব। যদি বেতার মারফত কিছু করা যায়, তাহলে সেটাও করা হবে।’ বঙ্গবন্ধু তখন প্রত্যুত্তরে বলেছিলেন, ‘এটা আমার বিরুদ্ধে একটা দলিল হয়ে থাকবে। এর জন্য পাকিস্তানিরা আমাকে দেশদ্রোহের বিচার করতে পারবে।’ এ কথায় তাজউদ্দীন আহমদ অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে সম্ভবত রাত নয়টার পরপরই ধানমন্ডির ৩২ নম্বর ছেড়ে চলে যান।

পরবর্তীকালে মঈদুল হাসান এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক আবদুল মোমিনকে জিজ্ঞেস করেছিলেন। তিনিও ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে উপস্থিত ছিলেন। আবদুল মোমিন বলেন, তিনি যখন বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ঢুকছিলেন, তখন দেখেন যে তাজউদ্দীন আহমদ খুব রাগান্বিত চেহারায় ফাইলপত্র বগলে নিয়ে চলে যাচ্ছেন। আবদুল মোমিন তাজউদ্দীনের হাত ধরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি রেগে চলে যাও কেন?’ তখন তাজউদ্দীন আহমদ তার কাছে আগের ঘটনাটি বর্ণনা করে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু একটু ঝুঁকিও নিতে রাজি নন।’ অথচ আমাদের ওপর একটা আঘাত বা আক্রমণ আসছেই।”


আওয়ামী লীগের সাবেক এ মন্ত্রী লিখেছেন, “২৫ মার্চ রাতে যখন পাকিস্তানি বাহিনী আমাদের আক্রমণ করে, সেই রাতেই শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। স্বাধীনতার ঘোষণাটি জনসমক্ষে কীভাবে এলো? ২৬ মার্চ তো সারা দেশেই সান্ধ্য আইন ছিল। আওয়ামী লীগের তরুণ কর্মী এবং ছাত্রলীগের নেতারা স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য বঙ্গবন্ধুকে মার্চ মাসে বেশ চাপ দিচ্ছিল। ধারণা করা যায়, সেই সময় তাজউদ্দীন আহমদ তার খসড়াটি তাদের দিয়েছিলেন এবং এদের মাধ্যমে যদি এটা স্বাধীনতার ঘোষণা হিসেবে প্রচারিত হয়ে থাকে, তাহলে আমি বিস্মিত হব না।”

ইপিআরের মাধ্যমে ওয়ারল্যাসে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে এ কে খন্দকার লিখেছেন, “পরবর্তী সময়ে ঘটনার প্রায় এক বছর পর আরেকটা কথা প্রচার করা হয় যে, ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হওয়ার ঠিক আগে শেখ সাহেব ইপিআরের বেতারযন্ত্রের মাধ্যমে চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরীর কাছে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠিয়েছিলেন। এ তথ্যটি মোটেও বিশ্বাসযোগ্য নয়। প্রথমত, সামরিক বাহিনীতে থাকার ফলে আমি জানি যে সিগন্যাল সেন্টার বা বার্তা কেন্দ্র সব সময় অত্যন্ত বিশ্বাসী লোক দ্বারা পরিচালনা করা হয়। সিগন্যালই কোনো বাহিনীর প্রতিরক্ষা ও আক্রমণের মূল যোগাযোগমাধ্যম। সেখানে তো বিশ্বাসীদের বাদ দিয়ে সন্দেহের পাত্র বাঙালিদের হাতে সিগন্যাল-ব্যবস্থা থাকতে পারে না।

বাস্তবেও পাকিস্তানি বাহিনী আগে থেকেই পিলখানায় ইপিআরের বেতার কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রেখেছিল। তার চেয়েও বড় প্রশ্ন, বঙ্গবন্ধু যার মারফত এই ঘোষণা ইপিআরের বার্তা কেন্দ্রে পাঠিয়েছিলেন, সেই ব্যক্তি স্বাধীনতার ৪৩ বছরেও জনসমক্ষে এলেন না কেন। বঙ্গবন্ধুও তার জীবদ্দশায় কখনো সেই ব্যক্তির নাম প্রকাশ করেননি কেন। একইভাবে চট্টগ্রামের ইপিআর বেতার কেন্দ্র থেকে কে, কীভাবে জহুর আহমেদকে বার্তাটি পাঠালেন, তা রহস্যাবৃতই থেকে গেছে। কাজেই ইপিআরের বার্তা কেন্দ্র ব্যবহার করে শেখ সাহেব স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠিয়েছিলেন- এটা সম্ভবত বাস্তব নয়। দ্বিতীয়ত, জহুর আহমেদ চৌধুরীর কাছে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠিয়েছিলেন, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এমন কোনো সংবাদ আমরা শুনিনি।”

প্রসঙ্গক্রমে তিনি লিখেছেন, “১৯৭১ সালের জুন মাসে বাংলাদেশের নেতারা স্বীকৃতিদানের প্রশ্নে ভারত সরকারকে বেশ চাপ দেওয়া শুরু করেন। ভারত সরকার বাংলাদেশ মন্ত্রিপরিষদের সদস্য ও অন্য প্রধান নেতাদের জিজ্ঞেস করে, শেখ মুজিবুর রহমান কি স্বাধীনতার প্রশ্নে কাউকে কিছু বলে গেছেন? তারা আরও জানতে চায় যে, স্বাধীনতা ঘোষণার কোনো প্রমাণ, কোনো দলিল, কোনো জীবিত সাক্ষ্য আমাদের কাছে আছে কি না? এ সময় জহুর আহমেদ চৌধুরীও উপস্থিত ছিলেন। প্রত্যেকেই বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধু কাউকেই স্বাধীনতা ঘোষণার কথা বলে যাননি। জহুর আহমেদ চৌধুরী নিজে তাজউদ্দীনকে বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধু তাকে কিছু বলে যাননি।

ইপিআরের বেতারযন্ত্রের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু চট্টগ্রামে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠান- এ দাবিটির প্রচার শুরু হয় ১৯৭২ সালে। এর আগে এটি শোনা যায়নি। অথচ ২৫ মার্চ রাত সাড়ে ১২টায় টেলিযোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে শেখ মুজিব চাইলে শুধু একটি ফোন করে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে (এখন রূপসী বাংলা) ভিড় করা যে কোনো বিদেশি সাংবাদিককে স্বাধীনতা ঘোষণার কথা জানাতে পারতেন। তাহলে মুহূর্তের মধ্যে সেটি সারা পৃথিবীতে প্রচার পেয়ে যেত। বেশ পরে স্বাধীনতার ঘোষণার বিষয়ে আরেকটি তথ্য প্রকাশ পায়। এতে বলা হয় যে, বঙ্গবন্ধু টেলিগ্রামের মাধ্যমে কাউকে কাউকে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠিয়েছিলেন। সেই ঘোষণার একটি কপি কিছু দিন আগে পত্রিকায় ছাপানো হয়। এ ঘোষণায় পাওয়া বিবৃতি আগের ঘোষণা থেকে পৃথক। ঘোষণা-সংবলিত টেলিগ্রামটি হাতে লেখা এবং প্রাপকের স্ত্রী দাবি করেছেন যে, এটি বঙ্গবন্ধুর নিজের হাতে লেখা। মিথ্যা প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতায় সাধারণ বিবেচনা বা জ্ঞানও রহিত হয়ে যায়। টেলিগ্রাম যে একটি বিশেষ পদ্ধতিতে পাঠানো হয় এবং এখানে প্রেরকের হাতের লেখা প্রাপকের কাছে যায় না, তা তারা ভুলে যান।”

স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে বিভিন্ন গ্রন্থে উল্লেখ করা তথ্যের সমালোচনা করে এ কে খন্দকার লিখেছেন, “বঙ্গবন্ধুর প্রেরিত কথিত স্বাধীনতা ঘোষণার কয়েকটি ভিন্ন ভিন্ন সংস্করণ বাজারে আছে। এ সংস্করণগুলো সরকারি গ্রন্থ ও আওয়ামী লীগের প্রচারিত গ্রন্থগুলোতে পাওয়া যায়। বিভিন্ন জায়গায় কেন এই ভিন্নতা, তার উত্তর কেউ দিতে পারে না। ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রকাশিত ‘স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র ৩য় খণ্ড’-তে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাগুলোর একটিকে সংযুক্ত করে। পরে ২০০৪ সালে, এই ঘোষণাটির দালিলিক কোনো প্রমাণ না থাকার কথা বলে উল্লিখিত বই থেকে তা বাদ দেওয়া হয়।”

তিনি লিখেছেন, “২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর অভিযানের পর ইস্ট পাকিস্তান রেডিওর চট্টগ্রাম কেন্দ্রের বাঙালি কর্মকর্তারা বেতারের মাধ্যমে কিছু করার পদক্ষেপ নেন। চট্টগ্রামে সান্ধ্য আইনের মধ্যেই তারা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে সেখান থেকে কিছু প্রচার করতে উদ্যোগী হন। সেখানকার বেতার কেন্দ্রের বাঙালি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মিলিত হয়ে সিদ্ধান্ত নেন যে, বেতারে কিছু না কিছু বলা অত্যন্ত প্রয়োজন। তারা সবাই মিলে স্বাধীনতা ঘোষণার একটা খসড়া তৈরি করেন। ২৬ মার্চ বেলা দুইটায় কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে গিয়ে তারা সেই খসড়াটি নিজেদের কণ্ঠে প্রচার করেন।

পরবর্তী সময়ে সেই ঘোষণা চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নানও পাঠ করেন। তার ভাষণটি সেদিন সাড়ে চারটা-পাঁচটার দিকে পুনঃ প্রচার করা হয়। তাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে- এমন কথা বলা হয়েছিল। তবে প্রথম যে ঘোষণাটি পাঠ করা হয়েছিল, তার থেকে পরবর্তী সময়ে পাঠ করা ঘোষণাটি একটু আলাদা ছিল।”

জিয়াউর রহমান নিজেকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা দিয়েছিলেন উল্লেখ করে আওয়ামী লীগের সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী একে খন্দকার লিখেছেন, “২৭ মার্চ সকাল ১০টার দিকে এসব বেতার কর্মী পটিয়ায় যান। তারা মেজর জিয়াকে বেতার কেন্দ্রের প্রতিরক্ষার জন্য কিছু বাঙালি সেনাসদস্য দিয়ে সাহায্য করার অনুরোধ জানান। মেজর জিয়া সঙ্গে সঙ্গে এ ব্যাপারে সম্মতি দেন। এ সময় তাদের মধ্যে কেউ একজন মেজর জিয়াকে অনুরোধ করে বলেন, কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার একটি ঘোষণা তিনি পড়তে রাজি আছেন কি না। মেজর জিয়া বেশ আগ্রহের সঙ্গে এই প্রস্তাবে রাজি হন।

তিনি পটিয়া থেকে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে এসে প্রথম যে ঘোষণা দিলেন, সেটা ভুলভাবেই দিলেন। কারণ তিনি প্রথম ঘোষণায় নিজেকে প্রেসিডেন্ট বলে সম্বোধন করেছিলেন। পরে সংশোধন করে মেজর জিয়া বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। সেটি টেপে ধারণ করা হয় এবং ২৭ মার্চ সন্ধ্যার কিছু আগে তা পুনঃপ্রচার করা হয়। আর এভাবেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রকাশ ঘটল।”

নিউজ লিংক : প্রতিমুহূর্ত ডটকম
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ সকাল ৮:৫৭
৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৮




আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না। আমাদের দেশে মানুষ জন্ম নেয়ার সাথেই একটি গাছ লাগানো উচিৎ । আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানবতার কাজে বিশ্বাসে বড় ধাক্কা মিল্টন সমাদ্দার

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:১৭


মানুষ মানুষের জন্যে, যুগে যুগে মানুষ মাজুর হয়েছে, মানুষই পাশে দাঁড়িয়েছে। অনেকে কাজের ব্যস্ততায় এবং নিজের সময়ের সীমাবদ্ধতায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারে না। তখন তারা সাহায্যের হাত বাড়ান আর্থিক ভাবে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিসিএস দিতে না পেরে রাস্তায় গড়াগড়ি যুবকের

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৫৫

আমাদের দেশে সরকারি চাকরি কে বেশ সম্মান দেওয়া হয়। আমি যদি কোটি টাকার মালিক হলেও সুন্দরী মেয়ের বাপ আমাকে জামাই হিসেবে মেনে নিবে না। কিন্তু সেই বাপ আবার ২০... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩



এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×