১.
কোয়ালিটি বা গুনগত মান আর কোয়ান্টিটি বা পরিমাণগত মানের মধ্যে একটা বড় পার্থক্য হলো, কোয়ালিটি নিয়ে চাপাবাজি করা যায়, কোয়ান্টিটি নিয়ে করা যায়না অথবা করলেও ধরা খাওয়ার চান্স থাকে। যেমন দেশের প্রধানমন্ত্রী যদি দাবী করেন যে তিনিই এদেশের সবচেয়ে বড় দেশপ্রেমিক, তখন হাসি পেলেও সেটাকে নাকচ করে দেয়ার প্রত্যক্ষ কারণ আমাদের হাতে থাকেনা। কে জানে? হতেওতো পারে যে তাঁর মতো এত বড় দেশপ্রেমিক আর কেউ নেই। হয়তো সেটা রোমিও-জুলিয়েট বা শিরি-ফরহাদকেও হার মানায়। সেই প্রেমের দাবীকে আমরা চ্যালেঞ্জ করতে পারিনা, বড়জোর মুখ চেপে হাসি লুকোতে পারি। পক্ষান্তরে, কেউ যদি বলে এই দেশে আমি সবচেয়ে বেশী করপ্রদান করি, তখন কিন্তু আমরা তাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারি। বলতে পারি যে কাগজ দেখাও।
রাজনৈতিক নেতাদের ভাষনের বেলায় এই কোয়ালিটি আর কোয়ান্টিটির ব্যাপারটা একটা বড় প্রভাবক হয়ে দাঁড়ায়। চতুর রাজনীতিক তাই কোয়ালিটি বিষয়ে হালকার উপর ঝাপসা বক্তৃতা দেয়, উন্নয়নের জোয়ারের কথা বলে, দেশের মানুষ "সুখে আছে" কথা বলে, "ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে" বলে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি "সবচাইতে ভালো আছে"বলে। তবে এসবের পক্ষে কোনো ডেটা বা উপাত্ত নিয়ে সে মাথা ঘামায়না। কিন্তু সমস্যা হয় চতুর রাজনীতিক যখন অতি চতুর হতে চায় তখন। এই অতিমাত্রিক চতুরেরা ভাবে জনগন হলো ভোদাই, চালাক শুধু তারাই। দশটা সত্য সংখ্যার মাঝে বিশটা মিথ্যে সংখ্যা ঢুকিয়ে জনগণকে গেলানো যাবে, এমন বোকার স্বর্গে তারা বাস করে। একটু চোখ মেলে দেখতেও চেষ্টা করেনা যে একটু নাড়া দিলেই আজকের "ভোদাই" জনগণ তাদের চাপাবাজিগুলো ধরে ফেলবে।
২.
কদিন আগে প্রধানমন্ত্রী সরকারের তিন বছরপূর্তি উপলক্ষ্যে ভাষন দিলেন। আগ;রহ নিয়ে ইউটিউবে দেখতে বসলাম। প্রথম ছয় মিনিট ভালোই চলছিলো, কিন্তু মোটামুটি আট-ন' মিনিটের মাথায়ই উৎসাহ চলে গেলো, কারণ, এরই মধ্যে গন্ডাখানেক মিথ্যে সংখ্যা তিনি উপস্থাপন করে ফেলেছেন। আর দেখার উৎসাহ বোধ করলামনা, যে কয়টা ডাহা মিথ্যে তিনি বললেন, সেগুলো টুকে রাখার প্রয়োজনবোধ করলাম।
চালের দাম
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তাঁরা ক্ষমতায় আসার আগে মানুষ যে চাল খেতো কেজি ৪০-৪২ টাকা, এখন নাকি সেই চাল মানুষ খায় কেজি ২৬ থেকে ৩০ টাকায়!
এবার দেখি কথাটা কতটুকু সত্যি।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার মাসখানেক পরে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম সিন্ডিকেটিং বন্ধ করতে পারলে চালের দাম কত হতে পারে সেটা নিয়ে আলোচনার জন্য। সেখানে তথ্য উঠে এসেছিলো (শওকত হোসেন মাসুম ভাই জানিয়েছিলেন), ২০০৯ এর শুরুতে ইরি চালের দাম ছিলো ২৫-২৬ টাকা কেজি। এটা গরীবেরা খেতেন। মিনিকেট চাল ৩২-৩৬ টাকা, এটা সাধারণ মধ্যবিত্তরা খেতেন।
পক্ষান্তরে, এখন ২০১১ এর ডিসেম্বরের বাজার দর হলো, মোটা ইরি ৩৬-৩৮ টাকা, মিনিকেট ৫৫-৫৮টাকা!
প্রধানমন্ত্রীর এই কতটা ডাহা মিথ্যা।
নাকি তিনি বুঝাতে চেয়েছেন যে তখন যারা সবচেয়ে দামী চালটা ৪০-৪২ টাকায় খেতো, তারা এখন আর্থিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় মোটা চাল খেতে শুরু করেছেন? এতেও তো হিসেব মেলেনা!
তাহলে কি লোকে এখন ৮০০ গ্রাম ইরির সাথে বাকী ২০০ গ্রাম ইট/পাথর মিশিয়ে কেজি ৩৬ টাকার চাল কেজি ৩০ টাকা হিসেবে খাচ্ছেন?
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, চালের নিয়ে দাম নিয়ে চাপাবাজি করা মানে গরীবের পেটে সরাসরি লাথি মারা।
দারিদ্র্য বিমোচন
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, দেশে দারিদ্রসীমার নিচে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর শতকরা হার নাকি গত তিন বছরে ৪০% থেকে কমে ২৩% এ নেমেছে। এই উপাত্ত তিনি কোথায় পেলেন? একটা সংখ্যা মাথায় এলেই কি সেটা বলে দিতে হবে? তিনি কি মনে করেন তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগেও গোয়েবলসের মতো একটা মিথ্যে সংখ্যা দশবার বললে লোকে সেটা বিশ্বাস করা শুরু করবে?
এবার দেখি পরিসংখ্যান কি বলে?
সিআইএ ফ্যাক্টবুকে ২০১০ সাল শেষে বাংলাদেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের শতকরা হার দেয়া আছে ৪০%! এখানেও আছে । মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী কি বলতে চাচ্ছেন যে গত একবছরে তিনি দারিদ্র্য প্রায় অর্ধেক কমিয়ে ফেলেছেন? গত বছর কি এমন ঘটেছে যে দেশের গরীব মানুষেরা হঠাৎ অগরীব হয়ে গেছেন? কোথায় পান তিনি এসব সংখ্যা?
আমি তো বরং বলবো তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের হাতে ঘটা শেয়ারবাজার জালিয়াতির ফলে বেশ ভালো সংখ্যক নিন্ম মধ্যবিত্ত ব্যক্তি দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছেন।
দারিদ্র্য কমানোর স্বপ্ন প্রধানমন্ত্রী দেখছেন হয়তো, সাধুবাদ জানাই। তবে কোনটা স্বপ্ন আর কোনটা বাস্তব সেটা তো বোঝা উচিত, তাইনা?
বিদ্যুৎ উৎপাদন
বিদ্যুৎ উৎপাদন নিয়ে শেখ হাসিনা মিথ্যাচার করে আসছেন আজ বহুদিন!তাঁর কথাবার্তায় মনে হয় ২০০১ থেকে ২০০৮ এ আমরা বিদ্যুতের অভাবে অন্ধকারে বাস করেছিলাম, এবং এখন তাঁর আমলে বিদ্যুতের সাগরে সারা দেশ ভাসছে।
তিনি বলেছেন আগের সাত বছরে এক মেগাওয়াট বিদ্যুতও জাতীয় গ্রিডে সোগ হয়নি, আর গত তিন বছরে আড়াই হাজার থেকে চার হাজারের বেশী মেগাওয়াট উৎপাদন হচ্ছে।
এবার দেখি পরিসংখ্যান কি বলে:
ইনডেক্সমান্ডির এই পেজে দেখুন। বছরভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের উপাত্ত দেয়া আছে।
হতাশাজনক হলেও যেটা সত্য, তা হলো, রাজনৈতিক সরকারের আমলে গড়ে প্রতিবছর মাত্র ১ বিলিয়ন কিলোওয়াট-আওয়ার উৎপাদন বাড়লেও, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বেড়েছে প্রতিবছর ২.৭ বিলিয়ন কিলোওয়াট-আওয়ারের কাছাকাছি।
একইসাথে শেখ হাসিনার জন্য যেটা হতাশাজনক, তা হলো, মুখে যতই মিথ্যাচার করুননা কেন, বাস্তবে তাঁর এই আমলে এই বৃদ্ধির হার বিএনপির গত আমলের চেয়েও কম!!
মাথাপিছু আয়
শেখ হাসিনা বললেন এই আমলে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় সাড়ে ছয়শ থেকে বেড়ে নাকি আটশো আটাশ ডলার হয়েছে!
আবারও আসুন দেখি পরিসংখ্যান কি বলে?
ইনডেক্সমান্ডির এই পেজে পিপিপি পারক্যাপিটার বছরভিত্তিক ডেটা আছে। পেজের ডেটাগুলো দেখলে কষ্ট পাবেন। মাথাপিছু আয় কমছে! কারণ জিডিপি ৬% হারে বাড়লেও, মুদ্রাস্ফীতির গড় হার ৮% এর বেশী।
প্রধানমন্ত্রী অবশ্য যে ৮২৮ ডলারের কথা বলেছেন, সেটা পিপিপি পার ক্যাপিটা ইনকাম না, সেটা হচ্ছে প্রকৃত মাথাপিছু আয়।
এবার আসুন কিছু হিসেব করে বের করি ২০১১ তে আমাদের মাথাপিছু আয় আসলে কত হতে পারে (শকিং!):
সিআইএ ফ্যাক্টবুকে বাংলাদেশের জিডিপির ২০১০ সালের উপাত্ত দেয়া আছে। ইউ এস ডলারে জিডিপি বা মোট আয় (প্রকৃত), ১০৪৯০ কোটি ডলার, এবং এখান থেকে হিসেব করলে,
প্রকৃত মাথাপিছু আয় হবে, (১০৪৯০ কোটি/১৬ কোটি) = ৬৫৫ ডলার।
উল্লেখ্য, ২০১০ সালে ডলারের এক্সচেঞ্জ রেট ছিলো ৭০.৪৭ টাকা। মানে, বাংলাদেশী টাকায় দেশের জিডিপি দাঁড়ায় (১০৪৯০ * ৭০.৪৭) = প্রায় ৭ লক্ষ ৪০ হাজার কোটি টাকা।
আইএমএফের উপাত্তে ২০১১ তে প্রবৃ্দ্ধির হার ৬.৪%।
ফলে, ২০১১ তে বাংলাদেশী টাকায় দেশের জিডিপি দাঁড়ায়, ৭৪০০০০*১.০৬৪ = ৭৮৭৩৬০ কোটি টাকা।
এখন এই টাকাকে ডলারে বদল করলে (১ ডলার = ৮২ টাকা) পাই,
৭৮৭৩৬০/৮২ = ৯৬০০ কোটি ডলার।
মাথাপিছু প্রকৃত আয় দাঁড়ায়, ৯৬০০/১৬ = ৬০০ ডলার!!
প্রধানমন্ত্রীর দেয়া উপাত্তগুলো শুনতে ভালোই শোনায়, কিন্ত হিসেবগুলো মেলেনা।