প্যান্টের চারটি পকেট তন্ন তন্ন করে খুজেও একশ টাকার নোটটি পাওয়া গেল না।
সকালে মামার দেয়া বকশিসের পাঁচশত টাকার নোটটি নিয়ে বের হয়েছিলাম। সারা দিনে রিকশা ভাড়া চল্লিশ টাকা, রবীন্দ্রনাথের ‘সমাপ্তি ‘ অবলম্বনে নির্মিত ছায়াছবি ‘অবুঝ বউ’ দেখতে পচাত্তর টাকা, একটি নীল রঙের রুমাল আর বড় দুই কাপ চা খেতে পচিশ টাকা আর রাস্তার পাশে এক বৃদ্ধকে চার টাকা দিয়ে খরচ হয়েছে দুইশত চার টাকা।
বাকি থাকার কথা দুই শত ছিয়নব্বই টাকা। কিন্তু আমার চারটি পকেট থেকে বের হয়েছে একশত, পঞ্চাশ ও বিশ টাকার একটি, দশ টাকার দুইটি আর দুই টাকার তিনটি নোট। তাহলে বাকি একশত টাকা কোথায় গেলো ? মুহুর্তেই মনে হল আমার প্যান্টেতো আরেকটি পকেট আছে। নিজের টাকায় হলেও আমরা সবাই একে চোরা পকেট বলেই ডাকি । কিন্তু কি অবস্থা! ওখানেও নেই। অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলাম হয়তবা রিকশাওয়ালাকে অথবা টিকেট কাউন্টারে টাকা দেয়ার সময় একশত টাকার নোটট বিনা দ্বিধায় মাটির বুকে লুটিয়ে পরেছে।
কতবার বলেছি একটা মানিব্যাগ কিনি। না! বলে কিনা এত টাকা দিয়ে মানিব্যাগ না কিনে এই টাকা দিয়ে দুইটা বই কিনে পড়া অনেক ভালো। যেদিন কেনার মত বই পাওয়া যাবে না সেদিন মানিব্যাগ কিনবো। কিন্তু কেনার মত বই এর কি আর অভাব আছে? তাই আমার মানিব্যাগও আর কেনা হয়। মানিব্যাগ থাকলে আজ আর আমার একশত টাকার শোক সইতে হত না। এখন হারানো টাকা দিয়ে ইচ্ছে মত বই কিন আর ইচ্ছেমত পড়। নিজেই নিজেকে বকতে লাগলাম। এই মানিব্যাগ না থাকার কারনে আমার টাকাগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে আমার বিভান্ন পকেটে। আর তাই কখনো রিকশাওয়ালাকে বা বাসের কন্টক্টারকে অথবা টিকেট কাউন্টারে টাকা দেয়ার সময় নিজের অজান্তেই দু একটি নোট মাটিতে লুটিয়ে পরে অবলীলায়। পরে অবশ্য সেটিকো দান করেছি বলেই নিজেকে সান্তনা দেই। আজো তার ব্যাতিক্রম নয়। মনে মনে বললাম দান করেছি।
কিন্তু আজকে কেনো জানি নিজের উপর খুব রাগ হল। পাঁচ টাকা আর দশ টাকা নয় পুরো একশ টাকা। কদিন আগেও একটা গল্পের বই পছন্দ হয়েছিল। আড়াইশ টাকা দাম। কিনবো কিনবো করেও আর কেনা হয় নি। এই টাকাটা না হারালে ওটা দিয়েই কিনতে পারতাম। অবশেষে চিন্তা ভাবনার পর সিদ্ধান্ত নিলাম এবার একটি মানিব্যাগ কিনেই ছাড়বো। কোনো রকমে রাতটা কাটালাম। সকালে ঘুম থকে উঠেই ছুটে গেলাম মানিব্যাগ কিনতে।
দোকানে নানা রঙের নানা রকমের মানিব্যাগ। ঝকঝকে সাদা,কুচকুচে কালো অথবা একটু মেটে কালার। কোনটা দুই অংশের কোনটা তিন অংশের। কোনটা বোতাম সিস্টেম কোনটা চেইন সিস্টেম। কোনটাতে আবার কিছুই নেই। এর মধ্যে আছে আবার হরেক রকমের সাজ। কোনটা বাঘের মুখের প্রতিচ্ছবি, কোনটাতে ঈগলের ছায়া কোনটাতে আবার সাপের চামড়ার ডোড়াকাটা চিহ্ন।
হঠাৎ একটা মানিব্যাগকে দেখে মনের মাঝে কিঞ্চিৎ মায়া জন্ম নিল। আহারে বেচারা! স্বাধীনতার পৃথিবী থেকে অনেক দুরে পরাধীনতার শৃংখলে আবদ্ধ। লোহার শিকলে আবৃত তার সারা দেহ। ‘খাটি গরুর চামড়া ‘ স্পষ্ট অক্ষরে সাদা সাইনবোর্ড এ মানিব্যাগ এর পাশেই লেখা রয়েছে। আচ্ছা এটা কি খাটি গরুর চামড়া হবে নাকি গরুর খাটি চামড়া হবে? খটকা লাগছে।এর পাশে আবার মহিষের চামড়াও আছে দেখছি।
হঠাৎ দোকানদারের কথায় ধ্যান ভাঙলো। কি স্যার পছন্দ হয় না? মহিষের চামড়ায় ঈগলের ছায়াযুক্ত মেটে কালারের দুই অংশের মানিব্যাগ এর দাম শুনে দোকানে আর থাকতে ইচ্ছা হল না। চলে এলাম পাশের ফুটপাতেই।
শুনেছি এখানে রাস্তার ধারে হকাররা কম দামে মানিব্যাগ বিক্রি করে। অবশ্য দামাদামি করতে যারা অপরিপক্ক বা অনভ্যস্ত তাদের এরা এইগুলোই বেশি দামে বিক্রি করে।
অবশেষে প্রচুর সাহস আর দামাদামি করে একশ টাকায় বাদামি কালারের দুই অংশের মহিষের চামড়া বলে চালান দেয়া মানিব্যাগটি কিনে ফেললাম। মানিব্যাগ এর একপাশে প্যাচানো অক্ষর দিয়ে লেখা ভেলেন্টাইন্স ডে। এই মানিব্যাগের সাথে ভেলেন্টাইনাস ডে এর সম্পর্ক খুজতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে নিজেই মুলতবি টানি।
প্যান্টের পেছনের পকেটে স্বযতনে মানিব্যাগটা রাখি। কেমন জানি অস্বস্তিকর লাগছে। মনে হচ্ছে পেছন থেকে কেউ চেপে ধরে আছে। নিজের কাছেই নিজেকে কেমন বন্দী বন্দী লাগছে।
যাইহোক,এখন আমারও মানিব্যাগ আছে। বত্রিশতলা টাওযার এর চুড়ায় উঠে সবাইকে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করছে ‘আমারও মানিব্যাগ আছে ‘। মানিব্যাগ নেই বলে ক্ষেপানোর আশায় কেউ যদি বলে পিচ্চি! তাহলে পেছনের পকেট থেকে চকচকে মানিব্যাগটি বের করে বলব আমারও মানিব্যাগ আছে। এখন আমার কাছে টাকা থাকুক আর না থাকুক সবসময় আমি একশত টাকার মালিক। এখন আর রিকশাওয়ালাকে বা বাসের কন্টক্টারকে টাকা দেয়ার সময় নিজের বেখেয়ালে বাড়তি কোন টাকাকে মাটির বুকে জলাঞ্জলি দিতে হবে না।
ক’দিন পরই পরীক্ষা। রেজিস্ট্রেশন এর জন্য সারে পাঁচ হাজার টাকা লাগবে। আজ সকালে আব্বা সব টাকা দিয়ে বলেছেন আজই যেন রেজিস্ট্রেশন এর সব কাজ শেষ করি।
পিতার আদেশ মান্য করতেই হোক বা নিজের জন্যই হোক, এগারটি পাঁচশত টাকার নোট মানিব্যাগের বড় পকেটে রেখে সকাল দশটার দিকেই বেড়িয়ে পরি কলেজের উদ্দেশ্যে।
বেলা সোয়া এগারোটা। শহরের সমস্ত যানজট ডিঙিয়ে আমি এখন কলেজ কেশিয়ার এর টেবিলের সামনে নাতিদীর্ঘ লাইন এর শেষ মাথায়। কিছুক্ষন পরই এল আমার পালা। বন্ধুদের সামনে হালকা একটু ভাব নিয়ে মানিব্যাগটা বের করতে পেছনের পকেটে হাত দিতেই মাথায় বাজ পরল। পকেটে মানিব্যাগতো দুরে থাক একটা ছেড়া চিড়কুটও নেই। তবে কি পঞ্চাশ একশত টাকার জলাঞ্জলি দেয়াকে বাচাতে একশত টাকার মানিব্যাগ এর কাছে সারে পাঁচ হাজার টাকা জলাঞ্জলি দিলাম?
আচ্ছা! বাসায় রেখে আসিনিতো ?
মুহুর্তেই ছুটে যাই বাসার দিকে।
টেবিল ও ওয়ারর্ডোব এর ড্রয়ার, বইয়ের রেক ও তোশকের নিচ সহ সারা বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুজেও সারে পাঁচ হাজার টাকা ভর্তি মানিব্যাগটি পাওয়া গেল না।