গ্যালাতিয়ার প্রতি প্যাগম্যালিয়নের কাল্পনিক চিঠি
❑
প্রিয়তম গ্যালাতিয়া,
অভিনন্দন জানাই । আর নত হই উলঙপদতলে, পরম ভক্তিতে। ভালোবাসি বলতে চাইনি আমি কখনো। 'ভালোবাসা' আজ আর নেই আপন উজ্জ্বলতায় , শুধু কয়টি সস্তা শব্দ একত্রে উচ্চারণ যেন ।
আমি তোমায় পুজো করি হে দেবী। বুকের লাল রক্ত ঢলে পড়ে পুজোমন্ডুপে। রঙিন আগুন শিখা আর ধূপের কড়া ঘ্রাণই সাক্ষী দেয়, ভক্তিতে কার্পণ্য করে না তোমার প্যাগম্যালিয়ন।
আমি অন্ধ হয়ে আছি তোমার ধ্যানে। অস্পষ্ট হয়ে গেছে পৃথিবীর যাবতীয় বস্তু-প্রাণী। হুটহাট তুমি আমার ঘরে হাঁটো নাচো আর ভূমি সুগন্ধে ভরিয়ে হেসে উঠো চুড়িদার আওয়াজে । ফেলে রাখো বুকের বসন। এক মুহূর্তে মাতাল হই আমি। গায়েব হই পৃথিবী থেকে। কেউ পায় না আমায়। আমি কারো নই। মৃত আমি। তোমার ভেতরেই বেঁচে উঠি। বাঁচার তীব্র লোভে বিশ্ববেহায়া। লজ্জানত মুখ গুঁজে দেই তোমার বোতাম খোলা বুকে।
আমি জীবিত ছিলাম কি কখনো? ছোট্ট একটা নদীকে আশ্বস্ত করে সমুদ্র বানিয়েছিলো যেই কুলক্ষি ঋতু, সেই ঋতুতেই প্রচণ্ডমূর্তি ভূমিকম্পে ভূমি উলটে মরুভূমি হয়ে ছিলো। শতাব্দীর পর শতাব্দী মানুষের অগোচরেই জ্বলে জ্বলে শুষ্কতম বালি উড়ে গিয়ে পড়েছিলো ঈশ্বরের বৈঠকখানায়। তিনি ফিরেও তাকাননি। আর যাওয়ার পথ ছিলোনা গ্যালাতিয়া।
তাই কোথায়ও আর যায়নি। ফিরছিলাম,ফিরতে ফিরতে গুটিয়ে নিতে নিতে অদৃশ্য করে ফেলেছিলাম নিজেকে ।
হঠাৎ তুমি কবর খুঁড়ে পচা শরীরে মাংস বসাতে আরম্ভ করলে। রঙিন পশম বুনলে। চোখে পরালে স্বর্গ ছোঁয়াআতর।
এখন আমি চোখ মেললে তোমায় দেখি গ্যালাতিয়া। আমি ঘুম ভুলে গেছি।খাওয়া ভুলে গেছি।নখ কাটতে ভুলে গেছি। দাঁত মাজতে ভুলে গেছি। ভুলে গেছি পৃথিবীতে তুমি ছাড়াও আরো কিছুর অস্তিত্ব আছে।
কাঠপাখির পাখায় চড়ে যাই তোমার শহরে। শহরের সেই বাড়ির ছাদে, যেখানে ছাতাওয়ালা একটি বৈঠকখানায় আমরা বৃষ্টিতে ভেজা চা পান করি।রাতের বেলায় বেরিয়ে পড়ি বন্যবিড়ালের মত। ডাহুকের মত ডেকে ডেকে পুকুরপাড়কে করে তুলি পানশালার উৎসববাতি।
গ্যাতালিয়া, চলো জাহাজে উঠে যাই, কাপ্তান সাজিয়ে রেখেছেন নৌবহর। সাইরেন অপেক্ষা করছে তোমার আর আমার প্রবেশের। তুমি পা ফেললেই কোলাহলময় হয়ে উঠবে জাহাজ, হাজারো মদ্যপ দেব-দেবীর মাতাল করা সঙ্গীতে।
চেয়ে দেখো, আমার জামার বোতামে বোতামে তোমার লালাজল বাজনা বাজায়।আমার পিঠের ডানাদুটি আমাদের ভক্তিপূজার শক্তিতে গজিয়েছে। যত গুটিয়ে নেওয়ার অভিনয় করছো,ততই দীর্ঘকায় হচ্ছে তারা। এবার আমাদের উড়ার সময়। আকাশ ছাড়া আমাদের তো আর কোনো আবাস অবশিষ্ট নেই গ্যালাতিয়া।
যদি ছেড়ে দেয় জাহাজ আমাদের ছাড়াই।যদি আর উঠা না হলো সোনাইজাহাজে। বকেদের মাছ ধরার কৌশল শেখা হবে না আর। শেখা হবে না কীভাবে পাহাড়ের বাঁকেও চালক তার একমাত্র সন্তানের চুমু চোখের ভ্রুতে ঝুলিয়ে রাখে। কীভাবে ডেকে ঢুকা প্রচণ্ড ঝড়ের তলোয়ার বুকে গেঁথে নাচতে নাচতে এগিয়েই যায় জাহাজটি , পেছন ফেরা তার রক্তে লেখা নেই।
গ্যালাতিয়া, রাস্তার কুকুরটি রাস্তায় পড়ে থাকবে একা।তোমার জুতারহিল থেকে খসে পড়া বালিরা শুয়ে থাকবে তার পশমের আলে। কেউ জানবে না তার জন্যই জাহাজটির এতো আয়োজন। কেউ জানবে না, গভীর অন্ধকারের ভেতরও নড়ছে এক প্রাণ, যার পকেটে হীরার খনির পথের মানচিত্র গুঁজা আছে।
❑
ভাস্কর প্যাগম্যালিয়ন।
লেখকঃ পাভেল আল ইমরান।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ সকাল ১০:২৬