আব্বার সরকারী চাকুরী । আমরা নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াই। পিকনিকের মতো। ঘুরতে ঘুরতে আব্বা কুষ্টিয়া চলে গেল , সাথে আমরাও। যে কোয়ার্টারে আমরা থাকতাম তার পিছন দিয়ে লম্বা ক্যানাল চলে গিয়েছিলো। সেই ক্যানালের এক কিলোমিটার পাড় ধরে ক্ষিন স্রোত কে অনুসরন করলে একটা সবুজ টিন সেডের প্রাইমারি স্কুল দেখা যায় । আমাকে সেই স্কুলের ভর্তি করানো হলো। বড় ওয়ানে।
আমি লাল মোজা সাদা জুতা পড়ে গুটি গুটি পায়ে স্কুলে যেতাম। বড় ওয়ান থেকে টু তে উঠলাম। থ্রি ক্লাসের পোলাপান বলা শুরু করলো," টু খায় গু" । আমার মনে হলো , এবার সত্যিই আমাকে গু খেতে হবে। গু খাওয়ার ভয়ে আমি স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিলাম।
স্কুলের আপারা বাড়িতে এসে পড়লো। বড় আপা বলল, ও তো ফার্স্ট হয়েছে , স্কুলে যাওয়া বন্ধ করেছে কেন! মা বিরস মুখে বলল, গু খাওয়ার ভয়ে স্কুলে যায় না।
আমি স্কুলে যাওয়া শুরু করলাম আবার। একদিন দেখি আমার পাশে লিকলিকে একটা ছেলে বসে আছে। সব প্রশ্নের উত্তর যেনো তার ঠোটের আগায়। তার নাম বাবু। ক্যানালের উচু পাড়ে তাদের বসত বাড়ি। ঝুপড়ি ঘর সুর্যের আলোই ফালা ফালা। একদিন দেখি ও বাসের বাস ঢুকিয় লম্বা লাঠি বানিয়েছে , সেই লাঠির মাথা আঠা । গাছের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হাটছে। বললাম কই যাস। বলল, পাখি শিকার করতে। তখন থেকে আমি ওর পাখি শিকারের সংগি। ওরা ছিল জাতীতে কোল। হিন্দু ধর্মের সবচেয়ে নিম্ন বর্ণ। বাস দিয়ে কোলা, ধামা, ঝুড়ি বানিয়ে গ্রামে গ্রামে বিক্রি করতো আর আমিষের অভাব পুরণ করতো পাখি শিকার করে। আমাদের ঝকঝকে কোয়ার্টার ,মাঝখানে ক্যানালের ঘোলা জল তার ওপাশে তার ছিন্ন বাড়ি , আমাদের ধর্ম কোনটায় আমাদের বন্ধুত্বের মাঝে বাধা হয়ে থাকতে পারি নি। আমার মা বলতো আমার দুই ছেলে, বাবু আর কাবু। ছোটবেলায় আমার স্বাস্থ্য মন্ত্রী ছিলাম !!
আব্বা অতি ধার্মিক হওয়া সত্বেও বাবুকে কখনো হিন্দুর ছেলে হিসাবে দেখেনি। পাশে বসিয়ে খাওয়াতো আর বলতো কি ভালো ছেলে, কি ভালো ছেলে! আর আমি হিংসায় ঝাঝরা হয়ে যেতাম। বাবুরদের বাড়িতে গেলে ওর মা আমার কোথায় বসাবে এই চিন্তায় অস্থির হয়ে যেত।আমি যেয়ে মাটিতে বসে পড়তাম। ওর মা কপালে হাত দিয়ে বলতো , হায় ভগবান করে কি , করে কি!! এই অতিরিক্ত আদরের লোভে ওদের বাসায় আমি পড়ে থাকতাম । আমি আর প্রাইমারি লাইফে আর ফার্স্ট হতে পারিনি। ফার্স্ট হতো বাবু।
ফাইভ থেকে সিক্সে উঠলাম। স্থানীয় চ্যেয়ারম্যান সিদ্ধান্ত নিলো, সকল খাস জমি থেকে অবৈধ স্থাপনা সরাতে হবে। বাবুরা তাদের বসত বাড়ি গুটিয়ে কোথায় যেন চলে গেল।
তারপর মেঘে মেঘে অনেক বেলা হলো। আর আমিও কেমন করে যেন বড় হয়ে গেলাম।পড়াশুনা শেষ, ঢাকাতে চাকুরী করি।
একদিন হন্তদন্ত হয়ে অফিসে যাচ্ছি । অলরেডি দশটা বাজে। রাস্তার ওপাশে তাকিয়ে দেখি, লাল ছোপওয়ালা একটা লুংগি আর সামনের বোতাম ছেড়া সাদা একটা জামা পড়ে একটা ছেলে , এই কুলা নিবেন , এই কুলা নিবেন বলে চিৎকার করে গলার তার ছিড়ে ফেলছে।
সামনে যেয়ে বললাম চিনতে পারছিস? আমার দিকে তাকিয়ে বলল, না স্যার , আপনি কিডা!! বললাম , স্কুলের পেছনের জংগলে আমি আর তুই পাখি শিকার করতাম। আমার নাম কাবু। বাবুর ঘাড় থেকে কুলার বস্তা পড়ে গেলো, আমার দিকে টলমল চোখে কিছুক্ষন তাকিয়ে থকে জড়িয়ে ধরলো। আমার চোখেও কি যেন যেয়ে পানি এসে পড়লো, হওতোবা স্মৃতী।
তারপর থেকে প্রতি সপ্তাহে ফোন করে বলা শুরু করলো , বাড়িতে আয়, বাড়িতে আয়। মানিকগঞ্জের দিকে এক গ্রামে থাকে। বিয়ে করেছে । এক মেয়ে । আমি আসবো আসবো করে দুই বছর পার করে দিলাম। এই শেষ দুর্গা পুজার অষ্টমীর দিনে ওর বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিলাম। ঝুম বৃষ্টি। আমি যখন ওদের গ্রামে পৌছালাম তখন বিকেল হয়ে গেছে। চুরি হয়ে যাওয়া আলোয় দেখলাম, ফুটফুটে এক মেয়ের সাথে আমার জন্য ছাতি মাথায় দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওর বঊ কে যখন আমার নাম বলল তখন সে গড় হয়ে আমাকে প্রনাম করলো। আমি অতি অস্বস্তিতে তার হাত চেপে ধরলাম ।
সাধ্যের চেয়ে বেশি আয়োজন করে তারা বসে আছে। আমি অতি সংকোচে সব আয়োজনে ভাগ বসাচ্ছি। সন্ধার পর বলল, চল বাইরে থেকে ঘুরে আসি। এ বলে সে আমাকে প্রায় ঘাড়ে করে এক দোকানে নিয়ে গেলো। বলল, জীবনে কোনদিন কিছু তোকে দিতে পারিনি, এখন আমার একটা রিকসা আছে, ঢাকাতে জিনিসপত্র বেচি, তোকে কিছু কিনে দেবো। না করবি না। কোন দামাদামি ছাড়ায় দোকানের সবচেয়ে দামি সার্ট কিনে দিলো। বাড়িতে এসে বলল, পড়ে ফেল। আমি পড়লাম। ও বলল, তুই অনেক লম্বা হয়ে গেছিস, বুঝতে পারিনি।
আমাকে পৌছিয়ে দিতে বাস স্ট্যান্ডে আসলো। বলল, আবার কবে আসবি। বললাম, যেদিন আমার অনেক অনেক মন খারাপ হবে। যেদিন এই জগত সংসার কিছুই ভালো লাগবে না, যেদিন মানুষের ভন্ডামী দেখতে দেখতে আমি ক্লান্ত হয়ে যাবো। সেদিন আসবো । বাবু বললো, সেতো অনেক দেরি।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৭ রাত ১:৪৯