হুমায়ুন আহমেদ মারা গেছেন। আমি তখন উত্তরার একটা গেষ্ট হাউজে চাকুরী করি। আমার দিনে বারো ঘন্টা ডিউটি, সপ্তাহে কোন ছুটি নাই, দুই ঈদের এক ঈদে ছুটি । এই রকম টাইট চাকরী। এই টাইট চাকরির ভেতর দিয়ে আমি ফাক খোজা শুরু করলাম । আমি ম্যানেজারের কাছে যেয়ে বললাম, স্যার আমার তিন চার ঘন্টার জন্য একটু ছুটি লাগবে, শহীদ মিনারে যাবো। ম্যানেজার স্যার ঘোৎ করে উঠলেন। আমি ভাবলাম হুমায়ুন আহমেদের কথা শুনে তিনি নরম হতে পারেন। বললাম , স্যার হুমায়ুন আহমেদ মারা গেছেন। আমি তাকে দেখতে যেতে চাই। ম্যানেজার স্যার বললেন, কোন হুমায়ুন আহমেদ, যে মেয়ের বান্ধবীকে বিয়ে করেছে। লুইচ্চার ব্যাটা লুইচ্চা।
আমি কথা বলি না। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি । ম্যানেজারের বোধ হয় আমার করুন মুখ দেখে দয়া হলো । বললো যাও।
অসংখ্য মানুষের ভিড়ে আমি হুমায়ুন আহমেদ কে দেখতে পারি নাই। পরে আমার আর ইচ্ছাও করে নি। যে এতো গুলো ম্যাজিক্যাল মোমেন্ট একটা জাতীকে দিলো , তার নাই হয়ে যাওয়া মুখ আমার দেখতে ইচ্ছা করে নাই। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। বকুল তলায় দেখলাম , একটা স্কুলের ড্রেস পড়া মেয়ে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে কাদছে। আমি সেই বালিকার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। যে লোকটাকে এই মেয়ে মনে হয় কোন দিন দেখেও নাই । সেই লোকটার জন্য এতো মায়া বুকের ভেতর মানুষ কেমনে রাখে। এই ভেবে আমার চোখ আদ্র হলো। আমি আকাশের দিকে তাকালাম । বৃষ্টি নামে না কেন!
তার পরের বছর গেষ্ট হাউজে একটা শ্রীলঙ্কান গেষ্ট এলো । তার নাম গামিনি সারথী। আমাকে একটা মুভি দেখিয়ে বললো, হ্যাভ ইউ ওয়াচড দিজ মুভি। আমি বললাম , ইয়েস। সে বললো , আমার বাংলাদেশে আসার অন্যতম কারন হলো, এই মুভি রাইটার এর সাথে দেখা করা। দিস মুভি মেইড মি ক্রাই। আমি বললাম, লেটস গো। আমি আর গামিনি গহিন শাল বনের এবড়ো থেবড়ো পথ পাড়ি দিয়ে যখন নুহাশ পল্লী পৌছালাম তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ভিজিটিং আওয়ার শেষ । আমি ওখানকার লোকদের বললাম , এই মানুষ শ্রীলঙ্কা থেকে এসেছে , হুমায়ুন আহমেদের সাথে দেখা করতে । আমি তাকে বলি নাই যে হুমায়ুন আহমেদ মারা গেছেন। একবার তাকে হুমায়ুন আহমদের কবর দেখার সুযোগ দেন। আমরা নুহাশ পল্লীর ভেতর ঢুকলাম। কবর দেখিয়ে বললাম , তিনি গত বছর মারা গেছেন। লোকটা হুমায়ুন আহমদের কবরের পাশে নতজানু হয়ে বসে চোখ বন্ধ করে বসে কিছুক্ষন বিড় বিড় করলো। আমি বললাম , কি প্রার্থনা করলে। সে বললো, আমি ঈশ্বরের কাছে বললাম, যে শ্যামল ছায়ার মতো মুভি বানিয়ে এই দুর পরবাসীর হৃদয় স্পর্ষ করেছে, তার পরের জীবন তুমি শ্যামন ছায়াময় করে দাও। আমি নিভু নিভু আলো্তে নুহাশ পল্লীর অগনিত বৃক্ষ, বিস্তৃত ঘাস , বৃষ্টি বিলাস, লীলাবতির দিকে তাকালাম । ভাবলাম মানুষ আসলে মরে না।
তারও বহু বছর আগে । আমি ক্লাস নাইনে। আমি আর আমার বন্ধু বাপ্পি সাইকেল চালিয়ে পাবলিক লাইব্রেরিতে যেতাম বই পড়তে। আমি পড়তাম মাসুদ রানা , তিন গোয়েন্দা। বাপ্পি পড়তো হিমু অমানিবাস। পড়ে আমার কাছে গল্প করতো। একটা যুবক, যার নাম হিমু। সে হলুদ পকেট বিহীন পাঞ্জাবী পড়ে , খালি পায়ে, জ্যোৎস্না রাতে সারা শহর হেটে বেড়াই। তার প্রেমিকার নাম রুপা। সে পড়ে নীল শাড়ি।
আমি আর বাপ্পি বহু জ্যোৎস্না ধোয়া রাত আমাদের শহরে হেটে বেড়িয়েছি। আমাদের হলুদ পাঞ্জাবী ছিলো না, ছিলো খালি পা। ইউক্যালিপ্টাস গাছের উপর চাদের আলো পড়তো, সেই গাছের পাতা , শাখা প্রশাখার ছায়া পড়তো রাস্তার উপর। মনে হতো আলো দিয়ে কেউ আল্পনা একেছে। আমরা সাবধানে হাটতাম যাতে আল্পনা নষ্ট না হয়ে যায় !
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে আগস্ট, ২০১৯ দুপুর ১:২৫