শাহবাগ আন্দোলন নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে দেখি এখন বেশ একটা শোরগোল চলছে। সব খবরের কাগজ আর টিভি চ্যানেলগুলোকে দেখি হঠাৎ করেই আন্দোলনকে সমর্থন করতে শশব্যস্ত হয়ে পড়েছে, যেন বেশ একখানা গরম খবর পাওয়া গেছে! খবরের কাগজ পরে আর দুই-চারদিন ইন্টারনেট ঘেঁটে নতুন নতুন আবিষ্কার করা ‘রাজাকার’, ‘জামাত’ ইত্যাদি শব্দগুলো সাধারন মানুষ, বিশেশত ছাত্র ও যুবসমাজের মুখে মুখে ফিরছে। বিভিন্ন কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠনগুলো দেখি শাহবাগ আন্দোলনকে সমর্থন করতে উঠে পড়ে লেগেছে, খানিকটা ফ্যাশনের মতো।
মনে হতে পারে, এ নিয়ে আমি ব্যঙ্গ করছি কেন? করার সঙ্গত কারণ আছে। যাদের কাছে বাংলাদেশ মানে শুধু ঢাকা ইলিশ আর হাসিনা, যারা জানেই না বাংলাদেশের পরিস্থিতি কি, যারা চেনে না বাংলাদেশের এই নতুন প্রজন্মকে, তারা আচমকা এমন রাস্তায় দাঁড়িয়ে টিভি ক্যামেরার সামনে ‘জয় বাংলা’ আর ‘রাজাকার হটাও’ ব্যানার নিয়ে চিল্লাচ্ছে -- ব্যঙ্গ না করে থাকা যায়!
যারা এসব করছেন তাদেরকে কিছু প্রশ্ন করতে চাই। আপনারা জানেন, বাংলাদেশি তরুণ তরুণীরা কাদের নিষিদ্ধ করতে এইভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পথে নেমেছে? সারা রাত জেগে আন্দোলনকারীদের সচেতন করেছে কাদের নতুন নতুন ষড়যন্ত্র সম্পর্কে? কারা এই জামাতী? ঠিক জানেন না, তাই তো! না জানাটাই স্বাভাবিক। কেননা খবরের কাগজের রিপোর্টারগুলোর এখনো পর্যন্ত সময় হয়ে ওঠেনি তলিয়ে দেখার জন্য একটু খোঁজাখুঁজি করার। তবে যেহেতু এই আন্দোলনের প্রথম থেকে আমি প্রতিটি ঘটনার সাক্ষী, তাই কিছুটা বলার অধিকার তো থাকেই, বলাটা কর্তব্যও।
জামাত বলতে বাংলাদেশে বোঝায় ‘জামাআত ই ইসলামী’ নামে একটি আন্তর্জাতিক গোঁড়াপন্থি সুন্নি মুসলিম ধর্মিয় সংগঠনের বাংলাদেশ-শাখাকে, যার জন্ম ১৯৪১ সালে, ভারতবর্ষের স্বাধীনতার আগে লাহোরে (বর্তমানে পাকিস্তানে) এবং জন্মদাতা সৈয়দ আবুল আলা মউদুদী।
এই সংগঠনটির সম্পর্কে কয়েকটি তথ্য—
১) ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে এদের ভূমিকা শূন্য, কিন্তু ভারত ভাগ এবং পাকিস্তান সৃষ্টিতে এদের বিশাল ভূমিকা।
২) এই সংগঠনটি তৈরি করা হয় পলিটিক্যাল ইসলামের প্রচার করতে। পলিটিক্যাল ইসলামের উদ্দেশ্য রাষ্ট্রের ইসলামী-করন। অর্থাৎ এরা যে রাষ্ট্রেই থাক না কেন এদের উদ্দেশ্য একটাই রাষ্ট্রটিকে মধ্যযুগীয় আদর্শ ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করা।
৩) বর্তমানে (পাকিস্তান ছাড়া) ভারত এবং বাংলাদেশে সক্রিয় থাকলেও এই সংগঠন কালও পাকিস্তানী ছিল আজও পাকিস্তানী এবং ভবিষ্যতেও পাকিস্তানীই থাকবে।
৪) যারা মনে করেন যে ইসলাম সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন করে না, তাদের জানিয়ে রাখি এরা কিন্তু সন্ত্রাসবাদীদের শিরোমণি ওসামা বিন লাদেনকে প্রকৃত মুসলিম এবং জেহাদকারী শহীদ বলে মনে করেছেন এবং সর্বত্রই ভারতবর্ষ পাকিস্তান ও বাংলাদেশে এরা লাদেনের প্রতীকী জানাযার অনুষ্ঠান করেছে। এই তিনটি দেশে সন্ত্রাসবাদীদের সমর্থনে এরা কথা বলে এসেছে এবং ধারাবাহিকভাবে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টানদের উপর সন্ত্রাসী আক্রমণ চলিয়েছে।
৫) ইসলামের সমালচনা এরা সহ্য করে না, কিন্তু অন্যধর্মের সমালচনা করার কোনও সুযোগ হাতছাড়া করে না।কেউ ইসলামের বিরোধিতা করলে কিম্বা মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও ইসলামী জীবনযাপন না করলে এরা তাদের শত্রু গণ্য করে।
বাংলাদেশে নিত্যদিন জামাতিরা অশান্তি সৃষ্টি করে চলেছে। অমুসলিম হিন্দু বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানদের বাড়িতে কোনও কারণ ছাড়াই আচমকা আক্র্মন ধর্ষণ হত্যা করে তাদের মধ্যে স্থায়ী সন্ত্রাস সৃষ্টি করে রাখতে এরা বদ্ধপরিকর। এরা পয়লা বৈশাখ পালনের বিরুদ্ধে, একুশে ফেব্রুয়ারির বিপক্ষে, বসন্তোৎসবের বিপক্ষে, রবীন্দ্রনাথের বিপক্ষে, বাংলাদেশের স্বাধীনতারও বিপক্ষে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এরা পাকিস্তানকে সমর্থন করেছিল এবং বঙ্গবন্ধু হত্যা ও তার পরবর্তি সময়ে এদের ইসলামীকরনের চোটে দেশের অমুসলিমরা তো বটেই এমনকি শিক্ষিত মুসলিম সমাজও শশব্যস্ত। দেশের একাধিক বুদ্ধিজীবীকে খুন বা খুনের চেষ্টা এরা করেছে এবং করে চলেছে।
তাই দীর্ঘদিন পরে হলেও স্বাধীনচেতা আধুনিক মনস্ক সমাজ তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে গন আন্দোলন শুরু করেছে। কিন্তু যতই আন্দোলন তারা করুক না কেন, জামাত কে নিষিদ্ধ করা সহজ হবে না। কেন না এরা আজ বাংলাদেশের সমাজের প্রতিটি রন্ধ্রে জায়গা করে নিয়েছে। তবু সেলাম বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মকে তারা অন্তত লড়াইটা শুরু করতে পেরেছে।
এ তো গেল বাংলাদেশের কথা। আজ আমার কলম ধরার কারণ অন্য। এই জামাত এ ইসলামীর ভারতীয় সংগঠন কিছুদিন ধরে আস্তে আস্তে ভারতে সক্রিয় হয়ে উঠছে। অনুকূল পরিবেশে পশ্চিমবঙ্গে তো ইদানীং অতি সক্রিয় হয়ে উঠেছে। পশ্চিমবঙ্গে তারা ছোট বড় ইসলামী দল গুলোকে একত্রিত করছে। তাদের মূল লক্ষ্য সারা ভারতে মুসলিম দলগুলোকে এক ছাতার তলায় নিয়ে আসা। এই ব্যাপারে তাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছে বাংলাদেশের জামাত শাখা। গত জানুয়ারির শেষ পনেরদিন ধরে সারা পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটি শহরে তারা প্রচার চালিয়েছে। অমুসলিমদের এবং মুসলিমদের মধ্যে পুস্তিকা বিলি করেছে। ভারতের ইসলামীকরন জরুরি এমন কিছু বিশয়ের পুস্তিকাও বিলি করেছে। অবশ্য পুস্তক বিলির সময় নাম জিজ্ঞাসা করা হচ্ছিল। কেননা অমুসলিমদের জন্য বই আলাদা, মুসলিমদের জন্য আলাদা।
এরা পশ্চিমবঙ্গে ইতিমধ্যেই অনেকগুলি মুসলিম দলকে একত্রিত করে ফেলেছে। বাংলাদেশে আন্দোলনের বিপক্ষে প্রচার করছে পশ্চিমবঙ্গে। আন্দোলনকারীদেরকে কাফির আর ইসলামবিরোধী বিদেশি মদদপুষ্ট বলেও প্রচার করছে। এই বাংলার মুসলিমরা কেবলমাত্র এদের জন্য বাংলাদেশের গনআন্দোলনকে সমর্থন করছে না। ভারতবর্ষের মাননীয় রাষ্ট্রপতির বাংলাদেশ সফরের আগে তাকে হুমকির স্বরে বার বার আর্জি জানিয়েছে, যাতে করে তিনি কোনও ভাবেই ‘ইসলাম বিরোধী’ বাংলাদেশের সরকারের সাথে কোনও যোগাযোগ না রাখেন। বাংলাদেশে ভারতবর্শের রাষ্ট্রপতি যাওয়ার পর তার অতিথিশালার বাইরের বোমা বিস্ফোরণের সাথে এর সম্পর্ক নির্ণয়ের জন্য কোনও বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন হয় না। (তবু মাননীয় রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের হাত শক্ত করেছেন বলে অন্তত স্বস্তি বোধ করছি একজন ভারতবাসী হিসাবে। যে জামাতরা ভারত সরকারকে ভিলেন তৈরির চেষ্টা সর্বান্তকরণে করে থাকে, সেখানে তাদের গালে ভারত সপাটে চড়টা মারতে পেরেছে।) আজ সমস্যা পশ্চিমবঙ্গ। পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান সরকার ভোটের জন্য যে মুসলিম-তোষণ শুরু করেছিল সেটা এখন ভয়ঙ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত এক বছরে হাফ ডজন মুসলিম পত্রিকা, মুখ্যমন্ত্রীর যত্রতত্র হিজাবী বেশে নিজেকে উপস্থাপন কলকাতার বুকে শরিয়তি স্টাইলে অনার কিলিং, পুলিশকে দিনে দুপুরে সর্বসমক্ষে হত্যা, একাধিকবার দক্ষিণ ২৪ পরগনায় হিন্দুদের ঘরবাড়ি লুটপাট, পোড়ান এবং মহিলা ধর্ষণ স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে যে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিকে পরিচালনা করছে কারা!
পশ্চিমবঙ্গের মানুষ এইসব বিষয়ে একেবারেই যে সচেতন নয়, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। নয়ত তিস্তা জলবন্টন চুক্তি নিয়ে ভারত সরকারের সাথে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর মতবিরোধ এবং শেষ মুহুর্তে মুখ্যমন্ত্রীর বাংলাদেশকে প্রতিশ্রুত পরিমাণ জল দিতে না চাওয়া যে কেবলমাত্র বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ হাসিনা সরকার কে বিপদে ফেলা ছাড়া আর কিছু নয়, তা খুব সহজেই এই দেশের মানুষ বুঝতে পারতো। পশ্চিমবঙ্গ সরকার কাদের কথায় চলছে আর কাদের হাত শক্ত করছে তা জলের মতো পরিষ্কার হলেও পশ্চিমবঙ্গের মানুশজন এসব বুঝতে পারছে না বা বোঝার প্রয়োজন বোধ করছে না।
যাইহোক, এইসব বলে সময় নষ্ট করতে চাই না। আমি বলতে চাই পশ্চিমবঙ্গ একটি ভয়ানক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে চলেছে, ভবিষ্যতে কিন্তু এর পরিণতি আরও ভয়ঙ্কর হতে বাধ্য। বাংলাদেশের মানুষেরাও প্রথমে বুঝতে পারেনি যে জামাতদের ইসলামের নামে সমর্থন করার ফল কি হতে পারে, আজ তারা তার খেসারত দিচ্ছে কিন্তু পশ্চিমবঙ্গও আজ সেই একই ভুল করছে। যা এখনি ফল দিতে শুরু করেছে। মিডিয়া এই সাম্প্রদায়িক হিংসার খবর গুলোকে চেপে দিয়ে আরও সর্বনাশ করছে। এভাবে পেইন কিলার দিয়ে রোগ সারানো যে অসম্ভব তা কেউ বুঝতে চাইছে না (কিম্বা হয়ত সরকারী চাপ আছে)। তবে সামনের দিনগুলো আরও ভয়ঙ্কর হতে চলেছে এই বিষয়ে নিশ্চিত থাকতে পারেন, যে বুদ্ধিজীবীরা এখন চুপ আছেন, নীরবে থেকে এড়িয়ে চলছেন, কাল যখন সহ্য করতে না পেরে মুখ খুলবেন তখন হয়ত বাংলাদেশের হুমায়ুন আজাদ আর আহমেদ রাজীব দের অবস্থা হবে।
মাননীয় রাষ্ট্রপতির বাংলাদেশ সফরের বিরোধিতায় বড়সড় সাংবাদিক সম্মেলন করে জামাতে ইসলামী (এবং তাদের ছত্রছায়ায় ঐক্যবদ্ধ মুসলিম দলগুলি সম্মিলিত ভাবে) যা দাবী করেছে, তার সারমর্ম এরকমঃ
১) বাংলদেশ নাকি আন্দলনে উত্তাল হয়ে উঠেছে দেলোয়ার হোসেন সাইদীকে ফাঁসীর নির্দেশের পর থেকে।
২) কোনও সাক্ষ্যপ্রমাণ ছাড়াই বাংলাদেশে মুসলিম ধর্মগুরুদের বিরুদ্ধে বিচারের নামে প্রহসন চালিয়ে ফাঁসি দেওয়া হচ্ছে।
৩) পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষজন উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে বাংলাদেশে এমনতর ইসলাম বিরোধিতা দেখে।
৪) বাংলাদেশের আন্দোলন আদতে নাকি সরকার বিরোধী আন্দোলন, সরকার এই আন্দোলনে গনহত্যা চালাচ্ছে।
এই দাবীগুলি যে সর্বৈব মিথ্যা তা বলাই বাহুল্য। মজার কথা হল, এত বড় একটা সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে এত কথা বলা হলেও কোনও সাংবাদিককে একটিও প্রশ্ন করার সুযোগ দেওয়া হয়নি। এইজন্য সাংবাদিকরা ক্ষোভে ফেটে পরেন সম্মেলন শেষে। এবং প্রশ্ন করার অধিকারের কথা বললে মুসলিম নেতারা একজন সাংবাদিককে বেশ মারধর করেন বলেও অভিযোগ করা হয়েছে সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে।
আমি পশ্চিমবঙ্গের এই ছাত্র ও যুবসমাজকে জানাতে চাই, এখন আমাদের বাংলাদেশের কথা পরে ভাবলেও চলবে। বাংলাদেশে যা পরিস্থিতি, তাতে জামাত এ ইসলামী ও তার সহযোগীদের পক্ষে খুব একটা সুবিধা হবে না সেখানে থাকা। তারা যেন-তেন প্রকারে পশ্চিমবঙ্গে ঢুকতে চাইছে (এবং ঢুকছে), কেননা এটাই তাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল। এখানে একবার চলে এলে তাদের আশ্রয় দেবে এখানকার জামাত সংগঠন এবং রাজ্যসরকার। তখন এরা দুই বাংলায় তাদের ক্রিয়াকলাপ চালাতে পারবে নিরাপদে। ফলে দুই বাংলার ধর্মনিরপেক্ষতা কঠিন চ্যালেঞ্জের সামনে পড়বে। চানক্যের একটি কথা মনে পরে গেল। তিনি বলছেন, “অন্যের ভুল থেকে শিক্ষা নাও কেননা, সব ভুল নিজে করে শেখার মতো যথেষ্ট দিন তুমি একটা জীবনে পাবে না”। আমাদের অবিলম্বে উচিত বাংলাদেশের অতীত ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়া।
আগামী ২৬ শে মার্চ শহিদ মিনার ময়দানে জামাতে ইসলামী (হিন্দ) এবং তাদের সহযোগীদের বিরাট সমাবেশ করা হবে। আমি পশ্চিমবঙ্গের সচেতন ছাত্র ও যুবসমাজকে আহ্বান জানাই, বাংলাদেশের আন্দোলনকে সমর্থনের পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গ তথা সারা ভারতে এদের কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সরব হন, প্রতিবাদ জানান। বাংলাদেশের মানুষ যেমন এদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে আপনারাও রুখে দাঁড়ান।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


