somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ঃ একটি অসমাপ্ত গন্তব্যে

০৯ ই জানুয়ারি, ২০১৪ দুপুর ১:২০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আজ ০৯ জানুয়ারি। ঠিক দু’বছর আগের এই দিনে জুবায়ের মারা যান। ছাত্রলীগ নামধারী ‘প্রশাসনপন্থী’ একদল হায়েনা নৃশংস ভাবে হত্যা করে জুবায়েরকে। হত্যকান্ডের পর পরই উত্তাল হয়ে ওঠে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। খুনিদের বিচারের দাবিতে ফুঁসে ওঠে সাধারণ ছাত্ররা। এ আন্দোলন পরে রূপ নেয় ভিসি পতনের আন্দোলনে। কয়েক মাসব্যাপি চলা এ আন্দোলন অবশেষে থামে তৎকালিন ভিসি ড. শরীফ এনামুল কবিরের পদত্যাগের মাধ্যমে।
শুধু জুবায়ের হত্যাকান্ডই কি ছিল আন্দোলনের প্রকৃত কারন? নাকি এর পেছনে কাজ করেছে অন্য কোন বিষবাস্প, যা ছড়িয়ে পরেছিল দাবানলের মত? পেছনের প্রেক্ষাপট আসলে কী ছিল- আসুন দেখে নিই একনজর।।


প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। বিশাল আয়তনের এ বিশ্ববিদ্যায় যেন সাজানো এক স্বপ্নরাজ্য। স্থানে স্থানে জঙ্গল, তারই মাঝে কী সুন্দর গড়ে উঠেছে একেকটি ভবন। পরিকল্পিতভাবে সাজানো অনেকগুলো লেক। টলটলে পানির দিকে তাকালেই শরীরে কেমন যেন এক শীতল অনুভুতি খেলে যায়। লেকের মাঝে লাল- সাদা শাপলা ফুটে আছে অসংখ্য। পাখির কিচির মিচির চারদিকে। কান ঝালাপালা করে দেয়ার মতো অবস্থা। অতিথি পাখি থেকে শুরু করে ভীর করে দেশীয় সকল পাখি। এখানে পাখি দেখার জন্য আছে চমৎকার সব ব্যাবস্থা। পাখি দেখার জন্য ‘পাখি চত্বর’ ই রেখে দেয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তাদের এ গাছ গাছালিতে ভরপুর নান্দনিক ক্যাম্পাস নিয়ে গর্ব করে। বহিরাগতরা এ সুন্দর বনানীঘেরা মুগ্ধ পরিবেশ দেখার জন্য ভীর করে প্রতিদিন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের এ নিয়ে অহংকারের শেষ নেই। যে কোন মুগ্ধ বহিরাগত দর্শনার্থীদের দেখলেই তারা বুক ফুলিয়ে মাথা উঁচু করে গর্বিত ভঙ্গিতে হাটে। ভাবখানা এরকম যেন ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিচ্ছে-- ‘এ ক্যাম্পাস আমাদের। দেখ, আমাদের ক্যাম্পাস দেখ। এমনটা আর কোথাও খুঁজে পাবে না’ক তুমি....॥’

কিছুদিন হল এ ক্যাম্পাসের ছাত্রদের মন ভাল নেই। তারা এখন আন্দোলনে। কারন তাদের এ গর্বের ক্যাম্পাস আগের মতো নেই। প্রতিদিন বিশ্ববিদ্যালয় তার সৌন্দর্য হারাচ্ছে। অপরূপা ষোঢ়শী তরুনী থেকে থুত্থুরে বুড়িতে পরিনত হচ্ছে। এখন আর আগের মতো জঙ্গল নেই। ফলে পাখি কমে গেছে। পাখির শব্দে এখন আবাসিক ছাত্রদের ঘোম ভাঙ্গে না। বাতাস ও যেন আগের মতো শীতল হয়ে বয় না। লেকগুলো একে একে শুকিয়ে যাচ্ছে বৃদ্ধ গরুর উলানের মতো । শাপলা ফুলগুলোও আগের মতো তর তাজা সজিব না। সবাই যেন কেমন একটা কষ্ট নিয়ে বাস করছে।
এসব দেখে ছাত্ররা দুঃখিত হয়। তাদের বুকে অভিমানের ব্যাথা বাজে। অভিমান থেকে ক্রমে ক্রোধ, তা থেকে প্রতিবাদ আর আন্দোলন।
ছাত্ররা আন্দোলনে নামে গাছ কাটার প্রতিবাদে। লেক মাছ চাষের নামে লীজ দেয়ার প্রতিবাদে। সৌন্দর্য বৃদ্ধির নামে ডুমুর গাছটা যেদিন কাটা পড়ল সেদিন ছাত্ররা কাঁদলো অনেক্ষণ। তারপর ডুমুরের ডাল নিয়ে সাদা কফিনে জড়িয়ে লাশ বানিয়ে প্রিয় ডুমুর হত্যার বিচার চাইল। তাদের প্রতিবাদের ভাষা তখনো বুকেই জমা হচ্ছিল। মুখে আসছিল অল্পই।

ছাত্রদের এ অল্প আন্দোলন কোন কাজ দিল না। গাছ কাটা চললো সমানে। ছোট ছোট বন কেটে সাফ করা হয় প্রতিদিন। প্রতিদিন ছাত্ররা আবিস্কার করে তাদের পাশের পরিচিত গাছ গাছালিতে ঘেরা শান্তির জায়গাগুলি নেই। বিকালে দেখে রাখা পাখির বাসাটি যে গাছে ছিল সেখানে পড়ে আছে বিশাল শূণ্যতা। যে বাসাটিতে তিনটি ডিম বাচ্ছা বেড়োনোর আশায় প্রতিদিন দেখা হতোÑ দেখা গেল সে গাছটিও নেই। সেখানে হয়তো চাষ হচ্ছে হলুদ গাছের অথবা পেপে বা পেয়ারা গাছের। প্রশাসনের ‘সৌন্দর্যের ব্যাঘাত সৃষ্টিকারী ও মশা উৎপাদনকারী অপ্রয়োজনীয় জঙ্গল কেটে লীজ দিয়ে হলুদ চাষ প্রকল্প চালুতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌন্দর্য বর্ধন হচ্ছে’, এ ধরনের বক্তব্য ছাত্রদের পাখির ডিম, বাসা আর ঘন গাছ গাছালিতে ঘেরা তৃণ কুঞ্জ হারানোর বেদনার কথা ভুলাতে পারে না।

ক্রমে আন্দোলনের ভাষা মুখে মুখে ছড়ায়। মানব বন্ধন হয় গাছের জন্য। দায়ী করা হয় ভিসিকে।

একজন নাম দেয়- গাছখেকো ভিসি।

একজন বলে- মেয়ের বিয়েতে কাঠ-মাল দেয়ার জন্য গাছ কাটছে ভিসি।

একজন সন্দেহের সুরে বলে- কী জানি ভিসিই আবার বিয়ে করবেন হয়তো।

একদিন দেখা গেল, শহীদ মিনার দূর থেকে দেখার অযুহাতে যে বিশাল গাছটি কেটে ফেলা হয়েছে, তার নিচে- কয়েকটি মুন্ডিত ডাল পাতা বিহীন গাছের চিত্র। নিচে লেখা, ‘শহীদ গাছগুলির জন্য শহীদ মিনার চাই, ভিসি।’

ক্যাম্পাস থেকে দেশীয় পাখিগুলো আস্তে আস্তে বিদায় নেয়। তাদের আবাসন ব্যাবস্থা ধ্বংস করেছে আবাসিক এ বিশ্ববিদ্যালয়। তাই তারা চলে যায় দুর্বোধ্য ভাষায় অভিশাপ দিতে দিতে। আর তা দেখে দেখে মুখ ভার করে প্রতিটি শিক্ষার্থী।

ক্রমে শীতের সময় এগিয়ে আসছে। ছাত্ররা প্রস্তুত হয়। এখানে শীত মানে উৎসব। শীত মানে মহুয়া তলায় পিঠা খাওয়ার ধুম। হরেক রকমের পিঠাপুলির ঘ্রাণে মৌ মৌ ক্যাম্পাস। তাছাড়া শীতে ওরা আসবে, বহু চেনা অতিথি পাখিরা। ছাত্ররা দেখবে নানা দেশ থেকে উড়ে আসা হাজারে হাজারে পাখির ঝাক। ওরা ক্যাম্পাসে যেখানে সেখানে উড়বে, গাইবে, নাচবে। সকালে ঘুম ভাঙ্গবে ওদের কথা মনে করে। দিন যাবে এদের দেখে দেখে। সন্ধ্যা হবে এদের অস্থায়ী বাসায় ফেরার তাগিদে। তারপর পিঠা খাওয়া, শীতে কাঁপতে কাঁপতে চায়ে ঠোঁট ভেজানো। বন্ধু বান্ধবীদের কলহাস্যে মুখর করে আড্ডা.... এত কিছু হবে, তার একটা প্রস্তুতি আছে না? সবাই প্রস্তুত হয়।

এ সময় বাইরের বন্ধুদের ক্যাম্পাসে আমন্ত্রণ করতে হবে। তাদের পুরান কলা, নতুন কলা, মেয়েদের হল, লেক, সুইমিং পুল এরিয়া সহ সব জায়গায় পাখিদের খেলা দেখিয়ে চমকাতে চমকাতে ক্লান্ত করে দেয়া; অতপর ‘‘আহ, এখানে যদি আমি পড়তে পাড়তাম’’ সূচক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলতে বাধ্য করে তবে ক্ষান্ত হওয়া এসবই তো এ শীতে। তাই সবাই শীতের আগমনে প্রস্তুত।

শীত আসে, তবে ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে দিয়ে অনেক পড়ে। তাও অন্যান্য বছরের তূলনায় কম। একেবারেই কম। সবাই অপেক্ষা করে কবে আসল শীত শুরু হবে। তারা বুঝতে পারে না শীত কেন দিন দিন পিছিয়ে যাচ্ছে! এইতো বাংলা পৌষ মাসের শেষ প্রায়। অথচ এ সময় অন্যান্য বছর কী শীত! কাঁপতে কাঁপতে কথা জড়িয়ে যেত।

আর পাখি! পাখিও শীতের মতো আসতে দেরি করছে কেন? না কি পাখির দেশে এখনো শীত পড়ে নি। কই তা ও তো না। ক্যাম্পাসের পাশেই সাভার বিপিএটিসির কাছের লেকগুলোতে শীতপাখির আগমন ঘটছে হাজারে হাজারে। তাহলে এখানে আসছেনা কেন? পাখিরা কি সব পথ ভূলে গেল? নাকি এ পাখিদের কোন অভিমান?

ক্রমে শীত চলে যাওয়ার সময় আসে। সবাই মন মরা হয়ে ঘুরে বেড়ায় এখানে সেখানে। এখনও তারা পাখির অপেক্ষা করে। যদিও বুঝতে পারে পাখি আসবে না। হার কাঁপানো শীতও না। সবাই বোঝে ঠিকই, কিন্তু মেনে নিতে পারে না। মেনে নিতে না পারার চাপা কষ্ট নিয়ে সবাই পড়াশোনায় অত্যধিক ব্যস্ত হয়ে পড়ে ; অথবা ব্যাস্ততার ভান করে।
শীত চলে যায়। এখন সবাই জানে কেন পাখি আসে নি। সবাই জানে লেকের পানিতে মাছ চাষের সুবিধার্থে কীটনাশক ব্যাবহারের কথা। জঙ্গল কেটে হলুদ চাষতো সবাই নিজ চোখেই দেখছে। সবাই জানে পাখি না আসার পেছনের কারন এগুলোই। শীত বেশি না হওয়ার কারনও এসবই। এ সব বিশেষজ্ঞরাই বলেছেন।

শীত পাখি না আসায় সবাই কষ্ট পায়। অভিমান করে। তবে শীত পাখির প্রতি ওদের কোন অভিমান নেই, অনুযোগ নেই। ওরা জানে গাছ কাটলে শীত কমবে। পাখি আসবে না। পাখিযে আসবে ওরা খাবে কী? থাকবে কই? চাষ করা বিশাল বিশাল মাছতো ওরা খাবে না। হলুদ গাছেতো ওদের বাসা তৈরি হবে না। ছাত্রদের তাই পাখিদের প্রতি কোন অনুযোগ নেই। তবে তারা কষ্ট পায়। অভিমান করে। যা রাগে রুপান্তরিত হয়ে বেড়িয়ে আসে সম্মিলিত সুরে। এখন সবাই পাখি ফিরিয়ে আনার জন্য আন্দোলনে নামে। প্রশাসনের নীতির বিরুদ্ধে তারা প্রতিবাদ করে। পাখি আসছে না কেন, শীত নেই কেন, গাছ কমছে কেন, শেয়াল পালিয়ে গেল কেন.... এ সবের জবাব চায় তারা সম্মিলিত কন্ঠে। বুকে জমানো সকল প্রতিবাদের ভাষা মুখে আসতে শুরু করে।

প্রশাসন এ ভাষা ভয় পায়। মুখগুলো থামিয়ে দেয়ার প্রয়োজন মনে করে। প্রতিবাদের কন্ঠকে গলা টিপে হত্যা করা জরুরি মনে করে। প্রশাসনের সে ক্ষমতাও আছে। তাদের হাতে আছে একটি গ্রুপ। ওরাও ছাত্র- এ ক্যাম্পাসেরই। প্রশাসনের ছত্রছায়ায় এদের বেড়ে ওঠা। ওরা প্রতিবাদীদের বিরোদ্ধে প্রতিবাদে নামে। কিন্তু এ প্রতিবাদ সাধারন ছাত্রদের কাছে অপরিচিত। এ প্রতিবাদে লাঠি থাকে। চাপাতি এমনকি পিস্তলও থাকে। তারপর বলা নেই কওয়া নেই বিশেষ এক স্লোগান মুখে নিয়ে ওরা এ্যাকশনে নামে। বেশিক্ষণ প্রয়োজন পড়ে না ওদের প্রতিবাদের। কয়েক মিনিটেই এ প্রতিবাদ ঐ প্রতিবাদকে থামিয়ে দেয়। অন্তত আপাতত। তারপর বীর দর্পে একেকজন ফিরে যায় মুখে সিগারেট গুজে। পেছনে ফেলে যায় কিছু রক্ত, আহত ক্ষত-বিক্ষত মানুষ, আর্তনাথে ভারী বাতাস আর অক্ষত অথচ ভয়ার্থ একদল মানুষ।

পরের দিন রক্তের প্রতিবাদ হয়। এবার আর গাছ পাখি নয়। এবার প্রতিবাদীদের কেটে ফেলার নুংরা ষঢ়যন্ত্রের বিরোদ্ধে প্রতিবাদ। তবে এ প্রতিবাদের স্বর দুর্বল, অনুচ্চ। প্রতিবাদীর সংখ্যা কম। গাছ কাটার প্রতিবাদ আর মানুষ আহতের প্রতিবাদ সমান ভাবে হয় না। মানুষ ভয় পায়। অতি সাহসি যারা ওরাই স্লোগান ধরে। অন্যরা সড়ে যায় আস্তে আস্তে চোরের মতো। প্রশাসনের কর্তা ব্যাক্তিরা এ দেখে হাসে তাদেরই অবদান ক্যাম্পাসে হারিয়ে যাওয়া খেক শেয়ালের মতো দাঁত বের করে।
কিছু দিনে আন্দোলন থেমে যায়। প্রতিবাদের ভাষা এখন কিন্তু বুকেই জমাট বাঁধে। মুখে আর উঠে না রক্তাক্ত দাঁ- লাঠির ভয়ে। প্রশাসনের ছত্রচায়ায় দাঁ- লাঠির রাজত্ব এখন প্রতিষ্ঠিত। প্রশাসন বিরোধী মিছিলে অংশগ্রহনকারী সাহসিদের রাতের আঁধারে এক এক করে মেরে বের করে দেয়া হয় ক্যাম্পাস থেকে। তাদের আর্তনাথে রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে খান খান হয় ভেঙ্গে ছড়িয়ে পড়া কাচের মতো। সবাই শুনে। আবার কেউই শুনে না। কী জানি হয়তো কানে আঙ্গুল দিয়ে রাখে সকলে।

এভাবে চলে কিছুদিন। ক্যাম্পাস এখন ফাঁকা। গাছ নেই, পাখি নেই। লেক গুলি শুকিয়ে ভরাট হচ্ছে আর সেখানে চাষ হচ্ছে ধান-গম- ভোট্টা। ছাত্ররা সবই দেখে। দেখেও নির্লিপ্ত ভাব করে চলে যায় আপন আপন কাজে। আড্ডা দেয়া ছেড়ে দেয় সকলে। লেখাপড়া নিয়ে ব্যাস্ত হয় সবাই।

এর ভেতর ক্যাম্পাসে অনেক পরিবর্তন ঘটে। মেহের চত্বর হারিয়ে যায়। ট্রান্সপোর্ট থেকে সব দোকান উঠিয়ে দেয়া হয়। চৌরঙ্গীর দোকানগুলোও নেই। রাত দিন ছাত্রদের মুখরিত স্থানগুলো এখন নীরব, জনশুন্য। পাহারাদার কয়েকজনকে দেখা যায় শুণ্যতায় বসে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে।

এভাবেই হয়তো চলতো সব। গাছ কাটা হতো দিন দিন। পাখির বংশ নাশ হতো, লেক শুকিয়ে খেলার মাঠ হতো। ছাত্ররা উৎকন্ঠা আর অভিমান নিয়ে লেখাপড়া করতো রাত দিন। প্রশাসন দাঁত খেলিয়ে হেসে হেসে হারানো শেয়ালের দুঃখ মনে করিয়ে দিত। প্রতিবাদ কেউ যদি করতো তবে তার রক্ত ঝরতে বেশিক্ষণ লাগতো না হয়তো।..

এভাবেই চলে যেতে পারতো অনেক দিন। ছাত্ররা একে একে বিদায় নিত দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে। নতুন যারা আসতো পরিবর্তিত এ পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে তাদের কোন বেগ পেতে হত না। শুধু যখন কোন সিনিয়র ভাই স্বগতুক্তি করে বলত- আহারে কী ছিল আগের ক্যাম্পাস! এই যে এখানটাতে- যেখানে তোমরা এখন বিচ্ছিন্নভাবে ফুটবল খেলছ- ঠিক এই কোনাটাতে - সেবার এক মস্তবড় সাপ দেখে ভয়ে চিৎকার করে উঠেছিল আমার এক বান্ধবি। আর ঐযে গর্তমত যায়গাটা দেখা যাচ্ছে- সেখানে ছিল এক বিশাল কাঠাল গাছ। নিচে ছিল অনেকগুলো কামরাঙ্গা গাছের সাড়ি। দলে দলে টিয়া পাখি এসে ভীর করতো এখানে। আহারে কী ছিল আমাদের ক্যাম্পাস!

এসব আহাজারি শুনে শুনে নতুন ছাত্ররা হয়ত মুগ্ধ হত। হয়তবা কেউ বিরক্ত হয়ে বলত-কী সব বাজে কথা। ক্যাম্পাস কখন আবার স্বর্গমত ছিল?

এভাবেই চলে যেতে পারত।

সেদিন ৮ জানুয়ারি। আর দশটা দিনের মতোই সূর্য পূর্ব দিক রঙ্গিন করে উঠেছিল কিনা কেউ বলতে পারে না। তবে প্রশাসনের ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা ছাত্র সংগঠনটি বেশ তেজদ্বীপ্ত ছিল অন্য দিনের চেয়ে। ছাত্ররা একটু বেশি সংকুচিত ছিল এক অজানা ভয়ে। কেন জানি সবার মন বলছিল, এরা আজ পশু হবে। ডিসকভারি চ্যানেলে দেখা হায়েনার রণপ্রস্তুতিতে এরা ব্যতিব্যস্ত। ওদের চোখে কি যেন লেখা। ছাত্ররা ঠিক পড়তেও পারছে না।

সারা দিন গেল নির্বিঘ্নে। বিকাল হয়ে এসেছে। পশ্চিমাকাশ একেবারেই লাল। রক্তের মতো লাল। যেদিকে সূর্যের আলো পরছে সেদিকই লাল হয়ে উঠছে। যেন ফিচকারিতে রক্ত মিশিয়ে কোন দুষ্ট বালক ছড়িয়ে দিচ্ছে সাদা জামায়। হালকা ঝিরিঝিরি বাতাস। কুয়াশা নেই মোটেও। একটু ঠান্ডা মত লাগছে।

এরকম সময়টাতেই ওরা কাজটা করল। প্রকৃতির অসম্ভব ভাল লাগা ছিটানো রক্ত ওরা জমিনেও ছিটিয়ে দিল। কিছু লাগল ওদের হাতের লাঠিতে, ধারালো চাপাতিতে। একজনের বামপাশের কপালেও লাগল হয়ত। হাত দিয়ে কপাল মুছতে গিয়ে তার হাতেও সামান্য লাগার কথা।

কাজটার নাম দিল ওরা অপারেশন। বিশ মিনিটের বেশি লাগেনি ওদের এ অপারেশনে। তারপর সফলতার সংবাদ ওরা জানিয়ে দিল মোবাইলে। কি জানি কাকে জানালো!

জুবায়ের মারা গেল।

জুবায়েরকে হত্যা করা হল।

সেদিন ছিল জুবায়েরের অনার্স শেষ বর্ষের শেষ পরিক্ষা।

নির্মিতব্য ওয়াজেদ মিয়া বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রের পেছনে নিথর দেহে পড়ে থাকা অবস্থায় ধীরে ধীরে রক্তক্ষরণে মারা যায় জুবায়ের। পরদিন সাভার এনাম মেডিকেলের কর্তব্যরত ডাক্তার তার মৃত্যুর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন।

বাতাসের গতিতে তার মৃত্যু সংবাদ ছড়িয়ে পরল। ছাত্ররা কিংকর্তব্যবিমুঢ়। কেউ কিছু বলে না। কি বলবে ভেবে পায় না। অনেক কিছু বলার আছে। কিন্তু কথার চাপে জ্যাম তৈরি হয়। গলা দিয়ে কোন শব্দ বের হয় না। বোবার কথা বলার আকুতির মতো সবাই কথা বলতে চাচ্ছে, কিন্তু বলতে পারছে না। এ এক মহা সংকটময় দৃশ্য।
অবশেষে কে যেন গলার জ্যাম ভাঙ্গতে পারে। সেই প্রথম চিৎকার দেয়- জুবায়ের ভাই মরল কেন...।

এবার আর শব্দ বেরুতে সমস্যা হয় না। গলার জ্যাম এবার তুচ্ছ হয়ে যায়। বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ারের পানির মতো শব্দ কিলবিল করে। একসাথে সবাই গর্জে ওঠে- প্রশাসন জবাব চাই...।

ছাত্ররা ভুলে যায় ভয়। যেন ভয় বলে কিছু কোনকালেই তাদের ছিল না। তারা যেন একেকজন প্রচীন যুদ্ধা। মৃত্যুর দরজাকে লাথি দিয়ে এগিয়ে চলা একেকজন তরুন তুর্কি।

প্রশাসন ঘাবড়ে যায়। যাদের সামান্য ধমক দিয়ে থামিয়ে রাখা যেত তারা এতটা অপ্রতিরোধ্য হবে প্রশাসন চিন্তাও করে নি। তাই তারা অন্য কৌশল ধরে। তিনজন খুনিকে তিন মাস করে বহিস্কার করে।
প্রশাসন ভুলে যায়, দিন কয়েক আগে লেকে মাছ ধরার অভিযোগে এক ছাত্রকে চার মাসের বহিস্কারাদেশ দেয়া হয়েছিল।

এ সিদ্ধান্তে ছাত্রদের ভেতরের আগুন আগ্নেয়গিরীর বিস্ফুরণ ঘটায়। রাগে ক্রোধে ছাত্ররা পাগল হয়ে যায়।

পাগল কি না করতে পারে। তিন মাসের মতো সব বিক্ষোব্ধ সাধারণ পাগলেরা অসাধারণ সব কাজ করে। প্রশাসনের সকল অথর্ব ধূর্ত শেয়ালদের গর্তে প্রবেশ করিয়ে তবে একেক জন সুস্থ হয়।

এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন প্রশাসন। নতুন প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ হয়ে যাদের পথ চলা। এ প্রশাসনের কাছে ছাত্ররা আবার তাদের পূর্বের স্বর্গ ফেরত চায়। গাছ কাটা বন্ধের দাবি জানায়। পাখি ফিরিয়ে আনার আব্দার করে। কনকনে শীতের দিনগুলি ফিরিয়ে দেয়ার আকুতি জানায়।
এ প্রশাসন ছাত্রদের আশ্বাস দেয়। বার বার মতবিনিময়ের মাধ্যমে ছাত্রদের মনের কথা জানার চেষ্টা করে।

ছাত্ররা আশ্বস্থ হয়। তারা এখন অপেক্ষা করে শীতের, শীত পাখির আগমনের। ছাত্ররা কল্পনায় স্লোগান তুলে,

‘‘আসছে ওরা শীতের পাখি, হাসছে তারা বেশ
কেউ মেরো না, কেউ ধরো না বাঁচাও পরিবেশ॥’’
৩টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মুসলিম কি সাহাবায়ে কেরামের (রা.) অনুরূপ মতভেদে লিপ্ত হয়ে পরস্পর যুদ্ধ করবে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৯




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৫। তোমরা তাদের মত হবে না যারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণ আসার পর বিচ্ছিন্ন হয়েছে ও নিজেদের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি করেছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদে মসজিদে মোল্লা,ও কমিটি নতুন আইনে চালাচ্ছে সমাজ.

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

গত সপ্তাহে ভোলার জাহানপুর ইউনিয়নের চরফ্যাশন ওমরাবাজ গ্রামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। লোকটি নিয়মিত মসজিদে যেত না, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েনি, জানা গেল সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল, স্বীকারোক্তিতে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গল্পঃ অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি

লিখেছেন ইসিয়াক, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১২

(১)
মাছ বাজারে ঢোকার মুখে "মায়া" মাছগুলোর উপর আমার  চোখ আটকে গেল।বেশ তাজা মাছ। মনে পড়লো আব্বা "মায়া" মাছ চচ্চড়ি দারুণ পছন্দ করেন। মাসের শেষ যদিও হাতটানাটানি চলছে তবুও একশো কুড়ি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×