somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাংলা ব্লগের বিভাজন রেখা : কর্পোরেট বনাম ইনডিপেন্ডেন্ট ব্লগ

১৩ ই জানুয়ারি, ২০১২ বিকাল ৪:৫৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

দৈনিক যায়যায়দিনে কাজ করার সময় হঠাৎ একদিন প্রথম আলোর একজন বড় কর্মকর্তার ফোন পেলাম। টুকটাক কুশল বিনিময়ের পর উনি বললেন, সাক্ষাতে বিস্তারিত বলবেন। 'কবে আসবেন?' দিন তারিখ ঠিক করে একদিন গেলাম।
'যায়যায়দিনে কেমন চলছে?' জিজ্ঞেস করলেন।
তখন যায়যায়দিন ভাল চলছে না। অনেক আগেই ১০৪ জন গুরুত্বপূর্ণ সাংবাদিকের চাকরি চলে গেছে। বসুন্ধরা গ্রুপ ইনভেস্টমেন্ট উঠিয়ে নিয়েছে। শফিক রেহমান এইচআরসির কাছে যায়যায়দিন বিক্রি করে দিয়েছেন বা দেবেন। বেতন অনিয়মিত হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। তবু বললাম, 'ভাল চলছে।'
উনি আর তর্কে গেলেন না। বললেন, ব্লগের ব্যাপারে আপনার ভাবনা কী?
তখন আমি ব্লগ নিয়ে অত্যধিক উচ্ছ্বসিত। ব্যাপক উচ্ছ্বাস নিয়ে ব্লগের সম্ভাবনার কথা বললাম। ব্লগ নিয়ে এত কথা বলার পর উনি সরাসরি প্রসঙ্গে এলেন। বললেন, প্রথম আলো একটি ব্লগ খুলতে চায়। আপনি দায়িত্ব নেন।
আমি বললাম, 'নিলাম।'
'এখনই কিছু বলতে হবে না। ভেবে চিন্তে বলেন।'
'ভাবনা-চিন্তার কিছু নাই। কবে জয়েন করতে হবে বলেন।'
কোনো চিন্তা ছাড়া যে বললাম তার কারণ যায়যায়দিনের খারাপ অবস্থা। প্রথম আলো ছাড়া সামনে কোনো অপশন নেই। ব্লগ আমার পেশা না, নিউ মিডিয়া এখনও বাংলাদেশে পেশা হিসেবে গড়ে ওঠেনি। তখন পরিস্থিতি আরও খারাপ। আমার পেশা ওল্ডমিডিয়া। সাংবাদিকতা। বেশিরভাগ সময় আমি সম্পাদকীয় পাতায় কাজ করেছি। দুই বছর আর্ট অ্যান্ড কালচার ম্যাগাজিনে। এইসব বিষয়ে আমার দক্ষতা আছে। কিন্তু ব্লগ নিয়ে আমার কোনো দৃশ্যমান দক্ষতা নেই। আমি ব্লগার। সামহয়ার চালু হ্ওয়ার বছর দুয়েক আগে থেকে ব্লগস্পটে ব্লগিং করি। সামহয়ার চালু হলে এই ব্লগেই লিখেছি। এছাড়া আর তেমন কিছু জানি না। বুঝলাম, আমার সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ। প্রথমত ব্লগ বুঝতে হবে, প্রথম আলো কী চায় তা বুঝতে হবে। দ্বিতীয়ত, নিউ মিডিয়ার পেশায় দক্ষতা অর্জন করতে হবে। হয়তো সামনের সময়গুলো আমাকে নিউ মিডিয়া নিয়েই থাকতে হবে।
প্রথম আলোতে যোগ দেওয়ার পর আমি শুরুতে বুঝতে চাইলাম প্রথম আলো কী চায়। কর্পোরেট মিডিয়া হিসেবে তাদের ব্লগ তাদের মতোই হওয়া উচিত। এটা আমার ব্যক্তিগত উদ্যোগ না, চাকরি। ফলে, পত্রিকাটির উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে নানা আলাপ-আলোচনা শুরু করলাম। বিশ্বের বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকার ব্লগের উদাহরণ দিয়ে আমি বললাম, কিছু পত্রিকা আমপাঠককে লেখার অনুমতি দেয় বটে কিন্তু অধিকাংশ পত্রিকাই সিলেকটেড লেখকদের ব্লগিং করে। পত্রিকার নিয়মিত ও সেলিব্রেটি লেখকরাই তাতে লেখেন। প্রথম আলো যদি ব্লগ খুলতে চায় তবে তাদের উচিত, নিজস্ব লেখকদের নিয়ে শুরু করা। নানা আলাপ-আলোচনার পর এদিকে কর্তাদের মন সরলো না। বাংলা ব্লগের আদর্শ সামহয়ার ইন ব্লগ। অতএব এমন একটা হিউজ জনসমাবেশ চাই। অ্যালেক্সায় একটা উল্লেখযোগ্য জায়গাও চাই। কেউ কেউ নিউজ ব্লগ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন তখন। আমার কাছে চিন্তাটা অপরিপক্ব মনে হয়েছিল। এখন্ও মনে হয়।
কর্তাদের মনোভাব বুঝে সামহয়ারের মতো একটা ব্লগ তৈরির কাজ শুরু হলো। সামহয়ারের আদি কালের ডেভেলপার হাসিন হায়দারের সঙ্গে চুক্তি হলো। ব্লগে কী থাকবে কী থাকবে না তা নিয়ে আমরা গবেষণা শুরু করলাম। তিন কলামের টেমপ্লেটে মাঝের কলামটা আমরা বরাদ্দ করলাম শুধু সিলেকটেড লেখার জন্য। ডানের কলামটিও বড় হবে। মাঝেরটিও। ব্লগাররা পোস্ট করলে সেটি সরাসরি প্রকাশিত হবে ডানের কলামে। পোস্টের শিরোনাম, কয়েক লাইন দেখা যাবে সেখানে। যদি লেখাটি মডারেটরদের ভাল লাগে তবে সেটি মাঝের কলামে সংকলিত হবে। এই কলামটি হবে স্লো আইটেম। নানা পর্যায়ে কথাবার্তার মধ্য দিয়ে ব্লগ ইঞ্জিন যখন তৈরি তখন প্রথম আলোর জুনিয়র কয়েকজন কর্মকর্তা বেশ তৎপর হয়ে উঠলেন। তারা বললেন, মডারেশন ছাড়া পোস্টগুলো ডানের কলামে আসবে তা কী করে হয়? কার্টুন-কাণ্ডের ভীতি তখনও কার্যকর। তারা বড়কর্তাদের বোঝালেন, কোনো পোস্টই যেন মডারেশন ছাড়া প্রকাশিত না হয়। বড় কর্তারা আমাকে মডারেশনের পরামর্শ দিলেন। আমি বললাম, প্রিপোস্ট মডারেশন হলে সেটিকে আর ব্লগিং বলা যাবে না। আমরা পোস্ট-পোস্ট (পোস্ট প্রকাশিত হওয়ার পর) মডারেশন রেখেছি। সবচেয়ে বড় কথা, একটা কড়া নীতিমালা হয়েছে। বড় কর্তারা রিস্ক নিতে চাইলেন না। প্রায় প্রস্তুত ইঞ্জিনে আবার হাত দিতে হলো। ডানের কলাম ছোট হলো। অনেক লড়াইয়ের পর সেখানে শুধু পোস্টের শিরোনাম রাখা সম্ভব হলো। এই পরিবর্তনের পর ব্লগ দেখতে একেবারে সামহয়ারের মতো হয়ে গেল। এ ঘটনাটি আমার বিশেষভাবে মনে আছে ছোট কর্তাদের কারণে। ছোট কর্তারা আসলে আমাকে সমস্যায় ফেলতে চেয়েছেন। প্রথম আলো চায়, হিউজ জনসমাগম। প্রিপোস্ট মডারেশন হলে জনসমাগম হবে না। আমি ফেইল করবো। হিসাব ক্লিয়ার।
অবশ্য এই ঘটনায় আমি অল্প সময়ে কর্পোরেট মিডিয়া বিশেষ ক্ষেত্রে প্রথম আলোর সীমাবব্ধতা বুঝতে পারলাম। সেখানে সাকুল্যে আমি কাজ করেছি একবছর। এসব ঘটনা যখন ঘটছে তখন আমার চাকরি তিন চার মাস হয়েছে।
আমি বুঝলাম, বড় মিডিয়া হিসেবে সোসাইটির মধ্যে প্রথম আলোর নানা স্টেক আছে। প্রথম আলোর কর্মীরা ব্যক্তিগতভাবে কিছু করলে তার দায়ও প্রথম আলোকে নিতে হয়। এমনকি পিজা হাট বা কেএফসি বা আনন্দধারা পত্রিকায় কিছু ঘটলেও তার দায় পড়ে প্রথম আলোর ওপর। পত্রিকাটির এমন একটি নৈতিক ভাবমূর্তি আছে যে, একে প্রায় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তুলনা করা চলে। আমার মতে, প্রথম আলো মূলত খবর বেচে না, বেচে নৈতিকতা। ফলে, ব্লগে কেউ কিছু লিখলে সেটির দায় প্রথম আলোর ওপর পড়বে। সবাই বলবে, প্রথম আলোতে এই হয়েছে, ওই হয়েছে। বায়তুল মোকারম সহ সমাজের অন্য নৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে মিছিল বের হবে।
বলাবাহুল্য, ব্লগ খুলবো অথচ লোকে স্বাধীনভাবে লিখতে পারবে না এটি জটিল পরিস্থিতি। এমন পরিস্থিতি যাদের আছে তাদের উচিত ব্লগ না খোলা। অনলাইন দুনিয়ায় বহুকিছু করার আছে সেগুলো করলেই হয়। সবাইকে ব্লগ খুলতে হবে এ দায় কে দিয়েছে? এখনও আমার মনে হয়, জনসমাবেশের মোহে না ভুলে প্রথম আলো যদি সিলেকটেড লেখকদের নিয়ে ব্লগিং করতো তবে সেটি প্রথমআলোচিত হতো।
সেটি হয়নি। তারা বারবার সামহয়ারের মতো ব্লগ করতে চেয়েছেন। আমার মনে হয়েছে, এটি একান্তই কর্পোরেট অভিব্যক্তি। দেশের সবচেয়ে বড় মিডিয়া প্রথম আলো। আর কোথাও কোনোভাবে বড় জনসমাবেশ হলে তাদের চিন্তিত হওয়ার কথা।
সামহয়ার একটি বড় চিন্তা। বিডিনিউজও। সামহয়ারে মত গঠিত হচ্ছে, খবর ছড়াচ্ছে। প্রচুর মানুষ লিখছে। এমন একটি জায়গা কি প্রথম আলোর থাকতে পারে না? কর্পোরেট মিডিয়ার এই অভিব্যক্তি ভাল। আমি কর্তাদের বলেছি, আপনারা যা চান তা মোটামুটিভাবে মেইনস্ট্রিমিং অব অলটারনেটিভ মিডিয়া। এটা করার জন্য যে কর্পোরেট টুল দরকার তা তো নেই। আমার মত হলো, সামহয়ারের মতো পাবলিক স্পেসের অলটারনেটিভ তৈরি করা কঠিন নয়। কিন্তু প্রথম আলো সে স্পেসের দায় বহন করতে পারবে না। প্রথম আলোর উচিত, বিডিনিউজের অডিয়েন্স আকর্ষণ করা। লোকে সারাদিন বিডিনিউজ পড়বে কেন শুধু, দিনের বেলাতেও যাতে প্রথম আলোর অনলাইন পড়ে সে ব্যবস্থা হোক। আমি থাকতে থাকতেই সে ব্যবস্থা শুরু হলো। সীমিত অনলাইন ধীরে ধীরে বড় হতে থাকলো।
মেইনস্ট্রিম মিডিয়া নিজের শক্তি অক্ষুণ্ণ রাখতে অলটারনেটিভ দখল করতে চাইবে এর মধ্যে বিস্ময়ের কিছু নেই। কিন্তু পরিহাস হলো, মেইনস্ট্রিম অলটারনেটিভ দখল করলে সেটি আর অলটারনেটিভ থাকে না।
........................................................
প্রথম আলো ব্লগে চাকরি নেওয়ার পরপরই একটি নীতিমালা তৈরির কাজ শুরু হয়। প্রথম আলো একটি নীতিনিষ্ঠ প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানে যারা চাকরি করে তাদের কী আচরণবিধি অনুসরণ করতে হবে তা নিয়ে তাদের নিজস্ব প্রকাশনা আছে। নানা বিষয়ে খবর কীভাবে প্রকাশিত হবে তা নিয়ে পুস্তিকা আছে। সেগুলো পড়লাম প্রাথমিকভাবে। তারপর দক্ষ একজন ব্যারিস্টারের সঙ্গে বসার ব্যবস্থা হলো। ব্যারিস্টারের সঙ্গে বসার অভিজ্ঞতা মজার। তিনি সাইবার জগতের সমস্যা নিয়ে নানা মোকদ্দমা পরিচালনায় অভ্যস্ত। আন্তর্জাতিক আইন ও দেশীয় আইন বিষয়ে ওয়াকিবহাল। অফিস থেকে বড় কর্তারা আমাকে বিশেষভাবে বলে দিয়েছিলেন যে একটি ওয়েবসাইট খোলার জন্য কোনো অনুমতি লাগে কি না সেটি বিশেষভাবে জেনে আসতে। পত্রিকা প্রকাশ করতে অনুমতি লাগে। সে অনুমতির প্রক্রিয়া কঠিন। ফলে, পত্রিকার লোকেরা ভাবতেই পারে না অনুমতি ছাড়া পত্রিকার মতো একটা জিনিশ বাজারে আসতে পারে। শুরুতে আমি ব্যারিস্টার সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম, ব্লগ বা কোনো ওয়েবসাইট চালু করতে অনুমতি লাগে কি না। অনুমতি লাগলে কারা সে অনুমতি দেয়।
ব্যারিস্টার বললেন, অনুমতি লাগবে কেন? ওয়েবসাইট খুলতে যদি অনুমতির প্রশ্ন আপনার মাথায় আসে তবে বুঝতে হবে ওয়েবসাইট বিষয়েই স্পষ্ট ধারণা আপনার নেই। আপনি আমাকে বলুন, আমেরিকার নাগরিক কোনো বাঙালি যদি বাংলা ভাষায় একটা ওয়েবসাইট খোলেন তাহলে তিনি কেন বাংলাদেশের কোনো কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেবেন? বাংলাদেশ সরকার যদি চায়ও তাহলে সে অনুমতি তারা দেবেই বা কীভাবে? যে কেউ (তৌফিক ইমরোজ খালেদীর ভাষায়) ওয়েবসাইট খুলতে পারেন। তবে, ওয়েবসাইটগুলোতে যদি বেআইনি কিছু ঘটে তাহলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থার উপায় আছে। সেটি যেমন বাংলাদেশের একটি সাইটের ক্ষেত্রে সম্ভব তেমনি আমেরিকার একটি সাইটের ক্ষেত্রেও সম্ভব।
মাধ্যমটি যেমন আন্তর্জাতিক আইনও সেক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক। আর এ আইনের কনসার্ন মূখ্যত অর্থনৈতিক। কপিরাইটই মূল বস্তু। অনেকে দেশেই পর্নগ্রাফি বৈধ বস্তু, কিন্তু চাইল্ড পর্ন ও অ্যাবিউজ নিষিদ্ধ। সরকারের সমালোচনা সেখানে নিষিদ্ধ নয়, কিন্তু ঘৃণার মতাদর্শও নিষিদ্ধ। আর একটা কনসার্ন সিকিউরিটি। ব্যারিস্টার আমাকে কপিরাইট, পর্ন ও সিকিউরিটিকে প্রাধান্য নিয়ে নীতিমালা করতে বললেন। তার পরামর্শ হলো, আইনে অনেক কিছু নাও থাকতে পারে, কিন্তু একটা ব্লগ নিজে একটা নীতিমালা তৈরি করে সেটা অনুসরণ করতে পারে। তবে শর্ত হলো, ব্লগারকে রেজিস্ট্রেশনের সময় সে নীতিমালা পড়াতে হবে। শর্তহীন রেজিস্ট্রেশনের পর নীতিমালা চাপালে সেটি মানতে ব্লগার বাধ্য নাও থাকতে পারেন।
ব্যারিস্টারের সঙ্গে কথা বলার আগে আমি ব্লগার, ওয়ার্ডপ্রেস, ফেসবুক সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশন ডাউনলোড করেছিলাম। সেগুলো একটা সারসংক্ষেপ আমার হাতে ছিল। সেগুলো দেখালে তিনি বললেন, বাংলাদেশের কনটেক্সটে আমাদের মূল কনসার্ন চারটা। রিলিজিওন, সিকিউরিটি, পর্ন ও ব্যক্তি আক্রমণ/ অবমাননা। সঙ্গে অবশ্যই কপিরাইট।
ব্যারিস্টারের সঙ্গে কথা বলে আসার পর, আমি কর্তাদের সঙ্গে বসলাম। তারা বললেন, আইনি বাধ্যবাধকতা থাকুক না থাকুক প্রথম আলোর নাম যেহেতু ব্লগের সঙ্গে থাকবে আমরা ব্লগকে প্রথম আলোর সাপ্লিমেন্ট হিসেবে বিবেচনা করবো। এবং প্রথম আলোর জন্য প্রযুক্তি নীতিমালা ও আইন ব্লগের জন্যও কার্যকর মনে করবো। সে আলোকে নীতিমালা তৈরি হয়। নীতিমালার খসড়া ব্যারিস্টার একগাল হেসে অনুমোদন করেন। যাই হোক, ব্লগের ডেমো রেডি হলে সেটি আপ করা হলো। পাসওয়ার্ড দিয়ে সীমিত লোকদের মধ্যে তা বিতরণ করা হলো। কিন্তু আমার ও প্রথম আলো ব্লগের বিরুদ্ধে ব্লগস্ফিয়ারের একটি কমিউনিটি এতটাই সরব ছিল যে পাসওয়ার্ড সমেত ঘটনাটি ফাঁস হয়ে গেল। রাতারাতি প্রচুর নিক তৈরি হলো। এর অধিকাংশই ভুয়া। এক রাতে হাজার খানেক ব্লগার পেয়ে আমরা অভিভূত হলাম ঠিকই। কিন্তু ব্লগের ডেমো অবস্থায় কিছুটা বিব্রত হলাম সামহয়ারের বিখ্যাত ব্লগারদের নিক নিয়ে সেখানে ভূয়ারা নিক খোলায় একেবারে লজ্জায় পড়লাম। ব্লগের কর্মচারি সাকুল্যে আমি একা। ফলে, হাজার নিক মানেজ করাই সমস্যা হয়ে দাঁড়ালো। ব্লগার এর পরে আরও বাড়লো। আমি যখন চলে আসি তখন প্রথম আলো ব্লগে ১৪ হাজার রেজিস্টার্ড ব্লগার ছিলেন। এখনও পর্যন্ত বাংলাদেশের ব্লগগুলোর মধ্যে সেকেন্ড লারজেস্ট ব্লগ প্রথম আলো। প্রথম আলো ব্লগের সাফল্য নিয়ে আমার সংশয় ছিল আগে। এখন প্রশ্ন দাঁড়ালো, এই কড়া নীতিমালা মেনে নেওয়ার শর্তে কেন হাজার হাজার মানুষ ব্লগে আসছেন? এদের অনেকেই প্রথম আলোর ভক্ত সন্দেহ নেই। কিন্তু অনেকেই পরিচ্ছন্ন ব্লগ চেয়েছেন। একথা সত্য, বাংলা ব্লগে গুরুতর সাইবার অপরাধ কখনোই সংগঠিত হয়নি। কিন্তু ব্লগগুলোতে, কিছু ব্লগটিজার গ্রুপ ছিল এবং আছে। এরা বিভিন্ন ব্লগারকে টিজ করতো। গালাগালিও করতো। ব্লগের মডারেটররা এদের নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে অমনোযোগী ছিলেন। প্রথম আলো ব্লগের পর অন্য ব্লগগুলোতে গালিবাজ ও টিজারদের ব্যাপারে সচেতনতা তৈরি হয়। এটি আগেই হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু হয়নি সেটা দুঃখজনক। এ ব্যাপারে আমি বিভিন্নভাবে সামহয়ার সহ অন্য ব্লগকর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইলেও লাভ হয়নি। কেন তখন ব্লগের মডারেটররা গালিবাজ ও টিজারদের প্রশ্রয় দিতেন সেটি তারা ভাল জানবেন।
যাই হোক, প্রথম আলো ব্লগ প্রাথমিকভাবে সফল হয়েছে সত্য, কিন্তু সামহয়ারের মতো প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারেনি। সামহয়ারে একজন ব্লগার মোটামুটি স্বাধীনতা নিয়ে ব্লগিং করতে পারেন। সমাজের সমস্যার কথা বলতে পারেন। সমাজ-সংসারে উপস্থিত বিবাদে ভুল হোক কি শুদ্ধ একটি পক্ষ নিতে পারেন। কিন্তু প্রথম আলো ব্লগে এটি করা কঠিন। আমরা সকলেই বুঝি যে, প্রথম আলোর মতো মিডিয়ার পক্ষে আগ বাড়িয়ে ব্লগারদের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা সম্ভব না। শুধু স্যাবোটাজের ভয় নয়, একটি বড় কর্পোরেট মিডিয়ার নানা স্টেক থাকে। একজন ব্যবসায়ীর শত কোটি টাকার ইনভেস্টমেন্ট থাকে। নানা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক থাকে। মেইনস্ট্রিম মিডিয়া নিজের অস্তিত্বের স্বার্থে চাইলেই যে কারো বিরুদ্ধে লিখতে পারে না। সরকার, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সহ বিভিন্ন জায়গায় ছাড় দিতে হয়। এর মধ্যেই তারা নিউজ করে। প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রথম আলোর যে দায় তা একজন স্বাধীন মানুষের দায় হওয়া উচিত নয়। কিন্তু প্রথম আলো ব্লগ করেছে। সে ব্লগকে এক নম্বর বানানোর জন্য আমি চাকরি করেছি। প্রশ্ন হলো, প্রথম আলো ব্লগকে এক নম্বর বানানো কি সম্ভব ছিল আমার পক্ষে? আমি বলবো, অবশ্যই ছিল। কীভাবে? প্রথম আলো ব্লগের নীতিমালা শিথিল করে? না, অন্য ব্লগগুলোর স্বাধীনতা খর্ব করে।
যদি কোনোভাবে সরকারের মাথায় ব্লগের নীতিমালা ঢুকিয়ে দেওয়া যায় তাহলেই কেল্লাফতে। সামহয়ার সহ বিভিন্ন ব্লগে শক্তনীতিমালা ঝুলবে। সমানে সমানে যুদ্ধ হবে। এভাবে আমি চিন্তা করতে অভ্যস্ত নই। আশার কথা, প্রথম আলোর কেউ এভাবে এখনও চিন্তা করেনি। তবে, অন্য মিডিয়াগুলো এভাবে চিন্তা করতে শুরু করেছে। বিডিনিউজের সম্পাদক ও ব্লগ টিমের কৌশিক ও আইরিন যে সাইবার নীতিমালা নিয়ে এত উৎসাহ দেখাচ্ছে তার পেছনে আছে ব্লগটিকে সফল করার জন্য তাদের আকুতি। প্রথম আলো ব্লগের পর বিডিনিউজই আরেক মেইনস্ট্রিম মিডিয়া যারা ব্লগ তৈরি করেছে। যে দেশে অনেক সাংবাদিকের নিউজ জ্ঞান নেই, সেখানে তারা নিউজ ব্লগ তৈরি করেছে। প্রত্যাশিতভাবে সে ব্লগ সাড়া ফেলেনি। শক্ত মডারেশন, অবাস্তব আইডিয়া তাদের ব্যর্থতার মূল কারণ হলেও তারা কারণ হিসেবে যা শনাক্ত করেছে তা ব্লগস্ফিয়ারের জন্যই সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা নীতিমালার মালা সব ব্লগের গলায় পরাতে চায়। প্রশ্ন হলো, সরকারের সঙ্গে বিডিনিউজের স্টেক আছে। সরকারে বন্ধুবান্ধব আছে। আপনাদের নীতিমালা আপনারা মানেন। কিন্তু সরকারের তরফে আইন আহবান করে সবাইকে তা মানানোর উদ্যোগ কেন?
সামহয়ারের তো সরকারের কাছে দায়বদ্ধতা নেই। নাগরিকদের স্বাধীনভাবে লিখতে দিতে সমস্যা নেই। মন্ত্রীদের অপকর্ম ঢাকার দায় বিডিনিউজ ব্লগের থাকতে পারে, সামহয়ারের থাকবে কেন?
অবশ্য সামহয়ারের যদি ব্যবসায়িক বাসনা থাকে, যদি সরকারের সঙ্গে দরকষাকষির আগ্রহ থাকে তাহলে অন্য কথা। আমার মতে, সামহয়ারের যদি তেমন বাসনা থাকেও, তবে সচলায়তনের থাকার কথা নয়, নাগরিক ব্লগের থাকার কথা নয়, আমরা বন্ধুর থাকার কথা নয়, উন্মোচন ব্লগের থাকার কথা নয়।
মজার ব্যাপার হলো, বিডিনিউজ বিরামহীনভাবে ব্লগ ও সাইবার স্পেস নিয়ন্ত্রণের জন্য কাজ করছে। প্রতিদিনই কোনো না কোনো আইটেম ছাড়ছে। তাদের মনোভাব হলো, আজই কেন সরকার ফেসবুকের বিরুদ্ধে নামছে না? কাল কেন আইন করছে না। বাতাসে যতটুকু আলামত তাতে কিছু কম্পিউটার ও সফটওয়ার ব্যবসায়ীও শীঘ্রই তাদের সঙ্গে যোগ দেবে। আমার মতে, ব্লগ নিয়ন্ত্রণের জন্য কোনো আইন হলে তার দায় বিডিনিউজের ওপর বর্তানো উচিত।
আমরা এমন একটি দেশে বাস করি, যে দেশে যে কোনো নাগরিককে গ্রেফতারের জন্য কোনো মামলা, ওয়ারেন্ট, অভিযোগ দাখিল করতে হয় না। আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সন্দেহ হলেই যে কেউ গ্রেফতার হতে পারে। এমন দেশে সাইবার স্পেস নিয়ন্ত্রণের জন্য যারা স্পষ্ট আইন চান তাদের মতো নির্বোধ আর কে হতে পারে? ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যুকামনা যিনি করেছেন তার বিরুদ্ধে মামলা করতে কি নতুন আইন দরকার হয়েছে? মেইলে যে হুমকি দিয়েছে কর্তাদের তাকে ধরতে কি আইন লেগেছে? প্রধানমন্ত্রীর ছবি বিকৃত করার অপরাধে ফেসবুক বন্ধ করার সময় কি আইন দরকার হয়েছে? ইউটিউব বন্ধ করার সময় কি আইন দরকার হয়েছে? নির্বোধরা তাহলে কী বন্ধ করার জন্য আইন চাচ্ছেন?
দেশে যে আইন আছে তা মানলে তো লেখালেখি বন্ধ করে খিড়কি আটকিয়ে ঘরে বসে থাকা উচিত। আবার আইন?
বাংলাদেশে তো আমরা বহুদিন ব্লগ লিখছি। বিএনপি ও জামাত যখন ক্ষমতায় ছিল তখন ব্লগে তাদের কত সমালোচনা হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার যখন ক্ষমতায় তখন এক সামহয়ারেই কত লেখা এসেছে। কই সরকারের পক্ষ থেকে কেউ তো কথা বলেনি। ব্লগ নিয়ন্ত্রণের জন্য মন্ত্রীরা উচ্চকণ্ঠ হননি। ব্লগকে পর্ন আখ্যা দেননি। তাহলে আওয়ামী লীগ সরকারের হঠাৎ এত শিরোপীড়া কেন? তবে কি এ সরকার যথেষ্ট গণতান্ত্রিক নয়?
যাই হোক, বিডি নিউজ প্রতিদিন ব্লগ, সামাজিক ও সাইবার স্পেস নিয়ন্ত্রণের জন্য যে আইটেমগুলো ছাড়ছে তাতে খুব শীঘ্রই ব্লগারদের স্বাধীনতা খর্ব হতে পারে। এজন্য কর্পোরেট বা মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার ব্লগগুলোকে সন্দেহের তালিকায় ফেলতে হবে। প্রথম আলো ব্লগ সরাসরি ক্ষতিকর কোনো উদ্যোগ নেয়নি, আশা করা যায়, নিপীড়নমূলক কোনো আইন হলে প্রথম আলোর জোরালো ভূমিকা থাকবে তার সমালোচনায়। তারপরও, বিডিনিউজের অভিজ্ঞতায় মনে হচ্ছে প্রথম আলো ব্লগ সহ সব কর্পোরেট ব্লগকে সন্দেহের তালিকায় রাখা উচিত। কর্পোরেট ব্লগগুলোর পাশাপাশি কিছু ধান্দাবাজ ব্লগও তৈরি হয়েছে। তাদের উদ্দেশ্য সরকারের নজরে পড়া, এঁটোকাটা খাওয়া। এদের ব্যাপারেও সতর্ক হতে হবে। পাশাপাশি, বাংলাদেশে যেসব ইন্ডিপেন্ডেন্ট কমিউনিটি ব্লগ তৈরি হয়েছে সেগুলোকে উৎসাহিত করা জরুরি। আজকে বিডিনিউজ কর্পোরেট ও ইন্ডিপেন্ডেন্ট ব্লগের মধ্যে বিভাজন রেখাটা স্পষ্ট করে দিয়েছে। বিডিনিউজের মতো ক্ষতিকর কর্পোরেট ব্লগ বর্জন করে ইন্ডিপেন্ডেন্ট ব্লগকে শক্তিশালী করা তাই ব্লগারদের কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমরা চাই, ইন্ডিপেন্ডেন্ট ব্লগগুলো অটুট থাকুক। মুক্তমতের চর্চা অব্যাহত থাকুক। সঙ্গে এটাও চাই, সামহয়ার সেই অর্থে ইন্ডিপেন্ডেন্ট ব্লগ না হলে ইন্ডিপেন্ডেন্ট ব্লগের ধারাটা অব্যাহত রাখুক।

ফেসবুকে চাই বাধাহীন ব্লগ, মুক্ত মিডিয়া- মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নামে একটি পেজ খুলেছি। চাইলে কেউ যোগ দিতে পারেন।



সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জানুয়ারি, ২০১২ রাত ৮:১৩
৩৮টি মন্তব্য ৩৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

খুলনায় বসবাসরত কোন ব্লগার আছেন?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:৩২

খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা কুয়েট-এ অধ্যয়নরত কিংবা ঐ এলাকায় বসবাসরত কোন ব্লগার কি সামুতে আছেন? একটি দরিদ্র পরিবারকে সহযোগীতার জন্য মূলত কিছু তথ্য প্রয়োজন।

পরিবারটির কর্তা ব্যক্তি পেশায় একজন ভ্যান চালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

একমাত্র আল্লাহর ইবাদত হবে আল্লাহ, রাসূল (সা.) ও আমিরের ইতায়াতে ওলামা তরিকায়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৬:১০



সূরাঃ ১ ফাতিহা, ৪ নং আয়াতের অনুবাদ-
৪। আমরা আপনার ইবাদত করি এবং আপনার কাছে সাহায্য চাই।

সূরাঃ ৪ নিসার ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×