দুঃস্বপ্নটা কিছুদিন ধরেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিল৷ কিছুদিন, নাকি কয়েক দশক৷ অনেক ভুল জমা হয়েছে৷ ভুল জমতে জমতে একদিন কালো মেঘ হয়ে গেছে৷ সে মেঘে মেঘে সংঘর্ষ হলে বজ্রপাত হবেই৷ ইতিহাসের উপর৷ দেশের উপর৷ মানুষ-সংস্কৃতির উপর৷ অনেকদিন ধরেই দুঃস্বপ্নটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে৷ এমন তো হওয়ার কথা ছিল না৷ পলাশির আমবাগানে, সেই জুনের দিনে মুসলমান নবাবের বিরুদ্ধে হিন্দু সৈনিকরাও তো লড়াই করেছিল৷ সিপাহিরা যেদিন সকলে মিলে বিদ্রোহ করেছিল, সেদিনও তো কেউ কোথাও আলাদা ছিল না৷ সত্যি বলতে এই দেশে, এই আলো, এই হাওয়ার মাঝে তো ধর্মীয় বিভজনিত ‘পৃথক’-এর বীজ এমন করে কোনওদিনই গাছের স্বপ্ন হয়ে মাথাচাড়া দেয়নি৷
আর দেশ যখন প্রভুদের হাতে কলের পুতুল মাত্র তখন তো এ বিভেদেক কণামাত্রকেও সমূলে দমিয়ে ফেলার সময়৷ অথচ হল তার উলটো৷ কবে যে গোপনে পেল জলের খোঁজ, কবে যে অনুকূল পরিবেশের ইন্ধন, সেই গোপন বীজই যেন মাথাচাড়া দিয়ে মহীরূহ হয়ে ভেঙে দিতে চাইছে আস্ত একটা দেশের সৌভাতৃত্বের বন্ধনটিকে৷ কোথায় যে এত চাপা অসন্তোষ জমা হয়েছিল৷ উলেমা ইকবাল কি এমনি এমনিই মুসলিম লিগের কনভেনশনে পৃথক মুসলিম রাষ্ট্রের ধারণা প্রথম জনসমক্ষে আনলেন? নাকি এ দীর্ধদিনের এক অশান্তির বহিপ্রকাশ মাত্র৷
তবে কি গোড়া থেকেই ছিল গন্ডগোল৷ জাতীয়বাদের ঝোড়ে হাওয়ায় যা খেয়াল করা হয়নি, আসলে তাই বুমেরাং হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ জাতীয়তাবাদের উত্থানের অন্য নাম কবে থেকে যেন হয়ে উঠেছিল হিন্দুত্বশক্তির উত্থান৷ হ্যাঁ, দেশমাতৃকার যে বন্দনা, যে স্তোত্র তা তো হিন্দু ধর্মের অনুসরণেই তৈরি৷ বিপ্লবীরা যে স্বামীজিকে অনুসরণ করেন, তিনিও তো হিন্দু জাগরণের পথিকৃত৷ ভাবীকালের ইতিহাস হয়তো বলবে না মানবিকতা, কিন্তু সমকাল তো তাঁকে এই রূপেই দেখে৷ ওই যে দেশের নেতৃত্বে বটবৃক্ষসমান গান্ধিজী তিনিও তো হাতে গীতা ধরে, বিপ্লবীরা শপথ নিচ্ছেন গীতা ছুঁয়েই৷ এত অনুষঙ্গ সব হিন্দুধর্ম মাফিক কেন? কেন ভাবা হল না এ দেশ হিন্দু-মুসলিম উভয়েরই৷
ভারতবাসীর চামড়ায় চাবুক চালানো ইংরেজরা যে ধূর্ত শেয়াল তা কি জানতো না পরবর্তী ভারতবাসী৷ ধর্মের দেওয়ালে এই সামান্য ছিদ্রপথ কী ঔপনিবেশিক প্রভুরা কাজে লাগাবেন না? চতুর শৃগালের মতোই সে ছিদ্রফথ দিয়ে তাঁরা মাথা গলিয়ে দিয়েছিলেন৷ কবে থেকে যেন দেশের মুসলিমরা বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল এই যে সংগ্রাম এ আসলে হিন্দুদের সংগ্রাম৷ তারা ব্রাত্য৷ Stampসংখ্যগরিষ্ঠ হিন্দুদের শাসনেই যে স্বাধীনতার পর তাদের থাকতেহবে, এ কথা মুসলিমদের মধ্যে কে বা কারা যেন প্রচার করে দিয়েছে৷ কে বা কারা যে বলে দিয়েছে, ধর্মে-প্রথায়-আচারে আলাদা বলেই হিন্দু ও মুসলিমের এক দেশ হতে পারে না৷ তাদের আলাদা আলাদা দেশ হওয়া উচিত৷ ৩৭ সালে সাতটা প্রদেশে কংগ্রেসের সরকার যখন হয়, তখন কে বা কারা যেন রটিয়ে দিয়েছিল মুসলিমদের উপর অত্যাচার করা হবে৷ যত দিন যাচ্ছে কংগ্রেস আর মুসলিম লিগও হাত ধরাধরি করে চলতে নারাজ৷ এই অবিশ্বাস-সন্দেহ কোন রূপ নিতে পারে তা কি ধারণা করতে পারছেন না শীর্ষ নেতারা? নাকি জেনেবুঝেও, সমকালীন রাজনীতিতে ক্ষমতার কেনদ্রগুলিকে অক্ষত রেকেই স্বাধীনতা আনতে তাঁরা সেই ভয়াবহ পরিণতির দিকেই এগোচ্ছেন? দুঃস্বপ্নটা যেন ক্রমশ অবয়ব নিচ্ছে৷
আচ্ছা কী হতে পারে? যদি মুসলিম লীগ আলাদা দেশের দাবীতে সোচ্চার হয়? যদি তারা একদিন মাঠে নেমে বলে, আজ ‘ডিরেক্ট অ্যাকশন ডে’, আর যদি দাঙ্গা বাধে! যদি কংগ্রেস নেতৃত্ব কোনওভাবেই মুসলিম লিগের সঙ্গে কাজ করতে না রাজি হয়? তাহলে তো দেশ ভাগ হবেই! কে করবে সেই ভাগ? তার কোনও ঠিক নেই৷ কোনও অজানা অচেনা অভিজ্ঞতাহীন লোককে ধরে এনে প্রভুরা বলবেন, দাও ভাগ করে৷ আর দেশের সংস্কৃতি-সীমানা সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা না থাকা সে লোক আঁশবটিতে কেটে কুঁচিয়ে ফেলবেন দেশটাকে৷ হয়তো এক পরিবারের ঘরটা থাকবে এ-দেশে, গোয়ালটা হযে যাবে আর এক দেশ৷ কত জীবনহানি যে হবে তার ইয়ত্তা নেই৷ কত মানুষ বাস্তুহারা৷ হয়তো বিশ্ব ইতিহাসে সবথেকে বড় মাইগ্রেশন হয়ে থাকবে এই ঘটনা৷ লক্ষ লক্ষ নারীর ধর্ষিতা হবেন৷ আর সেই সবের বিনিময়ে হবে স্বাধীনতা? দুঃস্বপ্ন যেন এখন অনেক কাছাকাছি৷ ইতিহাস যেন নিরুচ্চারে বলছে দোহাই আলি৷
নাহ, এসব কিছুই হবে না৷ ক্ষমতার কেন্দ্র যতগুলিই হোক, শেষমেশ শীর্ষনেতৃত্বরা স্বাধীনতাকেই এগিয়ে রাখবেন বেশি৷ ধর্মের কাঁটাটিকে তুলে ফেলে দেবেন৷ ঔপনিবেশিক প্রভুদের ছলনা ধরা পড়ে যাবে একদিন প্রকাশ্য দিবালোকে৷ দেশ স্বাধীনতা পাবে, হ্যাঁ প্রত্যক্ষ যুদ্ধ ছাড়া, গণতান্ত্রিক উপায়েই৷ দেশভাগ বলে ভারতের ইতিহাসে কোনও অধ্যায় থাকবে না৷ লেখা হবে না কোনও উদ্বাস্তুর ইতিহাস৷ সংস্কৃতির প্রাচুর্য নিয়েই অখণ্ড মানচিত্রের সীমানার ভিতরেই উত্থান হবে স্বাধীন ভারতের৷ নাহ, স্বপ্ন তো সর্বদা সত্যি হয় না৷ ইতিহাসনির্ধারি
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুলাই, ২০১৫ রাত ১২:১৫