somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শরতের একদিন অথবা শেষ দিনটাতে....

০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১১ সন্ধ্যা ৬:৫৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



বিকেলের রোদ প্রায় পড়ে আসছে। শরতের এ সময় বাতাসে ঠান্ডা একটা আমেজ থাকে। আকাশে মেঘের টুকরোদের কিছু কিছু এদিক সেদিক উদ্দেশ্যহীন ঘোরাফেরা করে। পূজো প্রায় এলো বলে। হরিপদ সাহার বাড়িতে এবার বিশাল মন্ডপ। মা কে ঠিকমত ঘরে আনতে দুহাতে টাকা খরচ করছে হরিপদ। নিতাই কিছুক্ষন আগেও ঢুলুঢুলু চোখে দু ঠ্যাং এ ভর দিয়ে মন্ডপের সামনে বসে ছিল।
মাটি মাখানো চলছে। খড়ের শরীরটা তৈরী হয়ে গেছে এখন মাটি লেপা হবে। এ সময়টা একটুও মিস করতে ইচ্ছে করেনা নিতাইএর।
সারাক্ষন ই সে আশে পাশে ঘুর ঘুর করে।
গতবার সরকারী মন্ডপের পূজা খুব একটা জমে নাই। বোধহয় শালারা নিজেরাই বরাদ্দ টাকা হজম করে ফেলেছিল। মা কে বড় দীন মনে হচ্ছিল নিতাইয়ের।
তাই বোধহয় এবার মা আসছে রাজরানীর মতন। আহ কি যে দারুন ! মাটির গন্ধ , ধান কাটা কাঁচা খড়ের গন্ধ সব যেন মিলে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে।
দুপুরে দুমুঠো ভাত জুটেছে নিতাইয়ের। ছেলের বৌএর হাত থেকে সহজে দানা বের হতে চায়না। এমন একটা ছোট মাটির থালায় ভাত বেড়েছিল! দু মুঠো মুখে দিতেই ফুরিয়ে গেল। একবার মিন মিন করে সে বলছিল আর কয়টা ভাত থাকলে দিও বৌ। অবশ্য জোরে বলার সাহস তার কোনোদিনই হয়না। যদি মুখ ঝামটা দিয়ে বলে দেয় খেতে দি এই কত!
থালার একপাশে একটু লবন ছিল তাও চেটে চেটে অনেকক্ষন ধরে খেয়েছে সে। যদি বৌ এর নজরে পড়ে আর দুটো ভাত দেয়। মিশালী শাক ঝোল ঝোল করে রেঁধেছিল আজ বৌটা। বৌটার হাতে মোয়া আছে মাইরি।
যা রাঁধে তাই অমৃত হয়ে যায়। সুড়ুৎ করে মুখ ভরে আসা লালাটা গিলে ফেলে নিতাই।

বিকেল ঠিকমত না পড়তেই পেটের মধ্যে ছুঁচো দৌড়াতে থাকে যেন। কালীগঞ্জ হাটের দিকে এক পা দুপা করে এগোতে থাকে সে। নিতাইয়ের বয়স প্রায় পঁয়ষট্টি পার হয়ে গেছে। লম্বায় আর কত হবে এই সাড়ে তিন কি চার হাত । গায়ের রং ঝাই কালো। নাকটা একটু বসার দিকে। ছোট ছোট চোখ দুটোতে যেন সারাক্ষন ক্ষিধে। হাটে মাছ নেমেছে। নীল রঙের পলিথিন বিছিয়ে জায়গায় জায়গায় মাছ জড়ো করা আছে। হাতের তালুর সমান লম্বা লম্বা কই। আরেকদিকে পোয়াটাক কুচো চিংড়ি।
ডুমো ডুমো কয়টা মাছি বড্ড ভ্যান ভ্যান করছে। শালার মাছি হইলেও হইতো। কাঁচা মাছের পচা পচা গন্ধ বুক ভরে ভেতরে টানে নিতাই। তার বড্ড ভাল লাগে। ইদানীং তার সব কিছুই খুব ভাল লাগে।

কালু ময়রা জিলাপীর আটা কব্জি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সানছে। স্টোভের আগুনে বড় কড়াই চাপিয়ে এক কড়াই তেল গরম করতে দিয়েছে কালু। তেল গরম হলেই কাগের মধ্যে আটা ঢুকিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ফুল বানাবে। মচমচে করে ভেজে পাশের মাটির হাড়িতে রাখা সিরার মধ্যে ডুবিয়ে তুলে রাখবে টিনের থালায়। এ সবই নিতাইয়ের মুখস্ত।

উল্টো দিকের একটা দোকানে পিয়াজু ভাজা চলছে। পায়ে পায়ে দোকানের পাশে এসে দাঁড়ায় সে। কি গন্ধ! আস্ত কড়াই সুদ্ধ তার খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। জীবন টা তার কেমন হয়ে গেল! একসময় রেস্ট্রিরি অফিসের কাছে একটা খাওয়ার হোটেল ছিল তার নিজের। কি রমরমা ব্যবসা। নিজের বৌটাও বেঁচে ছিল তখন। রোজ মাছ থাকতো, কোনোকোনো দিন পাঁঠার গোশ কিনে আনতো দোকানের জন্য। আর বিকাল হলেই ডাল পুরি, পিয়াজু ভাজা হতো। সেই সাথে দু রকমের চা। কুচো চিংড়ি পিষে পিয়াজুতে দিত সে। সেই পিয়াজুর স্বাদ ভোলার নয়। এখনো অনেকেই নাম করে।
চারিদিকে সেবার খুব গোল উঠলো। সরকার নাকি ওই সব খাস জমি দখলে নিয়ে নিবে। নিতাই কে হরিপদ বাবুই তো পরামর্শ দিল বেচে দিতে। সরকার নিয়ে নিলে কিছু তো আর পেতনা সে। তা ঠিক বটে। পাক্কা দশ হাজার টাকায় বেচে দিল কালামের কাছে। পরে অবশ্য কালাম নাকি হরিপদ বাবুর কাছে বেচে দিয়ে খড়িবাড়ি চলে গেছে। এখন তার হোটেলের জাযগাটাতে পাকা দালান উঠেছে। রাইতের বেলায় লাল নীল বাত্তি জ্বলে। কত রকম বাহারী কাপড় চোপড় ঝুলে থাকে। সে এক এলাহী কারবার। টাকা গুলা হাত বেহাত হয়ে গেল। নিতাই আর কোনো ব্যাবসাতেই মন বসাতে পারলোনা। কয়দিন সবজি বেচার ব্যাবসা ধরেছিল, তারপর গঞ্জ থেকে কাপড় এনে বেচেছিল কিছুদিন। কোনোটাই কপালে লাগলোনা। পোলা একটু বড় হইতেই রাজমিস্ত্রীর কামে বাড়ি থেকে পালালো।
বৌটাও দু দিনের নোটিশে হাগতে হাগতে মরে গেল। ভাবতে গিয়ে সব কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যায় নিতাইয়ের!

মটর সাইকেলে চড়ে এক সাহেব আর মেম এসে থামলো পিয়াজু ভাজার দোকানে। এই চা হবে? জ্বি। বৌটা চোখ থেকে কালো চশমা খুলে জিজ্ঞেস করলো দুধ চা হবে তো? জ্বি হবে। বসেন। তাড়াতাড়ি করে বেঞ্চ মুছে দিল দোকানের বয়। ঠিক পেছনের বেঞ্চ টাতে গিয়ে বসলো নিতাই। জুল জুল করে তাকিয়ে রইলো সে। অনেক সময় এসব সাহেব মেমরা অর্ধেক খায়। প্লেটেই বাকিটা ফেলে রাখে। আজ কি একটু পিয়াজু রাখবেনা? অবশ্য মাঝে মাঝে দোকানদার প্লেটের খাবার ফট করে রাস্তায় ফেলে দেয়। কুত্তা দৌড়ে আসে। আবার কোনো কোনো দিন মেজাজ মর্জি ভাল থাকলে ঝুটা খাবার নিতাই কে খেতে বলে।

এই শোনো , একটু এদিকে আসো না। কি? ওই লোকটাকে দুটা পিয়াজু দিতে বল তো। কেমন করে যেন তাকিয়ে আছে। হের তুমি বল! ভাই ওইখানে দুটা পিয়াজু দেন তো। দোকানের ছেলেটা পিরিচে একটা পিয়াজু নিয়ে নিতাইয়ের সামনে রাখে। একটু পর মেম তার পিরিচের একটা পিয়াজু নিতাইয়ের পিরিচে দেয়। নিতাই এর চোখ ভিজে ওঠে। কুট কুট করে চাবাতে থাকে সে। কি যে ভাল লাগে তার। এক কাপ চা ও তাকে দিতে বলে মেম। সাক্ষাৎ দূর্গা বোধহয়। নাইলে এত মমতা কই থাকে! নিতাই ধন্দে পড়ে যায়। সে অবশ্য শুনেছিল মানুষের মাঝে ভগবান থাকে । ধুতির খুঁটে সে চোখটা মুছে নেয় চট করে। সুড়ুত সুড়ুত করে চায়ে চুমুক দেয় নিতাই।
চায়ে আরেকটু চিনি হলে ভাল হইতো। চিনি চাওয়ার কথা তার মনে হয়না একবারো। তারিয়ে তারিয়ে চায়ের শেষ ফোটাটাও গিলে ফেলে সে। মাথা তুলে দেখে সামনের বেঞ্চে কেউ নাই। কখন চলে গেল ওরা! আহা বড় ভাল মানুষ ছিল গো! মা দুগ্গা তুমি ওদের দেখো বলে কপালে দু হাত ঠেকায় নিতাই।

সন্ধ্যে প্রায় হয়ে এল। আর একবার মন্ডপের দিকে পা বাড়ায় নিতাই। দিনের শেষবারের মত কাজ কতদূর এগোলো তা দেখে বাড়ি ফিরবে সে। আবার সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখতে আসবে। দুপুরে খাওয়া সেরে দেখে যাবে। মা চায়তো তার একটা নতুন ধুতিও জুটে যেতে পারে। এই পুজোর সময় অনেকে নতুন কাপড় বিলায়। পায়ের চপ্পলটাতে ফটফট শব্দ তুলে সে এগোতে থাকে। একটু আগে চা খেয়েছে বলে খাবারের চিন্তাটা আর মাথায় নেই নিতাইয়ের। মাকে দেখে বাড়ি ফিরতে গিয়ে অন্ধকারটা তার চোখে বড্ড লাগে।

দূরে আকাশের গায়ে গাড় কমলা রঙের শেড। বড় আলো আঁধারী। একটা দুটো করে তারা ফুটতে শুরু করেছে।

ডোবাটার ধার দিয়ে আসার সময় জলের গন্ধ পায় সে। ভাল করে তাকাতেই শাপলার পাতা নজরে আসে। কয়টা ডোগ তুলে নিয়ে যাবে নাকি? বৌটাকে দিলেও হয় না দিলেও হয়। একটু চুলায় আগুন দিয়ে রাতের বলায় সিদ্ধ করে খাওয়া যাবে। লবন বুলিয়ে দিলেই যা স্বাদ হয়! চপ্পলটা পাড়ে রেখে ধুতিটা একটু তুলে জলে নামতে থাকে সে। পা দিতেই যেন মোহিতের মত নেশা হয়ে যায় নিতাইয়ের। একটু একটু করে নামতে থাকে। মাঝখানের পানিটা কেমন আলো আলো। শাপলার পাতা ছেড়ে এগিয়ে যায় সে।


অ:ট: নামটা নিতাই না হলেও পারত। অন্য যে কোন নামের একজন। এই নিতাই কে দেখলাম কালীগঞ্জ বাজারে চা খেতে গিয়ে। ফিরে আসছিলাম। মোটর বাইকে তখন আমি ছিলাম উড়ন্ত এক পাখি। জলের বিলে আকাশ দেখতে দেখতে কখন সময় কেটে গিয়েছিল আমার! কেউ জলের ভেতর আকাশ দেখে কেউ আকাশের চোখে জল । শেষ বিকেলের রাঙা আলোয় নুয়ে পড়া পিত্তি সবুজ গাছেরা জলের দর্পনে দেখে নিচ্ছিল প্রসাধনহীন দেহটাকে। সুন্দর। তাকিয়ে থাকতে পারলে সব কিছুই সুন্দর!
সবার জন্য রইল শুভকামনা।
৬৪টি মন্তব্য ৬৪টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৮




আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না। আমাদের দেশে মানুষ জন্ম নেয়ার সাথেই একটি গাছ লাগানো উচিৎ । আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানবতার কাজে বিশ্বাসে বড় ধাক্কা মিল্টন সমাদ্দার

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:১৭


মানুষ মানুষের জন্যে, যুগে যুগে মানুষ মাজুর হয়েছে, মানুষই পাশে দাঁড়িয়েছে। অনেকে কাজের ব্যস্ততায় এবং নিজের সময়ের সীমাবদ্ধতায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারে না। তখন তারা সাহায্যের হাত বাড়ান আর্থিক ভাবে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিসিএস দিতে না পেরে রাস্তায় গড়াগড়ি যুবকের

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৫৫

আমাদের দেশে সরকারি চাকরি কে বেশ সম্মান দেওয়া হয়। আমি যদি কোটি টাকার মালিক হলেও সুন্দরী মেয়ের বাপ আমাকে জামাই হিসেবে মেনে নিবে না। কিন্তু সেই বাপ আবার ২০... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩



এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×