‘হ্যালো, সম্ভব হলে তুমি আমার জন্য একটা মশারি নিয়ে এসো। টার্মিনালের ভেতরে মশার ফ্যাক্টরি। আমরা সবাই অস্থির। রাতে তো থাকতে হবে। প্লিজ, যেকোনোভাবে একটা মশারি নিয়ে এসো, ভাই।’
গত ৬ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সৌদিপ্রবাসী এক বড় ভাই ফোন করে বলছিলেন। আমি বললাম, ‘তুমি বাইরে কেন? ভেতরে যাও, টার্মিনালে ঢুকে পড়ো।’
তিনি অনেকটা রেগেই বললেন, ‘আমি তো বললাম ভাই, আমি টার্মিনালের ভেতরে। আমার সঙ্গে এরকম আরও অসংখ্য লোকজন আছে, যারা সারাক্ষণ ঠাস-ঠুস করে মশা মারছেন। মশার হাত থেকে বাঁচার জন্য রীতিমতো নাচছেন। সারাক্ষণ অস্থির হয়ে হাঁটছেন। হাত-পা ছুঁড়ছেন।’
আমি দ্রুত ইংরেজিতে দুঃখিত বললাম এবং যথাদ্রুত আসবো বলে তাকে কথা দিয়ে কথা রাখার জন্য তক্ষুনি (সার্বক্ষণিক দুর্বিসহ যানজটের কথা মাথায় রেখে) রওনা হয়ে গেলাম। এই ফাঁকে দু’জন পুরোদস্তুর বুদ্ধিমান মানুষের সঙ্গে আলাপ করে মশারি নেয়ার ভাবনা বাদ দিলাম এবং মহাখালি নেমে এক প্যাকেট মশার কয়েল নিয়ে শাআবি’তে পৌঁছে গেলাম।
২শ’ টাকার টিকিট কিনে টার্মিনাল ওয়ানের চার নম্বর গেট দিয়ে ঝটপট ঢুকে পড়লাম। ঢুকতে না ঢুকতেই মশার উপস্থিতি টের পেলাম। দেখলাম, বিমানবন্দরের প্রায় সবাই মশার অত্যাচার সহ্য করছেন। মশা তো আর সরকারি-বেসরকারি বুঝে কামড়ায় না! তাই, খাকি-অখাকি সাধারণ-অসাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারী সবাইকে মশা জ্বালিয়ে মারছে।
‘প্রবাসীকল্যাণ ডেস্ক’ নামের একটা বুথ চোখে পড়লো। বুথে দু’জন কর্মকর্তা বসে ছিলেন। ইচ্ছে হলো একটু গপ্পো করি। বললাম, স্যার! গালফ-এয়ারের ফ্লাইটটি বাতিল হওয়ার কারণ জানেন নাকি? আমার প্রশ্ন মুখে থাকতেই দুজনের মধ্যে একজন চলে গেলেন। অপরজন প্রায় গুলি করার মতো করে বললেন, ‘এইটা আমাগো বিষয় না। গালফএয়ারকে জিজ্ঞাসা করেন।’
আমার আসল এবং অন্যতম প্রশ্নটি মুখেই ছিল, ছুঁড়ে মারলাম, বললাম, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে, আচ্ছা, বলেন তো এত মশা কেন চারদিকে?’
তিনি আগের প্রশ্নের তুলনায় আরো বেশি চটলেন এবং বললেন, এটাও আমাগো বিষয় নয়। এটা সিভিল এভিয়েশনকে জিজ্ঞাসা করেন।’
আমি দ্রুত প্রবাসী কল্যাণ ডেস্ক-এর সামনে থেকে চলে এলাম। এবং লক্ষ করলাম, আমার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ওই ভদ্রলোকও কোথায় উধাও হয়ে গেলেন। প্রায় ৪০ মিনিট ফাঁকা পড়ে রইলো প্রবাসী কল্যাণ ডেস্ক।
এরমধ্যে আমি ‘সিভিল এভিয়েশন’-এর লোক খুঁজতে গেলাম। এবং লোক না পেলেও বেশ কিছু তথ্য পেলাম, শাআবি’র পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার দায়িত্ব পেয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান একে ট্রেডার্স। তাও ‘ক্ষমতাসীন দলের লোক হিসেবে অবৈধভাবে। প্রথম প্রথম বেশ ভালোই সার্ভিস দিচ্ছিলো, বেশ লোকজন ছিলো ওদের। কিন্তু এখন দায়সারা-গোছের কাজ করছে। জবাবদিহিতার কোনো বালাই নেই।’ বলছিলেন টার্মিনালের নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক একজন দোকানি।
৭ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে ১১টার দিকে সিঙ্গাপুরের একটি ফ্লাইট ছিল। মশাকে কেন্দ্র করে সিঙ্গাপুরযাত্রীদের মধ্যে একটা টকশো শুরু হয়ে গেলো। তারা সিঙ্গাপুরের সঙ্গে বাংলাদেশের বিমানবন্দরের তুলনা করে করে অকথ্য ভাষায় দেশের লুটেরা ক্ষমতালোভী সরকারগুলোকে তুলোধুনা করতে লাগলেন। এতে সোৎসাহে যোগ দিলেন সৌদি আরব, কাতার, বাহরাইনসহ বিভিন্ন দেশের প্রবাসীরা।
এদের অনেকেই বিএনপি-আহূত হরতালের কারণে ঢাকার অদূরে বাড়ি হওয়া সত্ত্বেও বিমানবন্দরে রাত্রিযাপনের জন্য চলে আসতে হয়েছে। রাত্রিযাপন মানে হচ্ছে মশার কামড় খেয়ে না ঘুমিয়ে থাকা। থাকার ব্যবস্থা থাক দূরের কথা, ভালো কোনো খাবারের দোকানও নেই টার্মিনালজুড়ে। যেসব কনফেকশনারি ধরনের দোকান আছে, তাতে নিম্নমানের খাবারেরও আগুন দাম।
ফিরে এসে দেখলাম, প্রবাসী কল্যাণ ডেস্ক-এর ভেতরে মশার ওষুধ ছিটানো হচ্ছে। উধাও হয়ে যাওয়া প্রবাসীকল্যাণ ডেস্ক-এর ওই ভদ্রলোকও ফিরছেন। পথেই আমার সঙ্গে চোখাচুখি হওয়ায় ইঙ্গিত করে বললাম, ‘কী অবশেষে পেলেন?’
তিনি চমৎকার লাজুক হাসলেন এবং বললেন, ‘হারামজাদাদের পাওয়া যায় না। খুঁজে খুঁজে ধরে আনলাম!’
মজার বিষয় হচ্ছে, শুধু প্রবাসী কল্যাণ ডেস্ড়্গে ওষুধ ছিটিয়েই ওরা চলে গেলো। ওদের অনুসরণ করে করে গিয়ে দেখি, যে স্প্রে-মেশিন দিয়ে একটু আগে ওষুধ ছিটানো হচ্ছিলো সেটাও নষ্ট হয়ে গেছে। আরেকজন আরেকটি নিয়ে এলো এবং কিছুক্ষণ পর বিরক্ত হয়ে বললো, ‘হালার এইডাও নষ্ট!’
ক্যান্টিন ও বাথরুমঘেঁষা একটি রুম একে ট্রেডার্সের পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের। কিছুক্ষণ পর সেখান থেকে পরিচ্ছন্নতা-কর্মীরা মোছামুছির যন্ত্র নিয়ে দল-বলে বের হলো। দেখা হলো, ওই যন্ত্রটিও বিকল। মাল্টিপ্লাগসহ অন্যান্য সুইচ-টুইচ টিপেটুপে কয়েক মিনিট পর একটাকে সক্রিয় করা হলো। শুরু হলো পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা অভিযান।
এসব দেখে-শুনে মনে পড়ে গেলো আড়িয়ল বিলের কথা। মনে পড়লো ইতোমধ্যেই নতুন সেই বিমানবন্দরের জন্য প্রাণ দিয়েছে ওই এলাকার মানুষ। মনে পড়লো, নাম পাল্টানোর বিশ্রি খেলা, চোখে পড়লো ভেতরে এখনো শ্বেতপাথরে খোদাই করা ফলকে রয়ে গেছে ‘জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর’-এর নাম। নাম পাল্টাতে চাইলেই কী পাল্টানো যায়?
সংকীর্ণমনা প্রতিহিংসার রাজনীতির কারণে জিয়ার জায়গায় শাহজালাল এলো। এতে চুড়ান্তভাবে কি দাঁড়ালো? আমার কাছেই ঢাকা বিমানবন্দরকে এখন সিলেট মনে হয়। আর বিদেশিদের কাছে? ওরা কি বুঝবে? শাহজালালটা কে? বাঙালি ও বাংলাদেশের ইতিহাসে শাহজালালের নিকট-কার্যকর বা ঐতিহাসিক ভূমিকা কি? জিয়াকে বাদ দিতে গিয়ে এটা কী করলো হাসিনা সরকার? ইসলামিপনা না গাধামিপনা? বরং স্রেফ ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরই তো ভালো। বাংলাদেশের রাজধানী হিসেবে বিশ্ববাসী ঢাকা বিমানবন্দরের নামে চিনতে পারতো। এখন ওই এক মাইল লম্বা ইসলামি নাম দেখে মানুষ··· দেশ নিয়েই ধাঁধায় পড়বে!
যাকগে এবার ভয়াল সেই রাতের কিছু আলোকচিত্র শুধুই আপনাদের জন্য···
Click This Link

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




