কয়লা ধুলে যেমন ময়লা যায় না, তেমনি পুরনো মদ নতুন বোতলে ঢুকালে মদের ভালো-বদের কোনো রদ-বদল ঘটে না। যে-ই লাউ সে-ই কদুই থেকে যায়! যেমন ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে! ব্যাপারটা খোলাসা না করেই আরেকটু ‘ঘোলাসা’ করা যাক। বাইরে বাহারি পোশাক আর আহা-মরি নাম চাপিয়ে দিলেই কি চরিত্র কিংবা ‘স্বভাবজ দুর্নীতিপরায়ণ’ স্বভাবের কোনো পরিবর্তন হয়? যদি তাই হতো তাহলে গরিলা, শিম্পাঞ্জি কিংবা বানর-টানরকেই জমকালো পোশাক পরিয়ে, চমকপ্রদ একটা নাম গছিয়ে, গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক কাজের নথিপত্র হাতে ধরিয়ে দেয়া যেতো! তেমন হলে কোটি কোটি টাকার ডগ স্ড়্গোয়াডের র্যাবের মতো কালো কুকুরগুলোও ইতোমধ্যে ‘ক্রসফায়ার’ নাটকে কৃতিত্বের দৌঁড়ে বহুদূর এগিয়ে যেতো, তা নয় কি? কিন্তু তেমন তো হয় নি।
এ ‘সব কথার’ সব প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে ‘র্যাব’! র্যাব- মানে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন। প্রায় দু’বছর ধরে বাংলাদেশে বহুল উচ্চারিত, বহুল বিতর্কিত এ শব্দটি একটি বাহিনীর নাম। বিএনপি-জামাত সরকারের মতো ‘বিতর্কিত স্রষ্টার’ এ এক বিতর্কিত সৃষ্টি। র্যাবের জন্মলগ্ন থেকেই দেশ-বিদেশে যে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে তা এখনো অব্যাহত রয়েছে। র্যাবের কার্যক্রম বিশেষ করে ‘ক্রসফায়ার’ সম্পর্কে বহির্বিশ্ব এখনো বাঁকা চোখে পর্যবেক্ষণ করে চলেছে।
র্যাবের বৈধতা ও কার্যক্রম সম্পর্কে দেশ-বিদেশে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইলেও সরকার তার অবস্থানে অনড় থেকে আইনশৃঙ্খলা উন্নতিতে র্যাবের অভূতপূর্ব সাফল্যগাথার ফাঁপা-বুলি আউড়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু যে র্যাব সম্পর্কে সরকারের আকাশছোঁয়া উচ্চাশা এবং গর্ব, সেই র্যাব সদস্যরা নিজেরাই এখন আইনশৃঙ্খলা অবনতির কারক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঘটনা এমন দাঁড়িয়েছে, যে সর্ষে দিয়ে ভূত তাড়ানোর ব্যাপারে সরকার কবিরাজি-প্রত্যয় ঘোষণা করছে সে সর্ষেতেই এখন মহাভূত জেঁকে বসেছে।
সরকারের অপরিসীম বিশ্বাসের সর্বরোগহর ওই এলিট ফোর্স র্যাবও এখন সন্ত্রাসীদের সাথে পাল্লা দিয়ে চুরি, ডাকাতি, চাঁদাবাজিসহ নানা রকম জঘন্য অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। জানা গেছে, র্যাবের কর্ম পরিধি বিৃæত হওয়ার পাশাপাশি পাল্টা দিয়ে বাড়ছে র্যাবের দুর্নীতি। ইতোমধ্যে ১শ’ ২৭ জন র্যাব সদস্য ও কর্মকর্তা দুর্নীতির দায়ে শাস্তি ভোগ করছে। এছাড়া ৭২ র্যব সদস্যকে শৃঙ্খলা পরিপন্থী কাজের জন্য নিজ নিজ বাহিনীতে ফেরত পাঠানো হয়েছে।
এদিকে র্যাবের ক্রমবর্ধমান দুর্নীতি ছাড়াও র্যাবের ‘ধর-মার’ ও ক্রসফায়ার আতঙ্ক সাম্প্রতিক সময়ে দেশজুড়ে অপরাধের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। জনমনে র্যাবের সম্পর্কে যে ভয়াবহ আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে তাকেই সন্ত্রাসীরা নতুন অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে উঠে পড়ে লেগেছে। ফলে র্যাব পরিচয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ, অপহরণ এবং পারিবারিক কোন্দলের জের ধরে সন্ত্রাসীদের র্যাব সাজিয়ে প্রতিপক্ষকে বর্বর নির্যাতন করাসহ বহুমুখী অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে।
র্যাবের সাম্প্রতিক দুর্নীতিগুলো মধ্যে রয়েছে গত ৮ মার্চ রাজধানীর গোপীবাগ এলাকায় ‘ভাই ভাই চালের দোকান’ নামে একটি চালের আড়তে চাঁদাবাজির ঘটনা। সেদিন ১ লাখ টাকা চাঁদা গ্রহণকালে র্যাব-৩ এর সদস্য এসআই হাফিজকে র্যাব কর্মকর্তারাই গ্রেপ্তার করে।
গত ২৩ মার্চ রাজধানীর গাবতলী এলাকায় এক ব্যবসায়ীর বাসায় ডাকাতির ঘটনায় র্যাবের দুই সদস্যসহ ৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এদের একজন ডাকাতির পর পালানোর সময় জনতার হাতে ধরা পড়ে। অন্যজনকে এক আত্মীয়সহ পুলিশ সোনারগাঁও রোডের নাহার প্লাজা থেকে গ্রেপ্তার করে। এ দলের আরো ৫ জন লুট করা ৭ লাখ ৮০ হাজার টাকার বেশির ভাগ নিয়ে পালিয়ে যায়।
র্যাব সদস্যদের চুরি-ডাকাতি সম্পর্কিত প্রচার মাধ্যমে প্রকাশিত এসব খবরের বাইরে ‘ক্রসফায়ারের’ হুমকি দিয়ে, মুখ না খোলার ভয় দেখিয়ে এরকম অসংখ্য ঘটনা দেশজুড়ে ঘটিয়ে চলেছে। এসব ছাড়াও রয়েছে- যে জনগণের নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে ওই বাহিনীর জন্ম, সেই জনগণের সাথে ‘সিনেমাটিক ভিলেন’-এর মতো দুঃসহ দুর্বøবহার। অকথ্য গালিগালাজ।
সম্প্রতি গত ১৪ মার্চ র্যাব সদস্যরা দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার চীফ ফটোসাংবাদিক এসএম গোর্কির ওপর নির্মম নির্যাতন চালায়। এসময় র্যাব তাঁকে এলোপাতাড়ি বুট দিয়ে লাথি, আগ্নেয়াস্ত্রের বাঁট দিয়ে আঘাত করা সহ কিলঘুষি মেরে গুরুতর আহত করে। র্যাব তাকে অকথ্যভাষায় গালিগালাজ করে টেনেহিঁচড়ে টিকাটুলীর র্যাব কার্যালয়ে নিয়ে যায় এবং তার ক্যামেরায় ধারণকৃত ছবি নষ্ট করে দেয়।
গত ১৬ মার্চ ঘুষ গ্রহণ, ক্ষমতার অপব্যবহার ও প্রতারণা মামলায় র্যাবের দুই সদস্যকে কারাগারে পাঠানো হয়। চুয়াডাঙ্গা শহরের থানা রোডের রাজলক্ষ্মী জুয়েলার্সের মালিক রাজকুমারের ছেলে সুশীলকুমারের দায়েকৃত মামলায় তাদের এ শাস্তি হয়। এদিকে এ ঘটনার পর কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙ্গা থেকে র্যাব-৬ এর সদস্যদের প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।
শুধু তাই নয় র্যাব সদস্যদের বিরুদ্ধে স্ড়্গুল শিক্ষার্থীদের শারীরিক শাস্তি দান ও অশালীন ব্যবহারের অভিযোগ ওঠেছে। গত ৩ মার্চ রাজধানীর স্ড়্গলাস্টিকা স্ড়্গুলের ছাত্রছাত্রীরা স্ড়্গুল বাস থেকে র্যাব সদস্যদের ‘কুল সাইন’ ( দুই হাতের বৃদ্ধাঙুলি উঁচিয়ে শুভেচ্ছা) দেখালে র্যব সদস্যরা বাস থামিয়ে শিক্ষার্থীদের এক ঘন্টা রাস্তায় আটকে রাখে। এ সময় শিক্ষার্থীদের কান ধরে ওঠ-বস করানো হয়। এবং ‘হারামির বাচ্চা, তোরা বড় হলে সন্ত্রাসী হবি’ ধরনের কুকথা বলা হয়।
র্যাব সদস্যদের ক্ষমতার এহেন অপব্যবহারে জনমনে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। তাদের উপলব্ধি হচ্ছে- চিতা, কোবরা, ইদুর বাদুর, বাঘ-সিংহ যে-ই নামই রাখা হোক না কেনো, কালো-ধলো-কিংবা আসহবেনীকলার যে কোনো রঙের পোশাকই গায়ে চাপানো হোক না কেনো তাতে ভেতরের মানুষটির কোনো পরিবর্তন হয় না। ন্যায় বিচারের জন্য কাঙ্ক্ষিত সত্যদর্শী, ন্যায়পরায়ণ, নিরপেক্ষ, নৈতিক গুণসম্পন্ন অপেক্ষাকৃত যে কর্মকুশলীর চরিত্র আমরা আশা করি, যারা বর্তমান প্রেক্ষাপটে বর্তমান দুঃসহ অবস্থা থেকে দেশবাসীকে হারকিউলিস, সুপারম্যানের মতো উদ্ধার করবে- সেই আশার গুড়ে র্যাব বালি ছাড়া আর কিছুই দিতে পারে নি। অবশ্য না দিতে পারাটা কিছুতেই র্যাবের দোষ, অযোগ্যতা, ব্যর্থতা নয়। তাদের এই অপারগতার নেপথ্যে রয়েছে বাংলাদেশের সুদীর্ঘকালের পচা রাজনীতি।
কারণ ওই মানুষগুলো মানুষ হলেও মানুষ নয়। ওদের মানুষ হওয়া ও কাঙ্ক্ষিত কর্মতৎপর হওয়ার পথে মোটা দাগের কিছু প্রতিবন্ধকতা কাজ করছে। ওরা কোনো ভীনগ্রহের প্রাণী নয়, বাংলাদেশেরই সন্তান। আর বাংলাদেশের সন্তান হওয়াটাও একধরনের প্রতিবন্ধকতা। ওদের দুই নম্বর প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে ওরা সরকারের একধরনের পুতুল। ওদের স্বাধীন কোনো সত্তা নেই। ওদের নড়া-চড়ার চাবি সরকার নামের স্রষ্টার আঁচলে বাঁধা কিংবা পাঞ্জাবীর পকেটে। তাই রোবটের মতো ছকে বাঁধা প্রোগ্রামের বৃত্তেই তারা আবর্তিত হচ্ছে। কে দুর্বৃত্ত আর কে মিত্র, আর কিসের ভিত্তিতে, কেমন করে দুবৃêত্ত-মিত্র চিহ্নিত হবে তাও সরকার কতৃêক পূর্ব-নির্ধারিত। আর এ কারণেই সন্ত্রাসীদের স্রষ্টা ও লালন-পালনকারী গডফাদার, ইসলামি জঙ্গি ও জামাত শিবিরের ক্ষেত্রে র্যাবের ভূমিকা এখন পর্যন্ত প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে আছে।
তবে র্যাবের এহেন সীমাবদ্ধতা, দুর্নীতি, কার্যক্রমের বৈধতা নিয়ে দেশ-বিদেশে নানা মহলের জিজ্ঞাসা সত্ত্বেও ওদের সম্পর্কে প্রগলভতারও শেষ নেই। যারা দাবি করছে ওদের সৃষ্টির পর ‘পরিবর্তন’ হয়েছে, তাদের মধ্যে আছে খোদ ওই ‘প্রাণীর’ স্রষ্টা। সরকার। আর যে জনগণের সমর্থনের কথা বলা হয়, তারা ওই স্রষ্টা-শক্তিটির বান্ধা বান্দা, আন্ধা সমর্থক। ওদের মধ্যে জ্ঞানপাপী এবং অজ্ঞানও আছে। অজ্ঞান যারা- তাদেরকে সুদীর্ঘ সময় ধরেই অজ্ঞানতার বিষ দেওয়া হয়েছে। এমন বিষ দেওয়া হয়েছে, তারা যে অজ্ঞান-তারা এখন এটাই বুঝতে পারে না।
এদিকে র্যাবের এই ক্রমবর্ধমান দুর্নীতি ঠেকানোর জন্য খুব শীঘ্রই একটি স্বতন্ত্র নতুন কমিটি এবং নতুন আইন আসছে বলে জানা গেছে। গত ৯ মার্চ র্যাব সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত এক সভায় এ ব্যাপারে আলোচনা হয়।
২৭ মার্চ, ২০০৫

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




