পুলিশের অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে, জমা ১২ হাজার অভিযোগ
পুলিশ প্রশাসনের আইনি কর্মকাণ্ড ‘আইনের নিজস্ব গতিতে’ আর চলছে না। দেশের প্রতিটি থানার পুলিশ প্রশাসন ক্ষমতাসীন সরকারদলীয় সন্ত্রাসীদের কব্জায় চলে গেছে। পুলিশ প্রশাসন এখন সন্ত্রাসী ও তাদের গডফাদারদের ‘মতি-র গতিতে’ চলছে। পুলিশ, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সন্ত্রাসী ও গডফাদার- এ তিন অসম শ্রেণী মিলে এক বিষম অপশক্তির সৃষ্টি হয়েছে। ফলে বিএনপি- জামাত জোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর পরই দেশের আইনশৃঙ্খলায় যে বিশৃঙ্খলা শুরু হয়েছিল, সে ধারা এখন পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে, বরং মাত্রাগতভাবে তা দিন দিন বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাবনতির নেপথ্য কারণ হচ্ছে প্রতিটি থানার পুলিশ প্রশাসনে সরকারদলীয় সন্ত্রাসীদের আধিপত্য। সারাদেশের মত খোদ রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন থানাতে অভিন্ন অবস্থা বিরাজ করছে। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সত্য হচ্ছে যে, থানা পুলিশ প্রশাসনই হচ্ছে সন্ত্রাসীদের নির্ভরযোগ্য আশ্রয়স্থল, রক্ষক, দিকনির্দেশক এবং পরামর্শক। দেশের দুই তৃতীয়াংশ থানার এসআই’র অফিসকক্ষই সন্ত্রাসীদের অস্থায়ী নিরাপদ অফিসকক্ষ হিসেবে ব্যবহৃত হ্েচ্ছ বলে বিশেষ সূত্রে জানা গেছে।
পুলিশের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, অপহরণ, ডাকাতি, দুর্নীতি, ধর্ষণ, জমি, বাড়ি দখল, ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে টাকা লুটসহ গুরুতর অভিযোগের মাত্রা অস্বাভাবিক হারে বেড়ে চলেছে। এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়, পুলিশ সদর দপ্তর এবং পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে হাজার হাজার অভিযোগ জমা পড়েছে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিশেষ উপায়ে রেহাই পেয়ে যাচ্ছে পুলিশ।
পুলিশের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের ক্ষেত্রে লোক দেখানো তদন্ত ছাড়া কার্যকর কঠোর পদক্ষেপ না নেয়ায় ক্রমশ বেপরোয়া হয়ে উঠছে পুলিশ বাহিনীর একশ্রেণীর সদস্য। গত এক বছরে বারো হাজার সদস্যের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের মধ্যে মাত্র ২ হাজার ১শ’ ৭৪ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। স্বার্থহানির আশঙ্কায় ও স্বার্থান্বেষীদের বাধায় পুলিশের দুর্নীতি ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড কমিয়ে আনার লক্ষ্যে তিন বছরেও গঠিত হয় নি ‘কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স’।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় এবং পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা যায়, গত বছর শুধু কনস্টেবল থেকে পুলিশের সাবইন্সপেক্টর পর্যন্ত বারো হাজার অভিযোগ দাখিল করা হয় পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের প্রধান কর্মকর্তা, সদর দপ্তর এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। এসব অভিযোগের মধ্যে কনস্টেবল থেকে সাবইন্সপেক্টর পর্যন্ত দু’হাজারের বেশি পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তবে এমন অভিযোগও পাওয়া গেছে যে, লোক দেখানো তদন্তের কারণে হাজার হাজার পুলিশ সদস্য শাস্তি পায় নি। সাধারণত অভিযুক্তরা দুই উপায়ে রেহাই পেয়ে থাকে। তাদের কেউ কেউ সরকার সমর্থক পুলিশরূপে পরিণত হয়। আবার বড় কর্তাকে ম্যানেজ করেও রেহাই পেয়ে যায়।
একাধিক সূত্র জানায়, পুলিশ প্রশাসনের সাথে সন্ত্রাসীদের দহরম মহরম সম্পর্কের ভিত্তি হচ্ছে প্রতিটি থানার সরকারদলীয় সংসদ সদস্য, মন্ত্রী প্রতিমন্ত্রী। যে সব থানায় বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্য রয়েছে সে সব থানায় বিরোধী দলীয় সংসদ সদস্যের চেয়ে অপেক্ষাকৃত ক্ষমতাবান হচ্ছে সরকারদলীয় পরাজিত সদস্য কিংবা নেতা-কর্মীরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, দেশের থানা পুলিশ ‘যে দিকে বৃষ্টি- সে দিকেই ছাতা’ ধরার নীতি অবলম্বন করছে। আর এ নীতিই সব দিক থেকে বাঁচার জন্য উপযুক্ত নীতি। নিজের বর্তমান এবং ভবিষ্যত দুই-ই এ নীতি মেনে চললে উজ্জ্বল। না মেনে চললে দুই-ই ধ্বংস।
আর এ নীতি মেনে এবং ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী এমপিদের ‘পকেট অফিসার’ হিসেবে কোনো কোনো পুলিশ ইন্সপেক্টর প্রচলিত আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ব্যক্তিস্বার্থ হাসিল করে চলেছেন।
পুলিশের অতিরিক্ত এসপি মোফাজ্জল বা র্যাবের সার্জেন্ট অলিউলদের সংখ্যা অনেক হলেও গ্রেপ্তার হয়েছে মাত্র কয়েকজন। সুনামগঞ্জের দিরাইয়ের ওসি ইনাম আহমেদ চৌধুরী সাসপেন্ড হলেও দিরাই থাকাকালে গরুচোর সর্দারদের সঙ্গে যোগসাজশ করে অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনের ঘটনার কোনো তদন্তই শুরু হয় নি। সেই একই থানায় দুর্নীতিবাজ ও সংখ্যালঘু পরিবার সদস্যদের সম্পদ আত্মসাতে সহায়তাকারী সাব ইন্সপেক্টর জামশেদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় নি।
খোদ রাজধানীতেই পুলিশের প্রায় ৪শ’ সদস্যের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে ৩শ’ সদস্যের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে।
সম্প্রতি চট্টগ্রাম শহরের হালিশহর এলাকায় ওয়াহিদ মুজিব নামে এক ব্যবসায়ীর ১০ লাখ টাকা ছিনতাই করেছে সিএমপির গোয়েন্দা ও হালিশহর থানায় কর্মরত দুই পুলিশ সদস্য। বিষয়টি নিয়ে পুলিশের উচ্চ পর্যায়ে কথাবার্তা অনেক হলেও পুলিশ সদস্যদের বরখাস্ত করা হয়নি এবং অভিযোগ প্রমাণের পরও ব্যবসায়ীদের টাকা ফেরত দেয়া হয় নি। বরিশালে দৌলতখানে ঘুষ আদায় করার অভিযোগে এসইআই এবাদুল হক, সাইদুল হক, আনোয়ার হোসেন, আব্দুল জব্বার, আব্দুল খালেক, নজরুল ইসলাম ও শাহ আলম নামে ৭ পুলিশ সদস্য এবং সংশ্লিষ্ট থানার ওসিকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। বরিশাল রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ হেমায়েত হোসেন ঘটনার তদন্ত করে সত্যতা পেয়েছেন।
পুলিশের কর্মকর্তাদের সম্পদের উৎস খঁুজে বের করা হবে, বিধায় কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স গঠন করা হচ্ছে না। কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স গঠন ও সক্রিয় হলে সন্দেহভাজন পুলিশ সদস্যদের ওপর নজরদারি বাড়বে, দুর্নীতিবাজ পুলিশ সদস্যের তালিকা করা হবে এবং পুলিশ সদস্যদের আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সামঞ্জস্য খোঁজা হবে।
জনগণের করের টাকায় দেশের পুলিশ বাহিনী পোষা হলেও জনগণের বিপদ-আপদে পুলিশকে খুব একটা দাঁড়াতে দেখা যায় না। উপরন্তু ন্যায্য দাবিতে আন্দোলনরত জনগণের ওপর বিনা উস্ড়্গানিতে লাঠিচার্জ করতেও বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনী বিন্দুমাত্র পিছপা হয় না।
বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচি চলাকালীন দলগুলোর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে কর্মীদেরকে অন্তরীণ করে রাখা বা মিছিল করতে না দেয়া বা মিছিল চলাকালীন অতর্কিতে হামলা করা যেন পুলিশ বাহিনীর প্রধান কাজে পরিণত হয়েছে। বিরোধী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের ওপর বিনা উস্ড়্গানিতে হামলা চালানো বা নেতাদের সাথে অসদাচরণের মাধ্যমে কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পদোন্নতি লাভের আশা করে থাকেন। দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে লোক নিয়োগ দেয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে অনেকের অভিমত। নারী পুলিশ কর্তৃক নারী নেতা-কর্মীদের হয়রানি হওয়ার বিষয়টি আরো বেশি লজ্জাকর।
পুলিশকে রক্ষক হয়ে ভক্ষকের ভূমিকায় আবির্ভূত হওয়া অনুচিত ও নিন্দনীয়। তাদেরকে মানবাধিকার, নারী অধিকার, সংবিধান ও বহুল প্রচলিত বিভিন্ন আইন সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেয়া উচিত। জনগণের টাকায় পরিচালিত পুলিশের দায়বদ্ধতা থাকা উচিত। তাদের বেতন-ভাতাদিসহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধাও বাড়ানো উচিত। কিন্তু অনেকেরই প্রশ্ন, পুলিশের উস্ড়্গানিমূলক তৎপরতা আদৌ বন্ধ হবে কি?

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




