somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভিকারুননিসার চৈতীর দায় কে নেবে

২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১২ সকাল ৯:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

চৈতীর কথা জানা গেল পত্রিকার সংবাদ হিসেবে। এক অসম্ভব জেদি মেয়ে সে। বিজ্ঞান নিয়ে পড়ার জেদ ধরেছিল, ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল। চৈতীর সে স্বপ্ন পূরণ হতে দেয়নি আমাদের সমাজ, শিক্ষা ব্যবস্থা আর তথাকথিত স্কুলের নিয়ম। না ফেরার দেশে চলে গেছে সে। দেখিয়ে গেছে আমাদের নামিদামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাছে শিক্ষার্থীরা কতটা অসহায়।
চৈতীকে নিয়ে সংবাদ শিরোনামগুলো জানা যাক_ ২২ ফেব্রুয়ারির প্রথম আলো বলছে, 'অসময়ে চৈতীর মৃত্যু'; ২১ ফেব্রুয়ারি সমকাল লিখছে, 'বিজ্ঞান পড়তে না পেরে আত্মহত্যা করল চৈতী' আর কালের কণ্ঠ লিখেছে, 'বিজ্ঞান বিভাগে পড়তে না পেরে ভিকারুননিসা ছাত্রীর আত্মহত্যা'।
তার পুরো নাম চৈতী রায়। একই প্রতিষ্ঠান থেকে সে এ বছর জেএসসিতে ৪.৬০ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছিল। সে তার বাবা-মাকে বলত, নবম শ্রেণীতে বিজ্ঞান নিয়ে পড়বে, ডাক্তার হবে। বাদ সাধল তার প্রতিষ্ঠানের নিয়ম। জিপিএ গোল্ডেন-৫ ছাড়া বিজ্ঞান বিভাগে কাউকে ভর্তি করায় না প্রতিষ্ঠানটি। শিক্ষার্থীর স্বপ্ন আর অভিভাবকের অনুরোধ এ নিয়মের কাছে বড়ই নগণ্য। যেটা বোঝানোর মতো নয়, চৈতী সেটা বুঝিয়েছে তার নিজের জীবন দিয়ে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিয়ম থাকবেই এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়, কিন্তু তার একটা মাত্রা থাকবে, যৌক্তিকতা থাকবে। বিজ্ঞানে যাওয়ার পেছনে জিপিএ গোল্ডেন-৫ এর কী যৌক্তিকতা আছে। প্রথম কথা হলো, এটা অষ্টম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষা বা জেএসসির ফল। যেটা মাত্র দু'বছর ধরে চালু হয়েছে এবং এবারই কেবল অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা প্রথম পাবলিক পরীক্ষা হিসেবে জেএসসিতে অবতীর্ণ হয়েছিল। আর সেই রেজাল্ট কি-না তাদের পছন্দের বিষয়ে যাওয়ার জন্য প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিয়মানুযায়ী যে কোনো শিক্ষার্থী পাস করলেই যে কোনো বিভাগে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে জিপিএ গোল্ডেন-৫-এর শর্ত হাস্যকর। এটা অন্তত জিপিএ-৪ হতে পারে। কারণ জিপিএ-৪ মানে গড়ে ৭০ নম্বর; এটা কম কিসে।
তবে সবচেয়ে ভালো হয় সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থী যে বিষয়ে যেতে চায় তাকে সে বিষয় দেওয়া। শিক্ষার্থীর রেজাল্ট না দেখে তার আগ্রহ দেখা। কারণ পড়াশোনা শিক্ষার্থীর কাছে, সে পছন্দ অনুযায়ী বিভাগে ভর্তি হলে সেখানে ভালো করতে পারবে। ধরা যাক, একজন শিক্ষার্থী গোল্ডেন-৫ পেল, কিন্তু বিজ্ঞানে তার আগ্রহ নেই অথচ দেখা গেল সে তার অভিভাবক কিংবা প্রতিষ্ঠানের চাপে নিতে বাধ্য হলো। আবার আরেকজনের আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও সে রেজাল্টের কারণে বিজ্ঞানে যেতে পারল না। এসব কীভাবে মেনে নেওয়া যায়। যার ফল আমরা দেখলাম চৈতীর ক্ষেত্রে। এ রকম নিশ্চয়ই আরও অনেককে পাওয়া যাবে, যারা এভাবে পছন্দের বিভাগ না পেয়ে অরুচি নিয়ে অন্য বিভাগে পড়ছে।
এ রকমটা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার সর্বত্র রয়েছে। স্কুল পর্যায়ে যেমন অনেকে তার পছন্দের বিভাগে যেতে পারে না, আবার ঠিক উচ্চশিক্ষায়ও অনেকেই আগ্রহের বিষয় পায় না। অনেকে আবার আগ্রহের প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারে না। উচ্চশিক্ষায় বরং এটা খুব বেশি দেখা যায়। স্কুল পর্যায়ে দেখা যায়, অভিভাবক কিংবা প্রতিষ্ঠানের চাপ আর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এসে ভর্তি পরীক্ষাই ভাগ্য নির্ধারণ করে। সবক্ষেত্রেই অবশ্য রেজাল্ট একটা বড় ফ্যাক্টর। অর্থাৎ কোনো ক্ষেত্রেই শিক্ষার্থীর নিজের আগ্রহের কোনো দামই নেই। আর এই অরুচির মধ্য দিয়েই চলছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। ফলে এখানে পরিমাণগত পরিবর্তন হয় ঠিকই অর্থাৎ বছর বছর জিপিএ-৫ বাড়ে, কিন্তু গুণগত কোনো পরিবর্তন হয় না।
আর নামিদামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এই গোলকধাঁধায়ই চলছে। কোন প্রতিষ্ঠানের কতজন শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেল এটার প্রতিযোগিতাই করছে তারা। চৈতীর ঘটনা ব্যতিক্রম কিছু নয়। চৈতীর প্রতিষ্ঠানটি হয়তো ভেবে নিয়েছে, এসএসসির পাবলিক পরীক্ষায় তার বিজ্ঞানের সব বিষয়ে শিক্ষার্থীকে জিপিএ-৫ পেতেই হবে। ফলে আগ থেকে বাছাই করে কেবল রেজাল্টধারীদেরই নেওয়া হলো। এতে যেমন স্বপ্নবাজ ডাক্তার চৈতীকে আমরা হারিয়েছি, এ রকম আরও কত চৈতীর স্বপ্নের যে মৃত্যু হয়েছে জানা নেই।
অভিভাবকরাও ছুটছেন রেজাল্টের পেছনে আর এর চেয়েও বড় বিষয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। নামিদামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সন্তানকে পড়াতে অভিভাবকরা সবাই ব্যাকুল। চৈতীর ক্ষেত্রে যেটা দেখা গেল, সে তার বাবা-মাকে অন্য প্রতিষ্ঠানে হলেও বিজ্ঞানে ভর্তি করতে বলেছিল; কিন্তু তার বাবা-মা তাকে অন্য স্কুলে ভর্তি না করিয়ে তাকে উল্টা বোঝানোর চেষ্টা করে এবং শেষ পর্যন্ত তার ইচ্ছার বাইরে ওই প্রতিষ্ঠানেই বাণিজ্য বিভাগে ভর্তি করান। ফলে যা হওয়ার তা-ই হলো। চৈতীর অভিমান তাকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করেছে আর তাকে এনেছে পত্রিকার পাতায়।
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা যেভাবে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে সেটাই ভাবনার বিষয়। এখন সমাপনী পরীক্ষার মাধ্যমে পঞ্চম শ্রেণী থেকেই শিক্ষার্থীরা রেজাল্টের কারণে বৈষম্যের শিকার, যেটা অষ্টম শ্রেণীতে এসে খুব বেশি স্পষ্ট হয়। আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীরা অল্প বয়স থেকেই যে স্বপ্নের দোলাচলে দুলছে তার পরিণাম শুভ নয়। তবে আত্মহত্যা কখনোই সমর্থনযোগ্য নয় আর এটা কোনো কিছুর সমাধানও নয়। চৈতীর আত্মহত্যাকেও সমর্থন দেওয়া হচ্ছে না। চৈতীর যে বয়সে অতিরিক্ত মাত্রা ঘুমের ওষুধ খেয়ে মৃত্যু হলো তা মেনে নেওয়া কষ্টের বিষয়। একই সঙ্গে এটা তার অভিমানের মাত্রাও বোঝাচ্ছে।
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আর অভিভাবক সকলের গোঁজামিলে 'শিক্ষা' কী রূপ ধারণ করছে তা বলাই বাহুল্য। এদের সকলের ফল হিসেবে আমরা হারিয়েছি চৈতীকে। আর সুতরাং চৈতীর দায় তারা কেউই এড়াতে পারে না।


১৩টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্মৃতিপুড়া ঘরে

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৩০



বাড়ির সামনে লম্বা বাঁধ
তবু চোখের কান্না থামেনি
বালিশ ভেজা নীরব রাত;
ওরা বুঝতেই পারেনি-
মা গো তোমার কথা, মনে পরেছে
এই কাঠফাটা বৈশাখে।

দাবদাহে পুড়ে যাচ্ছে
মা গো এই সময়ের ঘরে
তালপাতার পাখাটাও আজ ভিন্নসুর
খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×