somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অমানবিক জাপানিজ হত্যা এবং মানবিক জাপানিজ বন্ধুদের প্রতিক্রিয়া

০৯ ই জুলাই, ২০১৬ রাত ৮:৩৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

গুলশান এর হলি আর্টিসান বেকারিতে যে এক হৃদয়-বিদারক ঘটনা ঘটে গেছে সেটা বুঝতে পারলাম ২রা জুলাই সকাল বেলা টেলিভিশনের সামনে বসে।ঠিক কতজনে নিহত হয়েছে সেই খবরটা তখন পর্যন্ত জানতে পারিনি তবে এর ভিতর বেশ কয়েকজন জাপানিজ আছে এটা বুঝতে পেরেছিলাম। এতগুলো জা্পানিজকে একসাথে শুধুমাত্র বিদেশী হবার কারণে হত্যার কথা শুনে কেন জানি বিশ্বাস হচ্ছিল না। জাপানিজদের মত নিরীহ ও বিনয়ী মানুষদের কিভাবে হত্যা করতে পারে জঙ্গিরা! পুরো ঘটনায় বিস্মিত, ক্ষুব্ধ, হতবাক আমার মুখ থেকে এই কথাটাই প্রথম বের হয়ে এসেছে।

যারা জাপানিজদের সাথে কখনো মেশেনি তারা হয়তো কখনো এই বিষয়টা ঠিকভাবে বুঝতে পারবেনা কারণ তাদের মনে দাগ কেটে আছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং তার পূর্ববর্তী সময়ের যুদ্ধবাজ জাপানিজদের কথা। প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর জাপানে থেকে তাদেরকে খুব কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা না থাকলে আমিও হয়তো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পূর্ববর্তী জাপানিজদের সাথে তাদের বর্তমান রূপের পার্থক্য বুঝতে পারতাম না। আগুনে পুঁড়ে যেমন সোনা খাঁটি হয়, যুদ্ধের ভয়াবহতা হয়তো তাদেরকে সেভাবেই পরিবর্তিত করেছে। আর এজন্য-ই হয়তো তাদেরকে কেও গলা কেটে হত্যা করতে পারে এটা ভাবতে আমার খুব কষ্ট হয়েছে।

তাদেরকে কেন আলাদা বলছি তা একটু পরিষ্কার করছি। অনেক সময় অনেক সামান্য ঘটনা নিয়েই আমরা ভারত, পাকিস্তান, মায়ানমার বা অন্য দেশকে নিয়ে আড্ডায় বা ফেসবুকের পাতায় কত জঘন্য মন্তব্য-ই না করে ফেলি। ঐ দেশগুলো থেকেও ঠিক একই রকম উত্তর ফিরে আসে। জাতি হিসেবে আমরা কতটা সভ্য হয়তো এটা তারই প্রতিফলন। কিন্তু ১লা জুলাই এর সেই ঘটনার পর আমি আমার কোন পরিচিত জাপানিজ এর ফেসবুকে বাংলাদেশ বা ইসলাম ধর্ম বিদ্বেষী কোন মন্তব্য দেখিনি।

ঘটনা ঘটে যাবার বেশকিছুদিন পার হবার পরও জাপানিজ কাওকে সহমর্মিতা জানানোর সাহস সঞ্চয় করতে পারছিলাম না। অথচ তারাই আমাকে বার্তা পাঠিয়ে আমার এবং আমার পরিবারের খবর নিতে শুরু করলো, কিন্তু সেই মেসেজ এ একবারও এতগুলো জাপানিজের নৃশংস পরিণতির ব্যাপারে কোন কথা নেই।

এবার বিব্রত, লজ্জিত আমি কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে বললাম, “ঐ দিনের সেই মর্মান্তিক ঘটনার জন্য আমি খুবই দুঃখিত এবং লজ্জিত”।

বন্ধুর উওর, “ঘটনাটি খুব দুঃখজনক, কিন্তু আমি জানি, আমরা বন্ধু”। এর উত্তরে কিছু বলার মতো সাহস আমার ছিল না, শুধু বলতে পারলাম, “ধন্যবাদ”।



আরেক বন্ধুর উত্তর যেন আমাকে স্তম্ভিত করল, “তোমার লজ্জিত হবার কোন কারণ নেই, তোমারা নিরাপদে আছ এটি জানতে পেরেই আমাদের ভাল লাগছে।”



আমার একজন সিনিয়র বন্ধু তার ফেসবুক নোট (view this link)-এ দিয়েছেন তার জাপানিজ বন্ধুর কাছ থেকে পাওয়া এমন অনেক মেসেজ যা হয়তো জাপানিজদের মানবিকতা এবং মনুষত্ব্যের উচ্চতা নিয়ে আমাদের অনেককে নতুন করে ভাবতে শিখাবে। এই রকম কাওকে কি গলা কেটে হত্যা করা যায়!


আমার আজ বারবার মনে পড়ছে আমার ঢাকার বাড়িতে আমন্ত্রিত জাপানিজদের নিয়ে আমার পুরো পরিবারের কাটানো চমৎকার কিছু সময়ের কথা। জাপান থেকে পিএইচডি শেষে দেশে ফিরে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম আমার জাপানিজ ল্যাব-মেটদের। পুরো সপ্তাহ-জুড়ে আমাদের বাসায় ছিল তারা। ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ঘুরাতে নিয়ে যেতে আমাদের নিজেদের যেমন এতটুকু ভয় লাগেনি তেমনি ওদের ভিতরেও কোন জড়তা দেখতে পাইনি। সেই সময়টাতে তাদের ভিতরে যেমন কোন নিরাপত্তাহীনতা ছিলনা আমিও ভাবিনি তাদের কোন বিপদ হতে পারে। অনেক বাংলাদেশী-ই তখন সেই জাপানিজদের সাথে ছবি তুলেছে তার ফেসবুক-কে সমৃদ্ধ করার জন্য। তখন কি আমি ভেবেছি এই ছেলে বা মেয়েটিও হতে পারে সুইসাইড স্কোয়াডের কোন সদস্য! আমার এই ঢাকার বাসাতেই রাত্রিযাপন করেছেন আমার জাপানিজ পিএইচডি সুপারভাইজার তার পরিবার নিয়ে! আজ ভাবতেই তাদের নিরাপত্তার কথা ভেবে কেমন যেন গা শিওরে উঠছে!





আমার পিএইচডি সুপারভাইজার আর মাত্র দুই/তিন বছর পরেই রিটায়ারম্যান্ট এ যাচ্ছেন। রিটায়ারম্যান্ট এর পর তার ইচ্ছে বিভিন্ন দেশে ঘুরবেন আর এই সব দেশে থাকা তার ছাত্রদের সাথে সময় কাটাবেন। পোষ্ট-ডক শেষে আমিও বড়মুখ করে বলে এসেছিলাম, “আমার দেশে আবার আসবে কিন্তু সেন্সেই(জাপানিজ ভাষায় শিক্ষক কে সেন্সেই বলা হয়) ”।আমার দেশে পাওয়া আতিথেয়তার কথা জানতে পেরে ল্যাব এর অনেকেই আমার দেশে আসতে চেয়েছে। এখনো কি তাদের সেই ইচ্ছে অবশিষ্ট থাকবে? না আমি সাহস করব তাদেরকে আমন্ত্রণ জানাতে? এত অল্প সময়ের ভিতর কেন এত বড় পরিবর্তন ঘটে যাবে!

জাপানিজদের হত্যার মোটিভ আমার কাছে পরিষ্কার না। তারা মুসলমান না এটিই যদি একমাত্র কারণ হয়ে থাকে তবে আমি বলবো এখানে অনেক বড় ভুল হচ্ছে। জাপানে থাকাকালীন সময়ে ধর্মের ব্যাপারে আমাকে কখনো কোন বিরূপ পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি। শুক্রবারের নামাজের জন্য লাঞ্চ এর সময় দীর্ঘ সময় ল্যাব এর বাইরে থাকা বা ঈদের দিন ল্যাব খোলা থাকলেও পুরোদিন ছুটি নিতে কোন দিন-ই কোন সমস্যা হয়নি। রোযার সময় ল্যাব এর কাজ তাড়াতাড়ি শেষ করে বাড়ি ফিরতেও মাঝে মাঝে তাড়া দিতেন আমার প্রফেসর। ল্যাব পার্টিতে আমাদের জন্য ব্যবস্থা করা হতো আলাদা খাবার, কখনো এ নিয়ে তাদেরকে বিরক্ত মনে হয়নি বরং ছিল অনেক আন্তরিক।

ফেসবুক থেকে জানতে পেরেছি যে, জাপানে তৈরি হয়েছে প্রায় ৬০ টি মসজিদ। প্রায় প্রতিটি বড় শহরেই আছে মসজিদ এবং এইসব মসজিদ স্থাপনে জাপানিজ সরকারের ছিল না কোন প্রকার অসহযোগিতা। ইসলাম ধর্ম সেখানে ক্রমেই প্রসার পাচ্ছে, মাঝে মাঝেই খবর পাই জাপানিজদের মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করার। view this link



সুপার মলে পাওয়া যাচ্ছে হালাল খাবার, অনেক ফুড কোম্পানি হালাল খাবার তৈরিতে এগিয়ে আসছে। যারা জাপানকে ইসলামের শত্রু ভাবছে তারা কি আসলেই এসব খবর জানে? আমি যেন কোনভাবেই হিসাব মিলাতে পারছিনা। গুলশানের ঘটনা যে শেষ নয় বরং শুরু এটা এখন সবার মুখে মুখে। সবার মনে এখন আতঙ্ক। ইসলাম যেই দেশের রাষ্ট্রধর্ম, মুসলমান যেই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেই দেশে ইসলাম ধর্ম প্রতিষ্ঠা করতে মুসলমানদের সাথে সাথে হত্যা করা হচ্ছে মুসলমানদের বন্ধুদের!!! এভাবে কি ধর্ম-প্রতিষ্ঠা হয়!!! এইসব হত্যাকাণ্ড ইসলাম ধর্মের সাথে সাথে মুসলমান প্রধান এই দেশটির উন্নয়নকেও যে অবনমিত করছে।

ফেসবুক পেজ
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জুলাই, ২০১৬ রাত ৯:৫৮
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশে কোন প্রজন্ম সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত? ১৯৭১ থেকে একটি সংক্ষিপ্ত ভাবনা

লিখেছেন মুনতাসির, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৮:৪৩

বাংলাদেশে দুর্নীতির প্রশ্নটি প্রায়ই ব্যক্তি বা দলের দিকে ছুড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু একটু গভীরে গেলে দেখা যায়, এটি অনেক বেশি প্রজন্মভিত্তিক রাজনৈতিক - অর্থনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত। ১৯৭১ এর পর... ...বাকিটুকু পড়ুন

চাঁদগাজীর মত শিম্পাঞ্জিদের পোস্টে আটকে থাকবেন নাকি মাথাটা খাটাবেন?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৫৭



আমাদের ব্রেইন বা মস্তিষ্ক কিভাবে কাজ করে লেখাটি সে বিষয়ে। এখানে এক শিম্পাঞ্জির কথা উদাহরণ হিসেবে টেনেছি মাত্র।

ধরুন ব্লগে ঢুকে আপনি দেখলেন, আপনার পোস্টে মন্তব্যকারীর নামের মধ্যে "জেন একাত্তর" ওরফে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টি দিল্লী থেকে।

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:১৫


((গত ১১ ডিসেম্বর ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টির ইতিবৃত্ত ১ শিরোনামে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। সেটা নাকি ব্লগ রুলসের ধারা ৩ঘ. violation হয়েছে। ধারা ৩ঘ. এ বলা আছে "যেকোন ধরণের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের হাদিকে গুলি করা, আর আওয়ামী শুয়োরদের উল্লাস। আমাদের ভুল কোথায়?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৫৩



৩০ জনের একটা হিটলিস্ট দেখলাম। সেখানে আমার ও আমার স্নেহের-পরিচিত অনেকের নাম আছে। খুব বিশ্বাস করেছি তা না, আবার খুব অবিশ্বাস করারও সুযোগ নাই। এটাই আমার প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

এ যুগের বুদ্ধিজীবীরা !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪০


ডিসেম্বর মাসের চৌদ্দ তারিখ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। পাকিস্তান মিলিটারী ও তাদের সহযোগীরা মিলে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন লেখক, ডাক্তার, চিকিৎসক সহ নানান পেশার বাংলাদেশপন্থী বুদ্ধিজীবীদের!... ...বাকিটুকু পড়ুন

×