এখনো সময় আছে আপনি ফিরে যান । গল্পের নাম দেখলেন আর ওমনি চলে এলেন,না?গল্পের এতই মজা?ছোটবেলায় দাদি - নানির মুখে কত গল্প শুনেছেন,আপনার নিজের ও চারপাশের কত গল্প গিলেছেন- তবুও লোভ যায় না কেন লোভী আপনার !
এখনো আছেন ? তাহলে একটা গল্প বলি।চাইলেই ঝটপট দুমিনিট ম্যাগি নুডলস এর মত চটপট গল্প বানানো যায়।গল্পের আদি - অন্ত নির্ধারণে দুমিনিট কিন্তু বিপুল সময়। মুহূর্তেই ত কত কিছু ঘটে যায়! তাই না ? জানেন নিশ্চয়ই এই পৃথিবী নিজেই বিরাট গল্পের আকর।
যা হোক গল্প বলা শুরু করি । গল্পটি আমার অথবা আমার নাম দিয়ে চালানো অন্য কারো গল্প হতে পারে । অথবা কাল্পনিক ও হতে পারে।যেটাই হোক,তাতে আপনার সমস্যা নেই । গল্পের শুরুতে ধরে নেয়া যাক - আমার শামিমা নামে একজন প্রেমিকা আছে । আপনার নিশ্চয় জানতে ইচ্ছে করছে শামিমা কেমন?দেখুন ত শামিমা এমন হলে আপনার পাঠক হৃদয় তৃপ্ত হয় কিনা ? -
পাট গাছটির মত চুল হলে
দুধে আলতা বন্ন হলে
ঘেচ কড়ির গতর হলে
বাশির মত নাক হলে
ছোট ছোট পা হলে
চাঁদপানা মুখ হলে।
প্রিয় পাঠক ! আপনার আগ্রহ কে জিইয়ে রাখার জন্য শামিমা কেমন তা এখনি বলছি না । তার চেয়ে বরং আমার ভাবনার দিকে তাকানো যাক।আমার বাবা অসুস্থ - দীর্ঘদিন ধরে , আজকেও হাজার কয়েক টাকার ঔষধ কিনলাম।ভাবছিলাম - আহ ! আজ বাবা মারা গেলে কেমন হত! ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে অর্থ শ্রাদ্ধ করার কি মানে ? কবরে যাবিই যখন ঝটপট গিয়ে রাস্তা ক্লিয়ার কর আমার !বেকার আছি তবু টাকা জোটে না ,বুড়ো বদমাশ সব নিজের কাছে আগলে রেখেছে ! এই বুড়ো ধরাধামে থাকা মানে শামিমাও হাতছাড়া হওয়া । আমি জানি বাবা বেঁচে থাকলে আমার আর শামিমার বিয়ে মেনে নেবেন না। এর চেয়ে ভাল বুড়ো মরলে - পটাপট কিছু পুঁজি হাতে আসলে ব্যবসা ও করা যাবে,শামিমাকেও বাগানো যাবে।
বিশ্বাস করুন বাবার মৃত্যু চাইবার মত পাষণ্ড আমি নই । স্রেফ অর্থনৈতিক কারণে আমাকে এমন ইচ্ছে পোষণ করতে হচ্ছে।তবু এই গল্পের জন্য আপনি ও আমি পুঁজিবাদের কাছে ঋণী। সমাজতন্ত্রে এ গল্পের হাল কি হত কে জানে!
পাঠক ! জানি অনেকে আমাকে মন্দ ভাবছেন হয়ত ভাবছেন এ ত দেখি মড়ার অপেক্ষায় থাকা মানুষরূপী শকুন! সুহৃদ আমার! দেখুন কি বিধিলিপি! শকুনের দোয়ায় গরু না মরলেও ( আমি জানি না শকুনের দোয়ায় আদৌ গরু মরে কিনা ! প্রবাদে আছে তাই বলছি ) সে রাতেই বাবা পরপারে চলে গেলেন ।হতবাক হয়ে গেল ধর্ম - নৈতিকতা - সামাজিকতার মিশেলে তৈরি আমার বিবেক । ধিক্কার দিতে থাকল আমাকে। তবে এ অবস্থা বেশিক্ষণ চলতে দিলাম না।এসব আপদ বাদরের মত , মাথায় চড়তে দিলে বিপদ! পরমেশ্বর না চাইলে নিশ্চয় তাকে তুলে নিতেন না। তিনিই ত সর্বজ্ঞ , তিনিই ত জ্ঞানী ! তার অসীম লীলার আমরা কটুকু জানি! এ এন্টিডোট বিবেকের উপর প্রয়োগ করায় বিবেক আমার গৃহপালিত গরুর মত শান্ত হয়ে গেল।
যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করার পর আমি শামিমার বাবার কাছে গেলাম ।শামিমার বিচক্ষণ বাবা আমার সদ্য গজানো পকেটকে সাদরে বরণ করে নিলেন। তারপর - কিঞ্চিৎ লজ্জামাখা মুখে বলি - শামিমাকে বিয়ে করে সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিলাম।
ভাইয়েরা আমার ! এখানেই যে গল্প শেষ করে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে খুব !
জানি তাতে আমার উপর বেজায় নাখোশ হবেন । আধুনিক বিজ্ঞ পাঠক হিসেবে গল্পের কাছে আপনাদের নানা দাবি -
টুইস্ট চান , শেষ হইয়াও শেষ হইল না চান , ইঙ্গিতময়তা-অস্পষ্টতা - দ্বার্থবোধকতার দ্যোতনা দোলা চান , মেদহীন ঠাসবুনোটে গাঁথা ঝরঝরে গল্প চান , গল্প হীন গল্প শোনার আবদার আছে কারো কারো।
আপনারা যত পান - তত চান - রাক্ষুসে খাই আপনাদের !এই গতানুগতিক সমাপ্তিতে আপনারা ক্ষিপ্ত হবেন তা ত জানা কথাই ! আমি অনুভব করছি গল্পরথের লাগাম আমার হাতে থাকলেও নিয়ন্ত্রক আপনারা - আপনাদের সন্তুষ্টি নিয়ে আমাকে চলতে হবে।গল্পের এ পর্যায়ে আমি খুব খোশমেজাজে আছি। এখন এমন জায়গায় আছি -যেখান হতে গল্পকে আমি যেকোন দিকেই ইচ্ছেমত ঘুরাতে পারি - ঘাড়ের উপর আপনারা আছেন জেনেও ।এ মুহূর্তে আমি এমনই ঈশ্বর যে একটু পর তার ঈশ্বরত্ব হারাতে যাচ্ছে।
যা হোক দেরি না করে আবার গল্পে ফিরে আসি। নতুন বিয়ে - বুঝতেই পারছেন কেমন এক ঘোর লাগা অনুভবে দিন কেটে যাচ্ছে আমার।সবার কললহরীতে মুখরিত আমার বাসভবন। একদিন আশীর্বাদ দিতে আমার এক শিল্পপতি মামা এলেন , শামিমাকে দেখে তার চোখে কেমন একটা ঘোর লাগা ভাব দেখতে পেলাম, পুরুষ মানুষ আমি - ত জানি এর কি মানে! শামিমাও বিব্রত। অস্বস্তি কাটাতে আমি বললাম - শামিমা ! এ আমার মামা ! সালাম কর!
হায় ! তখন কি জানতাম কিছুদিন পর শামিমাই আমার মামিমা হয়ে যাবে!
পাঠক! আপনাদের এই মর্মে আশ্বস্ত করছি যে - এই ট্র্যাজিক পরিণতিতে আমি দেবদাস হইনি। শামিমা গেছে তাতে কি আরেকটা বিয়ে করেছি!শামিমার চলে যাওয়ায় বরং আমার শাপে বর হয়েছে, প্রেম - ভালবাসা নামক ঠুনকো বায়বীয় ভাবাবেগ উবে গেছে। টাকার পিছনে পুরোপুরি মনোসংযোগী হয়েছি - যে টাকার জন্য শামিমা মামিমা হয়ে গেছে! এবার আমি নিশ্চিন্তে মুদ্রাস্ফীতির বিরুদ্ধে জেহাদ চালিয়ে যেতে লাগলাম। তারপর জীবন বয়ে গেল - কেটে গেল অনেক বছর -একদিন আয়নায় নিজেকে দেখে অবাক, এই আমি - হায়রে নিঠুর সময়!চুল একটাও কালো রাখেনি আমার! বড় হয়ে গেছে ছেলেমেয়েরা,বিয়ে করে সবাই সংসারী বাবা - মা , ওপারের ডাক এখন স্পষ্ট শুনতে পাই।
শামিমা ট্র্যাজেডির পর ব্যবসায় প্রচণ্ড খেটেছি , উথান - পতন চক্র শেষে সম্মান জনক অবস্থায় পৌঁছেছি। ভেবে অবাক হই , আমিও ঠিক বাবার মত -সব নিজেই ধরে রেখেছি । জানি আমি ছেলেদের মনে কি চলে - আমিও ত যুবক ছিলাম একদা ! ওরা চায় আমি সব বুঝিয়ে দিয়ে অবসর নেই,কিন্তু না !সব ছেড়ে - ছুড়ে নিজ - হাতে গড়া সাম্রাজ্যের কর্তৃত্ব হারাতে আমি রাজি নই !
!
একদিন বুকে প্রচণ্ড ব্যথা উঠে , সবাই মিলে হাসপাতালে নিয়ে যায় আমাকে । জ্ঞান হারাবার ঠিক আগ- মুহূর্তে আমার মনে হলো ওরা কি আমায় মেরে ফেলতে চায়! ৩-৪ পর জ্ঞান ফেরে আমার,সবাই বলে -আমার অপারেশন হয়েছিল , কোমায় ছিলাম, পরম করুনাময়ের দয়ায় বেঁচে ফিরেছি।
তারপর কিছুটা সুস্থ হতেই আমার প্রাণ প্রিয় ছেলেমেয়েরা আমায় ঘিরে ধরে , আলাদা আলাদা ভাবে - আমি জানতাম না তাদের মনে এত কথা আছে ! তখন কেউ নেই , আমার শিয়রে কেবল বড় ছেলে।আমার হাতটা তার করতলে নিয়ে বলে - বাবা!এই কয়দিন তোমার জন্য আমি কেবল কেঁদেছি।
চোখে আমার পানি আসে।শুধু বলি - বাপ আমার !
- বাবা ! তোমার ত বয়েস হয়েছে , আল্লাহর ইচ্ছেয় কখন কি হয় কে জানে ! আমার মনে হয় তুমি উইল করে গেলে ভাল করবে। এভাবে মরে গেলে ত হাসান ও সম্পত্তির ভাগ পাবে !
- হাসান ! আমার মনে পড়ে , আহ হাসান ! শামিমার গর্ভে আমার প্রথম ভালবাসার বীজ !
একটু সুস্থ হই বাবা ! ভেবে দেখি। -আমি বলি।
- আরেকটা কথা বাবা ! তুমি ত জান রফিক ব্যবসার কিছুই বুঝে না ! দোকান টা তুমি আমার নামে লিখে দিলে ভাল হয় ।
আমি চোখ বুজি।আমি ঘুম যাই আবার উঠি , চোখ খুলি আর বুজি ।
এর মধ্যে একদিন মেয়ে আমার বুকে আছড়ে পড়ে । আমার তখন চেতনা লোপ পাচ্ছে , এর মাঝেই শুনতে পাই - বাবা ! তোমার
জামাইয়ের ত অবস্থা খারাপ , তুমি মরলে ওরা কেউ কিছু দেবে না!কিছু জমি সরাসরি তুমি আমার নামে লিখে দাও বাবা!!
- আমি ত ওদের মা ! হাড়ে হাড়ে চিনি সবকটাই বদমাশ ! তুমি সবকিছু
আমার নামে লিখে দাও নয়ত বুড়া বয়সে ভিক্ষা ছাড়া উপায় থাকবে না । ।
আহ ! প্রিয় পাঠক! হৃদয়টা দুমড়ে - মুচড়ে গেছে , জীবন সায়াহ্নে তাহলে কি এমন ক্ষমাহীন অন্ধকার ওত পেতে থাকে ! ঠিক আছে জীবন ! আমিও ভেবে রেখেছি সুস্থ হই একবার , আমার সব সম্পত্তি এতিমখানায় দান করে দেব!
মোটামুটি সুস্থতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি আমি , সবকিছু ঠিক - ঠাক থাকলে কয়েকদিন পর ডাক্তার রিলিজ দিয়ে দেবেন। সবাই এখন আশঙ্কা মুক্ত,আগের মত আমায় ঘিরে জটলা নেই। পালা করে পরিবারের একেকজন রাতে আমার সাথে থাকে। আজ আছে ছোট ছেলে রফিক।
রাত দশ টার দিকে ঘুমিয়ে পড়লাম। হঠাৎ বাবা বাবা ডাকে তন্দ্রা ছুটে গেল। চোখ খুলে দেখি আমার দিকে তাকিয়ে আছে রফিক, কেমন উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি ! ভয়ঙ্কর কিছু বয়ে বেড়াচ্ছে যেন মুখে।দেয়ালে ঝুলানো ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখি - রাত দুইটা ।
- বাবা ! বাবা !
- কি ?
- আজ সালাম ভাই আমাকে দোকানে ঢুকতে দেয়নি। তুমি নাকি এই দোকান তাকে দিয়ে দিচ্ছ ?
আমি চমকালাম।
- না বাবা ! আমি ত এমন কিছু বলিনি !
- বিশ্বাস করি না আমি ! তুমি সবসময়েই আমাকে বঞ্চিত করছ !
এ কথা বলে রফিক আমার মাথার নিচ হতে বালিশ টেনে নিল।
চোখে আমার ভয় । কি করতে চায় রফিক ?
- বাবা শোন বাবা ..... আমার কোন কথা রফিকের কানে ঢুকে না,সে বালিশ টা আমার মুখ বরাবর নামিয়ে আনছে ........... তবে কি রফিক আমায় .. ... কি অদ্ভুত ... ঠিক সেই মুহূর্তে শামিমাকে দেখতে পেলাম........ শামিমা ! শামিমা ! ......
তারপর কি হল তা না হয় আপনারা নাই জানলেন ! হয়ত অনেকেই ভাবছেন রফিক আমাকে মেরে ফেলেছে! কিন্তু আমি মারা গেলে আপনাদের গল্প বলছি কি করে ! আবার মরেও ত গল্প বলা অসম্ভব কিছু না!ভাবনার ডালপালা আপনাদের হাতেই তুলে দিলাম। এমন বহুরৈখিক ডালপালামার্কা সমাপ্তি ই ত আপনারা প্রত্যাশা করেন - তাই না ? হাহাহ ।
গল্প শেষ , কিন্তু শামিমা কেমন তা ত আপনাদের জানানো হল না ! অনেকে হয়ত্ আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন ! ওয়াদা পূরণের খাতিরে বলছি - শামিমা ছিল সুন্দরী। কেমন সুন্দরী ? যেমন সুন্দরী হলে ট্রয় ধ্বংস হয় , যেমন সুন্দরী হলে পৃথিবীর প্রথম গল্পের সৃষ্টি হয়,কাবিল হাবিল কে মেরে ফেলে ।
আমি খুব খুশি যে , পৃথিবীর প্রথম গল্পের সাথে আমার শামিমা নামক গল্পের মিল আছে । আমি খুব খুশি যে ,পৃথিবীর প্রথম গল্পের সাথে আমার শামিমা নামক গল্পের কোন মিল নেই।মিল আছে কারণ শামিমা আমার হয়নি।মিল নেই কেননা পৃথিবীর প্রথম গল্প শক্তি দ্বারা নির্ধারিত হয়েছিল। আর আমার ? অর্থ মশায় অর্থ ।
আমি খুব খুশি যে গল্প পড়ে আপনার পাঠক - হৃদয় তৃপ্ত হয়নি।আমি জানি অনেক প্রশ্ন আপনার মাথায় কিলুবিলু করছে । কেমন হুড়মুড়িয়ে এক জীবনের গল্প শেষ হয়ে গেল ! এত সহজ ! হ্যা , আমি বলছি খুবই সহজ । জীবনটা একঘেয়ে ও গতানুগতিকভাবেই শেষ হয়।আপনি ইবলুন কটা জীবনে বৈচিত্র্য থাকে ? আপনি বলুন প্রতিটা স্বর্গদীপ্ত প্রাণ কি পৃথিবীর রোমশ অন্ধকারে ক্রমশ নিজেকে হারিয়ে ফেলে না ?তবু জীবনের মাঝেই মানুষ জীবন খুজে বেড়ায় , সবকিছুর মাঝে নিজেকে খুঁজে ফেরে , যাই পায় , তাই কুড়ায় । আমি ও তাই করেছি।আসলে জীবন একটা নেশার নাম , কিছুর না কিছুর নেশায় তাকে মেতে থাকতে হয় , নেশা কাটলেই বিপদ । তখন জীবনআরশিতে ষোল আনা মিছার সবটুকুই যে ধরা পড়ে যায় !
আমি আগেই সতর্ক করেছিলাম আমার গল্পে বৃথা সময় অতিবাহিত করবেন না । করেই যখন ফেলেছেন তখন আপনার কাছে একটা প্রশ্ন রেখে গল্পের নটে গাছ মুড়ে দিচ্ছি,বলুন ত - জীবনের কোন অর্থ কি আপনি খুজে পেয়েছেন ? নাকি এখনো হাতড়ে বেড়াচ্ছেন ?
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুলাই, ২০১৫ রাত ১২:৫৯