somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আত্মকথনঃ স্মৃতির এলোমেলো টুকরোগুলি -১ + ২ নওশাদ স্যার। গতম , আমি, আমরা ।

১২ ই নভেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

উৎসর্গ - নবরত্নের দল।নবরত্নের শুভাকাঙ্ক্ষী মামুন ভাই। কে জানত লিখতে এসে এমন চমৎকার সব মানুষের দেখা পাব।

ছোটবেলার মধুর স্মৃতির ষোলোআনার বারোআনা বোধহয় একে মারা ওকে ধরা, দুষ্টুমি, খুনসুটি,গাছে ওঠা, দল বেধে চুরি করা ইত্যাদি ইত্যাদি।এর মধ্যে মারধর বোধ হয় মানবজাতির স্বভাবজাত।আপনি হয় মার দেবেন,নয়ত খাবেন,নয়ত দেখবেন। ছোটবেলায় মূলত অনেক জটিল,কঠিন সমস্যার তাৎক্ষনিক সমাধান হিসেবে মারামারি র ব্যবহার হয়। এছাড়াও নির্মল আনন্দের উৎস হিসেবে এর জুড়ি নেই।
প্রথম কাকে মেরেছি বা প্রথম কার কাছে মার খেয়েছি তা আর আজ মনে নেই।স্মৃতি বড়ই প্রতারক। অনেক কিছুই ভুলে গেছি,ভুলে যাচ্ছি। বরং স্মৃতির ভাণ্ডারে যা জমা আছে তা দিয়ে শুরু করি।

মুরুব্বীরা বলে,ছোটবেলায় আমি নাকি খুব দুষ্টু আর জেদি ছিলাম। আমার অবশ্য তা মনে হয় না।বরং নিজেকে শান্ত ছেলেই বলব।আর শান্ত ছেলে হলে যা হয় উটকো বিপদাপদ মাথার উপর এসে পড়ে। এসবের প্রতিকার করতে গিয়ে হয়ত ''দুষ্টু আর জেদি'' র খেতাব কপালে জুটে গেছে।জেদ বা রাগের বসে যা কান্ডকারখানা করেছি তা আমলে না নিলে ল্যাটা পুরোপুরি চুকে যায়।

কিবোর্ড দিয়ে লিখতে গিয়ে কলমের কথা মনে পড়ছে।শুধু লেখাই নয়, কলম দিয়ে নানা কাজ করা যায়। এটি হতে পারে আত্মরক্ষা ও আক্রমণের আয়ুধ। যেমন ধরুন,কারো শাটের পিঠে লিখে দেওয়া, চৌকিতে ছারপোকা থাকলে বলপেন পুড়িয়ে(ইকোনো ডি এক্স হলে ভাল হয়)ছারপোকার দুর্গে আঘাত হানুন।বলপেন গলে গলে পড়ে যখন পটাপট আওয়াজ হবে,মরা পোড়ার গন্ধ পাবেন,বুঝবেন আপনার ক্ষেপনাস্ত্র ব্যর্থ হয়নি।বলপেনের আরেকটি ব্যবহার করতে দুষ্টু ছেলেদের দেখা যায়।স্যার আপনাকে পড়া বলবার জন্য উঠে দাঁড়াতে বললেন।আপনি বসা হতে উঠে পড়া বলছেন।তখনই আপনার পাশে বসা সহপাঠী তার ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে বসল। তিনি আপনার অজান্তে নিতম্বের মাঝ বরাবর একটি বলপেন খাড়া করে রাখলেন।এবার আপনি বসতে গেলেই........
কবির ভাষায় বলতে গেলে -
''চিরসুখীজন ভ্রমে কি কখন - ব্যথিতবেদন বুঝিতে পারে
কী যাতনা বিষে, বুঝিবে সে কিসে - কভূ আশীবিষে দংশেনি যারে''
কলমের আরো বহু বিচিত্র ব্যবহার আছে। সেসব অনেকেই জানেন।

মনে পড়ে, অভিমান করে দুইবার হাতে কলম তুলে নিয়েছিলাম।আমার জেঠাতো ভাই তার দলবল নিয়ে ফুটবল খেলছিল।এত করে বললাম খেলায় নিতে, নিল না।তখন রাগ করে বাসায় গিয়ে কলম এনে ভাইটার পিঠে জোরে উপর হতে নিচ বরাবর আক দিলাম।ছড়ছড় করে চামড়া ছিড়ে গেল। জায়গায় কেঁদে দিল। আমি সোজা বাসায় এসে বাথরুমে আশ্রয় নিলাম।ঘন্টাখানেক ছিলাম।সবাই মিলে আমাকে না মারার আশ্বাস দেওয়ার পর বাথরুম হতে বেরোই।মাফ চাইতে বলা হলো।চাইলাম।আমার জেঠাতো ভাই কয়েকদিন আমার সাথে কথা বলেনি।

আরেকবার চালিয়েছি আমার মামাত বোনের উপর। একদিন এত করে বললাম আমার সাথে খেলো,খেলে না। শেষ মেষ জিদ চেপে গেল।কলম দিয়ে মামাত বোনের বাহুর উপর দিলাম কষে টান।সে কথা এতদিন পরেও আমার মামাত বোন ভুলেনি।অথচ বছর দশেক হয় বিয়ে করে সংসারী। এই তুচ্ছ ঘটনা এতদিন ধরে মনে রাখার প্রয়োজন কি বুঝি না।তবে এ ঘটনার পর আর কলমের এমত ব্যবহার করিনি।অবচেতনে মনে হয় বুঝতে পেরেছিলাম,ইহা কলমের কাজ নয়।

কলমের কাজ কি কলম খেলা?প্রথমে আমার তা মনে হত না। অপছন্দ করতাম। কিন্তু রাকিবগুরুর কারণে পারলাম আর কই! তিনি আমার বন্ধু। ডাকনাম তুহিন। বাবা পদ্মা ওয়েলে চাকরি করত। স্কুলে তার সাথে আমার প্রথম বন্ধুত্ব হয়।ফর্সা , গোলগাল শরীর। গোল বড় মাথাটা অজস্র চুলে ভর্তি। শান্ত উজ্জ্বল চোখ। সবকিছুতে অমিত উৎসাহ। স্কুলে একসাথে বসতাম।রাকিব আমাকে জড়িয়ে ধরে বলত, আমরা বাল্যবন্ধু।খুব কলম খেলা খেলত।আমি প্রথম প্রথম অপছন্দ করতাম।ওকে বলেছি - তুই এই খেলা খেলিস কেন?তার উত্তর-
কলম খেলা আমার নেশা
স্কুলে আসা আমার পেশা!
তার কথাটা আমার আজো মনে আছে, তার নিজের মনে আছে কিনা কে জানে, হাহাহা।যা হোক,একসময় সে আমাকে নেশা ধরাতে কামিয়াব হল।গাইতে গাইতে গায়েনের মত আমিও কলম খেলার কুতুব হয়ে গেলাম।নিয়ম হলো বলপেন হতে হবে,ইকোনো ডি এক্স বা রাইটার হলে ভাল হয়। আমার কাছে ইকোনো ডি এক্স সুবিধার মনে হত।রাইটার খেলার জন্য একটু পেছল ছিল।তবে লেখার জন্য রাইটার আমার ভাল লাগত।নীল কালির। রাইটারের মুখের ডাকনাটাও পছন্দের ছিল।তখন অনেকে ফ্যাশন দেখাবার জন্য রেডলীফ ব্যবহার করত।আমার অবশ্য এই কলমটা ভাল লাগত না।ক্যাম্পাস নামে একটা কলম বেরিয়েছিল।টিভিতে এড ও দিত- '' লিখে ভাল , চলে ভাল।'' সম্ভবত সুইজারল্যান্ডের কালি,জার্মানির নিব এই শ্লোগান ছিল। ক্যাম্পাস কলমটা ক্লাস এইটে ব্যবহার করেছি। তবে সাইক্লোন বইয়ে দিয়েছিল ইকোনো ডিএক্স। ইকোনো ডিএক্সের তারুণ্যের শক্তিতে বুড়ো প্রাচীন ফাউণ্টেনপেন জাদুঘরে চলে গেল। কয়েকবছর দেদারছে একচেটিয়া ব্যবসা করেছে ইকোনো বলপেন।

যা হোক, কলম থেকে রাকিবে আসি।একদিন মনে হল আচ্ছা,ওর পিঠে চড় মারলে কেমন হয়? যেইভাবা সেই কাজ। স্কুল ছুটি দিলে যেই রাকিব সিড়ি দিয়ে নামছিল,ওমনি পিঠে মেরে দৌড়।পরেরদিন রাকিব স্কুলে আসেনি। এর পরেরদিন আসলো,ওর বাবা সহ। ভয় পেলাম। কমপ্লেইন দেবে নাকি! ওর বাবা নালিশ করলেন না। আমায় ডাকলেন। আঙ্কেল আমাকে খুব স্নেহ করতেন। বললেন,আমি খুব অবাক হয়েছি।তুমি ওকে মেরেছ কেন? সে খুব কেঁদেছে। আমি আর কি বলব!গলা শুকিয়ে গেছে।বললাম,এত ব্যথা পাবে ভাবি নাই! আঙ্কেল আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,আর এমন করবেনা কেমন ? আমি বললাম, জি আচ্ছা! ক্লাসে ঢুকতেই রাকিব বলল, টিফিন পিরিয়ডে তোকে মারব।ভয় পেয়ে গেলাম। আশারাফুল আশ্বাস দিল আমি তোকে বাঁচাবো। কিন্তু দেখলাম,টিফিনের সময় সে কিছুই করলনা।

তৃতীয় শ্রেণিতে তার সাথে আমার বন্ধুত্বে আস্তে আস্তে চিড় ধরে।দোষ আমারই।আমি তার পাশে বসা ছেড়ে দিলাম।সে আমার পাশে বসতে চাইলেও আমি বসতাম না।তখন আবদুল্লাহ ওরফে লিটন এবং আশরাফুল নামক দুজন বালকে মজে গেছি।ওরা খুব দুষ্টুমি করত।এখন মনে হয় রাকিব খুব ভাল বলেই আমাকে টানেনি। বড় বদ মন আমার। যাকে আমরা বলি মডেস্টি তা ওর ভেতরে ছিল।ওইটুক বয়সেই পরিশীলিত ভদ্রতাবোধ।

ক্লাস ফোরের বার্ষিক পরীক্ষার পর সে স্কুল লীভ করে। তার সাথে শেষবার দেখা হয় রাস্তায়।স্কুল থেকে ফিরছিলাম। আমাকে দেখে রাস্তার ওপাশ থেকে কেমন করে ছুটে এলো।অনেকদিনপর তার বাসার সামনে গিয়েছিলাম। জিজ্ঞেস করে জানলাম,তারা ওখান হতে চলে গেছে। জানিনা রাকিব এখন কোথায় আছে,কেমন আছে।জানিনা আমার কথা তার মনে আছে কিনা। চোখ বুজলে এখনো তার প্রাণবন্ত চেহারা দেখতে পাই। দেখতে পাই শেষবার দেখা হওয়ার সময় আমার দিকে তার ছুটে আসা। তাকে আরেকবার দেখার জন্য মন খুব খূব টানে। দোয়া করি যেখানেই থাকুক, রাকিব সুখে থাকুক, পরম করুণাময়ের ছায়া যেন তাকে আগলে রাখে। আর হ্যা রাকিব,তুমি যে প্রথম শ্রেণিতে রেজাল্ট কার্ডে আমার বাবার সাক্ষর নকল করে দিয়েছিলে তা কিন্তু মনে রেখেছি! আর বুকের গহীনে একটা চিনচিনে ব্যথা তোমার জন্য রেখে দিয়েছি।এই ফেসবুকে কত অজানা মানুষের সাথে পরিচয় হলো,তোমায় খুজেছি,পাইনি, আকাশটা নীল, দুনিয়াটা গোল,ঘুরতে ঘুরতে একদিন দেখা হয়ে যাবে নির্ঘাত, সে আশায় আজো আছি।আমার মনের সবটুকু আশিস তোমার অজান্তে তোমার দেহ জুড়ে থাকুক।

মাঝে মাঝে মনে হয়,এই যে গল্প টল্প লিখছি-এটা কি ভবিতব্য ছিল? পরম করুণাময়ের কোন ইশারা কি এতে আছে? রুবেলের কথা মনে পড়লে প্রশ্নটা আসে। রুবেলের সাথে গল্প খেলা খেলতাম। মানে রুবেল একটা গল্প লিখে আমাকে দিত। গল্পটা রুপকথা বা হোজ্জা বা নিজের মত করে কোন গল্প লেখা।প্রতিউত্তরে আমিও গল্প দিতাম। খুব অল্পসময়ে তার সাথে বন্ধুত্বের রসায়ন গাঢ হয়েছিল।আবার ছুটেও গিয়েছিল।ক্যারাম খেলতে গিয়ে ওর সাথে প্রথম পরিচয়। ওরা ছিল দুই ভাই।রাসেল রুবেল।রাসেল আমাদের চেয়ে বয়সে বড় ছিল, আর খুব মোটাসোটা।রুবেলের ছিল ফিট শরীর।টি শার্ট একদম গায়ের সাথে লেগে থাকত। খুব সুন্দর আর স্মার্ট লাগত ওকে।প্রথম যখন ওর বাসায় গিয়েছিলাম , তখন ওর মার আদিখ্যেতা দেখে বিরক্ত হয়েছিলাম। ওরা ক্যারাম খেলছিল,আর ওর মা মাখা ভাত ওদের মুখে তুলে দিচ্ছিল। ওরা এক নলা খায় খায় ত,১৪ বার মুখ ঘুরায়। না না আর খাবনা। যাও ত! ওর নাছোড়বান্দা মা ও ছড়েনা। ধানাই পানাই করে খাইয়ে ছাড়ে।এত বড় দামড়াদের আবার এভাবে খাওয়াতে হয় নাকি! এটাই ভাবছিলাম। হায় তখন কি জানতাম - বছর না ঘুরতেই বাচ্চা দিতে গিয়ে ওদের মা মারা যাবে। ওদের বাবা নতুন মা আনলেন ঠিক বউ মরার ৪১ দিনের মাথায়। পুরুষের নানা ছুতো থাকে। বাচ্চাদের দেখবে কে? আসলে নিজের জন্য নাকি বাচ্চার জন্য বউ লাগে তা কে জানে!

মাঝে মাঝে মনে হয় এভাবে মরে যাবে বলেই হয়ত একদম নিজেকে নিঃশেষ করে ছেলে দুইটাকে আদর দিয়ে গেছে।ওদের নতুন মা ছিল ঠাণ্ডা মাথার চালাক।নিজে কিছু বলত না,ওদের নানা কথা স্বামীকে বলে ওদের উপর মন বিষিয়ে দিত।হায়রে কই গেল বাবার সন্তানের প্রতি সেই আদর।রাত বিরাতে কষে মার দিত ওদের বাবা।একদিন দিনের বেলায় রুবেলকে মারার জন্য বেল্ট হাতে নিয়ে দৌড়ে খেলার মাঠে চলে এলো তার বাবা। রুবেল ভয়ে দৌড়ে আমাদের বিল্ডিং এ চলে এলো,আমরা থাকতাম তিন তলায়, দোতলায় থাকত আশিকের মা।রুবেল দোতলার বারান্দায় এসে হাপাচ্ছিল,ওর বাবা ততক্ষণে কাছে চলে এসেছে, হাতে বেল্ট। এমন সময় ঘর থেকে বেরিয়ে আশিকের মা রাসেল আর ওর বাবার মাঝখানে বাধার দেয়াল হয়ে দাঁড়ালো। আশিকের মার কল্যাণে ঐ সময় বেঁচে গেলেও ঘরে তাকে ঠিকই মার খেতে হয়েছিল।মা শোনার পর মার ও খুব খারাপ লাগল। একদিন সকালে অফিসে যাওয়ার সময় রুবেলের বাবাকে আমার মা যেচে পড়ে অনুরোধ করলেন ওদের না মারার জন্য। সে বয়সে বুঝে গিয়েছিলাম সৎ মা কি জিনিস।ওর মা মারা যাওয়ার পর আমরা একসাথে স্কুলে যেতাম। সে আমার বাসায় চলে আসত।তারপর আমরা একসাথে বের হতাম। আমার মা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব কথা জিজ্ঞেস করতেন।ওর পরিবর্তন টের পাচ্ছিলাম। খাওয়া কমে গিয়েছিল।একটু চুপচাপও।

কিছুদিন পর সে কি কারণে জানি স্কুলে গেল না।ওর স্কুলে না যাওয়ার খবর ওর সৎ মার কানে গেল। রুবেল স্কুলে যায়নি তা আমরা জানতাম।ওর সৎ মা রুবেলকে জিজ্ঞেস করল।রুবেল অস্বীকার করল।ওর সৎ মা এবার আমাদের সবাইকে জিজ্ঞেস করা শুরু করল।সবাই অস্বীকার করল।আমাকে জিজ্ঞেস করলে আমি বললাম বলতে পারব না।হঠাত মহিলা বলল, আমি জানি তুমি মিথ্যা কথা বলো না। আমাকে সত্যি কথা বলো।এ কথা বলাতে আমি দুর্বল হয়ে গেলাম। কারণ তখন আমি মোটেও মিথ্যে বলতাম না। সত্যি বলে দিলাম।সেই সত্যির দাম রুবেল কিভাবে চুকিয়েছিল তা আমি আজো জানি না। পরে অনেক ভেবেছি। জীবনের নানা পর্বে ইচ্ছে - অনিচ্ছেয় কম মিথ্যে ত বলিনি।সেদিন কেন আমি ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির হতে গেলাম ?

তারপর কথা বন্ধ,গল্প দেয়া নেয়া বন্ধ। মনে মনে ওর সাথে কথা বলার ছুতো খুজছিলাম।ওর আশেপাশে ঘুরাঘুরি করতাম।আমাকে দেখলে সে মুখ ফিরিয়ে নিত। আমাকে খেলতে দেখলে সে ঐ খেলায় অংশ নিত না। এশার নামাজের সময় সে আমার পাশে দাঁড়াত না।সে যখন মসজিদের বাইরে বের হয়ে আসত, আমি তার পেছন পেছন হাটতাম।আশায় থাকতাম সে হয়ত এইবার কথা বলবে। সময় ঘুরে রোজা এল,ঈদ গেল, বরফ গলল না। মাঝে মাঝে বন্ধুদের আড্ডায় ওর উদ্দেশ্যে কথা হাওয়ায় ছুড়ে দিয়েছি। না শোনার ভান করে গেছে।মাস কয়েক পরে ওরা অন্য এলাকায় চলে গেল।

ভেবেছিলাম, বাসা পাল্টানোর সময় সে এইবার কথা বলবে।বলল না। শেষ পর্যন্ত সে এতটা কঠিন থেকে যাবে ভাবতে পারিনি। ভ্যানগাড়িতে ওদের মালামাল একটার পর একটা ওঠানো হচ্ছিল। সে ভ্যানগাড়ির সামনে। আমি একটু দূরে। তবু একবার আমার দিকে তাকালো না।মন খুব খারাপ হয়ে গেল।কষ্টে আমার মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছিল না। ওখান থেকে চলে এলাম। উদ্দেশ্যহীন হাটতে হাটতে চলে গেলাম বহুদূর।তখন ফুরফুরে বাতাস ভরা দুপুর।মনের বিষণ্ণতায় আকাশ ও বিষণ্ণ লাগছিল।একটা সিমেন্ট বাধা জায়গায় অনেকক্ষণ বসে রইলাম।বিকেলে এসে দেখি তাদের বাসায় বাড়িওলার লাগানো তালা ঝুলছে। রুবেলের সাথে সেই আমার শেষ দেখা। মাঝে মাঝে শহরের আনাচে কানাচে তার বাবার সাথে দেখা হয়েছে। কিন্তু রুবেলকে আর দেখিনি। শহরের রাস্তায় পাখির মত চোখ মেলে তাকিয়েছি কতবার।একবার যদি দেখতে পাই।অদেখাই থেকে গেল শেষমেশ। এখনো ব্যথা পাই। বিবেকের আদালতের সাজা
ফুরোয়নি বোধ হয়, লেনাদেনা মিটে গেলে একদিন দেখা হবে নিশ্চয়।

আত্মকথনঃ স্মৃতির এলোমেলো টুকরোগুলি -২

আলিফ লায়লার জীনের হা হা হাহা হো হো হাসি খুব ভালো লাগত। ইচ্ছে করত আমিও এভাবে হাসি।কিন্তু সুযোগ কই? নিজে নিজে হাসলে সবাই পাগল বলবে। তবে উপায় একটা পেয়ে গেলাম। খেলার মাঠে মেয়েরা ডেকচি পাতিল নিয়ে ঘর সংসার খেলা খেলত কখনো পুতুল দিয়ে সংসার এই টাইপ।ভেবে দেখলাম এখানে বাগড়া দেয়া যায়।প্রথমে তাদের সাথে খেলায় যোগ দিতে চাইলাম। মেয়েগুলা নিতে চাইত না।তখন ভয় দেখালাম আমাকে জামাই না বানালে খেলা ভেঙ্গে দেব।বাধ্য হয়ে তারা সংসার খেলায় আমাকে জামাই বানাল।ত করলাম কি -যখন রান্না বান্না শেষ করে আমাকে খেতে ডাকত,আমি বলতাম এইটা কোন তরকারী! ছি! এই বলে সব উল্টে দিয়ে দিয়ে দিতাম দৌড়! মেয়েগুলো ভ্যা ভ্যা চিল্লানো শুনতে ভালো লাগত। তারপর নাগালের বাইরে গিয়ে জীনের হাসি। যা হোক এই কিসিমের কান্ড কয়েকবার ঘটানোর পর আমি এই খেলা থেকে একদম আউট।নিষিদ্ধ।তখন করলাম কি ডাকু সাজলাম।জব্বারের বলী খেলা হতে একটা টিপু সুলতান তলোয়ার কিনেছিলাম।সেটা হাতে নিলাম। ডাকু না হয় হলাম দলবল কই? পেয়ে গেলাম মুরাদকে।এবার দুইজন মিলে মেয়েদের সংসার খেলায় হাজির হলাম। তোরা খাজনা না দিয়ে খেলছিস,তোদের এত বড় সাহস/।এবার সব লন্ড বন্ড করে দেবো।ইয়া হাহাহাহা! ইয়া হা - হা - হা - হা। যাকে বলে গলা ফাটিয়ে জীনের হাসি! বলে দুজনে গলা কাঁপিয়ে একচোট হেসে নিতাম। মেয়েরা তখনই চিল্লানি দিত আ!!!!!!আহ!!!! অই ভাগ ভাগ !! দূর অ !ইত্যাদি নানা কিছু।তাদের চিল্লাচিল্লির ফাঁকে যা করার তা করে চলে আসতাম।

কিছুদিনের মধ্যে তারা সমস্যার সমাধান বের করে ফেলল। দুয়েকজন মেয়ের ভাই খেলার সময় তাদের গার্ড দিত। হামলা চালাতে গেলে
আমাদের ধাওয়া দিত। আমরাও কম কি - সুযোগের অপেক্ষায় থাকতাম।এ লেখাটা লেখার সময় পুরো দৃশ্য যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। হাহহা। যা হোক - এই লেখার মাধ্যমে মেয়েদের ধন্যবাদ দিচ্ছি, এত জ্বালাবার পর ও তোমরা কোনদিন বাসায় বিচার দাওনি। অথচ কত তুচ্ছ কারণে বাসায় বিস্তর বিচার যেত।

ধুমাধুম কিল বসিয়ে দিতে বেশ আরাম।বেশ মজা আছে ব্যাপারটায়। তবে দিতে মজা আর খেতে গজা।তা প্রথম বুঝেছি জাহাঙ্গীরের কিলে।জাহাঙ্গীর আমাদের সাথে পড়ত।কালো , আমার চেয়ে কিছুটা লম্বা ছিল তখন।মোটামুটি চিকন। কিন্তু শরীরের হাড় খুব শক্ত। বিলাইয়ের হাড্ডি যাকে বলে। জাহাঙ্গীর কিল দিতে পছন্দ করত। একদিন তার কব্জায় পড়ে গেলাম। সে আমাকে ভেংচালো।আমি বললাম, জাইংগা - টাইংগা।(জাহাঙ্গীরের সংক্ষেপ)। সে আমাকে কিল দিল। আমিও দিলাম। এইবার শুরু হল হুরুস্থুল কিলাকিলি। আমার এক কিলের ওজন ১ কেজি হলে তারটা ১ মণ। দুইহাত একদম অসাড় হয়ে গেল। স্কুল শেষ হবার পর বেরিয়ে স্কুলের মাঠের এক কোণায় বসে গুনগুনিয়ে ব্যথায় ওমারে,ওমারে করছিলাম।ওমা! ১ মিনিট পর দেখি আরেকজন ওমারে বলতে বলতে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। বুঝলাম তাকেও জাহাঙ্গীর সাহেব কুল্লু খালাস দিয়ে দিয়েছে।
কিরে তোকে জাইঙ্গা মেরেছে? - আমি বললাম ।
ছেলেটা ব্যথায় মোচড় খেয়ে বলল -হু!
আমি বললাম - জাইঙ্গা - টাইঙ্গা!
ছেলেটাও বলল-জাইঙ্গা - টাইঙ্গা !!
তারপর দুজন একসাথে কোরাস গাইলাম, - জাইঙ্গা - টাইঙ্গা!
তারপর বললাম - এর একটা বিহিত করতে হবে।
ছেলেটা বলল, কি করবি?
আমি বললাম - ওর মাকে বলে দেবো। কিন্তু ওর বাসা ত অনেক দূর!
ছেলেটা বলল, তাও ঠিক।
দাড়া মার্শাল আর্ট শিখে নেই।তারপর প্রতিশোধ নেবো।- আমি বললাম।
তখন পাড়ায় পাড়ায় মার্শাল আর্টের জোয়ার চলছিল।মোড়ে মোড়ে ব্ল্যাক ব্যাল্ট ধারী গজালো। কেউ কেউ নাকি বান্দরবনের ওস্তাদ থেকে শিখে এসেছে।বাংলা সিনেমা এই জোয়ারের জন্য দায়ী।কল্পনায় দেখলাম,ওকে ঘুষি মেরে শুইয়ে দিয়েছি।

এর মধ্যে চলে এল রওশন আরা।আমার সহপাঠী। বলল,জাহাঙ্গীর মেরেছে নাকি? কিল খাওয়া পার্টি হিসেবে লজ্জায় নুয়ে গিয়ে বললাম,হ্যা। রওশন আরা বলল,আমাকেও একদিন কিল দিয়েছিল। সুবিধা করতে পারেনি। স্যারকে বলা মাত্রই ওকে কান ধরে মেরেছে। একটু হিংসে হলো। মেয়েদের কত সুবিধা! আর আমি স্যারকে বিচার দিলে দুজনেই মার খাবো। তবে ওর মাকে আমরা ঠিকই বলতে গিয়েছিলাম।জাহাঙ্গীরের মা মানে আন্টি খুব হাসিখুশি ভদ্রমহিলা।আমাদের এত আদর করলেন যে,কি জন্য এসেছি ভুলেই গেলাম।
মার্শাল আর্ট শিখব টাকা কই ? মুফতে শিখতে চাইলাম। আমার এক বন্ধুর আত্মীয় মার্শাল আর্ট জানতেন।আমাদের খুব পছন্দ করতেন। তার কয়েকটা কৌশল দেখে রীতিমত ফ্যান হয়ে গিয়েছিলাম।শেখানোর ব্যাপারে আমার বন্ধুকে বললাম।কোন রেস্পন্স পাইনি। ব্যাটা বোধ হয় বলেনি! সেই সাথে তখনকার মত মার্শাল আর্ট চ্যাপ্টারের ইতি হল।

কিলের সাথে রক্তিম চৌধুরীর কথাও আসে। মনে পড়ে ক্লাস ফাইভে ম্যাডামের রোল কল রক্তিম চৌধুরী তারপর মাহমুদুর রহমান।ওর রোল ছিল তিন, আমার চার।রক্তিম হাইটে আমার মত হলেও শরীর ছিল গাঁট্টাগোট্টা মাংসল। তাতে আসুরিক শক্তি। ভয়েও তার সাথে লাগতাম না। দুষ্টুমির ছলে দুয়েকবার যা কিল দিয়েছে তাতেই ওর ক্লাস বুঝে নিয়েছি।
সে আবার নিজেও বলত -
জানিস, আমার খুব শক্তি!
আমি বলতাম - তুই কি খাস?
সে বলত, আমি কচ্ছপ খাই। তুই কচ্ছপ খেলে তোর ও আমার মত শক্তি হবে।
ধর্মমতে আমি কচ্ছপ খেতে পারি না।টিভিতে শচিনের এড দেখাত। বুস্ট ইজ সিক্রেট অফ মাই এনার্জি।আমার মনে হত বুস্ট খেতে পারলে আমিও শক্তিশালী হতে পারতাম। কিন্তু আব্বু আনেন মাল্টোভা। হরলিক্স আনলেও ত হয়! উলটা আব্বু শাক - সব্জি তরিতরকারী বেশি খেতে বলতেন।

রক্তিমের আরেকটা ব্যাপার ছিল। আমরা ছেলেরা মেয়েদের সাথে লাগতাম না বা মেয়েরা কখনো দুষ্টুমি করে মারলেও
মেয়েরা যাতে বেশি ব্যথা না পায় সেভাবে মারতাম।মোট কথা আমরা এ বিষয়ে সচেতন ছিলাম।সচেতনার উৎসমূল কোথায় ছিল তা অবশ্য কখনো বের করতে পারিনি।কিন্তু রক্তিম এসব মানত না। মেয়েদের কেও ধুমাধুম লাগিয়ে দিত। আর বলত - আরে ভয় কি!মেয়েদের কে কষে মার দিয়ে দিবি।আমাদের অনেক সুবিধা।মেয়েদের ত ইজ্জত আছে। আমরা মারলে ওদের ইজ্জত চলে যাবে।বলাবাহুল্য ইজ্জত ধারণাটি বাংলা সিনেমা হতে পাওয়া। আমার বোনের ইজ্জত কেড়ে নিয়েছিস এই টাইপ ডায়ালগ দিত সিনেমায়।ইজ্জত চলে যাওয়া বলতে বাংলা সিনেমায় দেখানো নায়িকার বাহুর কাছে ছেড়া ব্লাউজ , ব্যাকগ্রাউন্ডে বাতাসের শো শো আওয়াজ - এসবই ভাবতাম।একবার ত কি কারণে ক্লাসে ছেলে মেয়ে দুই গ্রুপে বিভক্ত হয়ে হুরুস্থুল মারামারি।ওই সময় দেখলাম মারামারিতে মেয়েরাও কম যায় না। যে কোন জিনিস অভীষ্ট লক্ষে পৌঁছে দিতে সক্ষম।মেয়েদের মধ্যে যারা চুলের বেণী করেছিল তারা মার বেশি খেল।

চুলের বেণীর কথা ওঠায় নিজের কিছু কথা বলতে ইচ্ছে করছে। মেয়েদের চুলের বেণী দেখলে এখনো মনে শয়তান কু পারে। দেখলেই মনে হয় দেই টেনে। বিশেষ করে মাথায় খাড়া বেণী করলেওলাদের গরুর শিং, শয়তানের শিং বলে খেপাতাম।যাদের কে পারতাম তাদের বেণী ধরে দিতাম টান।

লাথির কথায় আসি। লাথি খেলাখেলি সবচেয়ে বেশি চলেছে বোধ হয় মুহিবুরের উপর।সামিউর আর মুহিবুর ছিল বন্ধু। সামিউরকে সবাই ডাকত স্বামী। খেপত। আরো বলতাম - স্বামী তোর বউ কই? সামিউর আর মুহিবুরের সাথে মোরগ লড়াই খেলতাম।মোরগ লড়াই শেষ করার পর চলত লাথি খেলা। মানে লাথি মেরে কার প্যান্ট কতটা ময়লা করতে পারি। সামিউর প্রায়ই রণে ভঙ্গ দিত। তবে মুহিবুরের সাথে জমত।
খুব আনন্দ পেতাম কারো টাই ধরে টান দিতে। কমপক্ষে ১০০ এর উপরে ছেলেদের টাই ধরে টেনেছি। টাই ধরে টানার পর কেউ কেউ ভেউ করে কেঁদে দিত,বিশেষ করে এখন যাদের মাম্মি ড্যাডি টাইপ ছেলেপিলে বলে তারা।এ ক্ষেত্রে আমার সাফল্য শতভাগ। আমার গলার টাই কেউ টানতে পারেনি। টানবে কি করে? কিছু করার আগে আমি গলার টাই খুলে নিতাম।

আসলে লাথি নিয়ে বলতে গেলে মহাকাব্য হয়ে যাবে।একই কথা ধাক্কা নিয়েও।ধাক্কায় অপার আনন্দ আছে। কাউকে ধাক্কা দেয়া গেল,আর সে চলে গেল অনেক দূরে! হাহাহ। সবচেয়ে কড়া ধাক্কা দিয়েছিলাম আশিককে। ওর সাথে পরিচিত হবার ৫ দিনের মাথায়।আশিকের সাথে পরিচিত হবার ১ দিনের মাথাতেই কড়া বন্ধুত্ব হয়ে গেল। দুজনের সে কি ঘোরাঘুরি। আমাকে দেখলেই ফিচেল হাসি দিত।ওর মাথায় সবসময় ইবলিশি আইডিয়া গিজগিজ করত। বন্ধুত্বের নিদর্শন স্বরূপ আমি তাকে আমার কেনা সিঙ্গারার অর্ধেক ভাগ দিলাম। ইহা একটি বিশাল ব্যাপার কিন্তু। তখনো দুজনের কেউ স্কুলে ভর্তি হইনি। যা হোক, ৫ দিনের দিন বিকালে ঘুম থেকে উঠে মাঠে গেলাম।মাঠে বড়রা ব্যাটমিন্টন খেলছিল।আশিকের ভাই ও খেলছিল।তখন ওর ভাই অনেক বড়।ইন্টারমিডিয়েট পড়ে বোধহয়।মাঠের এক কোণায় একটা দেয়াল ছিল।আমি দেয়ালের উপর বসে খেলা দেখছিলাম।হঠাৎ আশিক পেছন থেকে এসে আমাকে ধাক্কা দিল।নিচে পড়ে গেলাম।তাকিয়ে দেখি হারামজাদা আশিক বাদরের মত হাসি দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার জায়গাটায় বসে গেল। উঠে আমি এবার দিলাম পেছন থেকে ধাক্কা। দেয়াল থেকে দু হাত দূরে একটা পিলার ছিল। আশিকের কপাল উড়ে গিয়ে যেন পিলারের ছোয়া পেল। তারপর ''ও মারে'' বলে গগনবিদারী চিৎকার। ওর ভাই খেলা থামিয়ে আমার দিকে দৌড়ে এলো।আমিও দিলাম দৌড়। এক ম্যারাথন দৌড়ে বাসায়। সিড়ি বেয়ে দোতলার মাঝামাঝি আসতেই আশিকের ভাই খুব কাছে চলে এলো। র‍্যাকেট দিয়ে দিলো আমার মাথায় বাড়ি।ভাগ্যক্রমে জালের অংশটা আমার মাথা ছুলো। হাহা। তারপর সোজা বাসায়। আশিকের মা বিচার দিলো। আমার মা দিল আমাকে কষে মাইর।ওদের সাথে কিরকম জানি পাড়ার নেতাদের ভালো সম্পর্ক ছিল। তাই আমাকে আশিকের সাথে মিশতে মানা করে দিলো মা।প্রায় ২.৫ বছর ওর সাথে কথা বলিনি। শেষে কয়েকজন ধরে এক ফুটবল খেলায় আমাকে ওর সাথে মিলিয়ে দিলো। মিলতেই দেরী হাতাহাতি হতে দেরি হলো না। ফুটবল খেলায় আশিক ল্যাং মেরে বসলো। একবার দুইবার তিনবার। ওর ছিল বকের মত লম্বা কাঠি ঠ্যাঙ , হাড়গুলো যেন সেগুন কাঠ!মেজাজ খারাপ হয়ে গেল।দিলাম ধাক্কা।আশিক মিয়া এবারো উড়ে গেল।

পাড় হারামজাদা বলতে যা বোঝায় আশিক ছিল তাই। আশিকের সাথে সবার মারামারি লাগত। গেরিলা সিস্টেমে মারামারি পছন্দ করত সে।মানে মেরে দিত দৌড়।সুযোগ পেলে চুরিও করত। ওরা ৪ ভাই।আশিক আর ওর বড় ভাই দুটাই বদের হাড্ডি। আর আশিকের মেজো ভাই , আর ওর ছোট ভাইটা ভাল ছিল। দিস্তার পর দিস্তা কাগজ ব্যয় করলেও আশিকের ফিরিস্তি শেষ হবেনা।পরে অকে নিয়ে আরো বিস্তারিত বলব।ওকে নিয়ে উত্তম নামের একজন ছড়া বানিয়েছিল।
''আশিক প্রেমিক
প্রেম করবো না! '' - এটা বললেই ব্যাটার মুখ লাল হয়ে যেত।

ওর সাথে শেষ দেখা হয় আট বছর আগে।দীর্ঘদিন পর দেখা হলেও আমরা পরস্পরকে চিনতে পারলাম।আমার সাথে ছিল আমার বাল্যবন্ধু জাবেদ। দুজনে ওকে ঘিরে ধরে মার লাগালাম। আশিক বলল,আরে ছাড় ছাড়। মেরে ফেলবি নাকি?
আমি বললাম,ছোটবেলার প্রতিশোধ নিচ্ছি। আশিক হো হো করে হেসে উঠলো। বললাম, ছোটবেলায় অনেক জালাইছস, এইবার লেগে দ্যাখ। জানলাম ওর বাবা মারা গেছেন। ওর বাবা দুবাই না জানি মালয়েশিয়া থাকত। মাটির মানুষ বলতে যা বুঝায় উনি ছিলেন তাই।মানুষটা সারাজীবন পরিবারের জন্য কষ্ট করে গেছে। খুবই ভাল মানুষ। আল্লাহ উনাকে বেহেস্ত নসীব করুক।


আদা রসুন পিয়াজ বলে কাউকে খেপানো যায় তা সাজুকে না দেখলে বুঝতাম না।জানতাম না ওকে কেন আদা রসুন পিয়াজ বলা হত ।তবে ও যখন খেপত,আমার বলতে সমস্যা কোথায় ।রেগে গেলে ইটের টুকরা, পাঁথর ইত্যাদি ছুড়ে মারত আদা ভাইজান। সুখের বিষয়,তার ছুড়ে মারা অস্ত্রে কখনো ঘায়েল হইনি। ওর একটা বোবা বোন ছিল,তানিয়া।কথা বলার চিকিৎসা করানো হত ওকে। খুব রাগী ছিল।এবং খুব সুন্দর।আন্টিরা বলাবলি করত্ বড় হয়ে এই মেয়ে বিশ্বসুন্দরী হবে,অথচ জবান নাই, আহারে!

বালিশ মারামারি হচ্ছে সবচেয়ে মধুর খেলা।বিশেষ করে দুজন নারীর সাথে বালিশ মারামারি খেলে মহানন্দ পেয়েছি। দুজনই ভাবী। একজন জেঠাত ভাই, আরেকজন নিজের ভাইয়ের বউ। বালিশ মেরে মাথা এলোমেলো করে দিতে ভাল লাগত। জেঠাত ভাইয়ের বউয়ের সাথে বেশি খেলেছি,একদম তাদের বিয়ের তিন বছর পর্যন্ত। আমার ভাবির সাথে অল্পসল্প। সবার ভেতর আসলে একটা শিশুবাস করে ।সংসারের চাপে যা মানুষ একসময় চাপা দিয়ে দেয়। যা হোক, সৃতির রেণু ত রয়ে যায়। এখনো তাদের পাড়ভাঙ্গা নতুন শাড়ির সুবাস পাই।ঝকঝকে সতেজ শিশুর সারল্যমাখা মুখ দুটি।সলজ্জ চাউনি, ঝরণাধারার মত হাসি সময়ের আবর্তে উজ্জ্বল অতীত হয়ে আছে।

আত্মকথন - নওশাদ স্যার।

শিক্ষক বলতে সচারাচর যেরুপ মুখমণ্ডল আমাদের চোখে ভেসে বেড়ায়, নওশাদ স্যার তার ধারে কাছে নেই। মনে হত,কোথা হতে এক ড্যাশিং হিরো মনের ভুলে এই আঙিনায় চলে এসেছেন,ভ্রম কাটলে চলে যাবেন।কড়া মাড় দেয়া ফুলহাতা শাট এর সাথে ডেনিম জিন্স, মুখে ফ্রেঞ্চ কাট দাড়ি,,গুরুগম্ভীর কণ্ঠ, রাশভারী মেজাজের স্যারকে দেখা মাত্রই প্রতিটা ছাত্র এক অজানা ভয়ে কেপে উঠত। ভুল হলে ভুরু কোঁচকাবেন,রাগলে দেবেন এয়সা মার। বদমেজাজের একশেষ।নওশাদ স্যার কি? সংক্ষেপে এই ছিল উত্তর।মাঝে মাঝে বইয়ে দেয়া স্নেহপ্রবাহ তার নিচে চাপা পরে গেছে।

নওশাদ স্যার রাগী,বদমেজাজি,খুব মারেন, বকেন, ঘাড়তেড়া,অবিনয়ী - তার যে কোন সহকর্মী শিক্ষককে জিজ্ঞেস করলে তিনি একথা বলতেন।মিথ্যে নয়। তবে পুরো সত্যিও ত নয়। সব মাছ ময়লা ঘাটলেও টাকি মাছের নাম হয়।নওশাদ স্যার একজন টাকি মাছ।এই টাকি মাছ বনে যাবার পেছনের কারণ গুলো হল- ভদ্রলোক মুখের উপর ফটাফট বলে ফেলতেন,কাউকে পাত্তা দেয়া বা ভক্তি করা তার স্বভাবে ছিল না।এমন লোকের টেকার কথা নয়।তিনি টিকলেন,কারণ ভদ্রলোক ইংরেজিটা খুব ভাল জানতেন, পড়াতেন।

ইংরেজিতে দুর্বলতা অনুভব করছিলাম।স্যারকে সরাসরি বললাম, আমাকে প্রাইভেট পড়াবেন কিনা? তিনি যেন আসমান থেকে পড়লেন।আমার কাছে ত কেউ প্রাইভেট পড়ে না!বললাম - আমি পড়ব।শুরুর দিকে স্যার ক্লাসের মতই রাশভারী থাকতেন।ভেতরে চপল স্বভাবী আমার এতে হাঁসফাঁস। স্যার বোধ হয় টের পেলেন।তিনি ধীরে ধীরে তার মনের অর্গল খুলে দিলেন।তাতে এক আশ্চর্য জগতের দেখা মিলল।

স্যার হাসতে শুরু করলেন।গাল ছড়িয়ে দেয়া মধুর সুন্দর সে হাসি।দেখে মুগ্ধ হয়ে ভাবি এভাবে স্যার কেন হাসেন না! একসময় আমরা সহজ হই।নানা কথা জিজ্ঞেস করি।স্যার আমলকী খেতে দেন।আর খাবি? স্নেহ নিয়ে জিজ্ঞেস করেন।বুঝলাম আমার প্রতি স্যারের মন নরম হচ্ছে।তাতে অবশ্য ভয় পুরোপুরি কাটেনি।মারদাঙ্গা ভাবমূর্তির কথা ত মনে ছিলই।ভাবতাম কোনদিন না আবার আমার উপর চড়াও হন।একদিন তেমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হল।আমি আগেভাগেই কেঁদে দিলাম।স্যার আমার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন। তারপর বললেন,তুই বসে বসে কাঁদ ত!আমি দেখি!! স্যারের কথা শুনে কান্না থামিয়ে ফিক করে হেসে ফেলি।স্যার সাথে হো হো করে হেসে দিলেন।শিশুর মত নিস্পাপ সুন্দর হাসি দেখে স্যারকে মন থেকে ভালবেসে ফেললাম।

সুন্দর সময় কাটতে লাগল।স্যারের সাথে প্রতিটা সন্ধ্যা হয়ে উঠলো মধুময়।পড়া শেষ হলে মনে হত এতক্ষণ কোন এক অজানা ঘোরে ছিলাম, এখন বাস্তবে ফিরেছি। ঘোরের ভেতর দিয়ে স্যার আমার কাছে একটু একটু করে স্পষ্ট হতে থাকেন।

স্যার খুব দ্রুত লিখতেন এবং হাতের লেখা ছিল চোখা।একদিন হঠাত করে দেখি তিনি ''অ '' গোল করে লিখছেন। আমি সাথে সাথে একটা বাক্য বললাম।স্যার এখন যেভাবে লিখলেন সেভাবে লিখেন ত দেখি।স্যারের লেখা শেষ হলে বিস্মিত হয়ে কিছুক্ষণ লেখাটার দিকে চেয়ে রইলাম।হাতের লেখা এত সুন্দর হয় কিভাবে! স্যার আপনি এভাবে লিখেন না কেন?কি বিতিচ্ছিরি করে লিখেন!! আমার প্রশ্নে যেন স্যার সুদূরে চলে গেলেন।মুখে বিষাদরেখা দেখা গেল। আনমনে বললেন, লিখি!? লিখি না কেন?সুন্দর করে লিখলে কি হয় বল ত? অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম।স্যারের কথাগুলো আজো মনে বাজে।

স্যার ধনী পরিবারের ছেলে।জমিদার বংশ।কথায় কথায় বুঝলাম স্যারের যেটুকু সৌখিনতা দেখছি, তা মূলত ধ্বংসাবশেষ।স্যার হেসে হেসে বললেন,জীবনে কত যে পাগলামি করেছি।আবাহনী-মোহামেডানের খেলা দেখার জন্য ঢাকায় চলে যেতাম।হোটেলে রাত কাটাতাম।মঞ্জু, নান্নু,আসলাম, সালাউদ্দিন এরাই হল জাত খেলোয়াড়।নানা কথা বলতে বলতে স্যার আচমকা নিরব হয়ে যেতেন।
যেন হ্যামিলনের বাশিওলায়া চট করে বাশি বাজানো বন্ধ করলেন।

স্যারের নানা কথায় মানুষ চিনবার চেষ্টা করি।ক্লাসে টিচার একদিন একটা গল্প বললেন।একজন শিক্ষক পাঠশালায় তার ছাত্রদের ''গোলে মালে যাউগগই দিন '' এটা মুখস্ত করতে দিয়ে চলে যেতেন।পরে সন্ধ্যায় এসে ছুটি দিয়ে দিতেন।একদিন ইন্সপেক্টর এসে এই অবস্থা দেখে ছাত্রদের বললেন,আমি একটা নতুন পড়া দিচ্ছি , তোমরা এইটা মুখস্ত কর। ইন্সপেক্টর শিখতে দিলেন, ''ইইং করি খাবি কয়দিন!''সন্ধ্যায় এসে ছাত্রদের নতুন পড়া মুখস্ত করতে দেখে শিক্ষক অবাক হন।ইন্সপেক্টর এসেছে জানতে পেরে শিক্ষক বুঝে নেন - এবার তার খেলা সাঙ্গ হয়েছে।গল্পটি নওশাদ স্যারকে বলার পর তিনি হো হো করে হাসলেন।বললেন, যিনি গল্প বললেন তিনি নিজেই ত ক্লাসে ঠিকমত আসেন না, ফাঁকি দেন। তখন একটু বিস্মিত হলাম। মানুষ এমন কেন? গল্পটি বলার সময় তার নিজের কথা মনে হয়না?স্যারের নানা কথায় শিক্ষকদের মনের হাঁড়ির কথা জানতে পেরে তাদের প্রতি আমার আস্থা ও শ্রদ্ধা উবে যেতে থাকে।

তার সোজাসাপ্টা কথায় শত্রু বাড়ছিল। সিনিয়র ছাত্ররা তার উপর ক্ষেপছিল।পলিটিক্সে ইন থাকা ছাত্রদের চোটপাট তিনি সহ্য করতেন না।সোজা ধমক দিতেন।বলতেন ধান্দাবাজি। বিশেষ করে ধর্মভিত্তিক দলগুলার ত আরো না।আমরা সবাই গরম হাওয়া টের পাচ্ছিলাম।একদিন স্যারকেও কিছু কথা ইঙ্গিত করে বললাম।কারণ স্যারকে ঘিরে কিছু পরিকল্পনার কথা আমাদের কানে আসছিল।শুনে স্যারের কোন বিকার নেই।হেসে উড়িয়ে দিলেন।বললেন,এইসব ঘুঘখোরদের পোলাপাইন আমার কিছু করতে পারবে না।আমি টাকার জন্য পড়াই না।

তা বিলকুল বুঝতে পারতাম।কিন্তু এটাও টের পেয়েছি- কোন এক অজানা অভিমানে স্যার এখানে চুপচাপ পড়ে আছেন।এটা তার ক্ষেত্র নয়। দুনিয়া অনেক খারাপ।আমি যা বুঝি স্যার কি তাও বোঝেন না?স্যার বোকা নন।কিন্তূ কুছ পরোয়া নেহি ধরণের লোকেরা বিপদ আমলে নেয় না।

সন্ধ্যায় তাই এসবের কোন আঁচ থাকে না।আমরা আমাদের মত দিন কাটাতে থাকি। একদিন স্যারকে জিজ্ঞেস করলাম,কলকাতার লেখকদের বই এত ডাউস সাইজের,আমাদের লেখকদের তেমন বই নেই কেন? উত্তরে স্যার বললেন, হুমায়ূন কবির এর একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন।তিনি বলেছিলেন,এদেশের মানুষের জীবন কাটে ভাঙ্গা- গড়ায়,উত্তেজনায়।নদী,বন্যা জলোচ্ছ্বাস,ঘূর্ণিঝড় এসে ঘর ভেঙ্গে দিয়ে যায়।মানুষ আবার ঘর বাধে।আবার ভাঙ্গে।তাই মানসিকভাবে সুস্থির হতে পারেনা এই বাংলার লোক।নিরাপদ ঘেরাটোপে থাকা মধ্যবিত্ত শ্রেণিও দাড়ায়নি।তাই কাঙ্ক্ষিত সাহিত্য হচ্ছে না।

স্যার আমাকে বলেছিলেন, বড় হলে লরেন্সের উপন্যাস যেন পড়ি।তলস্তয় পড়ছি জেনে বললেন,বড় হয়ে যেন আবার পড়ি।এখন অনেক কিছু বুঝব না। স্যার উপদেশ দিয়েছিলেন- সব কথা যেন সবাইকে না বলি। সব কথা সবাই বুঝে না।নিজেকে প্রকাশ করার আগে ভেবে নেবে,প্রকাশের ক্ষতি তুমি সইতে পারবে কিনা। সবচেয়ে মুগ্ধ হয়েছি স্যারের সুন্দর পরিচ্ছন্ন পবিত্র মনের দেখা পেয়ে।একটুও কলুষতা নেই। যারা সর্বক্ষণ তার অমঙ্গল কামনা করেন,দিন রাত ২৪ ঘন্টা যারা তার মুণ্ডুপাতের চেষ্টারত,তিনি তাদেরও, তাদের অগোচরে কল্যাণ কামনা করেন,গোপনে উপকার করে দেন।স্যারের মনমন্দিরে সারাদিনের কর্মকাণ্ডের কোন প্রভাব লক্ষ্য করতাম না।

স্যার মাঝে মাঝে খুব বিষণ্ণ হয়ে যেতেন।তিনি খুব দামী আংটি পরতেন। একদিন দেখলাম খুলে ফেলেছেন।ধীরে ধীরে শেভ করার হার কমে যাচ্ছে। কেন কিছু বলতেন না।তবে উনার কথার ধাঁচে বুঝতাম তিনি নিজেকে কোথাও মানিয়ে নিতে পারছেন না। মাঝে মাঝে বলতেন - আমরা আসলে তোদের সাথে প্রতারণা করছি। কিছু শিখাচ্ছিনা। শিখাতে চাইলেও শেখানো যাচ্ছে না।অনেক সময় তোরাও নিতে পারছিস না।গ্রহণের পরিপক্কতা তোদের নেই। এজন্য আমরাই দায়ী।জমিদার বংশের ছেলে আমি। রাগ কন্ট্রোল করতে পারিনা।
অন্যায় দেখলে মাথা গরম হয়ে যায়।আমার দাদা ত বন্দুক দিয়ে ডাকাত মেরেছেন।আমাকে চোর ডাকাত সব সহ্য করতে হচ্ছে।

স্যারের পরিচর্যায় ইংরেজিতে উন্নতি লাভ করতে শুরু করি।আমার মুখে স্যারের সুনাম শুনে এবার আমার সাথে আরো দু তিনজন যোগ হল।একসময় স্যারের সাথে আমার কাটানো সন্ধ্যাগুলো শেষ হয়। স্যারের প্রফুল্ল মুখখানি বুকের অ্যালবামে ভরে রেখে আমি আরেকটু উপরে ওঠার অভিযানে নেমে পরি। এরপর অনেক দিন কেটে গেছে। তারপর একদিন- যা আশংকা করতাম তাই হল।

লিখতেও রুচিতে বাধছে এমন একটি মিথ্যে অভিযোগে স্যারের সম্মানহানি করা হয়।আর এই সুযোগে কিছু স্যারের গ্রীণ সিগ্ন্যাল পেয়ে ছাত্র নামের পলিটিক্যাল বর্বরগুলো রাতের অন্ধকারে একাকী নওশাদ স্যারের উপর হামলা চালায়। স্যার যাতে আজীবন কষ্ট পান সেভাবে - শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঘাত করা হয়।আবার এই হামলাকারীদের গডফাদাররাই হয় বিচারক। তারা জানত নওশাদ স্যার নিজে থেকে চলে যাবেন। তাই হল।এসব শুনেছি ঘটনা ঘটে যাবার অনেক দিন পর।

স্যারের কিছু হবে জানতাম,কিন্তু এতটা হবে , এ লাইনে হবে বুঝতে পারিনি।স্যার মনের পবিত্রতায় গরীয়ান। তাই শয়তানদের কাদামাটি লেপ্টে দেয়া সহজ হয়েছে।

জানিনা আর কোনদিন স্যারের সাথে দেখা হবে কিনা। না হলেও দুঃখ নেই। ভুল সময়ে ভুল জায়গায় চলে আসা মানুষ - একথা স্যার প্রসঙ্গে বলার কোন সুযোগ নেই। তিনি মিসফিট।তার সুন্দর হস্তাক্ষরে পৃথিবীর কিছু আসে যায় না।

আত্মকথন - গতম , আমি, আমরা ।
ছোট শিব্রাম বাড়ি থেকে পালিয়ে কলকাতায় এসেছিলেন।বালক চোখে দেখা জীবনের সেই রুপ বোধ হয় বড় দুর্বিষহ হয়ে মনে দাগ কেটেছিল। নয়ত কেনই বা বাস্তবকে আড়ি দিয়ে শিব্রামের আমরণ স্বেচ্ছাশিশু থাকা?মেসে জীবন কাটিয়ে দেয়া?
আজকালকার ছেলেপিলেরা পালাতে ভুলে গেছে বোধ হয়। প্রাকৃতিক স্বাধীনতার গোপন আবাহন হয়তবা তাদের রক্ত উদ্বেলিত করে না।বজ্রকঠিন শৃঙ্খলে তাদের আটঘাট বাঁধতে সফল হয়েছি আমরা। তবু কেউ কেউ এখনো পালায়।সংখ্যাটি অঙ্গুলিমেয়।

আমি রঞ্জুকে পালাতে দেখেছি।শুনেছি আমার পিতাও পালিয়েছিলেন।দুবার।ফাইভে আর এইটে। আমিও চেয়েছি। রাতে বলেছিলাম,,কাল সকাল আট্টায় ঘুম থেকে উঠবো। কিন্তূ সাতটা তেপ্পানো মিনিটে ডাক দেয়া হলো। রাগে দুখে ঘোষণা দিলাম চলে যাব।
মুখ ধুয়ে বেরিয়ে গেলাম।রাস্তায় হাটছি। দোকানদার জিজ্ঞেস করল কই যাচ্ছি? আমি বললাম একেবারে চলে যাচ্ছি। হাটতে হাটতে রাস্তার এক জায়গায় দাঁড়িয়ে গাড়ির চলাচল দেখছিলাম।এভাবে কতক্ষণ ছিলাম মনে নেই। হঠাৎ দেখি বাবা এসে কাধে হাত রাখলেন।বাসায় নিয়ে যাওয়ার পর মার হাতে এয়সা মার। এ মারের গূণে কিনা জানি না, আর পালাবার কথা মনে হল না কখনো।

গতম , যার ভাল নাম গৌতম , তার ছল করে এসব বলে নিলাম - অন্যভাবে বলা যাবে না বলে। ঠিক কিভাবে গতমের সাথে প্রথম পরিচয় হয়েছিল তা আজ মনে নেই। ওরা ছিল সাত ভাই চম্পা।গতমের সিরিয়াল পাঁচ।রঞ্জু তিন। মেধাবী ছাত্র রঞ্জু হঠাত পালিয়ে গেল।
বাংলাদেশ তন্ন তন্ন - কোথাও রঞ্জু নেই। তারপর রঞ্জুর দাপুটে চঞ্চল মা নির্জীব শায়িত হয়ে গেল। মাঝে মাঝে ক্লান্তিকর তাপদুপুরে সুরলাগানো কখনো বা দমফাটানো বিলাপ।রঞ্জু ! রঞ্জুরে! কি হতে পারে রঞ্জুর?গুঞ্জন - রঞ্জুকে ফুসমন্তর দিয়ে নিয়ে গেছে কেউ।পরিচিত এক আন্টির দিকে আঙ্গুল শানালো রঞ্জুর মা।আমি মাঝে মাঝে ভাবতাম এত ছেলে থাকলে এক রঞ্জুর জন্য এত কান্নার কি মানে!

রঞ্জু এল আড়াই বছর পর। জানা গেল রঞ্জুকে নদী ডেকেছিল। নদীমাতার ডাকে রঞ্জু ঘুরে বেরিয়েছে রঙ রসিয়া ঘাট। চঞ্চল রঞ্জু এইবেলা কেমন গম্ভীর , শান্ত হয়ে গেল। তবে এর ভেতরে - ছাইছাপা হুতাশন টের পাচ্ছিলাম । যে কোন দিন লকলকিয়ে....... কিন্তু কখন? কোথায় ? তা জানতাম না ।

গতম এর উল্টোটা। ভেতরে যেন রেগেই আছে।ছোয়া পেলে তেতে যাওয়া অগ্নিদানব। প্রতিদিন কারো না কারো সাথে আছেই। হয় মারো নয়ত মার খাও।এর ভেতরে কিভাবে কিভাবে যেন তার সাথে মিলে গেল জানি না।
কিরে তুই কয়টা ছেলেকে মারতে পারবি? মাঠে খেলারত ১০ ছেলের দল দেখিয়ে গতম জিজ্ঞেস করে। আমি তখন বেশ ভগ্নসাস্থ্যের। ধাক্কা পেলে মক্কা যাব অবস্থা। গুণে দেখলাম ৭ জনই আমাকে পিটিয়ে ছাতু বানাবার ক্ষমতা রাখে! আমি বললাম তিন জন ! গতম হো হ করে হাসে /। মাত্র তিনজন ! আমি ৯ জনের সাথেই পারব । এগুলা একটাও আমার সাথে পারবে না । দেখ আমার বডি! এই বলে
গতম হাতের পেশী ফুলিয়ে দেখায়। গতম এম্নিতেই আমাদের চেয়ে ২ ইঞ্ছি লম্বা। শুকনো কিন্তু শক্তিশালি কাঠামো। চওড়া কাধ ও চোয়াল। গতমের সাথে বন্ধুত্ব হওয়ায় বড় বাচা যে বেচে গেছি তা কিছুদিনের মধ্যে বুঝতে পারলাম - নানাজনের মুখ ওশরীরের জিওগ্রাফি চেঞ্জ হতে দেখে।
তাই বলে গতম কিন্তু এম্নে এম্নে মারেনা।ক্রিকেট খেলায় অন্যায় ভাবে আউট দিবি , ফুটবল খেলায় ল্যাং দিবি। রেডি খেলায় টান দিয়ে শার্ট ছিড়ে ফেলবি আর গতম আঙ্গুল চুষবে? ইম্পসিবল!! বাসায় যেত বিচার। মেরে কেটে গতম কি আর সিনে থাকে!
এম্নিতে গতম কিন্তু সোশ্যাল।পাড়ার আন্টিদের বাজার করার , দোকানে যাওয়ার কেউ নেই,গতমকেই বললেই করে দেবে।এমন কি অনেক সময় বলাও লাগতনা , সে আচ করতে পারলেই হত। কাউকে অন্যায়ভাবে মার খেতে দেখলে, মারামারি দেখলেই গতম নিজ উদ্দেগে এগিয়ে যেত।অনেক সময় এমনও হত্, অই দুই গ্রুপের বিবাদ মিটাতে গিয়ে দুদলের তরফেই মার খেয়ে আসত। মানা করতাম। তবুও যেত। হাসত , বলত - শালারা একেকটা পাগল!
আমরা এক দলে খেলতাম। এক সাথে মার দিতাম। এ সময় আমরা নানা পরিকল্পনা শুরু করি।
জাবেদ নতূন আসছে পাড়ায়।কিন্তু আমাদের সাথে কথা বলে না তেমন। মানে দাম দেখায়।গোলাপি রঙের জ্যাকেট পরে ঘুরে পকেটে হাত ঢুকিয়ে ঘুরে বেড়ায়। গতমের জ্যাকেটের কালার ফ্যাকাসে সাদা , আমার সবুজ। দুজনের টা একটু ঢোলা । জাবেদের টা
বডি ফিট । ফলে তাকে খুব সুন্দর দেখায়।
গতম দাত চেপে বলে- ফুডাই দেহাদ্দেনা ( ফুটানি দেখাস ! )
ইতারে মারন পরিবদে! - গতম ঘোষণা দেয় ।
অয় , বাড়ি গিয়িগুই ইতায় ! আমিও তাল মিলিয়ে বলি ।
ঘোষণা ছাড়াই আমরা ঝাপিয়ে পরি এবং আশ্চর্য এর পরেই জাবেদকে আমরা বন্ধু হিসেবে পাই। বুঝতে পারি জাবেদ হচ্ছে একটি সুন্দর বান্দরের নাম। এভাবেই দিন কেটে যাচ্ছিল। বড় হচ্ছিলাম। খেলা খেলা এবং খেলা। আমার মা খুব বিরক্ত হয়ে যেতেন। এত খেলা বের করব তোর। হুঙ্কার।তবে আমাকে বাধ দিতে পারেন নি। ঠিকই পাখা মেলতাম।

আমরা তিনজন এক দলে ক্রিকেট খেলি। আমি জাবেদ ওপেনার । গতম ওয়ান ডাউন। জিতে গেলে গতমের অনাবিল হাসি আর হেরে গেলে খিস্তি দেখে কে! তবে সময়ের সাথে সাথে আমাদের পারফর্মেন্স ও ভাল হচ্ছিল। একসময় কিভাবে কিভাবে নিজেকে ক্যাপ্টেন পদে দেখতে পেলাম!আর প্রতিদন্ধি হিসেবে পেলাম মিঠুনকে ( চুপ সালেহ)।

আমাদের মধ্যে কে সেরা তা নির্ধারিত হবার জন্য দুটা ম্যাচের আয়োজন করা হল। প্রথম ম্যাচ ছিল আমিময়। আমরা বিশাল স্কোর করি।আর তার জবাবে একের একের পর এক আউট হয়ে মিঠুনের দলের শোচনীয় পরাজয়। আমার দলে আমি সেরা পারফর্ম করি আর তার দলে সে।আমি ম্যান অব দ্যা ম্যাচ হই।
এবার দ্বিতীয় ম্যাচ। পা ভাঙ্গা থাকায় গতম খেলবে না। প্রথম ওভার আমি করি ১ উইকেট তুলে নিয়ে ১ রান । দ্বিতীয় ওভার থেকে শুরু হয় তাণ্ডব। দ্বিতীয় ওভারের দ্বিতীয় বলে ডাউন দ্যা উইকেটে এসে রাসেল ছক্কা মেরে যে সুনামির উদ্ভব ঘটায় তার জোয়ারে আমরা ভাসে যেতে লাগলাম।মাত্র সাত ওভারে ওদের স্কোর ৭৯ হয়ে গেল। মিঠুন ৪৯ । সত্যি বলতে কি মিঠুন সুন্দর স্বপ্নের মত খেলছিল।সাঙ্গাকারার ধাচ ছিল তার খেলায়। আর ঠিক তখনই আমার বল ডান দিকের ষ্ট্যাম্প ছুয়ে গেল।আউট! কিন্তু বেল পরেনি । ক্রিকেটীয় আইন মতে এটা আউট না। কিন্তু মিঠুনের যে আউট হতেই হবে। কারণ যে মাঠে খেলা হচ্ছিল সে মাঠে আমাদের কেউ ৫০
করতে পারেনি।আমার সরবচ্চ ছিল ৪৪.মিঠুনের আগেও একটা ৪৯ ছিল এই মাঠে । আমার স্বপ্ন ছিল আমাদের মধ্যে আমি প্রথম ৫০ করব।সেই সপ্ন ত আর ভেস্তে দিতে পারি না! তার উপর আমাদের মাঠ । বেশ হট্টগোল বেধে গেল। আমার যুক্তি এটা আমাদের মাঠের নিয়ম। আমরা এই নিয়মেই খেলি!এবার গতম মুখ মেলালো।এইটা আউট!! খুব কষ্টে মিঠুন ব্যাটের হ্যান্ডল থেকে হাত ছাড়িয়ে নিল। যাই হোক এই সলিড ফাউন্ডেশনের উপর ভিত্তি করে ১৫ ওভারে ওরা ১৬০ রানের স্কোর করে বসল। জবাবে আমাদের শুরুটা হল স্বপ্নময় ।প্রথম বলেই জাবেদের সিক্স । ৩য় বলে আরো একটা । শেষ বলে আমার। প্রথম ওভারেই ২০ রান। কিন্তু ২য় ওভা্রেই সুখস্বপ্ন শেষ।আমার ভুলের কারণে জাবেদ রান আউট হয়ে গেল/।মাত্র ৪১ রানে ৪ উইকেট। ৫ম উইকেটে জুনিয়র সাইয়িদ কে নিয়ে দেখেশুনে খেলতে শুরু করলাম।৬ , ৭, ৮ ওভারে বুঝতে পারলাম আজ আমার দিন। বল ব্যাটে সুন্দরভাবে আসছিল।যেভাবে চাচ্ছিলাম যেভাবে খেলতে পারছিলাম।কয়েকটা সুন্দর শটে হাত তালি পড়ল। ৯.৩ বলে চার মেরে ৪৫ থেকে ৪৯ এ চলে আসলাম।দলের রান ৮৭।হঠাত একটা সুখের বাতাস পুরা শরীর বুলিয়ে দিল। এই মাঠে প্রথম ৫০ আমার হতে যাচ্ছে। ৫০ হবার পর কিভাবে উদযাপন করব ঠিক করে ফেললাম। এই ম্যাচ আমাদের, আমরা আমাদের মাঠে হারতে পারি না। আর ঠিক তখনই ম্যাচের প্রথম পর্বের পুনরাবৃত্তি হল।মিঠুনের বল অবিকল আমার বলের মত ডান পাশের ষ্ট্যাম্প চুমু দিয়ে গেল,বেলের নজর এড়িয়ে। বলটা উইকেট কিপারের হাতে যাওয়া মাত্রই মিঠুন নীরবে আমার দিকে তাকাল। আমিও বিনা বাক্যব্যয়ে ব্যাটের হাতল হতে হাত ছাড়িয়ে নিলাম।খুব কষ্ট হচ্ছিল। একেই বলে আল্লার মার। নিজের আইনে নিজেই ফেসে যাওয়া। ৫ম উইকেট হিসেবে আমার পতনের পর ম্যাচে হারাটা সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল । তবুও নিজেদের মাঠে হার এড়াবার জন্য আমরা প্রানপণ লড়লাম। লাভ হলনা । একদম শেষ দিকে আমাদের হার্ড হিডার মুরাদের
বিশাল ২টা ছক্কা কেবল হারের ব্যবধান কমালো।ম্যাচটা আমরা ৩০ রানে হারি।
এতদিন পর এত খুঁটিনাটি মনে থাকার কথা নয়। মনে আছে মিঠুন ও নিজে বঞ্চিত হবারকারণে, মনে আছে গতমের কারণে।খেলতে না পেরে তার কি আফসোস।বার বার বলছিল আজ যদি খেলতে পারতাম। আমাদের প্রতিটা ছক্কা চারে সিঙ্গেলে তার উল্লাস , আনন্দ আমাদের কোণঠাসা সময়ে তার মাথার চুল ছেড়া মনে রাখার মত।ম্যাচ হারার পর ওর চোখে পানি চলে এল।নিজেদের মাঠে হারার ব্যাপারটা মেনে নিতে পারছিল না।

আমরা এভাবেই মিলে মিশে বড় হচ্ছিলাম। বড় হবার পথে যে মানসিক পরিবর্তন ঘটে, তা সবার একলয়ে ঘটে না।বিচিত্র জীবন্ অভিজ্ঞতায় গতমের দ্রুত ঘটছিল।ওদের মা বাবার বনিবনা ছিল না।যদিও ওর বাবা ভালই টাকা কামাতেন,কিন্তু অশান্তির দরুণ মদ খেয়ে -আজেবাজে পথে উড়াতেন।
একদিন গতম বলল, চল! পিস্তল ভাড়া নিয়ে ডাকাতি করি। স্বর্ণের দোকান।অনেক অনেক টাকা পাবো!
রোমাঞ্চিত হলাম। বললাম কিভাবে?
সবার আগে ওষুধ খেয়ে চোখ লাল করতে হবে।খাওয়ার ৩০ মিনিট পরে শরীরের সব রক্ত চোখে চলে আসবে।তারপর দোকানে গিয়ে পিস্তল বের করা মাত্রই কাজ হয়ে যাবে ! গুলিও ভাড়া পাওয়া যায়। প্রতি বুলেট আশি টাকা।
এবার ভয় পেলাম। আব্বার কথা মনে পরল। ডাকাতি করতে গিয়ে যদি ধরা খাই তাইলে আমার আবা পিটিয়ে আমাকে তক্তা বানিয়ে ফেলবেন। এই প্রথম গতমকে এড়িয়ে চলার কথা মাথায় এল। ওকে বললাম,এসব বাদ দে।সে উত্তেজিত্ হয়ে গেল। আমার বাবা বাসা ভাড়ার টাকা দিতে পারছে না । বাড়ীওলা শাসিয়ে গেছে।
তুই হলে কি করতিস ?
জবাবে মুখে কিছু এল না। সে বলল যা আসতে না চাইলে নাই কিন্তু কিছু টাকা দিস পরে তোকে লাভ সহ দিয়ে দেব। কিন্তু আমার হাতে তেমন টাকা থাকত না। গতমকে বললাম ঈদের বকশিশ পেলে তোকে কিছু দিতে পারব । গতম বলল তাই সই।কিন্তু ঈদের দিন পালিয়ে পালিয়ে থাকলাম যাতে তার সাথে দেখা না হয় । ভাগ্য খারাপ দেখা হয়ে গেল টাকা ও দিতে হল!

সে শেষতক ডাকাতি করেনি।তবে জীবনঅভিজ্ঞতা ও পড়াশোনায় পরিবর্তিত হচ্ছিল। গরীব দুখি অসহায়দের প্রতি হাত বাড়িয়ে দিচ্ছিল।আর পাড়ার গজিয়ে উঠা নব্যকিশোর মাস্তানদের সাথে তার টক্কর লাগছিল। একদিন একটার সাথে টক্কর খেয়ে অঝোর ধারার কাঁদল।বলল, ওকে আমি একদিন মেরে ফেলব। যদি সে তোদের মসজিদের ভেতর লুকিয়ে থাকে সেখান থেকে ওকে টেনে আনব।সেই প্রথম ওকে কাঁদতে দেখলাম ।সেই শেষ। এসব টক্করবাজি চলত যখন আমি তার সাথে থাকতাম না।

আর আমি থাকলে অন্য নিয়ম।আমরা একসাথে ভিডিও গেমস খেলতাম।কখনো কখনো অনেক দূরে চলে যেতাম। যেখানে তখনো পর্যন্ত নগরায়নের হাওয়া লাগেনি।তার শক্তি , সাহস ,আবেগ, বোহেমিয়ানায় দিনকে দিন মুগ্ধ হচ্ছিলাম।একদিন ভিডিও গেমসের দোকানে ঝগড়া লেগে ওখানকার দোকানী ছেলেকে এক হাতে গলা চেপে শুন্যে তুলে ফেলল। ঐ ছেলের দুটি পা শুন্যে ছটফট করতে দেখে মনে হল - এর চেয়ে সুন্দর শিল্প আর কি হতে পারে! এই সুন্দর নন্দিত চিত্র আমার ভেতরও তেমন কিছু তৈরি করতে উৎসাহ যোগাল।একদিন করেও ফেললাম। সিনেমায় দেখেছিলাম পুরো শরীর দু হাতের মাঝখানে নিয়ে হাটুর চাকতি দিয়ে নায়ক শত্রুর মেরুদণ্ড বরাবর যে শক্তিপ্রয়োগ ঘটায় , তার দাপটে মেরুদণ্ড মাঝবরাবর ভেঙ্গে যায়।ভিডিও গেমসের দোকানে আমিও তেমনটা করতে গিয়ে শেষতক ছেলেটার প্রতি মায়া জন্মে। দু হাতে তার পুরো শরীর ধরে রেখে ভাবি এখন কি করিব? শেষতক সুন্দরভাবে মাটিতে শুইয়ে দেই।তাতেও ছেলেটার কি কান্না !

সময় এগিয়ে যাচ্ছিল। বেগবান হাওয়ায় গতম প্রতিবাদী হচ্ছিল। চলতি স্রোতে কোথাও কোথাও আমিও। পাড়ার নেতা সাধের ব্যাট কেড়ে নিল।অস্ত্রের দাপটে কেউ কেউ কেবল মারতে বাকি। পাড়ার বড় ভাই ডেকে নিয়ে আর্মস দেখালো। আমরা বিস্মিত। এটা হাতে নিলেই পাওয়ার? কেউ কেউ অপঘাতে মারা গেল। কেউ পুকুরে তলিয়ে। পাড়া ছেড়ে গেল কেউ কেউ। কেউ নিখোঁজ ত কেউবা পালিয়ে। ফাঁকতালে উথাল পাতাল দুলছিলাম।কখনো ক্রোধে উত্তাল,কখনো নিরাবেগ শান্ত উদাসীন।হ্যা,অনেক অবজ্ঞা অবহেলা পাচ্ছিলাম। একদিন শিক্ষকের কথায় চোখে পানি চলে আসল।আমি ফার্স্ট সেকেন্ড থার্ড হতে চাইনা। ইটস মাই চয়েজ। ফার্স্ট সেকেন্ড থার্ডওলাদের আমি সোজাসুজি ঘৃণা করি। এরা কৌশলী। চকচকে সার্টিফিকেট আর জব ছাড়া ওদের বেশিরভাগের কোন অর্জন নেই।এরা জীবন দেখেনি।বুঝেনা।এদেরকে মানুষ নামের অবোধ জন্তু ছাড়া ভাবতে পারিনি। যেভাবে লিখলাম তার কাছাকাছি একটা ধারণা আমার মনে তখন থেকেই ছিল।সেই বলে কিংবা বলা যায় সেই বিশ্বাসে আমি এসব কখনো ভাবিনি। মাথা ঘামাইনি। পরোয়াই করিনি,করিনা।কিন্তু এসব কথা কাকেই বা বলা যায়। প্রকাশ্যে বড় উদ্ধত দেখায়। অনেক কষ্টে বললাম, চাইলেই হতে পারি।স্যার বললেন, প্রুভ ইট।অন্তত আমার সাবজেক্টে দেখাও।আমি বললাম,তাই হবে।তবে এর পর আমাকে কিছু বলবেন না।, নিতে পারব না।স্যার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,তাই হবে। তোমার বেপরোয়া খাসলত তোমাকে কষ্ট দেবে।এজন্য দুঃখ হয়।নিজেকে কেয়ার করতে শিখ।তখন এসব ভাবতে আমার বয়েই গেছে।

তখন কষ্ট পাচ্ছিলাম।এখন জানি- এই পৃথিবী।এই হয়। এই ঘটে। শুধু পোশাক বদলায়।আর সবশেষে সময়ের বুলডোজারে সব গুড়ো হয়ে যায়।

নানারকম শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে চলতে চলতে ধীরে ধীরে একা হচ্ছিলাম। কিংবা বলা যায় চলতি স্রোত থেকে বিছিন্ন হচ্ছিলাম। আমার ভাল চায় বলে গতম দূরে সরছিল। যেভাবে আমাকে আগেও আগলে রেখেছিল। তখন বুঝিনি। তখন জানতাম না এই দূর একদিন দূরত্ব হয়ে যাবে। আমার ফিজিক্স ,বায়োলজি, বাংলা ব্যাকরণ, সাহিত্য ভাল লাগছিল। এই ধরণের লোকদের পরবর্তীতে পলায়নবাদী নামে ডাকতে শুনেছি।
গতম অনেক কিছু জেনেছিল।তবু দুটো জিনিস শিখতে পারেনি।মানুষ মানুষকে ফাঁদে আটকায়। মানুষ মানুষকে খাঁদে ফেলে দিয়ে আনন্দ পায়।তার মূল্য গতমকে চুকাতে হয়েছে।

নদীর স্রোতের মত বহে জীবন জলধারা। তাতে কত ঘাট,কত ঘটনা,কত রহস্য,কত দুঃখ, কত আবেদন। বয়ে যেতে যেতে আমরা একদিন মহাকালে ঝাপ দেবো। উত্তাল ও নিরাবেগ ঘূর্ণিপাকে বিলীন হবার আগে নিজেদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গল্পগাথা কি মহৎ কি বিরাট।যেন আমরা সবাই রাজা।সময়ের সিংহাসনে বসা মহাজন আড়ালে নিশ্চয়ই মুচকি হাসেন।

তবু,গতম আর আমার এক ঘাটে থাকাকালীন সময়ের দিকে তাকিয়ে দেখতে পাই, একটি হাসিমাখা মুখ আমার দিকে তাকিয়ে। প্রশান্ত হাসি নয়,কিন্তু ভালবাসা আর আবেগে জ্বলজ্বল।কেনরে, কি দেখেছিলি তুই আমার মাঝে?তোর ত কোন বন্ধু ছিল না। কেউ সাততলায় আর কেউ গাছতলায় - তা হয়না, তা হয়না।তোর আর মাহফুজের মত আর কাউকে এত জোর দিয়ে,শরীরের সমস্ত জীবনীশক্তি ও বিশ্বাস নিয়ে এ কথা বলতে দেখিনি। খুব চেয়েছিলাম মিশে যেতে। তোরা ভালবেসে এড়িয়ে গেছিস। জীবনের কোন কোন বিন্দুতে আমি তোদের চেয়ে অনেক অনেক খাটো। তোদের অনেক ভালবাসি- সময়মত বলতে পারিনি। তোদের সাথে কত শত সৃতিপট ।
যে সব ছবি বাস্তবে কখনোই আঁকতে পারব না।

লেখাটির এ পর্যায়ে মন বিষণ্ণ হয়ে গেল।। তাইএখানেই, যতি চিহ্ন একে দিচ্ছি।
( চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই মার্চ, ২০২২ রাত ১২:৫১
৪০টি মন্তব্য ৪০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×