( গল্পের নামটা মাহমুদুল হকের বই থেকে নেয়া হয়েছে)
মাজারে এসে পরিচিত এক ফকিরকে খুজছিলাম।কয়েক বছর ধরে উনাকে এখানে দেখছি।বয়স ৬০ এর বেশি হবে ,কপালে নামাজের কালো দাগ, থুতনিতে দাড়ি, চেহারায় উদাসী উদাসী ছাপ আছে। দেখলে বোঝা যায় নিয়মিত নামাজ পরেন।নামাজি ভাবটাই সবচেয়ে দরকারি। পই পই করে মার বলা আছে, নামাজ - কালাম পড়ে এমন ফকির আনবি ! আর এসবের উপলক্ষ একটাই - বাবার মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আজ দুপুরে মা একজন পরহেজগার ফকিরকে ভাত খাওয়াবার নিয়ত করেছেন। যাকে খুজছি তাকে দেখলে মা পছন্দ করবেন কোন সন্দেহ নেই। কিছুক্ষণ এদিক -ওদিক তালাশের পর তাকে পেয়ে গেলাম। খাওয়ার কথা বলতেই তিনি কিছুক্ষন উদাস হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর মাথা চুলকিয়ে বললেন, কিন্তু বাবা অহন আপ্নের লগে গেলে ত আমার লস!
কথাটা শুনেই বিরক্ত লাগল। আমি বললাম - কেন ?
- অহন গেলে ত ইনকাম করতে পারুম না। দেহেন না কত মানুষ ! তয় আপনে ১০০ টাকা দিলে বিষয়টা ভাইবা দেখতাম পারি !
ওরে আমার ফকির রে! কয় কি শালায় ! মেজাজটাই বিলা করে দিল লোকটা। তারপরও ঝামেলা না বাড়িয়ে তাতে রাজি হয়ে গেলাম ।
- ঠিক আছে , টাকা দিব । চলেন চাচা মিয়া। আমি বললাম।
লোকটা মুখের সব দাত ছড়িয়ে দিয়ে হাসি দিল।আপনের মেহেরবানি বাবা!
বাসায় এনে লোকটাকে বারান্দায় বসতে দিলাম ।ফকির খাওয়াবেন বলে মা আজ গরুর মাংস রান্না করেছেন।গরুর মাংসের কারণে ফকির খাওয়াবার ব্যাপারটায় আমার মন থেকে সায় নেই। কারণ আমার স্কুল শিক্ষিকা মা সামান্য টাকা বেতন পান বলে দুই জনের সংসার সত্ত্বেওপুরো মাসে আমাদের টানাটানি যায়। গরুর মাংস বলতে গেলে কেনাই হয় না। অথচ ফকির খাওয়াবেন বলে মা আজ গরুর মাংস কিনলেন।তাই ঠিক করলাম ফকিরকে ভাত বেড়ে দিয়ে আমি ঘরের বাইরে চলে যাব। ভাত বেড়ে দিয়ে সেভাবেই এগুচ্ছিলাম হঠাৎ গরুর মাংসের বাটিটার দিকে তাকিয়ে ফকিরটা বলে উঠল, ও! ঝোল সিস্টেমে রানছেন ? এইগুলা ঝোল না গাঙের পানি বাবা ?
শুনে মেজাজটা আর ধরে রাখতে পারলাম না। রাগে চিৎকার করে বললাম - উঠ তুই ! খাওনের মায়রে বাপ! আর কোনদিন তোরে এই পাড়ায় দেখলে ঠ্যাং হাতে ধরায়া তোর বাড়িত পাঠাই দিমু! খালি বুড়া মানুষ দেইখ্যা আজ পার পাইলি!
চেচামেচি শুনে মা ঘরের ভেতর থেকে বাইরে এলেন। ততক্ষণে লোকটা ঘরের গেট পেরিয়ে চলে গেছে । সব শুনে মা আমার দিকে চোখ লাল করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তারপর কেঁদে দিলেন।
'একটা কাজ ও ঠিকমত পারিস না তুই , তোকে নিয়ে আমি কিভাবে চলব ! আজ তোর বাবার মৃত্যুবার্ষিকী এই দিনেও তুই ভাল থাকতে পারলি না,গণ্ডগোল বাধাইলি ! ভাতের পাত থেকে বুড়া মানুষটারে তুই উঠাই দিলি! এই লোক যদি তোকে অভিশাপ দেয়, কি হবে তোর?'
- কি হবে ! কিছুই হবে না! ফকিরের দোয়ায় পিঁপড়াও মরে না !
- ফালতু বকিস না । এই লোককে খুজে বের করে মাফ চাইবি উনার কাছে। মাফ না নিয়ে আজ আর বাসায় ফিরবি না ।
মার সামনে দাঁড়িয়ে এমনিতেই অস্বস্তিতে ভুগছিলাম। কথা না বাড়িয়ে সোজা বাসা হতে বের হয়ে গেলাম। রুঢ আচরণ করায় এখন নিজেরই খারাপ লাগছে। মনে হচ্ছে এভাবে না বললেও পারতাম। এসব সাত - পাচ ভাবতে ভাবতে মাজারে আবার ফিরে এলাম। মাজারের এক কোণায় ফকির লোকটাকে দেখতে পেলাম , বসে আছে। একজন বয়স্ক লোক তখন তাকে অতিক্রম করছে। লোকটার যাওয়ার পথে হঠাৎ তিনি দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন , টেকা দে ! বয়স্ক লোকটা তখন হাতের নাগালের বাইরে ঘুরে গিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে এমন সময় তিনি বলে উঠলেন , তোর না মাইয়ার অসুখ !! এ কথা বলার সাথে সাথেই বয়স্ক লোকটা থেমে গেল, ফকিরের হাতটা ধরে অঝোর ধারায় কান্না শুরু করল।
- বাবাগো আপনি আমারে মাফ কইরা দেন ! আমার মাইয়ারে ভালা কইরা দেন! পকেট হতে একটা ৫০০ টাকার নোট বের করে ফকিরের হাতে ধরিয়ে দিয়ে দোয়া চাইল। ফকির লোকটা ততক্ষণে তার আসনে বসে চোখ বুজে বিড় বিড় করছে । তোর মাইয়ারে আল্লায় দেখব, যা! লোকটা চলে যাবার পরও তিনি চুপচাপ চোখ বুঝে রইলেন। ঘটনাটা দেখে আমি খুব অবাক হলাম। লোকটা অলিআল্লাহ্ নাকি? তাহলে ত অনেক বড় বেয়াদবি করে ফেলেছি আমি! ধীরে ধীরে আমি লোকটার পাশে এসে দাঁড়ালাম। কিছু বলার আগেই লোকটা আমাকে বলল - মাফ চাইতে আইছেন আব্বা ?
আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। খেয়াল করলাম ফকির লোকটাকে আমি ভয় পেতে শুরু করেছি। তবু হার মানতে ইচ্ছে হল না।
- আপনি কিভাবে বুঝলেন যে আমি আপনার কাছে মাফ চাইতে এসেছি ?
আমি এমনিতেই এসেছি !
লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল ।
- শুনেন , ঘটনা কি হইছে আমি বলি। আমি চলে আসার পর আপনার মা আপনারে খুব বকছে। তারপর বলছে , যা তাড়াতাড়ি যা উনার কাছে মাফ চাইয়া আয় , নাইলে অভিশাপ লাগব!
- বুঝেই যখন বলেছেন তখন বলেন মাফ করছেন কিনা ?
- বাবা ! আপনারে আমি এক শর্তে মাফ করতে পারি ।
- কি ?
- বাবা ! আমার সাথে আজ রাতে আপনে চাইরটা ভাত খাইবেন। তাইলে মাফ কইরা দিমু।
বলে কি লোকটা? ফকির খাওয়াতে গিয়ে নিজেই ফকির বনে যাওয়ার অবস্থা দেখি! কিন্তু সব মিলিয়ে লোকটাকে ঘিরে কেমন রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি। আগ্রহের খাতিরেই আমি রাজি হলাম। আজ রাতে বাসায় খাব না - ফোন করে মাকে বলে দিলাম। সন্ধায় ফকির লোকটার সাথে মূল শহর থেকে অনেক দুরের একটি আবাসিক এলাকায় এলাম। একেকটা বাড়ির সামনে তিনি কিছুক্ষন দাঁড়ান।তার সাথে সাথে আমাকেও দাঁড়াতে হয়। তারপর আবার হাটতে শুরু করেন। এভাবে ২০ - ২৫ টার মত বাড়ির সামনে তিনি দাঁড়ালেন । এরপর একটা বিলাসবহুল বাড়ির সামনে এসে হাজির হলাম। ততক্ষণে আমার বিরক্তি চরমে।
- ব্যাপার কি? আপনি না বললেন আপনার বাসায় যাবেন? এসব আপনি কি করতাছেন?
ফকির লোকটা রহস্যময় হাসি হাসল।
- বাবা! আপনে একটু সবর ধরেন। সবকিছুরই একটা কারণ থাকে।
ততক্ষণে আমরা একটা বিলাসবহুল বাড়ির সামনে এসে হাজির হয়েছি। আমরা বাড়িটিতে প্রবেশ করলাম । দারোয়ান কে দেখলাম ফকির লোকটাকে সালাম দিতে। এর মধ্যে আমি মনে মনে ঠিক করেছি যাই দেখি চুপচাপ থাকব নিজে থেকে কিছু বলব না । বাড়ির ভেতরটা অনেক সুন্দর । তিনি আমাকে একটা রুমে নিয়ে এসে বসালেন। রুমটার চারদিকের দেয়াল ঘেঁষে বুকশেলফ, তাতে বই ভর্তি । ইতিমধ্যে তার চেহারায় বেশ কৌতুকের ছাপ দেখতে পাচ্ছি। বুঝতে পারছি তিনি আমার কাছ হতে প্রশ্ন আশা করছেন। কিন্তু তিনি জানেন না তার খেলায় আমি ইতিমধ্যেই অভ্যস্থ হয়ে গেছি। আমি চোখে - মুখে ভাবলেশহীন একটা ভাব ফুটিয়ে রাখলাম । তিনি আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, বাবা! আপনি বসেন আমি একটু আসি।
ফকির লোকটা চলে যাবার পর আমি সেলফের বই দেখতে লাগলাম । সাহিত্য , ধর্ম , দর্শন বিষয়ক অনেক বই আছে । সবচেয়ে বেশি রবিন্দ্রনাথ , তারাশঙ্কর ,লালন এর বই।রবীন্দ্রনাথ ও তারাশঙ্করের উপন্যাসের অনেক লাইনে লাল আন্ডারলাইন দেখতে পেলাম । এসব দেখতে দেখতে টের পেলাম একজন লোক আমার পিছনে এসে দাড়িয়েছে। আমি তার দিকে তাকালাম।
- আপনি কি বাবার সাথে এসেছেন ? লোকটি ফর্সা, মাঝারি স্বাস্থ্য , বয়স ৩৫ এর মত হবে ।
- বাবা ? আমার চোখে প্রশ্ন ।
- আপনি ফকির মত এক লোকের সাথে এসেছেন না ? উনি আমার বাবা। এটা আমাদের ই বাড়ি।
আশ্চর্য হয়ে গেলাম। কি বলেন ? তাহলে আপনার বাবা মাজারে ভিক্ষা করেন কেন ?
- সে অনেক কাহিনী । লোকটা মিষ্টি করে হাসল। এই বাড়িটাও আবার ভিক্ষার টাকায় করা ! আর বাবা কিন্তু শিক্ষিত মানুষ , বাংলায় অনার্স!
অবাক হতে হতে আমি এখন অবাক দশা হতে মুক্ত ।
- কিন্তু এসব তিনি করেন কেন ? আর আপনারাও কিছু বলেন না কেন ?
- ঐ যে বললাম! সে অনেক কাহিনী!!
( চলবে )
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে অক্টোবর, ২০১৭ রাত ১২:২১