মানুষকে যে অন্যান্য সব প্রাণীর চেয়ে আলাদা করে দেখা হয়, সবার চেয়ে শ্রেষ্ঠ মনে করা হয়, সেটা কি কারণে? মানুষের মধ্যে এমন কি আছে, যা আর অন্য কারও নেই?
মানুষের সেই বিশেষ গুণটি হলো যেকোন বিষয় নিয়ে চিন্তা ভাবনা করে ভাল মন্দ বিচার করার ক্ষমতা। এই একটি মাত্র গুণ পৃথিবীর কোটি কোটি প্রাণী থেকে আমাদেরকে অনন্য করে দিয়েছে। শুনতে হয়ত খারাপ লাগতে পারে, কিন্তু একই সাথে এটাও চরম সত্য যে, যে মানুষটার মাঝে এ গুণটা নেই বা যে মানুষটা তার বাস্তব জীবনে এই গুণটা কাজে লাগায় না, তার সাথে একটা গরু বা গাধার আসলেই কোন পার্থক্য নেই।
শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য কিন্তু একজন প্রকৃত মানুষ, আদর্শ মানুষ তৈরি করা। এজন্য অবধারিতভাবেই প্র্রকৃত শিক্ষা আমাদের শিখাবে কিভাবে করে চিন্তা ভাবনা করে সত্যের কাছে পৌঁছাতে হয়, জীবনকে সত্যিকারের লক্ষের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়।
আর এখানেই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার চরম ব্যর্থতার সূত্রপাত। আমরা জীবনের এতগুলো বছর, এত বিশাল সময় ব্যয় করে যে পড়াশোনা করি, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেটা তো আমাদের চিন্তা করার শক্তিকে জাগ্রত করেই না বরঞ্চ তিলে তিলে তাকে নিঃশেষিত করে ফেলে। যত আমরা উপরে যেতে থাকি ততই আমাদের অন্যের অন্ধ অনুসরণ করা শিখানো হয়। আমরা কখনো বইয়ের নিয়মের বাইরে অন্যভাবে কোন অংক করার বা উপপাদ্য প্রমাণ করার কথা কল্পনাও করতে পারিনা; ভাইয়া বা কোচিং এর লেকচার শীটের উত্তরের বাইরে অন্য কোন উত্তর মাথায় আনতেই পারিনা; গ্রামার বইয়ে লেখা Aim in life রচনাকে নিজের বিশ্বাস দ্বারা রাঙিয়ে ফেলার সাহস করতে পারিনা; বিজ্ঞানের বিষয়গুলোকে বাস্তব জীবনে উপলব্ধি করার মতো বুঝে নেওয়ার চেষ্টাও করতে পারিনা। সবচেয়ে বড় সমস্যা আমরা সত্যিকারের প্রশ্ন করার, সত্যকে জানতে চাওয়ার সাহস হারিয়ে ফেলেছি।
অবস্থা এমন দাড়িয়েছে যে, কোন কিছু পড়ার সময়, করার সময় কি পড়ছি, কেন করছি এ বিষয়গুলো নিয়ে একটু চিন্তা করে বুঝে নেওয়াটাকে আমাদের কাছে স্রেফ পাগলামি মনে হয়।
অন্তত পড়াশোনার ক্ষেত্রে, এরকম ভয়াবহ অবস্থা থেকে কিছুটা হলেও উত্তরণের একটা উপায় হতে পারে বিভিন্ন অলিম্পিয়াডগুলো।
যাদের এ ধরনের অলিম্পিয়াডগুলো নিয়ে সামান্যতমও অভিজ্ঞতা আছে, তারা এটুকু অন্তত জানে যে এখানে চিন্তা করার, ভালভাবে বুঝে নেওয়ার গুরুত্বটা কতটুকু।
কেউ যদি সত্যিকার অর্থেই এসবের সাথে ভালভাবে involved থাকতে চায়, যেকোন অলিম্পিয়াডে ভাল করতে চায় তাহলে সত্যি সত্যি সবকিছু ভালমতো বুঝে পড়াশোনা ছাড়া তার হাতে আর কোন বিকল্প নেই। খালি ভাইয়ার লেকচার শীট পড়ে এখানে কোন কাজ হয়না। যার সুফল হিসেবে আর যাই হোক চিন্তাশক্তির স্বাভাবিক বিকাশ এখানে বাধাগ্রস্থ হয়না, বরং একটু হয়ত বিকশিত করতেও সাহায্য করে।
আমি এই দাবী করব না যে, যারা অলিম্পিয়াড করে না, তারা সবাই পড়াশোনায় পিছিয়ে থাকে। কেননা, অনেকেই হয়ত ব্যাক্তিগতভাবে বুঝে পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে পারে, হয়ত স্কুল কলেজের মতো অনেক উচ্চতর পড়াশোনাও না বুঝেও করা যায়।
তবে যেই দাবীটা করাই যায় সেটা হলো যে, যারা সত্যি সত্যি এসবের সাথে জড়িত থাকে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা অন্তত পড়াশোনার দিকটাতে অনেক ভাল করে। মানুষের অনন্য, special গুনটাকে যখন আমরা পড়াশোনায় কাজে লাগাব, তখন সেই পড়াশোনা যে উন্নত হবে সেটাই তো স্বাভাবিক।
তো, তাহলে কি আমরা উপসংহার টানতে পারি যে, যারা অলিম্পিয়াডের সাথে যুক্ত থাকে তারাই কেবল প্রকৃত মানুষ হওয়ার দৌঁড়ে এগিয়ে?
না, বরং সত্যটা আরও একটু ভয়াবহ!
আমরা যারা অলিম্পিয়াডের সাথে যুক্ত আছি, স্বাভাবিকভাবেই(by default) এবং বেশিরভাগ সময় অজ্ঞাতভাবে পড়াশোনায় এই গুনটা কাজে লাগিয়ে ফেলি। কিন্তু বাস্তব জীবনে গিয়ে আমাদেরও সেই একই দশা হয়ে দাঁড়ায়: অন্যের অনুকরণ।
২.
আমি যখন প্রথম বিষয়টা একটু উপলব্ধি করতে পারি, আমি সত্যি হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আমিসহ আমার চারপাশের সবার জীবনযাত্রাটা অনেক অদ্ভুত, হয়ত অনেক হাস্যকরও। জীবনের প্রথম থেকে আজ পর্যন্ত আমি যা যা করে চলেছি, সেগুলো আমি কেন করছি, কি উদ্দেশ্যে কি কারণে করছি?
অন্য কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করে “তুমি পড়াশোনা কেন কর? এটা কেন কর? ওটা কেন কর?” তাহলে হয়ত আমি বানিয়ে বানিয়ে অনেক কিছু বলে দিতে পারি। কিন্তু সত্যি সত্যি আমার মনের কাছে প্রশ্ন করলে আমি একটাই উত্তর পাই: অন্যেরা করে তাই, আমার আশেপাশের মানুষেরা করে তাই।
অন্যকে copy করার এই বদভ্যাস আমাদের জীবনের সর্বত্র এমনভাবে ছেয়ে গেছে যে এই নিয়ে আমাদের কখনো কিছু মনেই হয় না।
স্রোতের টানে যেমন কচুরিপানা ভেসে চলে ঠিক তেমনি আমাদের জীবনটাও যেন হয়ে গেছে বানের জলে ভাসা কচুরিপানা। স্রোত যেদিকে টেনে নিয়ে যায়, আমরাও সেই পানেই ছুটি!
ব্যাপারটা এমন যেন, আমি ঘুম থেকে উঠে চোখ কচলাতে কচলাতে নিচে নেমে দেখি অবাক কাণ্ড! অনেকগুলো মানুষ রাস্তার একদিকে ছুটতেই আছে, ছুটতেই আছে। আমিও খানিকখন চোখ কচলে টচলে সেই ছুটন্ত মানুষের দলে যোগ দিলাম। কোথায় ছুটছি, কেন ছুটছি কেউ জানিনা, অন্য সবাই ছুটছে, আমিও ছুটছি।
এরকম ব্যাপার মাঝে মাঝে পিপড়াদের মধ্যে হয়। অসংখ্য পিপড়া একটা বৃত্তাকার পথে সামনেরটাকে অনুসরণ করে ঘুরতেই থাকে, ঘুরতেই থাকে। এই ঘটনাকে বলা হয় ant mill (https://en.wikipedia.org/wiki/Ant_mill)। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই চক্রের অবসান হয় মাত্রাতিরিক্ত পরিশ্রমের ফলে পিপড়াগুলোর জীবনাবসানের মাধ্যমে।
সত্যি কথা বলতে কি, আমরাও কি একেকজন ঐ ant mill এর পিপড়ার মতই জীবন চালাচ্ছি না??
এজন্যই হয়ত এক পরিচিত বড়ভাই বলেছিল, “অতিমানব না হতে পারি, মানুষ তো হই। পশুর মতো ঘুম-খাওয়া-মলমূত্র বিসর্জন-প্রজননের চক্র থেকে বেরিয়ে তো আসি।”
ছোটখাট ব্যাপারে হয়ত প্রভাবটা খুব ভয়াবহ না। কেউ যদি একটুও না বুঝে, চিন্তা ভাবনা না করে সারাজীবন পড়াশোনা করে যায়, তাহলে তার সম্পর্কে সর্বোচ্চ এটুকু বলা যায় যে, হয়ত সে জীবনে যে অবস্থানে যাবে তার চেয়ে আরেকটু ভাল অবস্থানে যেতে পারত। আমি এটা কখনোই বলতে পারিনা যে, তার জীবনটা ব্যর্থ হয়েছে।
কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রভাবটা সত্যি মারাত্মক হয়ে উঠে। যার মধ্যে সবার ওপরে আছে The life itself. অন্যের অন্ধ অনুকরণ আর বিবেক কাজে না লাগানোর ভয়াবহ অভ্যাসটা আমাদের জীবনকে এমনভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে যে, আমরা সারাটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারি, অথচ একথাটা চিন্তা করার জন্য আমার ২ মিনিটও সময় হয় না যে, কিসের জন্য এ জীবন? সত্যি সত্যি আমার জীবনের মূল উদ্দেশ্য কী? আমার জীবনটাতে কি করার কথা ছিল আর কি করে কাটাচ্ছি? যেখানে বিবেকের দাবী ছিল যে, জীবনের সত্যিকারের লক্ষ্যটাকে চিনে সেটা অর্জনের উপায়গুলো জেনে সেগুলো মানার মাধ্যমে লক্ষ্যপানে এগিয়ে যাওয়া, সেখানে আমরা জীবনের আদৌ কোন লক্ষ্য আছে কিনা সেটা নিয়েও ভাবিনা।
এ ধরনের জীবনকে কি বলা যায়? ব্যর্থ? অর্থহীন? নাকি অন্যকিছু??
ব্যাপারটা এমন যে, অফিস থেকে বেশকিছু কাজে ৩ মাসের ভিসা নিয়ে বিদেশে গিয়ে দেখলাম, বাহ! এখানকার মানুষরা তো বেশ মজা করতে পারে! আমিও একটু মজা করি। তারপর ভিসার মেয়াদ শেষের আগে একবারের জন্যও ভাবার সময় পেলাম না যে, কেন আমি এখানে?
এই ভয়াবহতার মাত্রা আরও বেড়ে যায় একারণে যে, কেউ একটু খারাপ পড়াশোনা করলে ক’বছর পরই হয়ত ফলাফল টের পায়, অন্যেরাও তাকে দেখে শেখার সুযোগ পায়। কিন্তু জীবনের ফলাফলটা যে ওপারে যাওয়ার আগে টের পাওয়া যায় না! অন্যের দুর্ভোগ চাক্ষুস দেখে শিক্ষা নেওয়া যায়না‼
.
.
তাহলে শেষ পর্যন্ত কি দাঁড়ালো?
যে বিবেক বা চিন্তাশক্তিকে গতানুগতিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রায় নিঃশেষ করে দেয়, অলিম্পিয়াডগুলো হয়ত সেগুলোকেই একটু বিকশিত হওয়ার সুযোগ করে দেয়।
কিন্তু লাভ কি যদি আমি নিজের জীবনেই তা কখনো কাজে না লাগাই?
আমার আর একটা বইয়ের বোঝা বহনকারী গাধার মাঝে আর কি পার্থক্য থাকল তাহলে??
.
.
যেটা সত্য, সেটাতো সবসময় সত্যই থাকবে, তাইনা? আমি বা আরও অনেকে সেটাকে না বুঝতে পারি, সেটাকে না মানতে পারি, তাতে তো আর সত্যটা বদলে যাবেনা। আমি না পারি, কিন্তু কেউ না কেউ তো থাকবেই যে এটাকে গ্রহণ করবে, সত্যি সত্যি বোঝার চেষ্টা করবে, জানার ও মানার চেষ্টা করবে।
আর শেষ পর্যন্ত যার যার পরিণতি তো তার নিজেরই, তাই না???
.
One last quote
“বলুন, ‘আমি কি তোমাদের বলবো নিজেদের কর্মের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি ব্যর্থ ও ক্ষতিগ্রস্থ কারা?’ তারাই, যাদের দুনিয়ার জীবনের সমস্ত প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম সবসময় সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত থাকতো এবং তারা মনে করতো যে, তারা সব কিছু সঠিক করে যাচ্ছে।” (আল কোরআন— সুরা কাহাফ: ১০৩-১০৪)