somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নতুন ডায়েরি (পর্ব ১)

১৮ ই নভেম্বর, ২০২২ সন্ধ্যা ৭:২৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম


আমি? আমি ট্যাপাট্যাপির মা। সকাল থেকে রাত, রাত থেকে সকাল, ২৪/৭ সার্ভিসে নিয়োজিত একজন মা। বাচ্চা দুটি খুবই ছোট, তাই স্বাভাবিকভাবে তাদের ঘিরে আমার ব্যস্ততাও অনেক অনেক বেশি। আগে প্রায় প্রতিদিন ডায়েরি লিখতাম। প্রতিদিন কি হলো না হলো, নানান চিন্তা ভাবনা, হাবিজাবি যা মাথায় ঘুরতো প্রায় সবকিছুই ডায়েরির পাতায় পাতায় গুছিয়ে রাখতাম।

সময় বয়ে যায়। সময়ের সাথে সাথে মানুষের জীবন বদলায়। এটাই তো চিরন্তন সত্য। সময়ের সাথে সাথে, সেই আমি জীবনের নানান বাক পাড়ি দিয়ে, কতো পরিবর্তন হয়ে, হয়ে যাই নতুন আমি! এই আমি, সেই আমি -র পার্থক্য নিয়ে লিখবো না। জীবনে কি ছিলাম, কি হতে পারতাম, কি পর্যায়ে আছি, এসব সমীকরণ মেলাবো না। আমি জানি, Happiness lies in acceptance আর মুমিন কখনো তার রবের রহমত থেকে হতাশ হয় না। নতুন ডায়েরি হাতে নিয়েছি দুজন খুব কাছের মানুষ, আত্মার আত্মীয়ের আবদার পূরণ করতে। আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, অক্টোবরে বাইতুল্লাহ দেখে আসার নসীব আল্লাহ এই অধমকে দান করেছেন। সেই সফরনামা জানার জন্য আল্লাহর এই দুই বান্দা বেকারার। তাদের তৃষ্ণা মেটাতে মহাব্যস্ত এই নতুন আমি দীর্ঘদিন পর ডায়েরি লিখতে বসলাম।

২০১৮ তে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা আমাকে প্রথমবার বাইতুল্লাহ সফরে নেন। তখন দুইবোন মিলে, মনের মতো করে ১৫ রাত মক্কা -মদিনায় ইবাদত করে এসেছিলাম, আলহামদুলিল্লাহ। ঐসময় একটা নিয়ম ছিল। একবার উমরাহ করে আসার পর পরবর্তী ২ বছরের মধ্যে সে যদি আবার উমরাহ আদায় করতে যেতে চায় তাহলে অতিরিক্ত ২০০০রিয়াল দিতে হবে। দেশে ফেরার পর থেকে আমাদের দুই বোনের মনে তীব্র অস্থিরতা। এই ২০০০রিয়ালের নিয়মই যেন আমাদের এবং বাইতুল্লাহ যাওয়ার পথে সবচেয়ে বড় বাধা। সারাক্ষণ দোয়া করতাম যেন এই নিয়ম উঠে যায়। মন তো তবুও শান্ত হয় না। বারবার মনে হতো, এটা অন্যায়। আমাদেরকে বাইতুল্লাহ সফরে বাধা দেয়ার অধিকার সৌদি সরকারের নেই। মন শান্ত করতে কি করতাম জানেন? সৌদি হজ্জ মিনিস্ট্রিতে মেইল পাঠাতাম। যেদিন নিউজে দেখলাম, এখন থেকে আর অতিরিক্ত ২০০০রিয়াল লাগবে না। আমাদের মনে সেদিন থেকে ঈদের আনন্দ!

এরপর এলো কোভিড-১৯। আহা! সে দিনগুলোতে কি অসহায় অবস্থায় ছিলাম আমরা! চিরব্যস্ত মাতাফ সেদিন জনশূন্য। কা'বার চারপাশে ব্যারিকেডের পর ব্যারিকেড। ডিসিপ্লিনড হজ্জ-সালাত। আবারও শুরু হলো হেরেমে সুদিন ফিরে আসার জন্য অস্থিরতা, দোয়া।

হঠাৎ একদিন ফেসবুক পোস্টে দেখলাম, কা'বার চারপাশের ব্যারিকেড তুলে নিয়ে যাচ্ছে। মনের ব্যাকুলতা চোখের অশ্রু হয়ে রাব্বে কারীমের দরবারে কড়া নাড়ছে। আবার কি পাবো না বাইতুল্লাহ দেখার সুযোগ! এই অধম কি মাতাফে সেজদায় লুটানোর আরেকটা সুযোগ পেতে পারে না! চারটা বছর হয়ে গেছে, চারটা বছর! মদিনা, আমার জানের শহর, আমার প্রাণের শহর ছেড়ে এসেছি। এবার কি একবার মদিনা দেখার সুযোগ আল্লাহ দিবেন না!

আমার, আমার সন্তানদের জন্য সময়টা অনুকূলে ছিলো না। বারবার দোয়া করছিলাম। আমার, আমার সন্তানদের জন্য কল্যাণকর না হলে মনের এই তৃষ্ণা একটু কমিয়ে দাও প্রভু। বাইতুল্লাহর এই বিচ্ছেদ যে আর সইতে পারছি না। আমাকে সবর করার শক্তি দাও। অনেক চিন্তা ভাবনা করে বের করলাম আমাদের জন্য উপযুক্ত সময় কি হতে পারে। ঠিক করলাম অক্টোবর মাসে যাবো ইনশাআল্লাহ। ছোট বাচ্চার বয়স তখন ৮ মাস হয়ে যাবে। মক্কা-মদিনার আবহাওয়াতে গরম কমে যাবে। আর ২৫ অক্টোবর আংশিক সূর্যগ্রহণ আছে। সফরের তারিখটা যদি ২৫ তারিখকে ঘিরে তৈরি করি তাহলে বোনাস হিসাবে পাবো সালাতুল কুসুফ বা গ্রহণের সালাত।

অক্টোবর মাসে উমরাহতে যাবো ঠিক করেছি। ছোট বাচ্চার বয়স তিন মাস হলে বাচ্চাদের পাসপোর্টের কাজ শুরু করলাম। আল্লাহর রহমতে কোনো প্রকার ঝামেলা ছাড়া পাসপোর্ট হাতে পেয়ে গেলাম। এরপর শুরু করলাম এজেন্সি খোঁজা। আমি কাস্টোমাইজড প্যাকেজ এ যেতে চাচ্ছি। আমার চাহিদার কথা জানিয়ে বেশ কয়েকটি এজেন্সির সাথে কথা বললাম। এক এজেন্সির সাথে ১৪ রাত, ৭ রাত মক্কায় আর ৭ রাত মদিনায় থাকার কথা বলে কাস্টোমাইজড প্যাকেজ করে এলাম। পরবর্তীতে এজেন্সি থেকে ফোন করে জানালো তারা ভুলে ১৬ রাতের হোটেল বুকিং দিয়ে দিয়েছে। আমরা যদি চাই, বুকিং বাতিল করে আবার ১৪ রাতের বুকিং দিয়ে দিবে। আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহর উপর ভরসা রেখে ১৬ রাতের হোটেল বুকিং -ই কনফার্ম করলাম।

আমার আম্মুকে সারাজীবন দেখেছি, হাতে টাকা নেই, পয়সা নেই, ব্যাংক-ব্যালেন্স নেই; অথচ এমন সব কাজ হাতে নেয় যে আমরা ভেবে পেরেশান হয়ে যেতাম টাকা যোগাড় হবে কোথা থেকে! কিছুদিন পর দেখতাম সত্যিই ব্যবস্থা হয়ে গেছে। কারো কাছে হাত পাততে হয়নি, কোনো অন্যায় করতে হয়নি। আমার আব্বুর হালাল রুজিতে আল্লাহ এতো বরকত দিয়েছেন, সুবহান আল্লাহ। আম্মুর এই কূল-কিনারাহীন অথই সমুদ্রে ঝাপ দেয়ার নামই বোধহয় তাওয়াক্কুল আলাল্লাহ। কোভিড-১৯ এর ঝড়ের পর উমরাহ খরচ আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে। আমাদের কাস্টোমাইজড প্যাকেজ এর খরচও অনেক বেশি পড়ছে। জীবনে এই প্রথম আম্মুর মতো আমিও ঝাপ দিলাম কূল-কিনারাহীন অথই সমুদ্রে। কিভাবে ব্যবস্থা হবে, আদৌ ব্যবস্থা হবে কিনা কিছুই জানি না। আমার শুধু আছে আল্লাহ উপর অগাধ বিশ্বাস। এই বিশ্বাস আর দোয়া রাব্বে কারীমের দরবারে কবুল হয়ে গেলো আলহামদুলিল্লাহ। তিনি আমার সব কাজ এক এক করে সহজ করে দিলেন, আমার সব ফরিয়াদ কবুল করে নিলেন আলহামদুলিল্লাহ।

দেখতে দেখতে সফরের সময় ঘনিয়ে এলো। আমাদের প্রস্তুতিও আল্লাহর রহমতে শেষ হলো। এবার শুধু যাওয়ার অপেক্ষা, আমার রবকে পাওয়ার অপেক্ষা। ২২ অক্টোবর রাতের ফ্লাইটে জেদ্দার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। আগে যেহেতু মক্কায় যাবো সেহেতু বাসা থেকে ইহরাম করে গেলাম। জেদ্দা এয়ারপোর্টে পৌঁছে বেল্ট থেকে ব্যাগেজ নিয়ে বের হবার পথে দেখলাম বিশ্বের সবচেয়ে বড় এয়ারপোর্ট একুরিয়াম। বিশাল এই একুরিয়ামে আছে নানান জাতের কোরাল আর মাছ। ছোট ছোট হাঙর মাছগুলো দেখতে আমার খুব ভালো লেগেছে। সারাজীবন তো টিভি পর্দায় হাঙর মাছ দেখেছি, এবার সামনাসামনি দেখতে পেলাম আলহামদুলিল্লাহ।

এয়ারপোর্ট থেকে বের হবার পর এক লোক নিজে থেকে এসে ড্রাইভারের নাম্বার নিয়ে ফোন করে ড্রাইভারকে আসতে বললো। সিম বিক্রি করে এমন একটা ছেলেকে ডেকে সিম কেনার ব্যবস্থা করে দিলো। আলহামদুলিল্লাহ, অল্প সময়ের মধ্যে সিম আর গাড়ির ব্যবস্থা হয়ে গেল। এতো ক্লান্ত ছিলাম যে জেদ্দা থেকে মক্কা যেতে যেতে আর তাকিয়ে থাকতে পারছিলাম না। ঘুমিয়ে গেলাম। ঘুম ভাঙলো বাচ্চাদের বাবার ডাকে। হেরেমের মিনার দেখা যাচ্ছে। কখনো গাড়ির এইপাশের জানালা, কখনো ঐপাশের জানালা দিয়ে হেরেমের মিনার দেখছিলাম। কেমন যেন ঘোরের মতো লাগছে। খুব অবিশ্বাস্য কিছু জীবনে ঘটে গেলে আমরা যেমন হিসাব মেলাতে পারি না। কেমন যেন লাগছে। প্রথম যখন এসেছিলাম তখনও এতোটা ঘোরের মতো লাগেনি। আমি মক্কায়, কিছুটা দূরে বাইতুল্লাহ! যেন ঘুমের মধ্যে মধুর স্বপ্ন দেখছি! আমার এতোদিনের প্রতিক্ষা! আমার এতো দিনের প্ল্যানিং! লেখাগুলো কেমন এলোমেলো লাগছে! অনুভূতিগুলো লেখায় ফুটিয়ে তোলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। এই অনুভূতি আসলে কোনো ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। আলহামদুলিল্লাহ! সত্যিই আমি মক্কায়! আমার এই চোখ আবার কা'বা দেখবে! আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, শুকরিয়া আদায় করে শেষ করা যাবে না।

জাজাকুমুল্লাহ খাইরান

ছবি - নেট
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই নভেম্বর, ২০২২ সন্ধ্যা ৭:২৩
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×