হোসেন শহীদ
২০০২ সাল। ইফতি ঢাকা কলেজে পড়ে। ময়মনসিংহে ব্রহ্মপুত্রঘেঁষে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে [বাকৃবি] পড়ছে তার হরিহর আত্মা মহীবুল কাদের। কাদেরের দীর্ঘদিনের দাবিতে ছুটির অবসরে ইফতি গিয়েছিল বাকৃবিতে। তারপর তিরতিরে হাওয়ায় মৃদু দোলায়মান ব্রহ্মপুত্রের জলে নৌকায় বসে চুটিয়ে গল্পের এক ফাঁকে কাদের জানালÑপ্রশ্নের উত্তর পাঠানোয় কয়েকবার তার নাম-ঠিকানা কারেন্ট এ্যাফেয়ার্সে ছাপা হয়েছে; সেই সুবাদে বিভিন্ন ভার্সিটির বেশ কয়েকজন তরুণী বন্ধু হওয়ার আহŸান জানিয়ে তাকে লিখেছে। এরপর ৩-৪টি মেয়ের সঙ্গে ওর চিঠি চালাচালি চলছে। ঠিক প্রেম নয়; ভাব বিনিময় চলছে পুরোদমে। ইফতি তো থÑঢাকা কলেজ শুধু ছেলেদের [ভর্তির সময় অবশ্য এ তথ্য জানত না; জানলে ভর্তি হত কিনা সেটাও বলা মুশকিলÑকারণ ইন্টারমিডিয়েট পড়েছে সহ-শিক্ষায় কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে] তাই ঢাকা কলেজে প্রেম তো দূরের কথাÑবান্ধবীদের সাথে একটু আড্ডার উষ্ণতাও মেলে না। তরুণী-সান্নিধ্য পেতে হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়তো নিউ মার্কেটে যেতে হয়! [কেনা-কাটায় ব্যস্ত নানা চেহারার তরুণী দেখে যেনবা দুধের সাধ ঘোলে মেটানো]। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার আগেই নাজমুল আহসান হলে শামীমের রুমে ফিরে ইফতির মন উশখুশ করছিলÑকখন সে তরুণীদের পাঠানো সেইসব চিঠি পড়বে! এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। আবেগঘন-চাঞ্চল্য-সঞ্চারী তরুণীদের চিঠি পড়ে ইফতিরও খুব ইচ্ছে করলÑএকটা কিছু করতে...।
কল্পনার ঘোড়া আকাশে উড়ে! ঢাকায় ফিরে রঙীন সব ¯^প্নে বিভোর হয় ইফতিÑবেশ খোশমেজাজে কারেন্ট এ্যাফেয়ার্সের কয়েক সংখ্যার প্রশ্নের উত্তর পাঠাল, কিন্তু কাজ হলো না। ফিরতি চিঠি এল না। পড়াশোনার পাশাপাশি দৈনিক রূপালীতে বন্ধু কাজল রশীদের সহযোগী হিসেবে সাংবাদিকতার হাতেখড়ির ব্যস্ততায় পত্রমিতালীর ভ‚ত আপাতত মাথা থেকে নামল ইফতির।
পরের বছর আবারো ইফতি গেল বাকৃবিতে। এরই মধ্যে কাদের আনন্দ মোহন কলেজপড়–য়া পত্রমিতা নিশির সঙ্গে দু-তিনবার দেখাও করেছে। ইফতিকেও একদিন নিয়ে গেল নিশির মেসের অভ্যর্থনাকক্ষেÑহালকা-পাতলা গড়নে এখনো কৈশোরিক-চাঞ্চল্য যেন লুটোপুটি খাচ্ছে। নিশির সাহচর্য ইফতিকে নাড়া দিল। মনের কোণে সম্ভাবনা দানা বাধেÑনিশির মতো তারও একজন মেয়ে বন্ধু হবে! নিশির মেস থেকে ফেরার পথে কথাচ্ছলে কাদের বলেÑনিশি ডাক্তার হতে চায়। ইফতির মনে পড়েÑ কাদেরের মা-বাবার প্রাণান্ত ইচ্ছে ছিল সে ডাক্তার হোক। আপ্রাণ চেষ্টায় দ্বিতীয়বারে ভাইভাবোর্ডে পৌছলেও শেষরক্ষা হয়নি কাদেরের। ডাক্তার হওয়ার ¯^প্নѯ^প্নই থেকে গেছে।
হলে ফিরে কাদের বলেÑনিশি যদি ডাক্তারিতে চান্স পায় তবে ওকেই জীবনসঙ্গী করব। কাদেরের অন্য পত্রমিতাদের ২/৩ জন তখনও তাকে লিখছে। সেসব চিঠির উত্তর দেওয়া, নিশির সঙ্গে চুটিয়ে আড্ডার পাশাপাশি পড়াশোনাটা অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গেই করছে কাদের। ওর এসব দেখে ইফতির মাথা খারাপ-অবস্থা। এবার একটা পত্রবন্ধু অন্তত চাই-ই চাই। কাদেরকে সে-কথা বলতেই একটু ভেবে কাদের বলে
Ñএক কাজ করতে পার; ৫/৬দিন আগে আমার ঠিকানায় রাবির [রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়] ৪৩৮ রোকেয়া হল থেকে একটা চিঠি এসেছে। তুমিই আমার প্রক্সি দিয়ে চিঠি লেখ।
Ñএরকম করে শেষে না জানি কি বিপদে পড়ি।
Ñশুরু করে দেখ না; তারপর ঘনিষ্ঠতা হলে তোমার পুরো নাম, পরবর্তীতে ঢাকার ঠিকানাও জানাবে। বন্ধুত্ব জমে গেলে ঠুনকো এই মিথ্যেটা ধোপে টিকবে না।
শত দ্বিধাদ্ব›েদ্বর মধ্যেই কাদেরের কথামতো ইফতি পরের দিন রোকেয়া হলের মেয়েটির চিঠির জবাব লিখে ময়মনসিংহ থেকে পোস্ট করে তবেই ঢাকা ফিরল।
চার-পাঁচদিন পরে নাজমুল আহসান হলের ঠিকানায় চিঠির উত্তর এলÑখাম খুলল কাদের। তারপর আরেক খামে ভরে ওই চিঠি পাঠিয়ে দেয় ইফতির ঢাকার ঠিকানায়। ইফতি তো চিঠির ঘোরে আচ্ছন্ন!Ñওহ্ ; এমন যতেœর-সুন্দর হাতের লেখা যেন ইফতি আগে কখনো দেখেনি! একেবারে বিস্ময়মুগ্ধতায় চনমনে হয়ে উঠে তার দেহমন! ...
শামীম,
শুভেচ্ছা নিবেন। আশা করি ভালো আছেন। আমার মতো অচেনা একজনের চিঠিতে সাড়া দেয়ার জন্য অফুরান ধন্যবাদ। ...আমার কোন বিষয় যে আপনাকে মুগ্ধ করেছে তা ঠিক বুঝতে পারছি না। খুব সম্ভবত ‘প্রমিতি’ নামটি তাই না? ভুল বলে ফেললাম না কি?Ñসঠিক তথ্য জানতে চাই ...।Ñ প্রমিতি
প্রতিউত্তরে লেখে ইফতিÑ
প্রমিতি,
গ্রামদেশে ‘মিতি’ শব্দের আঞ্চলিক অর্থ বন্ধু। প্র-এর পূর্ণরূপ প্রকৃষ্ট। তাহলে কি দাঁড়ালোÑপ্রমিতিÑপ্রকৃষ্ট বন্ধু ...।Ñশামীম
এরপর চলতে থাকে তাদের পত্রালাপ বিরামহীন। সময় এগিয়ে যায়; সম্পর্কও এগোয়। চিঠির ভাষায় আসে অনিবার্য পরিবর্তন। কখন কবে কে কাকে প্রথম ‘তুমি’র বেড়াজালে জড়িয়ে ফেলে খুঁজে বের করার চেয়ে ভালোবাসা-মনোবৈকল্য কিংবা মান-অভিমানের ছিদ্রাšে^ষণে উৎসাহী হয়ে উঠে তাদের বন্ধুরা। সেসব তথ্যের আদ্যোপান্ত এ উপাখ্যানের শেষাবধি জানা গেলেও যেতে পারে। ইফতি সেই পরিণতির দিকে না গিয়ে ভাবতে বসে সেই হিরš§য় ভালো-লাগা, ভালোবাসা অথবা বন্ধুত্বের অবগুণ্ঠনে আচ্ছন্ন থাকার দিনগুলোর কথা। প্রমিতি লিখেছিলÑ
কথাবন্ধু,
স¤ে^াধনে অবাক হবার কিছু নেই। পেনফ্রেন্ড, পত্রমিতা, কলমবন্ধুÑএসব না, তুমি এখন থেকে আমার কথাবন্ধু. ...।Ñপ্রমিতি
কথাবন্ধুÑওহ্! কি দারুণ একটা শব্দ! এ শব্দের যাদুকরি মন্ত্রমুগ্ধতায় পল্লবিত-মুকরিত হয়েছিল ইফতির মন। প্রমিতির সঙ্গে হƒদ্যতা-অন্তরঙ্গতা বাড়তে লাগল। ইফতির মনে এক ধরনের ঘোর সৃষ্টি হত প্রমিতির একেকটা চিঠি পড়ার পর। নতুন আরেকটা চিঠি না আসা পর্যন্ত সে ঘোর কাটত না। ¯^প্নেরা ডানা মেলত ...।
বাকৃবির গোছানো পরিবেশ, জয়নুল গ্যালারি, ব্রহ্মপুত্রের ছলাৎ-ছলাৎ পানির বুকে নৌকায় বৈকালিক ঘরেফেরা সূর্যের মায়াবি-মিঠে রোদের ঝিকিমিকি আর দু-ধারের কাশবন ইফতিকে টানতো বড়ো আপন করে। তাই তৃতীয়বারের মতো বাকৃবিতে গেল ইফতি। এবার তার বন্ধুবরটিকে পেল ভিন্নরূপে। নিশি মেডিকেলে চান্স পায়নি; দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় ব্যস্ত। সম্পর্কটা চুকিয়ে দিয়েছে কাদের। কিন্তু নিশি এখনও ওকে পত্র লেখে, হলের গেস্টরুমে এসে মাঝে মধ্যে কল পাঠায়, কিন্তু মহীবুল কাদের তখন অন্য যুবক। পারতপক্ষে এড়িয়ে চলে নিশিকে।
অন্যদিকে আনন্দমোহন থেকেই বাকৃবিতে এমএস করতে আসা পপির সঙ্গে হƒদ্যতা গড়ে তুলে কাদের। পপি তাকে বিয়ের জন্য অস্থির। মনোমালিন্যের এক পর্যায়ে ঘুমের বড়িও খেয়েছে পপি। মাঝে কাদেরের বাবা একবার এসেছিলেন ক্যাম্পাসে; পপি তাকে তাদের বাসা পর্যন্ত নিয়েছে। তার ব্যবহারে কাদেরের বাবা মহাখুশী। পারিবারিকভাবে বিয়ের বিষয়টি আলোচনা হচ্ছে। বেচারা নিশির জন্য মন খারাপ হয়। এতো কিছুর মধ্যেও ভালো ছাত্র কাদের তার পড়ালেখায় যথেষ্ট ভালোই করছে। অনার্সে ফার্স্টকাস সেকেন্ড হয়েছে; মাস্টার্সের রেজাল্ট হব হব করছে। সেখানেও তেমনটাই প্রত্যাশা। এতোসবের মধ্যেও কিন্তু কারেন্ট এ্যাফেয়ার্সের প্রশ্নের সঠিক উত্তর পাঠায় কাদের। নাম-ঠিাকানাও ছাপা হয়Ñচিঠিও আসে। দু-একজনের উত্তর দেয়, বাকিগুলো পড়ে থাকে...। এমনি একটি চিঠি এবার ইফতিকে দিয়ে কাদের বলেÑলিখে দেখ বন্ধুত্ব হয় কিনা। [ইফতি প্রমিতির সঙ্গে তার হƒদ্যতার কথা খুব একটা জানায়নি কাদেরকে] কাকতালীয়ভাবে এটাও রাবিরÑতবে ৪২৭ মুন্নজান হলের। লোভ হয় ইফতিরÑএভাবেই তো প্রমিতিকে পেয়েছি। এবার দেখি রতœার সঙ্গে কি হয়। সে লুফে নেয় চিঠিটি। উত্তর পাঠিয়ে ঢাকায় চলে আসে। রতœার উত্তর পেয়ে কাদের সেই চিঠি ইফতির ঠিকানায় পাঠায়। দ্বিতীয় চিঠিতে ইফতি [প্রমিতিকে যেমন লিখেছিল] রতœাকেও লেখেÑ‘পড়াশোনা-পরীক্ষা তো শেষ, তাই আপাতত ঢাকাতেই থাকছি। এখন থেকে ঢাকার ঠিকানায় লিখলেই হবে।’ ফিরতি চিঠি আসেÑকে আপনি? আপনি যে মহীবুল কাদের না তা বুঝতে পারছি। আপনি আমার সম্পর্কে জানতে চেয়েছেনÑআমি রতœা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ৪র্থ বর্ষ, বাড়ী সিরাজগঞ্জ। আসল পরিচয় পেলে আমি আপনার বন্ধু হব...।’
ইফতি লেখে আসল পরিচয়। রতœার উত্তর আসে না। রতœা-ঘোরে থাকায় এ ক-দিন ইফতি খেয়ালই করেনিÑগত ৭ দিনে প্রমিতির কোনো চিঠি আসেনি তার ঠিকানায়। কিন্তু এর আগে সে একটা চিঠি লিখতে লিখতে প্রমিতির দুটো চিঠি এসেছে। কিন্তু কেন এই ছন্দপতন। ইফতি প্রমিতিকে পরপর দুটো চিঠি লেখেÑকোন উত্তর নেই। অস্থিরতা বাড়ে।... না রতœা, না প্রমিতি কেউ লেখে না...। তারপর..., তা র প র...।
পুনশ্চ : ২০০৯ সালের ২৩ এপ্রিলের সন্ধ্যায় আসাদ গেটের পার্টি প্যালেসে দেশের একটি জাতীয় দৈনিকের নামকরা সাংবাদিক আরিয়ান রহমান ইফতির বিবাহোত্তর প্রীতি অনুষ্ঠানে গণমান্য অনেকেই এসেছেন। ইফতি একরকম জোর করেই ধরে এনেছে মহীবুল কাদেরকে। সঙ্গে তার সহধর্মিনী পপিও আছে। কাদেরকে একটু বিব্রত দেখাচ্ছিল কি? কিন্তু ইফতি হেসে হেসে ওর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার ছলে যেন সকলকে উদ্দেশ্য করে বলেÑঅভ্যাগত সুধীনজন এই হচ্ছে আমার হরিহর আত্মা মহীবুল কাদের, আর এটি হচ্ছে ওর উছিলায় পাওয়া আমার কথাবন্ধু প্রমিতি। এখন অবশ্য প্রমিতি আমার জীবনসঙ্গীও। কিন্তু ইফতির সঙ্গে প্রমিতির এ পুনর্মিলন কীভাবে হয়েছিল, কোন ভালেবাসার জাদুবলেÑতা তারা দুজন কাউকে জানাতে নারাজ। সেটা না সবার না জানলেও চলে বোধহয়! ভালোবাসা এমনই হয়!

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





