রাতে বাসায় ফেরার আগেই রুমমেটের কাছ থেকে মোবাইলে খবরটা চলে এলো, “দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে বুয়া আসতে পারেনি তাই রাতের খাবার স্ব-ব্যবস্থাপনায় করে শুধুমাত্র ঘুমের নিমিত্তেই বাসায় ফেরা যাবে অন্যথায় ফেরার আবশ্যকতা নেই”। তাই কোন জল্পনা-কল্পনা না করে গাড়ী থেকে নেমেই একটি রেস্টুরেন্টে ঢুকে হাত-মুখ ধুয়ে টেবিলে বসতেই ১৬-১৭ বছরের এক কিশোর এসে বলল, স্যার কি খাইবেন খাওয়োন তো নাই। ছেলেটির কথায় মেজাজ এতটাই চটে গেল, মনে হচ্ছিল ওর দুই গালে দুই’টা চড় বসিয়ে দিয়ে অন্য কোন রেস্টুরেন্টে চলে যাই। কিন্তু বাইরের আবহওয়ার যে অবস্থা তাতে মনে হয় অন্য কোথায় গেলে শুধু খাবার না চড় দেওয়ার জন্য মলিন কোন গালও খুঁজে পাওয়া যাবেনা। নিরুপায় হয়ে মেজাজ নরম করে ছেলেটির দিকে তাকাতেই ভুল ভেঙ্গে গেল, আসলে মেজাজ গরম করে অনেক কিছু করা গেলেও এরকম মায়াবী চেহারার উপর আঘাত করা যায়না।
যদিও ক্ষুধার্ত তবুও ছেলেটির চেহারায় দৃষ্টি রাখতেই কিছুটা মায়া জন্মে গেলে ওকে নরম সুরে জিজ্ঞেস করলাম কিছুই নেই?
‘না স্যার লবণ-মরিচ আর লেবু ছাড়া আর কিছুই নেই’
তাহলে যাই-
‘স্যার একটু বসেন, দেহি কিছু করোন যায় নি’
ওর কথায় সুবোধ বালকের মত কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেই এক প্লেট ভাত ও একটি রুই মাছের মাথা নিয়ে ছেলেটি ফিরতেই অবাক হয়ে গেলাম ও অনাহারে রাত্রি যাপনের চিন্তা দুর হয়েছে ভেবে খুশি মনেই জিজ্ঞাসা করলাম-
“কিছুই নেই, এখন আবার কোথায় পেলে, খাবার থাকতে মিথ্যা কথা বললে কেন?”
‘স্যার- এইডা আমার খাওন, আপনি খায়া বিলটা আমারে দিলেই চলবো’
আমি খেলে, তোমাকে তো না খেয়ে থাকতে হবে?
‘স্যার- হোটেলেত চাকরী করলে বাসনা শুইকায় পেট ভইরা যায়, দু’এক বেলা খাওনা না খাইলে তেমন কিছুই অয়না। আমার খিদা নাই আর এইডা আপনি খাইলে দুই’ডা উফকার হইবো।’
‘মানলাম তোমার ক্ষুধা নেই, কিন্তু কিভাবে দু’ইটা উপকার হবে?
‘স্যার আপনের সারাদিন অনেক কষ্ট হইছে, চেহারায় কইতাছে আপনেরে খিদায় পাইছে। আপনার খাওন দরকার।’
হ্যা, আমি ক্ষুধার্ত আমার খিদে মিটবে আর কি উপকার হবে?
আমার শেষ প্রশ্নে ছেলেটা কিছুটা আনমনা হয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে বলে ফেলল-
‘স্যার- আমি পাঁচ দিন হয়, মা’র লগে কথা কইবার পারিনা, আমার মোবাইলে ব্যালেন্স নাই, মা’র লগে প্রত্যেক দিন কথা কওনের লিগা এই মাসে নতুন মোবাইল নিছিতো পকেট খালি তাই ফ্লেক্সি করবার পারতাছিনা আর ইমারজেন্সীও ফুরায়া গেছে। মা’র লগে কথা কওনের খুব মন চাইছে, আফনের কাছ থেইকা বিলটা লয়া মোবাইলে ভইড়া চাচা’র নম্বরে ফোন দিলেই মায়ের লগে মন খুইলা কথা কইবার পারুম, চাচা’র নম্বরের লগে এফএনএফ করা আছে।’
আর কোন কিছু চিন্তা না করে পকেট থেকে একশ টাকার নোট বের করে ছেলেটিকে দিয়ে বললাম যাও রিজার্চ করে এসো। টাকা’টা হাতে নিয়েই ছেলেটি দৌড়ে চলে গেল আর আমি রুই মাছের মাথার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
কিছুক্ষণ পর ছেলেটি ফিরেই পঞ্চাশ টাকা আমাকে ফেরত দিয়ে বলল নেন স্যার, ‘আর লাগবো না ইমারজেন্সীর দশ ট্যাকা কাইটা নিছে এহনও চল্লিশ ট্যাকা আছে। অনেক কথা কওন যাইবো। স্যার-আপনি খান আর শোনেন আমি এখানে বইসাই লাউড স্পিকার দিয়া কথা কই আমার মায় কেমন লজ্জা পায় মোবাইলে কথা কওনের সময়।’
‘হ্যালো, বড় আব্বা- আমি সুজন’
‘কিরে তুই কয়’দিন ফোন দেস না কেন? তোর মায় কথা কইবার চাইছিল, তোর নাম্বার নাই তাই ফোন দিবার পারি নাই, ঐদিন তোর মালিকের নম্বরে ফোন দিলাম হ্যায় কইল তুই নাকি হ্যার হোটেলে আর কাজ করস না।’
‘কেন, বড় আব্বা- আমি তো এইহানেই আছি। মনে হয়, হোটেলে ভিড় চাপছিল তাই মালিকে কইছে।এইডা আমার নাম্বার আফনি নাম্বারডা সেভ করেন নাই?’
‘আমি তো আর জানি’না এইডা তোর নাম্বার, তুই কি মোবাইল লইছসনি?’
‘হয়, মোবাইল লইছি, তয় ব্যালেন্স আছিল না বইলা কল দিবার পারি নাই। যান আমি লাইনে আছি মায়েরে দেন।’
‘সুজন- তোর সামনে কেউ আছেরে?’
‘হু-আছে যেই সাহেবের ট্যাকা দিয়া ফ্লেক্সি করছি হ্যায় আছে। কথা কইবা, কও।’
‘স্যার-আফনি কথা কন, আমি পানি নিয়া আসি।’
আমি মোবাইলের লাইড স্পীকার বন্ধ করে কানে নিলাম
‘বলেন-’
‘ভাইজান- একটা খারাপ খবর আছে আমি যে সুজনরে কেমনে কই?’
‘কেন কি হয়েছে? আমাকে বলেন। আমি বুঝিয়ে বলবো’
‘ভাইজান-সুজনের মায়তো গত তিনদিন আগে দুনিয়া ছাইড়া চইলা গেছে। আমি কেমনে ওর মায়ের লগে কথা কওয়ামু। ওর মালিকেরে কত ফোন দিছি হ্যায় রিসিভ করে না, প্রথমে একবার রিসিভ কইরা কয় সুজনে হোটেলে নাই, হ্যায় এইহানে কাজ করে না।ওর মোবাইলে ফোন দেন বইলাই রাইখা দিল। আমারে কথা কওনেরও সুযোগ দেয় নাই যে কমু ওর মা’য় মারা গেছে।’
‘আচ্ছা আমি ওকে বুঝিয়ে বলছি। আর বাড়ীতে যাওয়ার কথা বলে দেব’
‘হয়-ভাইজান কন, পোলাডা মায়ের কবরডা অনন্ত তাজ থাকতেই দেইখ্যা যাইক।’
সুজন পানি এনে সামনে দাড়াতেই বললাম-
‘সুজন তোমার মা’নাকি অসুস্থ ঘুমিয়ে পড়েছে। তোমাকে বাড়ী যেতে বলল তোমার চাচা।’
‘স্যার কেমনে বাড়ী যামু, কইলেই কি হয়? পকেটতো খালি!’
আমি পকেট থেকে একটা ৫০০ টাকার নোট বেড় করে এগিয়ে দিয়ে বললাম
‘আচ্ছা এই নাও টাকা সকালে উঠে বাড়ী চলে যেও। এই টাকায় বাড়ী যেতে পারবে?’
‘হয় স্যার- যদি ছুটি পাই তয় যাইতেও পারুম আর মায়ে’র ল্যায় কিছু কিনাও নিতে পারুম। আমি আফনের এই ট্যাকা কেমন শোধ করুম, আমি আফনেরে আবার কই পামু।’
‘আচ্ছা- শোধ করতে হবে না। তুমি সকালে আগে বাড়ী যেও আর তোমার চাচারে ফোন দিয়া ডিস্টার্ব করার দরকার নাই। সেও নাকি অসুস্থ?’
আমি বলতে বলতে অর্ধেক খাবার রেখেই উঠে বিষন্ন মনে বাহির হলাম।
পিছন থেকে শুধু সুজন এর কথা শুনতে পারছি বলল, স্যার সময় পাইলে আবার আইসেন বেতনের ট্যাকা থেইকা আফনের ল্যায় ৫০০ টাকা আলাদা কইরা রাইখা দিমুনে।
রাস্তায় এসে ভাবতে লাগলাম-
সুজন কি সকালে বাড়ী যাওয়ার জন্য ছুটি পাবে? ছুটি পেয়ে যদি যায় তবে বাড়ী পৌছানো আগে মা’এর সাথে আবার কি কথা বলতে চাইবে? মা কি খেতে চায় তা জানার জন্য? ওর মোবাইলে তো এখওন ব্যালেন্স আছে!
আলম তারেক
০৯-০৪-২০১৫