somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইরানের স্থাপত্য-শৈলী ও সংস্কৃতি

০৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ রাত ৯:১৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সাসানীয় যুগের ইরানের স্থাপত্য-শৈলী ও সংস্কৃতির কিছু নিদর্শন কেরমানশাহ ও আযারবাইজানসহ ইরানের বিভিন্ন অঞ্চলে পাওয়া গেছে। সাসানীয় যুগের খোদিত চিত্র-কর্মের নিদর্শনগুলোয় যেসব ব্যক্তির ছবি স্থান পেয়েছে সেসব ব্যক্তির পরিচয়ও জানা গেছে। পাথরে খোদিত এসব ছবির উপরে পাহলভী বা ফার্সী ভাষার মধ্যযুগীয় লিপিও গ্রীক ভাষার খোদিত লিপির মাধ্যমে এইসব ব্যক্তির পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। সাসানীয় যুগের ইরানের স্থাপত্য-শৈলী ও সংস্কৃতির কিংবদন্তীতূল্য নিদর্শনগুলোর মধ্যে খিলান আকৃতির তাক্বে বোস্তানের ত্বোরণ অন্যতম। তাকে বোস্তান শব্দের অর্থ বাগানের খিলান। চন্দ্রাকৃতির বা খিলান আকৃতির দুটি বৃহৎ ত্বোরণ বা গেট পাথরের পাহাড় কেটে তৈরি করা হয়েছে। এই ত্বোরণের পেছনের দিকে পাথরের দেয়ালের খোদিত-চিত্রকর্ম দুটি অংশে বিভক্ত। উপরের অংশে একটি রাজকীয় অনুষ্ঠানের ছবি তুলে ধরা হয়েছে। এতে দেখা যায় সম্রাটকে পাগড়ী বা রূমালযুক্ত মুকুট দেয়া হচ্ছে। যে তিন ব্যক্তির ছবি এখানে খোদিত রয়েছে তাদের শরীরের সামনের দিক তিনটি স্তম্ভের ওপর স্থাপিত। নীচের অংশে ঘোড়-সাওয়ার এক ব্যক্তিকে দেখা যাচ্ছে। ইনি হলেন সাসানীয় সম্রাট দ্বিতীয় খসরু। এই ঘোড়াটির নাম ছিল শাবদিজ। দ্বিতীয় খসরু ছিলেন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)'র সমসাময়িক যুগের ইরানী সম্রাট।
সুদৃশ্য তাক্বে বোস্তান সংলগ্ন দেয়ালগুলোতে খোদিত চিত্র-কর্মে শিকারের দুটি দৃশ্য রয়েছে। বিখ্যাত ঐতিহাসিক হার্টসফিল্ডের মতে স্মৃতি-স্তম্ভ জাতীয় এইসব স্থাপনার খোদিত চিত্র-কর্মগুলো চিত্র-শিল্পে প্রাচীন ইরানের বিস্ময়কর অগ্রগতির নিদর্শন। ত্বাকে বোস্তান ত্বোরণের পাশের ডান দিকের দেয়ালে হরিন শিকার এবং বাম দিকের দেয়ালে বুনো শুকর শিকারের দৃশ্য রয়েছে। এসব দৃশ্যে দেখা যায়, নল-খাগড়ার ঝাড় ও জলাভূমিতে এইসব রাজকীয় শিকারের ঘটনা ঘটেছিল। সম্রাট ও তার সঙ্গীরা বড় ধরনের নৌকায় থেকে এই অভিযান পরিচালনা করছিলেন এবং হাতীর ওপর সওয়ার দেহরক্ষীরা ও একদল বাদ্য-বাদক তাদের সাথে রয়েছে। ছবিগুলো এত নিখুঁত এবং বন্য জন্তুগুলোর শরীরের বিভিন্ন দিক এত বিশদভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যে দর্শকরা সে যুগের স্থাপত্যবিদ ও শিল্পীদের স্থাপত্য এবং শিল্প-নৈপূণ্য দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়েন।
সাসানীয় যুগের ইরানের স্থাপত্য-শৈলী কেবল স্মৃতি-স্তম্ভ জাতীয় স্থাপনা এবং প্রাসাদের মধ্যেই সিমীত নয়। সাধারণ ঘর-বাড়ী, অগ্নি-উপাসনালয়, সরাইখানা ও দূর্গগুলোও এ যুগের স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন। এ যুগের অধিকাংশ স্থাপত্য নিদর্শন হিসেবে প্রাসাদের পরেই অগ্নি-উপাসনালয়ের কথা উল্লেখ করা যায়। সে যুগে ইরানের রাষ্ট্রধর্ম ছিল অগ্নি-উপাসনা বা জরাথ্রুস্ত ধর্ম । অগ্নি-উপাসনালয়গুলোর বিশেষ স্থানে সব সময় আগুন প্রজ্জ্বলিত থাকতো এবং এসব অগ্নি-উপাসনালয়ে বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালিত হত। এসব অগ্নি-উপাসনালয় নির্মাণের রীতি আজো প্রায় একই রকম।
সাসানীয় যুগের ইরানের স্থাপত্য-শৈলীর আরো একটি অপূর্ব নিদর্শন হল কিসরার খিলান বা মাদায়েনের ত্বোরণ-কমপ্লেক্স। এটি বর্তমানে ইরাকে অবস্থিত। এই প্রাসাদের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল এর সুদৃশ্য ত্বোরণ। বহির্মূখী এই ত্বোরণ ব্যাপক বিস্তৃত ও অনেক উঁচু। এর পেছনে রয়েছে আয়তক্ষেত্র আকৃতির একটি হল বা প্রাসাদ। এই স্থাপনার মাঝামাঝি অংশের দুই দিকে রয়েছে অনেক করিডোর, কক্ষ ও হল এবং এসবের ওপরে রয়েছে দৃষ্টি-নন্দন গম্বুজ। মূল হল-কক্ষে আলো প্রবেশ করে ১৫০ টি ছিদ্র-পথে। শুধু দেয়ালের ওপর ভিত্তি করে নির্মিত হয়েছে কিসরার খিলান বা মাদায়েনের ত্বোরণ-কমপ্লেক্স। এই স্থাপনার বিভিন্ন অংশে এক সময় চকের পুরু আস্তরণের কারুকাজ ছিল এবং বিভিন্ন নক্সায় ছিল নানা রংয়ের সমাহার। সব মিলিয়ে এই স্থাপনাটি সাসানীয়দের চোখ ধাঁধানো আভিজাত্য, অপরূপ স্থাপত্য-শৈলী এবং বৈচিত্রময় কল্পনার ঐন্দ্রজালিক সংমিশ্রণের কালোত্তীর্ণ নিদর্শন।
ইরানে সাসানীয়দের শাসনামলে বিশ্বকে নাড়া দিয়ে আরবের বুকে আবির্ভূত হয় পবিত্র ধর্ম ইসলাম। আবির্ভাবের কয়েক দশকের মধ্যেই একত্ববাদ, সাম্য, মৈত্রী ও ন্যায়বিচারের সংস্কৃতি এবং শালীনতার নান্দনিক সৌন্দয্যে ভরপূর এই পবিত্র ও শাশ্বত ধর্মের দূনির্বার আকর্ষণের কাছে পরাজিত হতে থাকে সমস্ত তাগুতি শক্তি ও তাদের সংস্কৃতি। বিশেষ করে ইসলামের সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তির কাছে একে একে মাথা নত করে গোটা আরব সমাজ, মিশর, সিরিয়া ও ইরাক। ইরাকের অধিকাংশ অঞ্চলই ছিল তখন ক্ষয়িষ্ণু সাসানীয় সাম্রাজ্যের অংশ। আর সিরিয়া ছিল সে যুগের অন্য এক পরাশক্তি তথা রোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। প্রথমে কুফা ও পরে বসরা মুসলমানদের দখলে আসার পর সাসানীয়দের কতৃত্বাধীন ইরান পরাশক্তির জাত্যাভিমান নিয়ে প্রবল প্রতিরোধ চালায়। কিন্তু হিজরী ২২ সাল নাগাদ ইরানের বাদ-বাকী অংশও ইসলামী সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত হয় এবং বিলুপ্ত হয় ইরানী সাম্রাজ্য । সে সময় সাসানীয়দের অত্যাচারে অতিষ্ঠ ও শ্রেণী-বৈষম্যে জর্জরিত ইরানীরা সাম্যের ধর্ম ইসলামকে সাদরে গ্রহণ করে। ইসলামের অব্যাহত অগ্রাভিযানে পশ্চিমে মরোক্ক, স্পেন ও আটলান্টিকের উপকূল এবং পূর্বে সূদূর চীন ইসলামী সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত হয়।
পূর্ব ও পশ্চিমে মুসলমানদের বিজয় অভিযানের পাশাপাশি ইসলামী সংস্কৃতির প্রসারও শুরু হয়। কিন্তু বনি উমাইয়া শাসকরা ইসলামের মূল শিক্ষা থেকে বিচ্যুত হওয়ায় তাদের পতন ঘটে। এরপর ইরানীদের সহায়তায় আব্বাসীয়রা ক্ষমতায় আসে। তাদের খেলাফতের সময় ইসলামী-ইরানী বা ইরানকেন্দ্রীক ইসলামী সংস্কৃতির প্রসার শরু হয়। এ সময় বাগদাদ ছিল বিশ্বের জ্ঞান ও শিল্পের প্রধান কেন্দ্র। ইসলামের এই সোনালী সভ্যতার বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইরানীরা রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান। এ যুগে পাহলভী বা প্রাচীন ফার্সী, ভারতীয়, গ্রীক ও সিরীয় ভাষার বইগুলো আরবীতে অনূদিত হয় এবং গড়ে উঠে বিজ্ঞান ও ধর্মীয় বিষয়ের খ্যাতনামা অনেক বিশ্ববিদ্যালয়।
ইরানে ইসলামী সংস্কৃতির ব্যাপক বিস্তার এবং ইসলামী সংস্কৃতিতে ইরানীদের অবদান প্রসঙ্গে প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ইবনে খালদুন লিখেছেন, "মুসলিম মনীষী ও পন্ডিতদের মধ্যে অল্প কয়েকজন ছাড়া অন্যরা ছিলেন অনারব এবং তাদের অধিকাংশই ছিলেন ইরানী। হাদীস বিশারদদেরও অধিকাংশই ছিলেন ইরানী।" তিনি আরো বলেছেন, জ্ঞান-বিজ্ঞানের সংরক্ষণ ও সংকলন বা সম্পাদনায় কেবল ইরানীরাই অগ্রসর হয়েছিল। এ দিক থেকে ইরানীরা বিশ্বনবী (সাঃ)'র এবটি বিখ্যাত হাদীসের দৃষ্টান্তে পরিণত হয়। রাসূলে খোদা (সাঃ) ঐ হাদীসে বলেছেন, "জ্ঞান-বিজ্ঞান যদি সুরাইয়া নক্ষত্রেও থাকে, ইরানীরা তা সেখান থেকে আয়ত্ত্ব ও সংগ্রহ করবে। "
হ্যা, ইরানীরা শাসন-ব্যবস্থা, রাজনীতি, ভাষা, শিল্প ও সাহিত্য, ধর্ম, দর্শন, সংস্কৃতি, চিকিৎসা বিদ্যা, রসায়ন, বাণিজ্য ও অর্থনীতিসহ ইসলামের সোনালী সভ্যতার বিভিন্ন দিকে গুরুত্বপূর্ণ বা প্রধান ভূমিকা রেখেছেন। তবে ইসলামের স্থাপত্য-শৈলী ও সংস্কৃতিতে ইরানের ভূমিকা এবং ইরানের স্থাপত্য-শৈলী ও সংস্কৃতিতে ইসলামের ভূমিকা আমাদের মূল আলোচ্য বিষয়।
যা-ই হোক্, এটা স্পষ্ট যে ইরানসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের স্থাপত্য-শৈলী ও সংস্কৃতিতে ইসলামের ব্যাপক প্রভাব অনস্বীকার্য।



নাসীর মাহমূদ
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ রাত ৯:১৭
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ মিসড কল

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইল বিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভ

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ০৩ রা মে, ২০২৪ সকাল ৮:০২

গাজায় হামাস উচ্ছেদ অতি সন্নিকটে হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক ও লসএঞ্জেলসে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরেছিল। আস্তে আস্তে নিউ ইয়র্ক ও অন্যান্ন ইউনিভার্সিটিতে বিক্ষোভকারীরা রীতিমত তাঁবু টানিয়ে সেখানে অবস্থান নিয়েছিল।


... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×