ক্লাস নাইনে উঠার আনন্দ আমার জীবনের সবচেয়ে উত্তেজনাকর ঘটনাগুলোর একটি । কারন নিচের ক্লাস গুলিতে পড়ার সময়ই দেখেছি নাইনে উঠার পরেই বড় ভাইদের হাব-ভাব-ভংগিমা পাল্টে যায় । আমাদের স্কুলে একটা প্রবাদ খুব জনপ্রিয় ছিল, 'যে উঠে নাইনে, সে উঠে লাইনে' । কানে কানে বলে রাখি, এই 'লাইন' শব্দটা ছিল আমাদের কাছে ব্যাপক উত্তেজনাকর । আমাদের এলাকায় 'লাইন' মানে 'প্রেম' । যেমন একটা মেয়ের সাথে একটা ছেলের প্রেম চলছে, মানে 'লাইন' চলছে । একজনের একটা মেয়েকে খুব পছন্দ হইছে, মানে সে মেয়েটার সাথে 'লাইন' মারতে চাইছে । তো প্রেম করা বা মেয়েদের সাথে 'লাইন' মারার অধিকার একজন ছাত্র ক্লাস নাইনে উঠার পরেই পাইত ।
ক্লাস নাইনে উঠার পর আমিও চুলে টেরি কাটা শুরু করলাম । সেলুনে গিয়ে এমন ভাবে চুল কাটিয়েছি যেন কানের উপরের অংশ চুলে ঢাকা থাকে আর পেছনে ঘাড়ে চুল কিছুটা লম্বা থাকে, তখনকার দিনের ইস্টাইল আর কি । সবচেয়ে বড় কথা ক্লাস নাইন থেকে স্কুল ক্যাপ্টেন নির্বাচিত হত, যার জন্য স্কুলে মাতবরি আর নিচের ক্লাসের ছাত্রদের সাথে ভাব নেয়ার অফিসিয়াল স্বীকৃতি মিলত ক্লাস নাইনের ছেলেদের ।
ক্লাস নাইনের প্রথম দিনের ক্লাস টিচার তাকদির স্যার । বিশাল দেহ, হাতে সবসময় ৪ নম্বরি সাইজের জালিবেত আর বিকট কর্কষ হাকডাকের জন্য স্যারের খুব বদনাম ছিলো, এক কথায় তাকদির স্যারের হাকডাকে স্কুলে বাঘে-মহিষে এক টিউবওয়েলে পানি খেত । স্যার জালিবেত দিয়ে টেবিলে টুকটুক করে বাড়ি দিচ্ছেন, আর অমিতাভ বচ্চন স্টাইলে একটা লেকচার দিলেন । "তোরা দেহি লাইনে উইটা গেছস, কান আর ঘাড়ের চুল লাম্বা হওয়া শুরু হইয়া গেছে ? যা একটা কইরা 'লাইন' কর, যেদিন ইস্কুলে বিচার আইবো হেদিন কানের বাবরি সব একটা একটা কইরা ছিইড়া ফালামু "। আমরা সবাই স্যারের লেকচার শুনে মুচকি মুচকি হাসছি । একই রাস্তায় সামান্য ব্যবধানে দুইটা স্কুল, সরকারি বালক আর বালিকা । তাহলে বুইঝা নেন সম্ভাব্য কমপ্লেনের উৎস কি হইতে পারে ।
স্যার নামডাকা শুরু করলেন, 'উপস্থিত স্যার' চলতে থাকলো । শেষের দিকের কয়েকটা নাম অপরিচিত ঠেকলো, পেছনে তাকিয়ে দেখি তিনজন মাথা নিচু করে বসে আছে । বুঝলাম এরা আগের ক্লাসের ফেলটুস । ভালো করে দেখার জন্য উঁকি দিতেই দেখি একজন মাথা আরো নিচু করছে । আরে, এ যে আমাদের খালিছ মিয়া ভাই । কিন্তু খালিছ মিয়াভাইতো বাড়িতে কইছে হে পাশ কইরা টেনে উঠছে । ক্লাস শেষ হতেই পেছনে চলে গেলাম, মিয়া ভাই আমারে দেইখা লজ্জায় লাল হইয়া গেলো ।:!> :!> আমারে ইশারায় কাছে ডাইকা নিয়া কইলো, 'ফেইল করছি এইডা বাড়িত কইসনা, আব্বায় হুনলে ইবার বাড়িত থাইকা খেদাইয়া দিব' । আমি মাথা নেড়ে কইলাম, 'ঠিকাচে মিয়া ভাই, কমুনা' ।
খালিছ মিয়াভাই আমাদের পাশের বাড়ির, পাড়াত সম্পর্কের বড় ভাই । বড় মানে এক-দুই বছরের না, কমসে কম চার-পাঁচ বছরের । জীবনে অনেক ফেইলের সুখ-স্মৃতি নিয়া মিয়া ভাই এখন আমার ক্লাসমেট । গর্বে আমার সিনা দেড় হাত বড় হয়ে গেলো । গতবার আমারে বাদ দিয়া মোল্লারে এসিসটেন্ট ক্যাপ্টেন বানাইছিল । খালিছ মিয়া ভাই যদি একবার আমার নাম কয়, এই স্কুলের কারো বুকের পাটা এত বড় হ্য় নাই যে তার মুখের উপর 'না' কইব ।
খালিছ ভাইয়ের চেহারা ষন্ডা মার্কা, পেটানো শরীর আর সারা গায়ে অনিল কাপুরের মত ঘন পশমে ঢাকা । পাড়ায় তার একটা গ্রুপ আছে, হেন কোন শয়তানি-দুষ্টামি নাই তারা করেনা । রাতে বিভিন্ন বাড়ি থেকে হাস-মুরগি-কবুতর চুরি করে এনে নিজেরা রান্না করে খায় । একবার চধরি বাড়ি থেকে আস্ত খাশি চুরি করে এনে পিকনিক করে খেয়েছে । একবার চুরি করা ডাবের ভাগ আমিও পাইছি সে আবার খুব ভাল ফুটবল খেলে, মাঝে মাঝে খেপ খেলতে অন্য গ্রামেও যায় । এলাকার কেউ তাদের নিয়ে ঘাটায়না, পাড়ার কোন বিপদে-আপদে খালিছ ভাইরাই সবার আগে ছুটে আসে । তাদের এই গ্রুপ প্রতি বছর একবার বাড়ি থেকে পালায় । নিজেদের গোলা থেকে চুরি করা ধান বিক্রি করে কাউকে কিছু না বলে ঢাকা চলে যায় । তারপর কয়েকদিন থেকে এসে সারা পাড়া জুড়ে তাদের সিনেমা দেখার গল্প করে বেড়ায় । খালিছ ভাই অভিনয় করে রসিয়ে রসিয়ে সিনেমার কাহিনি বলে আমাদের পিচ্চিকুলের মন জয় করে নিয়েছিল অনেক আগেই । আড়ালে-আবডালে শুনতাম, হেরা ঢাকায় গিয়ে নাকি 'ইংলিশ রোডে' ঘুরে বেড়ায় ।
যাই হোক পরের ক্লাস বাংলা । ক্লাস নিতে এলেন আমাদের স্কুলের পন্ডিত রতন স্যার । টিচারদের মধ্যে উনারই বয়স সবচেয়ে কম । সারাক্ষন পান চিবান, উনার কাছে গেলে জর্দার মিষ্টি ঘ্রান পাওয়া যায় । তবে স্যারের একটা দূর্নাম আছে, কেউ দুষ্টামি করলে তার বাবরি ধরে টান দিয়ে মাথায় ঠোয়া মারেন । আর প্রতিটা ঠোয়া মারার আগে মজার মজার কথা বলেন । স্যারও হাসতে হাসতে মারেন, আর যে ঠোয়া খায় সেও হাইসা হাইসা বলতে থাকে, 'ছাইরা দেন স্যার আর করতাম না, উঁউউ দুখ্ পাই' ।
রতন স্যার ক্লাসে এসেই পিছনের দিকটা ভাল করে দেখে নিলেন । তারপর মাথা ঝাঁকিয়ে মুচকি হেসে বললেন, 'খালিছ্যা, মকবুইল্ল্যা, ওয়াহেদ্যা তোরাও আছস' । খালিছ ভাই পেছন থেকে নাকি স্বরে জবাব দেয়, 'জ্বী স্যার আছি, আফনে বালা আছুইন্নি ?" রতন স্যার বলেন, বালা থাহা ছুডাইমুনে, খাড়া । তারপর স্যার কারক আর সমাস নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলেন । পড়াতে পড়াতে হঠাৎ চুপ হয়ে গেলেন, নাকে ঘ্রান নেবার মত করে কি যেন শুকার চেষ্টা করলেন । তারপর দড়াম করে চেয়ার থেকে উঠে সোজা ক্লাসের পিছনের দিকে ছুটতে থাকলেন । পেছনে তাকিয়ে দেখলাম খালিছ ভাই ব্রেন্চ থেকে উঠে জানালা দিয়ে কি যেন ফেলে দিলেন ।
রতন স্যার পেছনে গিয়েই ডান হাতে খালিছ ভাই'র বাবরি মুঠো করে ধরে বাম হাতে ধুম করে পিঠে একটা কিল লাগালেন । আরেকটা কিল দিতে দিতে বলেন, 'তোর এত সাহস ! কিলাসে বিড়ি খাস ! দে, সব বিড়ি আমার কাছে দে !' খালিছ ভাই খুব ব্যথা পাইছে এমুন ভান করে কইলো, 'উঁহুহু, স্যার আর নাই, একটাই আছিলো খাইলাইছি' । স্যার নাছোড়বান্দা, বলেন 'জলদি বাইর কর, নাইলে কিল আরেকটা দিমু' । খালিছ ভাই না স্যার না স্যার বইলা বুক পকেট উল্টায়া দেখাইলো, খালি । স্যার তখন বলেন, 'তোর কুছের ভিত্রে আছে, জলদি বাইর কর' । খালিছ ভাই না স্যার না স্যার বইলা লুংগীর গিট্টুটা শক্ত কইরা ধরলো । স্যার তখন এক ঝটকায় খালিছ ভাই'র লুংগীর ভাজ থেকে এক প্যাকেট 'রমনা' চুরুট বাইর কইরা কইলেন, 'এইডা কি ??'
খালিছ ভাই সিগারেরটের প্যাকেট হারাইয়া মুখটা পেঁচার মত কইরা কইলো, সব নিওইন্যা স্যার সব নিওইন্যা, আধা প্যাকেট নিয়া যান' । স্যার হাইসা হাইসা কইলেন, 'একটাও পাইতিনা' । স্যার আর খালিছ ভাইয়ে অনেকক্ষন সিগারেট নিয়ে টানাটানি আর মোচরামুচরি করার পর স্যার এক শলাকা সিগারেট খালিছ ভাইরে দিলেন । খালিছ ভাই মাথায় হাত দিয়ে অসহায় ভংগিতে বলে উঠলো, 'হায় হায় আমার পুরা এক প্যাকেট সিগারেটই মাইর' ।
তারপর ঐ এক শলাকা সিগারেট কানে গুজে খালিছ মিয়া ভাই মনযোগ সহকারে ক্লাস করতে থাকেন ।
**************************************************
জীবনে প্রথম রম্য লিখলাম, আদৌ কিছু হয়েছে কিনা জানিনা । যার রম্য পড়ে এটা লেখার দুঃসাহস করলাম, সেই লোলরাজ 'চেয়ারম্যান০০৭' কে লেখাটি উৎসর্গ করলাম ।