somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ জীবনের সপ্তসুর ।

০৭ ই জুন, ২০১৪ রাত ৯:১৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল আম গাছটা অনেক আগেই তার যৌবন হারিয়েছে । এক আকাশ বিস্তৃত ডালপালা আর ঘন কালচে সবুজ পাতার অরণ্যে মাত্র দু'চারটা আম লিকলিক করে ঝুলছে । পাড়ার দস্যু ছেলেদের ছোঁড়া মাটির ঢেলার নিখুঁত ঢিল ঝপাৎ করে শব্দ তুলে ব্যর্থ মনোরথে ভূ-পৃষ্ঠে ফিরে আসে, গাছের আম দেখার ভাগ্য তাদের কদাচিৎ হয় । বিশাল বেড়ের এই গাছ বেয়ে উঠাও কম ঝক্কি নয় । ভেজা মরা বাকলে শ্যাঁওলা জমে একেতো পিচ্ছিল, তার উপর গোছাগোছা পরগাছা আর মরা ফার্নের আড়ালে চোরাই কোটরে গিরগিটি আর সাপের বাসা । পক্ষীকুলের ঠোকর খাওয়া কোন আম যখন বাতাসে ঝরে পড়ে, ছেলেপুলেদের মাঝে শুরু হয় কাড়াকাড়ি ।

গাছের গোড়ায় বড় শিকড়ে বসে আছে মাঝহাটির মন্নার । যে দুয়েকটা দুঃসাহসী ছেলে এই প্রাচীন আমগাছে তিড়তিড় করে বেয়ে উঠে, মন্নার তাদের একজন । তার গলায় লম্বা লম্বা কালো সুতায় ঝোলানো পেতলের তাবিজ । তাবিজের সাথে ঝুলছে কনে আঙুলের সমান একটা টিনের চাকু । গাছের মগডালে আরামসে বসে এই চাকু দিয়ে আম কেটে খায় সে । আজকেও গাছে চড়েছিল, তবে আম পাড়ার জন্য নয় । তার চেয়ে ছোট একটা ছেলে ঘুড়ি হাতে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল । মন্নার ছেলেটার হাত থেকে ঘুড়ি কেড়ে নিয়ে গাছের ডালে বেঁধে রেখে এসেছে । ঘুড়িওয়ালা ছেলেটা ছলছল চোখে গাছে ঝোলানো ঘুড়ির দিকে তাকিয়ে আছে । তাকে ঘিরে আরো দুচারটা ছেলে হাসাহাসি টিকাটিপ্পনি কাটছে ।

পাশের নিচু জমি থেকে খুটে খুটে গিমাই শাঁক ঝুড়িতে ভরে রাস্তায় উঠে আসে আলোই নামের ধিঙ্গি মেয়েটা । হাফপ্যান্টের নিচ থেকে কানিবকের মত চিকন লম্বা পা জোড়া বেরিয়ে এসেছে । হাটুর গিট্টু ফোলা ফোলা, কয়েক পরত চামড়া উঠে কালচে হয়ে গেছে । বেরিয়ে আসা বুকের হাড় জীর্ণ ময়লা জামাকে যেন উপহাস করছে । জটলার কাছে আসতেই ঘুড়িওয়ালা ছেলেটা কাঁদো কাঁদো হয়ে তার কাছে নালিশ জানায় । শাঁকের ঝুড়িটা এক পাশে রেখে মেয়েটা মন্নারের দিকে খিস্তি ছুড়ে, 'ঐ হারামজাদা বিতলা পুলা, হের ঘুড্ডি নিছস ক্যান?' গালি শুনেও মন্নার সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করেনা, গলায় ঝুলানো চাকু দিয়ে একমনে পুরনো আমের আঁটি ঘষতে থাকে । আলোই সময় নষ্ট না করে দুহাতে থুথু ছিটিয়ে পাঞ্জা ঘষে লাফ দিয়ে গাছে চড়ে । মন্নার দ্রুত এসে পা ধরে টেনে তাকে নামিয়ে আনে । এবার দুজনে শুরু হয় ধস্তাধস্তি । আলোইর জীর্ণ জামা ছেঁড়ার শব্দ হয় । জামা ছেঁড়ার ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে সে মন্নারের চোখে মুখে খামচি দেয় । মন্নার এবার তার দুর্বল জায়গায় আঘাত করে, জটা ধরা লম্বা চুল ধরে আলোইকে হ্যাচকাতে থাকে । আলোই কোনরকম নিজেকে সামলে নিয়ে মন্নারকে নিচে ফেলে দেয় । তারপর দুই হাটুর গিট্টু দিয়ে ইচ্ছেমত ঢুঁসতে থাকে । ঢুঁসি খেয়ে কাতরানো ছাড়া মন্নারের আর কিছু করার থাকে না । গাছে থেকে ঘুড়িটা নামিয়ে ঘুড়িওয়ালার হাতে বুঝিয়ে দিয়ে গিমাই শাঁকের ঝুড়ি মাথায় নিয়ে আলোই তার বাড়ির পথ ধরে ।

আলোই আমাদের পিচ্চিকুলের অবিসংবাদিত নেতা । আমচুরি-ফলচুরি, দাড়িয়াবন্দা খেলা আর মিছেমিছে বনভোজন, সবই হয় তার নেতৃত্বে । মুখের অশ্রাব্য বচন কিংবা শক্তিশালি হাটু, কোনটাই তার সেরা অস্ত্র নয় । তীরের বেগে সে ঢিল ছুঁড়তে পারে । মগডালে ঝুলে থাকা ঠাসাঠাসা আম কিংবা প্রতিপক্ষের শরীর, কোনটাই তার হাতের নিশানা থেকে রেহাই পায় না । এত জোড়ে আর এত সঠিক নিশানায় আমরা কেউই ঢিল ছুঁড়তে পারি না ।

বর্ষায় গ্রামের শীর্ণ খাল নতুন পানিতে ভরে উঠে । ভরদুপুরে সেখানে আমরা দাপিয়ে বেড়াই । পায়ের কাছে গর্ত করে হাত দিয়ে পানি টেনে সেই গর্ত থেকে চ্যাং আর মিনি মাছ ধরি । খালের পানি শুকিয়ে এলে কাদা থেকে শিং মাছ ধরার উৎসব লেগে যায় । শিং মাছের কাঁটা ফুটলে খুব ব্যথা হয় । কিন্তু এই কাঁটায় আলোইর কিছুই হয়না, পাতিল ভর্তি শিং মাছ ধরে নাচতে নাচতে সে ঘরে ফিরে ।

ঘরে তার ল্যাংড়া বাপ জইল্যা । সারাদিন দস্যিপনা করে বেড়ানো মেয়েকে ধরে বাপ পুকুর ঘাটে নিয়ে যায় । বাংলা সাবান দিয়ে শরীর ঘষে ঘষে ময়লা তুলে । উঠোনে বসিয়ে চুলে নারিকেল তেল মাখিয়ে দেয় । সাথে চলে শাপশাপান্ত- 'আর যদি কারো গাছের ফল চুরি করস, আর যদি গায়ে ধুলোময়লা মাখস, তাইলে ঠ্যাঙ ভাইঙা ঘরে বয়াইয়া রাখমু' । কিন্তু কে শোনে কার কথা! দুপুর গলিয়ে বিকেল হতে না হতেই সঙ্গি সাথি জুটিয়ে আবার সে নিজের কাজে লেগে পড়ে । পাড়ার সবাই তাকে এক নামে ডাকে 'ডাক্কুফুড়ি' । তাকে দেখলেই পাড়ার মহিলারা হৈহৈ করে উঠে, 'সাবধান ডাক্কুফুড়ি, একটা শষায় হাত দিবি না!' শুধু তার দস্যিপনার জন্যই এই উপাধি পেয়েছে তা নয়, আক্ষরিক ভাবেই তার বাপ জইল্যা ছিল ডাকাত ।

হাওড় পাড়ের মানুষের কাছে জইল্যা ডাকাত ছিল মূর্তিমান আতন্ক । পুরো বর্ষাকাল তার বাহিনী নিয়ে ডাকাতি করে বেড়াত । কাকাইলসেঁও-ইটনা-আজমিরিগঞ্জ-মার্কুলি, হাওড়ের এই অংশের গৃহস্থবাড়ি আর মহাজনের নৌকা ছিল তার শিকার । বানিয়াচং থানার পুলিশ তাকে বেশ কয়েকবার গ্রেফতার করে নখের ভেতরে সুই দিয়েছে । কোন লাভ হয়নি । কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের বছরে সে ভীষণ সংকটে পড়ে যায় । বর্ষায় পুরো হাওড় চলে যায় মুক্তিদের দখলে । কচুরিপানা মাথায় নিয়ে হাওড়ের পানিতে ভেসে ভেসে মুক্তিদের অপারেশনের কথা মানুষের মুখে মুখে ঘুরছে । তাদের ভয়ে পাক আর্মি হাওড়ে টহল দেয়া বন্ধ করে বানিয়াচং থানার ভেতরে ক্যাম্প করেছে । বর্ষায় ডাকাতির ভরা মৌসুমে জইল্যা একরকম বেকার হয়ে পড়ে । অনেকে তাকে রেজাকার বাহিনীতে যোগ দিতে বলেছিল । কিন্তু তার কাছে পাক আর্মি আর পুলিশ সমার্থ । পায়ের আঙুলের মরা নখ আর সুই ফোঁটানোর কালচে দাগ খাকি পোষাকের প্রতি তার ঘৃণা উসকে দেয় ।

হাওড়ের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পাকআর্মি আর স্থানীয় শান্তি কমিটি নতুন ছক আঁটে । বিশাল হাওড়ের মধ্যে ছোট দ্বীপের মত ভেসে থাকা হিন্দু অধ্যুষিত সমৃদ্ধ গ্রাম মাকালকান্দি । মুলত কৈবর্ত জেলে-গৃহস্ত আর কিছু চৌধুরীর বাস । ব্রিটিশ আমল থেকেই গ্রামটি ধানে-মাছে ধনী । ছোট্ট গ্রামে অনেকগুলো পাকা ঘর, প্রতিটা বাড়িতেই আলাদা গোলাঘর । একদিন কালভোরে হানাদার বাহিনী নৌকা দিয়ে গ্রামটি ঘিরে ফেলে । প্রাপ্ত বয়স্ক নারী-পুরুষকে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে । তারপর ঘরের ভেতর খুঁজে খুঁজে বাকিদের হত্যা করে । সেদিন তিনশো'র উপরে মানুষ মেরে পাকআর্মি গ্রাম ছাড়ে ।

আর্মি গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার পর রেজাকারেরা বাড়িঘর লুট করা শুরু করে । আশে পাশের গ্রাম থেকে লোভী মানুষের দল নৌকা নিয়ে তাদের সাথে যোগ দেয় । পুরো গ্রাম কাদা-পানি আর মানুষের রক্তে একাকার । লাশগুলো ভয়ার্ত চেহারা নিয়ে ছড়িয়ে পড়ে থাকে পুরো গ্রামজুড়ে । বেঁচে থাকা আর আহতদের আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠে আকাশ বাতাস । মানবিক বিপর্যয়ের এই চরমক্ষণেও রেজাকারেরা চালিয়ে যায় লুটতরাজ । গোলাঘর থেকে ধান এনে লাশ আর রক্ত-কাদার উপর ফেলে চলার পথ তৈরি করে । প্রত্যেকটা বাড়ি থেকে মুল্যবান জিনিসপত্র লুট করে ভরিয়ে ফেলে তাদের নৌকা ।

জইল্যা ডাকাত লুটের খবর পেয়ে একটা ছোট নৌকা নিয়ে মাকালকান্দি পৌছায় । কিন্তু তার পৌছতে দেরি হয়ে যায় । ততক্ষণে লুটেরা বাহিনী ফিরে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে । চারপাশে পড়ে থাকা আহত মানুষের গোঁঙানি আর বেঁচে থাকাদের আর্তনাদে জইল্যা ডাকাতের মন আর্দ্র হয়ে উঠে । হাতে থাকা বৈঠা দিয়ে বাকি লুটেরাদের সে পেটাতে শুরু করে । একটা ঘর থেকে ছোট বাচ্চার আর্তনাদ ভেসে আসছিল । সেখানে মেঝেতে রাখা হারমোনিয়ামের উপর মুখ থুবরে পড়ে আছে এক মহিলার লাশ । দুইতিন বছরের একটা বাচ্চা মেয়ে তার মৃত মা'কে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করছে । মেয়েটাকে দেখে জইল্যার খুব মায়া হয় । বাচ্চাটাকে কোলে নেয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু সে তার মৃত মা'কে কিছুতেই ছাড়বে না । এই সময় দুর থেকে গুলির শব্দ ভেসে আসে । কিছু লুটেরা চিৎকার করে উঠে, 'মুক্তি আইতাছে, তাড়াতাড়ি ভাগো.." । জইল্যা কোনরকম বাচ্চাটাকে কোলে করে নিয়ে আসে । নৌকার কাছে গিয়ে আবার কি মনে করে যেন ঘরে ফিরে আসে । মৃতদেহটা সরিয়ে এক হাতে হারমোনিয়াম আর এক হাতে বাচ্চাকে নিয়ে নৌকায় উঠে ।

মাকালকান্দি গ্রামে পাকআর্মির গণহত্যা আর রেজাকারের লুটের খবর মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে পৌছতেই তারা নৌকা নিয়ে সেদিকে যাত্রা করে । গ্রামের কাছে পৌছে তারা এলোপাথারি গুলি করতে থাকে । গুলির শব্দ পেয়ে লুটেরারা দ্রুত পালিয়ে যায় । সেদিন মুক্তিবাহিনীর গুলিতে কয়েকজন লুটেরা আহত ও নিহত হয় । জইল্যা ডাকাতের পায়ে গুলি লাগে । গুলি খেয়েও জইল্যা প্রাণপনে নৌকা চালিয়ে নিজের গ্রামে ফিরে আসে । সেই থেকে আলোই জইল্যাকে বাপ বলে জানে । গুলি খাওয়া পা'টা অচল হয়ে পড়ায় জইল্যা আর ডাকাতির পেশায় যেতে পারেনি । বিয়েথাও করেনি, কুড়িয়ে পাওয়া আলোই কে নিয়েই তার বাকি জীবন কেটে যায় ।

যুদ্ধ শেষ হওয়ার বছর দুই পরে আলোই'র বেঁচে থাকা স্বজনেরা তার খোঁজ পেয়ে তাকে নিতে এসেছিল । কিন্তু আলোই তার পালক বাপকে ছেড়ে যায়নি । মাকালকান্দি থেকে তার আত্মীয়েরা মাঝে মাঝে তাকে দেখতে আসে, ধান-চাল জামা-কাপড় দিয়ে যায় ।

জইল্যা সারাদিন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বাড়ির কাজকর্ম করে । আর রাত হলেই তার কিছু স্যাঙ্গাত নিয়ে গানের আসর বসায় । গাঁজার কলকিতে ধোঁয়া উঠে, সাথে চলে বাদ্য বাজনা । সে নিজেই সেই কুড়িয়ে আনা হারমোনিয়াম বাজায়, বাজাতে বাজাতে মোটামুটি সুরও তুলতে পারে । আরেকজন তাকে হাতে বানানো ডুগ্গি বাজিয়ে তাল দেয় । মধ্যরাত পর্যন্ত চলে তাদের মরমী গানের আসর ।

কিশোরী আলোই এক সময় দস্যিপনা কমিয়ে ঘরের কাজে থিতু হয় । ঘরের প্রতিটা কাজ সে নিজেই করে, তাই বাপের উপরেও তার সমান দাপট । জইল্যাও তাকে খেপাতে সাহস পায়না । ঘরের কাজকর্ম শেষ হয়ে এলে বিকেলে আলোই পাড়া বেড়ায় । পাড়ার এ ঘর ও ঘর ঘুরে, মহিলাদের সাথে আড্ডা জমায় । মিষ্টিমিষ্টি কথা বলে অনেক মহিলাই তাকে দিয়ে নানান গার্হস্থ্য কাজ করিয়ে নেয় । আর একটু পান-সুপারী খাইয়ে দিলে কথাই নেই, নিজে থেকেই বলবে, 'চাচি দ্যাও, মশলাটা আমি বাইট্যা দেই!'

এই বয়সে মেয়েদের শরীরে যৌবনের বান আসে । এই বয়সে তারা বিনাকারনে হাসতে হাসতে ঢলে পড়ে, আবার পরক্ষণেই বিষণ্নতায় চুপসে যায় । এই বয়সের মেয়েদের দিকে কোন না কোন পুরুষের লোভী চোখ খেলা করে বেড়ায় । এই বয়সের মেয়েদের জীবনে গোপন ভালোলাগা-ভালোবাসা আসে, অন্যরকম আহবানে তাদের শরীর-মন পর্যদুস্ত হয় । কিন্তু এই বয়সে এসেও আলোই যেন দশ বছরের নিষ্পাপ কিশোরী । চিকন লম্বা পা'গুলো দৈর্ঘে আরো বেড়েছে, বুকের উপরের দিকে বেরিয়ে আসা কন্ঠার হাড় আরো বেশি প্রকাশ্যমান । শুধু পার্থক্য এই, শরীরে জীর্ণ জামার বদলে জীর্ণ মলিন শাড়ি পেচায় । অসাবধানতায় শাড়ির আঁচল সরে গিয়ে বুকের শুকনো হাড়গুলোই কেবল হা করে তাকিয়ে থাকে ।

ইদানিং আলোই'র আত্মীয় স্বজন ঘন ঘন আসছে । তারা আলোই কে মাকালকান্দি নিয়ে যেতে চায় । মেয়ে মুসলমান বাড়িতে বড় হয়েছে, তার নিজ সমাজের আচার আচরণ কিছুই জানেনা । একদিন না একদিন তাকে বিয়ে দিতে হবে । তাই আচার-ধর্ম শেখানোর জন্য তাকে তার নিজ গ্রামে নিয়ে যাওয়া হবে । জইল্যা ইতস্তত করে, হাঁ বা না কিছুই বলে না । কিন্তু আলোই মুখের উপর বলে দিয়েছে, এ বাড়ি ছেড়ে সে কোথাও যাবে না ।

আমরা যারা আলোই'র ছোটবেলার খেলার সাথী ছিলাম, সবাই এখন স্কুলের বড় ক্লাসের ছাত্র । আরো অনেক বছর আগে আমরা আলোই কে ত্যাগ করেছি । আমরা স্কুলগামীরা এক সাথে পড়ি, এক সাথে খেলি, এক সাথে আড্ডা দেই । আলোই আমাদের চোখের সামনে হেটে বেড়ালেও আমাদের কারো নজরে পড়েনা । গার্লস স্কুলের মেয়েদের দেখলে আমরা চোখ গোল করে তাকাই, তাদের কেউ সুন্দরী হলে আমাদের চোখ ছানাবড়া হয় । আলোই কে তার স্বজনেরা গ্রামে ফিরিয়ে নিয়েছে কি না, সেই খবরে আমরা কেউ উৎসাহ বোধ করি না । কিংবা ঠিক কতদিন বা কত বছর ধরে আলোই তার গ্রামে গেছে, তারও কোন খবর রাখি না ।

একদিন হঠাৎ করেই আলোই'র বিয়ের খবর পেলাম । আমার মা পাশের বাড়ির মহিলাদের সাথে এই প্রসঙ্গে আলাপ করছিলেন । আলাপ যতোটা না আলোই'র বিয়ে নিয়ে, তার চেয়ে তার পালক বাপ জইল্যা চাচা বিয়েতে কি কি দিবে তা নিয়েই উনাদের যত আগ্রহ । জইল্যা চাচা নাকি আলোই'কে নাকের নথ বানিয়ে দিবে, সোনা দিয়ে । পাত্র কে সোনার আংটি আর একটা সিকো-ফাইভ ঘড়ি দিবে । টাকা যোগার করার জন্য সে তার জমি বিক্রি করে দিয়েছে । আলোই'র বিয়ের খবরে এমন কোন উপাদান ছিলো না যা নিয়ে বন্ধুদের সাথে ভাগ করা যায় । সবাই হয়ত জেনেছে, কিন্তু আমরা কেউই এটা নিয়ে কোন কথা বলার প্রয়োজন বোধ করিনি ।

আলোই ফিরে এলো একদিন, আলো রানী দাশ হয়ে । আমাদের সবার মাথা প্রায় খারাপ করে দিয়ে । বিয়ের কয়েক মাস পর তার স্বামীকে নিয়ে পালক বাবাকে দেখতে এসেছে । বিকেলে আমাদের বাড়িতে এসেছিল । লাল সিল্কের শাড়ি পড়া আলো কে দেখে প্রথমে আমি চিনতে পারি নি । সেই আলো, যার ঢেংঢেঙা চিকন শরীর আর বের হয়ে আসা শুকনো বুকের হাড় চোখে কেবল বিরক্তিই ধরিয়েছে । এখন তার চোখের ঝলক আর কামিনী হাসি বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে । তার পুরুষ্ট গাল বেয়ে, পিনোন্নত বুক বেয়ে, শাড়ির আঁচল বেয়ে, গায়ের সাথে লেপ্টে থাকা ব্লাউজ বেয়ে সদ্য ফোটা যৌবন যেন গলে গলে পড়ছে ।

বন্ধু মহলে আলো'র কামিনী রুপের কথা চাউর হতে বেশি সময় লাগেনি । আমরা কেউ কেউ তাকে দেখে পাগল হয়েছি, কেউবা শুধুই শুনে । দলবেঁধে আমরা চলে যাই জইল্যা চাচার বাড়িতে, আলো'র স্বামীকে দেখার ভান করে । উঠোনে পেতে রাখা কাঠের টুলে বসে আমরা আলো'র স্বামীর সাথে গল্প করি, আড়চোখে আলো কে খুঁজে বেড়াই । আলো'র স্বামী আগে একটা দোকানে চাকরি করতো, বিয়ের পর শ্বশুর বাড়ি থেকে কিছু টাকা পেয়ে নিজেই মার্কুলি বাজারে একটা টং দোকান দিয়েছে । আলো কিছুক্ষণ পর পর এটা ওটা খাবার নিয়ে আসছে, আর আমরা দুচোখ ভরে তার উতল যৌবন ভক্ষণ করছি ।

আলোর স্বামীর সাথে আমাদের মিছে আড্ডা চলতে থাকে । উনাকে কিছু খাতির করতেই হচ্ছে, যৌবনবতী আলো'র বৈধ অধিকারী বলে কথা! আর দিনে দুইবার আড্ডার সুযোগে আমরাও আলো'র আগ্রাসী রুপের আগুনে পুড়ে সেদ্ধ হতে পারছি ।

সুখের দিন দ্রুতই শেষ হয়ে আসে । আলো তার স্বামীকে নিয়ে চলে যাবে । বিদায়ের দিন আমরাও এসেছি । আলো'র স্বামী বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে, আমরা যেন শীঘ্রই মার্কুলি বেড়াতে যাই । আমরা তাকে খুশ দিলে আস্বস্ত করি । বিদায়ের করুণ সুর বেজে যাচ্ছে, আমরাও এতে ক্রমে আক্রান্ত হয়ে চলেছি । জইল্যা চাচার মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না । হঠাৎ করে সে যেন বুড়ো হয়ে গিয়েছে । আমরা অনুধাবন করতে চেষ্টা করি, কতোটা ভালোবেসে সে আলো কে বড় করেছে । আলো তার জীবনে কতোটা জড়িয়ে আছে, আমরা তার রেশ মাত্র অনুমান করতে পারি ।

বিদায়ের অন্তিম মুহূর্তে দেখতে পাই জইল্যা চাচা ঘরে খাটের উপর শুয়ে আছে, ভাঙা হারমোনিয়ামের উপর মাথা রেখে । আলো তার গ্রামে ফিরে যাওয়ার পর তিনি আর এটা বাজান নি । আলো তার পাশে গিয়ে বসে, আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় । ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করার জন্য তাগাদা দেয় । কিছুদিন পরে আবার এসে দেখা করে যাবে বলে কথা দেয় । তারপর এক সময় বাপের দুই হাত ধরে অনুনয় করে, 'বাজান কিছু মনে কইরো না, আমার মায়ের একমাত্র স্মৃতি হইল এই ভাঙা হারমোনিয়াম । এইটা তুমি আমারে দিয়া দ্যাও!"

জইল্যা চাচা নিষ্প্রাণ চোখে আলো'র দিকে তাকিয়ে থাকে । কিছু বলতে গিয়েও যেন বলতে পারছে না, অসহায় দৃষ্টিতে আলো'র দিকে চেয়ে থাকে । এই দৃষ্টি আলো কে ঠিকই বিদ্ধ করে । বাপের হাত দুটি শক্ত করে চেপে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে সে । বাপ তার উঠে বসে, মেয়ের মাথায় মুখে হাত বুলিয়ে বলে, "এইটা খালি তোর মায়ের স্মৃতি না, এইটা আমার মায়েরও একমাত্র স্মৃতি" ।

বাপ-মেয়ের যুগল কান্নার ঢেউ আমাদেরও ভিজিয়ে দিয়েছিল সেদিন ।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জুন, ২০১৪ সকাল ১১:৫৪
৬৯টি মন্তব্য ৬৯টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×