somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প্রত্যাবর্তিত অতীত ও জীবন্ত ভবিষ্যত

৩১ শে অক্টোবর, ২০১৩ সকাল ১০:৫৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কোমল হাতটি জায়গা করে নিল প্রবালের হাতের উপর। শিউরে উঠল প্রবাল। বাতাসে অক্সিজেনের অপ্রতুলতা অনুভব করলো। ঘন নিঃশ্বাস আর দ্রুত হৃত্‍কম্পনে পুরো শরীরে জুড়ে বইতে লাগল লবণাক্ত জলের স্রোতধারা।

এলার্ম ঘড়িটা অনবরত বেজে চলেছে। ভোর পাঁচটা। তরুণ সমাজের কাছে এটি বিছানা ছাড়ার সময় না, বিছানায় যাবার সময়। প্রবালও এরকমই ছিল। কত রাত চাঁদ দেখে কাটিয়েছে!! অবলোকন করেছে রাতের সৌন্দর্য, উপভোগ করেছে আলো আধারের খেলা। ছন্দ মিলিয়েছে জোনাকীর আলো আর ঝিঁঝিঁ পোকার সাথে। গা ভাসিয়েছে অন্ধকারের অবগাহনে। গত একমাসে সবকিছু পাল্টে গেছে। হারিয়ে গেছে ছায়াঘেরা ১৮ বছরের জগত। পাল্টে গেছে জীবনের রোডম্যাপ।

অনেকটা চোখ বুজেই বিছানা ছাড়ল। শাওয়ার নিচ্ছে আর আশি ভাগ ভুলে যাওয়া স্বপ্নের বাকি বিশভাগ মনে করার চেষ্টা করছে। অস্পষ্ট একটা হাতছাড়া সবকিছুই হারিয়ে গেছে তার মস্তিষ্ক থেকে। দুঃস্বপ্নের বিষচক্রে ঘুরপাক খাওয়া মানুষের মনে এসব স্বপ্ন সহজে আঁচড় কাটতে পারে না। তবুও কেন জানি প্রবালের মনে খানিকটা হলেও দাগ কেটে গেছে।

ফজরের নামাজ পড়লো। গত একমাস ধরে এক ওয়াক্ত নামাজও বাদ দেয়নি। নিজেকে সম্পূর্ণরুপে সমর্পণ করেছে খোদার কাছে। একমাত্র সৃষ্টিকর্তার উপরইতো ভরসা করা যায়। প্রতিটা নামাজ শেষে তার শুধু একটিই চাওয়া তার প্রাণের বিনিময়ে হলেও একটি প্রাণ ভিক্ষা। যদিও সে জানেনা যার জীবন সে বাঁচাতে চাইছে তাকে ছাড়া সে একমুহূর্তও বাচঁতে পারবে না। প্রবালই তো তার একমাত্র অবলম্বন।

হাসপাতালে নুসরাত বেগম শুয়ে আছে। এখনও ঘুম ভাঙেনি। ইনি প্রবালের মা। প্রবাল নিরবে প্রবেশ করে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। সকালের মিষ্টি আলোর আভায় পবিত্র মুখখানি জ্বলজ্বল করছে। প্রকৃতির সমস্ত সৌন্দর্য যেন ঠিকরে পড়েছে তার মুখের উপর। জন্ম থেকে শুরু করে কত রজনী কাটিয়েছে এই মহিলার বুকে মাথা রেখে! কত হাসি-আন্দের মুহূর্ত পেয়েছে এই মানুষটির জন্য! প্রবালের চোখ অশ্রুতে জ্বলজল করে উঠল।

ছেলের শরীরের গন্ধ পেলে ইনি আর ঘুমাতে পারেন না। তার কাছে প্রবাল এখনও সেই ছোট্টটি। সবসময় চোখের সামনে থাকে না। তাই যতক্ষণ থাকে ততক্ষণই আগলে রাখতে চায় নিজের বাহুডোরে। প্রবাল ফ্লাস্ক থেকে কফি ঢালছে। কফি ইনার খুব পছন্দ। এক কাপ কফি যে কারো মন এত ভালো করতে পারে তা এনাকে না দেখলে কল্পণাও করা যাবে না। অত্যন্ত সৌখিন মহিলা। হাসি খুশি চেহারা দেখে কেউ বলতে পারবে না, ইনি প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে চলেছেন মৃত্যুর সাথে। মরণব্যাধীর কড়াল গ্রাসে ভেতরে ভেতরে নিঃশেষ হয়ে গেলেও বাইরে তিনি সদ্য প্রস্ফূটিত গোলাপের মতই সজীব, প্রাণবন্ত।

নিজকে প্রাণবন্ত রাখার আরেকটা কারণ হলো প্রবাল'কে কোন কষ্ট না দেওয়া। প্রবাল সবই বোঝে কিন্তু বহিঃপ্রকাশ ঘটায় শুধু সেটুকুরই যেটুকু তার মা বোঝাতে চায়। চাপা কষ্টে দুজনই মৃদু হাসির অভিনয় করলেও দুশ্চিন্তার ছাপগুলো অবদমিত করতে পারে না।

আত্মীয়স্বজন বলতে যারা আছে তারা থেকেও নেই। চীনের মহাপ্রাচীরের মত অভেদ্য একটা দেয়াল দাড়িয়ে আছে তাদের সম্পর্কের মাঝে। প্রবালের বাবা আশরাফ সাহেবের সাথে তার দাদার পরিবার সমস্ত সম্পর্ক চুকিয়ে ফেলেছিলেন প্রবালের মাকে ভালবাসার কারণে। আর নানার পরিবার বলতে কিছু ছিলনা। এতিমখানায় বড় হওয়া নুসরাত বেগমকে যেন পৃথিবীর সর্বসুখ এনে দিয়েছিলেন আশরাফ সাহেব। বেশী সুখ কপালে সহ্য হয় না। তাই অদৃষ্ট আশরাফ সাহেবকে তুলে নিলেন পৃথিবী থেকে। একমাত্র সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে প্রতিদিন মরেও বেঁচে ছিলেন নুসরাত বেগম।

প্রায় প্রতিদিনই একবার করে হলেও প্রবালের মাকে দেখতে আসে সোমা। আজও আসলো। প্রবাল আর সোমা খুব ভালো বন্ধু। তাদের বন্ধুত্ব ক্লাস ওয়ান থেকেই। প্রথম যেদিন সোমাকে দেখে সেদিন সোমার উপর প্রবালের চরম রাগ হয়েছিল। রাগের কারণ ছিল সোমার হাসি আর হাসির কারণ ছিল প্রবালের মুখে আর শার্টে কলমের উগলে দেওয়া কালো কালি। পরবর্তীতে এই রাগই তাদের মাঝে গড়ে তোলে ঘনিষ্ট বন্ধুত্ব। একই সাথে পার করে স্কুল, কলেজ লাইফ। ভার্সিটি লাইফে পড়ালেখার মধ্যে দূরত্ব তৈরী হলেও তাদের সম্পর্ক একটুও দূরত্ব তৈরী হয়নি। এখনও প্রায় বিকেলেই দুজন আড্ডা মারতে চলে যায় ছোটবেলার খেলাঘর নদীতীরে।

দিন যত যাচ্ছে নুসরাত বেগমের অবস্হার ততই অবনতি হচ্ছে। তিনিও চাইছেন না পৃথিবীতে থাকতে। আশরাফ সাহেব যে, এত বছর ধরে তার জন্য প্রতীক্ষা করছেন। প্রতীক্ষা করাতে করাতে তিনি এখন ক্লান্ত। সময় এসেছে অবসানের। শুধু প্রবাল'কে নিয়েই যত চিন্তা। তাই ছেলের অগোচরেই তার দায়িত্বভারের অনুরোধটা সোমাকে তিনি করেই ফেললেন।




৫ বছর পর

অন্ধকারটা ঘনিয়ে এসেছে। প্রবালের কাঁধে হাত রেখে দাড়িয়ে আছে সোমা। স্বপ্নের অচেনারুপী চিরচেনা অস্পষ্ট হাতটা হঠাত্‍ করেই মায়ের মৃত্যুর পর কল্পণাজগত থেকে উঠে এসেছিল জীবণ জগতে। মৃত্যুশয্যায় শায়িত নুসরাত বেগমের সেদিনের অনুরোধ ফেলতে পারেনি সোমা। আবার সোমা যতখানানি প্রবালকে জানে ততখানি প্রবাল নিজেও জানে না। অগভীর সম্পর্কে জড়াতে গেলে এর থেকে আর কত গভীর জানাশোনারই বা প্রয়োজন হয়। এ ব্যাপারে প্রবাল এখনও কিছু জানে না। সোমা কিছু জানায়ও নি। কিছু কিছু কথা অগোচরে থাকাই ভালো। তাতে তার প্রকৃত মর্যাদা অক্ষুন্ন থাকে।
প্রবাল মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছেন সোমার দেওয়া শ্রেষ্ঠ উপহারটার দিকে। উপহারটা যেন নিগূঢ় বিস্ময়ের আঁকর। যেন কোন দক্ষ শিল্পীর নরম তুলির আচড়ে সুণিপুণভাবে আঁকা কোন ছবি। নিষ্পাপ মুখখানি যেন হুবহু তার মায়েরই প্রতিচ্ছবি। আকাশে দুটি তাঁরা জ্বলজ্বল করছে। প্রবালের কেন জানি মনে হচ্ছে তাঁরা দুটি তার বহুপরিচিত। প্রবালের নিউরন যেন সরাসরি তাদের সাথে ভাব বিনিময় করছে। আকাশের তাঁরা আর কোলের তাঁরার ঝলকানি অবদমিত করে ফেলেছে অন্ধকারকে। চারপাশ আলোময়। এই আলোর সাথে জীবন প্রদীপের আলোর অনেক মিল। অন্ধকার পৃথিবীর মাঝখানে জীবন প্রদীপের আলোর বৃত্তটি ধীরে ধীর সংকুচিত হচ্ছে। সকলেরই অপেক্ষা কখন বৃত্তটি পরিণত হবে ছোট্ট অমোঘ সংকেতবহনকারী অপ্রতিরোধ্য বিন্দুতে।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমরা কেন এমন হলাম না!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪১


জাপানের আইচি প্রদেশের নাগোইয়া শহর থেকে ফিরছি৷ গন্তব্য হোক্কাইদো প্রদেশের সাপ্পোরো৷ সাপ্পোরো থেকেই নাগোইয়া এসেছিলাম৷ দুইটা কারণে নাগোইয়া ভালো লেগেছিল৷ সাপ্পোরোতে তখন বিশ ফুটের বেশি পুরু বরফের ম্তুপ৷ পৃথিবীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিমানের দেয়াল

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৪




অভিমানের পাহাড় জমেছে তোমার বুকে, বলোনিতো আগে
হাসিমুখ দিয়ে যতনে লুকিয়ে রেখেছো সব বিষাদ, বুঝিনি তা
একবার যদি জানতাম তোমার অন্তরটাকে ভুল দূর হতো চোখের পলকে
দিলেনা সুযোগ, জ্বলে পুড়ে বুক, জড়িয়ে ধরেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি

লিখেছেন প্রামানিক, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



২৬শে মার্চের পরে গাইবান্ধা কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের উপর ট্রেনিং শুরু হয়। আমার বড় ভাই তখন ওই কলেজের বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি রোভার স্কাউটে নাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিকেল বেলা লাস ভেগাস – ছবি ব্লগ ১

লিখেছেন শোভন শামস, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৫


তিনটার সময় হোটেল সার্কাস সার্কাসের রিসিপশনে আসলাম, ১৬ তালায় আমাদের হোটেল রুম। বিকেলে গাড়িতে করে শহর দেখতে রওয়ানা হলাম, এম জি এম হোটেলের পার্কিং এ গাড়ি রেখে হেঁটে শহরটা ঘুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

One lost eye will open thousands of Muslims' blind eyes

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭



শিরোনাম'টি একজনের কমেন্ট থেকে ধার করা। Mar Mari Emmanuel যিনি অস্ট্রেলীয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি চার্চের একজন যাজক; খুবই নিরীহ এবং গোবেচারা টাইপের বয়স্ক এই লোকটি যে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×