somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কাকগৃহ

২৩ শে মার্চ, ২০০৮ রাত ১১:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১.
শান্ত পাখায় কিন্তু সাঁ সাঁ করে ভাসছে আকাশে ঈগলটা। আকাশ বলতে কেবল জমাট বাধা ধূলো, আর ধোঁয়া, আর তার সঙ্গে নগর-কুয়াশা। নিরেট ধূসর, নিখাদ শুকনা মাটির রঙ। নীল নয় একটুও। নীল ছিল কখনো হয়তো। আর ইংরেজি ব্যাকরণ বইয়ে ক্রিয়াপদ শিখবার বেলায় 'আকাশ নীল' ছিল। ধূসর রঙের এই আকাশ তবুও আকাশ ছিল। এখন যখন এই ঈগলটা আকাশে ভাসছে আরো স্পষ্টভাবে বোঝা যায় অন্তত ধূসর -- নীল নয় -- যে আকাশটা ছিল সেটাও আর নেই। আকাশের প্রান্তসীমা ভেঙে ভেঙে বসতবাড়িরা ঢুকে পড়েছে। এরকম আকাশে ঈগলদের ভাসতে কেমন লাগে সেটা নিয়ে আলোচনার কোন সুযোগ নেই। এমনকি আদৌ ঈগলরা ভাসা ভিন্ন আর কোন কাজ কখনো করে কিনা সেকথাও জানার উপায় নেই। সে এক ঈগল গোত্রীয়দের ব্যাপারে যিনি খোঁজ-খবর রাখতেন সেই জীবনানন্দ দাশের সঙ্গেও কোন নিয়মিত যোগাযোগ রাখা হচ্ছে না, ইদানীং রাখা হয় না। আমার, এবং হতে পারে, অন্য অনেকেরই, ভিন্ন ভিন্ন কারণে। তবুও ঈগলটি যখন ভেসে বেড়ায়, আকাশের প্রান্তসীমা ভেঙে যে বসতবাড়িরা ঢুকে পড়েছিল, সেই বাড়িগুলোর বারান্দায় বারান্দায় মানুষেরা জমে যায়। এই ঈগলটিকে তারা স্বাগত জানায় নাকি ঈগলটিকে ভাসতে দেখে আমোদিত হয় তা বোঝা যায় না। সেই মুখগুলো দূরপরাহত। আর ততক্ষণ মনে হয় ঈগলের এই ভেসে থাকাই বুঝি মুখ্য ঘটনা। অকস্মাৎ চারধার থেকে তুলকালাম কাকেরা উড়ে আসে। ঈগলটার চারপাশে ঘুরে ঘুরে উড়তে থাকে। তাদের চিৎকারে চমকে ওঠে বারান্দায় দাঁড়ানো মানুষেরা। নির্দ্বিধ আমরা প্রথমত অবগত হই বার্তাটি, এবং ক্রমশ অনুভব করি যে এই কাকেরা স্বাগত জানায়নি। আর কাকেদের চিৎকারে বারান্দার মানুষজন আকস্মিক কর্তব্যবিভ্রাটে আটকা পড়ে যায়। কিন্তু নির্বিকার ঈগল উড়ে চলে।

২.
তিয়েন আনমেন স্কোয়ারে মানুষের ভিড় ছিল। ভিড়গুলো নানাবিধ উদ্দেশ্যমাফিক। অনেকটা গুলিস্তানে যেরকম ভিড় থাকে সেরকম। কিংবা গোটা ঢাকার ফুটপাতেই যেরকম মানুষের ভিড় থাকে। মানুষেরা নিরন্তর কথা বলে। কথা বলতেই হয়। কথা দিয়ে যে রাজ্য তৈরি হয় সেখানে বস্তুসকল বসবাস করে। কথার অধিকন্তু জিনিসপত্তরকে চেনার কোন রাস্তাই নেই। অন্তত আমাদের সেরকমই প্রস্তুতি আর অনুশীলন। তিয়েন আনমেন স্কোয়ারের সেই ভিড়ে মানুষের কথামালা, আর সেখানে হত্যাকাণ্ডের কথা কিছুতেই মানুষ এড়িয়ে যেতে পারে না। আবার খুব আলগোছে ছাড়া তা নিয়ে আলাপ করতেও পারে না। অধিকন্তু, উত্তরের পর্যটকেরা কেবল সেটাকেই তিয়েন আনমেন সংক্রান্ত একমাত্র আলাপমালা মনে করে। ফলে নির্বিচার বাদ পড়ে যায় ফিরিওয়ালার টুকরিগুলো, আর তাতে ভরে থাকা হরেক রহস্যের ঝাঁপি। আমাদের ফোটোগ্রাফার বন্ধুর এগুলো চোখ এড়ায় না। ওর ক্যামেরা আর চোখ দুটোই বোধিতে পাল্লা দিয়ে ছোটে। তাই অনায়াসেই দেখতে পায় তিয়েন আনমেন স্কোয়ারের সম্মুখভিড়ে ফিরিওয়ালার ঝুড়িতে টুকটুকে লাল সিগারেট-বাতি। তার গায়ে বিপ্লবের মহানায়কের ছবি -- মাও। আর টিপি দিলে সেটা সিন্থাসাইজড অর্কেস্ট্রাও শোনায় -- সাংস্কৃতিক বিপ্লবের গান। সেটা ও নিয়ে এসেছিল। যদিও সিগারেটে ওর রুচি নেই। আর এই পেল্লাই ঘুড়ি আর লাটাইও দেখেছিল। সিল্কের ফিনফিনে কাপড় দিয়ে বানানো ঈগল, কারুকারের হাত কী নিখুঁত, একে জৈব ঈগল বলেই মনে হয়, সঙ্গে লাল টুকটুকে লাটাই। সেটা এখন ওর হাতে। আর ওর চোখ ক্যামেরা নয়, এখন উড়ন্ত ঈগলটাকে দেখছে। গভীর মনোযোগে। ঠিক যেরকম ক্যামেরার মধ্যে বা বাইরে ও দেখে। আমরাও ঈগলটাকে দেখি -- আমরা, মানে বন্ধুরা আর আমি।

৩.
কাকেদের নিবাস কোথায় আমরা সে বিষয়ে অনেক অবগত থাকি না। এমনকি তাদের নিবাস যে একটা প্রসঙ্গ সেটাও আমাদের কখনো মনে হয়নি। অন্তত আমার হয়নি। আমরা সর্বদাই দেখি তাদের কর্মেক্ষেত্রে -- ব্যস্ত, যূথবদ্ধ, এবং সতর্ক। ফেলে আসা মফস্বলগুলোর, কিংবা বিরলপ্রায় ঢাকার রাস্তায় নারকেল গাছের ডানাগুলোতে আমরা ওদের থাকতে দেখেছি। কিন্তু সেইটুকু জ্ঞান ভীষণ বিপন্ন করে দেয়। আজ, যখন লালরঙা লাটাইয়ে পাকা হাত আকাশে জৈবপ্রায় ঈগলটাকে ওড়াচ্ছে আর আমরা এতগুলো ছাদবাসী মানুষ আমাদের বসতগৃহ ছেড়ে ঈগলের প্রতিপালক হয়ে এসেছি। হোক সে সিল্কের ঈগল। তবু কাকেদের কোন জ্ঞান নেই জৈব-ঈগল আর রেশমী কাপড়ের ঈগলের ভেদবিচার করে। তাই কাকেদের চেঁচামেচি আমাদের নিশ্চিত ঈগল-ভাসানে ছন্দপতন ঘটায়। আমুদে ব্যালকনির যাত্রীরা কাকেদের কিভাবে গ্রহণ করেন সে আলোচনা ছাদ বেয়ে আমরা গড়ে তুলতে পারি না। কাকেরা কিন্তু বেজায় চেঁচাচ্ছে।

৪.
ক্রমশ আরো কাক, আরো অজস্র কাক আমাদের মাথার ওপরে ঘুরপাক খেতে থাকে। উড়তে থাকে। আর ডাকতে থাকে -- তারস্বর, একটানা। আর কান্ত হয়ে, কিংবা নতুন কর্ম-পরিকল্পনা পাকা করে নেবার ব্যাপারে ভেবে নিতে, ওরা গিয়ে বসে সেইসব ছাদে যেগুলোর নিচেই ব্যালকনিমণ্ডলী জুড়ে আমাদের দর্শকেরা। কাকেরা একদল যখন বসে, অন্যদল তখনো আকাশে চক্কর দেয়, চিৎকার করে। আবার সেইদল গিয়ে বসে, অন্যেরা আকাশের দখল নিতে আসে। এবং ওরা এখনো সতর্ক, এখনো যূথবদ্ধ, এখনো ব্যস্ত। ওদের সতর্কতার সবচে বড় লক্ষ্য খোদ ওই ঈগল। ওরা ঈগলটির সঙ্গে প্রথমত কোনরকম সংঘর্ষ এড়িয়ে যায়। ক্রমশ আমরা নিশ্চিত হতে থাকি এই চিৎকার, ওড়াওড়ি আর বিশাল জমায়েত প্রাথমিকভাবে ভয়ের, আর সংশয়ের। সতর্ক, যূথবদ্ধ, ব্যস্ত ওরা এমনকি এখন অস্থির, আর ভয়ার্ত। বেদখলের সংশয় কিংবা আশঙ্কা কাকেদের অস্থির করে দিয়েছে। ঈগলটা তা জানে না। কিন্তু আমরা, এবং আমি ততণে জেনে গেছি। ব্যালকনি ঘিরে উত্তেজনা। একটা দারুণ ক্রীড়াময়তা আচ্ছন্ন করে ফেলেছে আকাশটাকে। মাথা-ঢোকানো দালানগুলোর পরন্তু যেটুকু আকাশ আর অবশিষ্ট তা তখন স্টেডিয়াম যেন। আর বারান্দা ব্যালকনিময় ক্রীড়ার উত্তেজনা। কাকেরা তা বিবেচনা করে কিনা তা আমরা কিছুতেই বুঝতে পারি না। কেবল আরও অকস্মাৎ একেকটা কাক সাহসী হয়ে ওঠে। তাদের নিজব্যোম খোয়াবে না বলে ছুটে এসে একেকটা ঠোকর দিতে শুরু করে ঈগলটাকে, যার কোন ভ্রূক্ষেপও নেই। শত্রুর ভয়ে নিরন্তর বসবাস, আর বেদখলের সংশয় এই কাকেরা প্রত্যাখ্যান করেছে।

৫.
অতঃপর ঢাকার আকাশে কাকেরা নিজব্যোম খোয়ানোর আশঙ্কায় উড়ছে, চেঁচাচ্ছে। অজস্র, অগণ্য। আমাদের মাথার ওপরে খালি আকাশ আর প্রায় থাকেই না। কাকেদের লোকে লোকারণ্য হয়। এবং আমরা, নিবিড় জ্ঞানসঞ্চয়হেতু নিদারুণ বিহ্বল হয়ে পড়ি। কাকেদের সতর্কতার পাশে আমাদের সেই বিহ্বলতা, বিশেষ, আমার বিহ্বলতা খাপছাড়া ঠেকে। ওদের নিবাস কোথায়! কীসের দখল নিয়ে এই মুখরতা, বিক্ষোভ! অথচ কী আশ্চর্য! নিবাস ছাড়া আমরা আর কীইবা রক্ষা করতে চাইতে পারি? তথাপি, কাকেদের নিবাস সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান কেবল ঐ একটা কাহিনীই আশ্রয় করে আছে।

"কোকিলের গৃহ নেই, আর কাকেদের গৃহ আছে। কোকিল বসন্তে সমাগত হয়। আমাদের চারপাশে সমাগত হয়, আবার পরস্পর সমাগত হয়। তাদের সমাগম অপরাপর প্রাণীর মত সঙ্গমমুখী। ফলতঃ গৃহহীন কোকিলকুল ডিম পাড়বার জন্য ব্যাকুল হয় গৃহের খোঁজে। আর এটাই নিয়তি যে তারা কাকের গৃহসকল খুঁজে পায়। সেখানে ডিম পাড়ে। আর ডিমগুলো, আমাদের জানা নেই, কাকেরা নিজেদের বলেই মনে করে। আর তারা সেগুলোতে উষ্ণতা দেয়, জীবনের জন্য যা অত্যাবশ্যক -- কাকেদের, কোকিলকুলের, কিংবা আমাদের। সন্তান কোকিলেরা জনক-জননী, উষ্ণতাদাতা-দাত্রী কাকেদের পরিত্যাগের জন্য কেবল পাখার অপেক্ষা করে, উড়বার জন্য যা অত্যাবশ্যক। তারপর একদিন, কোনদিন, যখন সেই পাখা প্রসারিত হয়, শরীর ভাসিয়ে নিতে পারে -- তখন কোকিলেরা একা বা দল বেঁধে কাকেদের নিবাস ত্যাগ করে। এর সঙ্গে ঈগলদের কোন সম্বন্ধ জানা যায় না।"

গল্পটা ভীষণ রহস্যময়। আমরা কিছুতেই জানতে পারি না কেন কোকিল আর কোন পাখিদের গৃহ খুঁজে পায় না। আমরা এও জানতে পারি না কোকিলের ডিমপাড়ার কালে কীভাবে, আর কেনই বা, কাকেদের গৃহ অরক্ষিত থাকে। এমনকি, ভেবে দেখলে, এসকল দুর্ভাবনাও আমাদেরকে আনত করে যে কাকেদের গৃহ কোথায়, আর কেমনই বা! কোকিলের জন্য বড় মনোলোভা কি! কখনো কি স্বচ্ছল কুশল সফরে কৃতজ্ঞতা জানাতে যায় কোকিলেরা? কাকেদের গৃহে? এসব আমরা না জেনেই থাকি। বসবাস করি আমাদের ঢাকা নগরীতে। এমনকি আজও যখন কাকেদের লোকারণ্য। গল্পটার অর্থনির্দেশ আমরা কেবল টের পেতে থাকি। কাকেদের অর্বাচীনতা। আর কোকিলকুলের সপ্রতিভতা, এমনকি চাতুর্য। কোথাও কি শুনেছি কখনো গৃহস্থ কাকেদের সংসার জীবনের কথা? প্রতিপালনের কথা? জনক-জননী হয়ে নিরুপায় নিরুচ্চার সন্তান-বেদখলের যন্ত্রণার কথা?

৬.
মা বলছিলেন একটা রঙ্গিন ট্রাঙ্ক আনতে। বাবাও তাই চাইছিলেন। সুন্দর রঙ্গিন ফুলতোলা একটা রঙ্গিন ট্রাঙ্ক। ঠিক যেমনটা খাটের নিচে পুরোনো লুঙ্গিতে মোড়ানো ট্রাঙ্কটা মা-বাবার এতদিনের সংসারের একজন হয়ে আছে। ওর ভেতরে নানাবিধ খুঁটিনাটি জিনিস। হয়তো অমূল্য কিছুও। মা ওটাকে তালা দিয়ে রাখেন। আর আমার কিছুতেই ফুলতোলা ট্রাঙ্ক নিয়ে ঢাকা আসতে মন চাইছিল না। আমার নবলব্ধ সামাজিক অস্তিত্বে ওই ফুলগুলো কাঁটার মত বিঁধত। আমি চাইতাম একরঙা। কেবল সেনাবাহিনীর জওয়ানেরাই তখন ওগুলো ব্যবহার করে। দোকানে গিয়ে সেইমত বায়না করা হলো। আর ট্রাঙ্কের দোকানীর এতে কিছুই যায় আসে না। বরং একরঙা কালো ট্রাঙ্ক তার সহজ কারিগরি। একদিন বাবা আর আমি কালো রঙের ট্রাঙ্কখানা রিকশায় চাপিয়ে নিয়ে বাড়ি ফিরি। আর সেইদিনের পর ট্রাঙ্কটা আবার চেপে বসল। এবারে গাড়ি। দূরপাল্লার গাড়ির ছাদে তালা-লাগানো ট্রাঙ্কটা, ওটার কোঁচরে তখন আমার শৈশব আর কৈশোর ভরে নিয়ে বাসে চাপি। ট্রাঙ্কটা প্রথমবারের মত গাড়িতে চেপে, ছাদে, লাফাতে লাফাতে ঢাকা চলে আসে। ঢাকা নগরে আমার নিবাসের পয়লা নিমিত্ত হয় ওই ট্রাঙ্ক। কুচকুচে মিষ্টি কালো, ফুলতোলা নয়। সেই থেকে ঢাকা নগরী আমার হয়ে গেল। সে কবেকার কথা। অথচ এরপর আর ওই ট্রাঙ্কের কোন খোঁজ জানা নেই। এক অনিচ্ছুক স্মৃতিভ্রমে, কিংবা কিজানি, কোন এক পূর্বগৃহে রেখে এসেছি। কোথায় সে কথাও মনে করতে পারি না।

৭.
বারান্দা আর ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষেরা কাকেদের বিপন্নতা দেখে। আর পুলকিত হয়। এই বারান্দা আর এই ব্যালকনি যেসব গৃহে সেগুলোতে তাদের নিশ্চিত নিবাস। নিশ্চিত, আবার নিশ্চিত নয়। কারণ মালিকানা প্রসঙ্গ এখানে গুরুতর। আকাশের বেলায় সেটা ভিন্ন। মানুষেরা, যারা আকাশে কালেভদ্রে থাকে -- তাও সকলে নয়, তাও বহুকাল নয় -- ক্কচিৎ, ক'জনা -- তাদের ভূমিনিবাস নিয়েই ভাবনা। তারা এখন যে যেখানে থাকে, সেখানে আরো কিছুকাল থাকবে হয়তো। নির্ভর করে এটা তাদের মালিকানায় কিনা। আমি জানি, তেমনি অন্যেরাও জানেন, মালিকেরা সংখ্যায় নগণ্য হয়। সেই অর্থে মানুষগুলোর নিবাস অনিশ্চিত। আবার, বারান্দা-ব্যালকনি ধরে যে মানুষেরা দাঁড়িয়ে, তারা থাকে ঢাকার আকাশে মাথা গলিয়ে পড়া বাড়িগুলোতে। মাথা গলিয়ে তারা থাকবে। ঢাকাতেই। তাদের বাস্তুচ্যুতি নেই। এ বাড়ি থেকে অন্য বাড়ি। গৃহ থেকে গৃহান্তর। সে অর্থে তাদের নিশ্চিত নিবাস।
গৃহান্তরকে কি কেউ বাস্তুচ্যুতি বলে? গৃহসকল পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে। গৃহান্তর তাই অভিযাত্রা। বাস্তুচ্যুতি অন্য মানুষের গল্প। কিংবা কাকেদেরও -- এই ভরবিকেলে যারা নিশ্চিত ব্যস্ত-সফর বাদ দিয়ে ঈগলকে ধাওয়া দিয়ে বেড়াচ্ছে, তাও এক অজৈব ঈগল।

৮.
গৃহস্থ মানুষদের জৈব-সন্তানেরা নিরন্তর ঢাকা থেকে চলে যায়। গৃহস্থেরা যত বড়, তাদের সন্তানদের, বিশেষত পুত্রদের তত বড় যাত্রা। সেই পুত্রেরা, কখনো কন্যারা, যায়। তারা আকাশে ওড়ে এবং ওড়া সমাপ্ত করে টেলিফোনে, কিংবা ইদানীং ইমেইলে, জানায় তারা ভাল আছে, তারা ওখানেই থাকতে চায়। পরের বার তারা জানায় কেন এবং কীভাবে ঢাকার থেকে ওখানে থাকা ভাল। তার পরের বার তারা জানায় কেন ঢাকাতে থাকা কিছুতেই ভাল নয়। এবং শেষবার নিবাস বিষয়ে ফয়সালা আরো পোক্ত করে তারা জানায় ঢাকা গেলে তাদের গা গুলাতে শুরু করবে, তাদের সন্তান-সন্ততিদের স্বাস্থ্য-বিপর্যয় ঘটবে। অথবা, তারা এখন কোষাগারের দয়ায় অনেক বড় ক্রেতা, এখন যেতে নেই। কিংবা ঢাকায় কীইবা উপার্জন করা যাবে -- এই প্রশ্ন রাখে। ইমেইলে কিংবা টেলিফোনে এই বার্তা পেয়ে জৈব জনক-জননীরা জানালায় দাঁড়ায় কিনা, ব্যালকনি কিংবা বারান্দাতে দাঁড়ায় কিনা, আর দাঁড়িয়ে কাকেদের খোঁজ নিতে চায় কিনা, কুশল বিনিময় করে কিনা -- সেসকল বার্তার আমি কোনদিন তল পাই না। আর এগুলো বিশেষ সহজ কোন জিজ্ঞাসা নয়। এই প্রশ্নের মীমাংসা নির্ভর করে ব্যালকনি-মানুষেরা কাক নাকি কোকিল-সদ্ভাবী!

৯.
ঈগলটা সূতোয় ধরা ছিল, লাটাইয়ে, তার পেছনে হাতে। সে নেমে এল। সন্ধ্যা সমাচ্ছন্ন। আকাশে ঘুড়ি ওড়াবার বেলা ছিল না আর। আমরা বন্ধুরা ফ্যাটবাড়ির ছাদ থেকে নামি। আমাদের নগর-গৃহ! একেকটি ছাদের নিচে অনেক গৃহ, গৃহের মোজাইক, মোজাইকের গৃহ। আমরা নিশ্চিতভাবে নিজ নিজ গৃহে উপগত হয়েছিলাম সেই সন্ধ্যায়। মা-কে একটা চিঠি লিখতে বসি রাত্রিকালে, ছোট্ট মফস্বলের ততোধিক ছোট গৃহে বসে মা সেখানি পড়বেন:
"মা, অনেকদিন ... সেই যে কালো ট্রাঙ্কখানা, আমি হারিয়ে ফেলেছি। ওই দোকানে বাবাকে বলে একখানা বানাতে ব'ল। আমি এবারে গিয়ে নিয়ে আসতে চাই। না, কোন প্রয়োজন নেই এখন। তবুও, ওটাকেই আমি আগেরটা ভেবে রেখে দেব। ... মা, তুমি কি কখনো তোমার দেশের বাড়িতে গিয়েছিলে? বরিশালের কোন গ্রাম যেন! তুমি না বলেছিলে সেখানে কেউ থাকে না? সেই একা বিধবা জেঠিমা তোমার, তিনিও তো মরে গেছেন। এবারে কি যাবে? দেখো, খুঁজে খুঁজে আমরা ঠিকই যেতে পারব। কেউ না কেউ ঠিকই থাকতে দেবে, দেখো। আসবার পথে খুলনা হয়ে আবার বাবাদের দেশের বাড়িতেও যাব। তিন-চার দিনের তো ব্যাপার। যাবে? ... ট্র্যাঙ্কটার কথা ভুলো না যেন। আমি ২ দিনের বেশি থাকতে পারব না। তোমরা ভাল থেকো।

-- ইতি
তোমাদের "কাক-সন্তান"

(২৮ ফেব্রুয়ারি -- ১৮ই আগস্ট ২০০৩/শ্যামলী)

প্রকাশ:
বাংলা প্রকাশ: প্রথম আলো, ১৩ই ফেব্রুয়ারি ২০০৪
ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ: ডেইলি স্টার লিটারেচার, ডেইলি স্টার, ১১ অক্টোবর ২০০৩ (খাদেমুল ইসলামের অনুবাদ); কিয়োটো জার্নাল, সংখ্যা ৬৪, কিয়োটো

একটা নেহায়েৎ "ব্যক্তিগত" টীকা:
পুরোনো লেখা কি উৎসর্গ চলে? আমার কোনো ন্যায্যতা বোধ নেই। শহীদুল জহির-এর মৃত্যুর খবর জানার পর থেকে আমার কেবল নিবাসের কথাই মাথায় ঘুরে চলেছে। নিশ্চয়ই এর মনো-সামাজিক বিশ্লেষণ সম্ভব। কিন্তু নিজেকে সাবজেক্ট বানিয়ে ঠিক এক্ষুনি তা চাই না। বরং নিবাস নিয়ে পুরাতন এই লেখাটাই পুনর্পাঠ করি। পুনর্পাঠ কিংবা পুন:পৌণিক পাঠ। পাঠ কিংবা অভিযাত্রা। অভিযাত্রা কিংবা ঘুরঘুরানি... পুনরাবর্তন। - মোহাম্মদপুর, ২৩.১২.০৮
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মার্চ, ২০০৮ রাত ১:২৯
৫৯টি মন্তব্য ৪৮টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×