অ্যামেরিকায় থাকার সুবিধা হচ্ছে বিশ্বের এমন কোন জাতি নাই যে জাতির লোকের দেখা এই দেশে মেলে না। বাঙালি বলেন, আফ্রিকান বলেন, ভিয়েতনামি বলেন সব এদেশে উপস্থিত। চাইনিজ আর ভারতীয় সংখ্যাতো লাখে লাখে। ভারতীয়দের মধ্যেও যে কত জাতের মানুষ আছেন, সেটা এইদেশে এসে উপলব্ধি করলাম। অথচ একটা জীবন ওদের প্রতিবেশি হয়েই কাটিয়ে দিয়েছিলাম। ভাবতাম, ভারত মানেই "বলিউড" অথবা "জাতীয় ক্রিকেট দল।"
যাই হোক - কাশ্মীর ইস্যুতে ভারতীয় এবং পাকিস্তানিদের জাতীয়তাবোধ চরম। ওরা কেউই এক বিন্দু ছাড় দিতে রাজি নয়। দুইজনেরই দাবি "কাশ্মীর হামারা হ্যায়।"
সমস্যা হচ্ছে, কাশ্মীরিদের কী সেটা জিজ্ঞেস করা হয় যে ওরা কাদের?
এক কাশ্মীরি ভাই খুব আফসোস করে বললেন, "ভাই, আমাদের নিয়ে টানা হ্যাঁচড়া বন্ধ করো - আমাদেরকে নিজেদের মতন আলাদা একটা দেশ দিয়ে ছেড়ে দাও। দুইদিন পরপর এই হামলা, ঐ হামলা আর ভাল লাগেনা।"
একটু নিজেকে তাঁদের অবস্থানে রেখে ভাবুন।
ধরুন আমরা স্বাধীন হবার সময়ে পূর্ব ও পশ্চিম বাংলাকে নির্দিষ্ট সীমারেখা টেনে ভাগ না করে পাক-ভারতকে বললো, "তোমরা ভাগাভাগি করে নাও।"
তখন কী হতো জানেন? এই কাশ্মীরিদের মতন অবস্থা হতো। সকালে কাজে যাবার সময়ে জানেন না বিকালে সুস্থ দেহে বাড়ি ফিরবেন কিনা। স্কুলের শিক্ষার্থীরা জানতো না তাঁদের উপর বোমা হামলা হবে কিনা। গৃহিনী জানতো না আগামীকাল সকালে সবাই ঘুম থেকে জেগে উঠতে পারবেন কিনা।
রাস্তায় রাস্তায় মিলিটারি চেকপোস্ট থাকতো। দুই দেশই নিজের সর্বোচ্চ ক্ষমতা ব্যবহার করতো আমাদের ধরে রাখতে। পাটায় পুতায় পিষাপিষি হতো, আমরা মরিচের মতন দফারফা হতাম।
রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানকে যতদূর চিনি, মৌলবাদকে প্রশ্রয় দিতে দিতে নিজেরাই এখন হাঁসফাঁস করে মরছে। শুরুটা সেই জিয়াউল হকের সময় থেকে, অথবা তারও আগে, শেষ এখনও হয়নি। বর্তমান পাকিস্তানে জঙ্গিবাদ এমন একটি ক্যান্সার যা টার্মিনাল স্টেজে পৌঁছে গেছে। এখন রাষ্ট্র হিসেবেই তাদের অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন। চোর ধরতে গ্রাম উজাড় অবস্থা।
ভারতের পেছনে লাগতে লাগতে এখন নিজেদেরই অবস্থা দফারফা।
ভারতের মোস্ট ওয়ান্টেড টেরোরিস্ট দাউদ ইব্রাহিমকে ওরা ওদের পাসপোর্ট দিয়ে জামাই আদর করেছে। ওদের লেজেন্ডারি ক্রিকেটারের ছেলের সাথে দাউদের মেয়ের বিয়ে ধুমধামে দিয়েছে। এছাড়াও নানা সময়ে নানাভাবে ওরা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হামলা করে ইনোসেন্ট ভারতীয় হত্যা করেছে। তাজ হোটেলে হামলার ঘটনা এখনও মনে আছে। কাসাব ও তার সহযোগীরা সবাইতো পাকিস্তানীই ছিল। মোট কথা, ভারতে হামলার পেছনে যাবতীয় মদদ পাকিস্তান থেকেই আসতো এবং এখনও আসে। এইটা প্রমাণিত সত্য।
কিন্তু রাষ্ট্র হিসেবে দায় স্বীকার করার বদলে ওরা বরাবর সেটা অস্বীকার করে গেছে। এইটা তাদের পুরানো অভ্যাস। একাত্তুরকে এখনও তারা স্বীকার করেনা।
হয়তো ভাবছে আন্তর্জাতিকভাবে লোকে তাদের আজকে বাজে কথা শোনাবে, তাই অস্বীকার করাই ভাল।
কিন্তু এতে উল্টো হয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে দুয়োতো শুনতেই হয়েছে, মাঝে দিয়ে সরকারি আস্কারা পাওয়ায় জঙ্গিরা একদম মাথাচাড়া দিয়ে উঠে দেশটার বারোটা বাজিয়েছে।
বরং তারা যদি আগেই বলতো, "আমার ভারতীয় ভাইয়েরা, আমার দেশি জঙ্গিরা তোমার বাড়িতে হামলা করায় আমরা খুবই দুঃখিত। আমরা উচিৎ ব্যবস্থা নিচ্ছি। প্রয়োজনে সাহায্য চাইবো, আমাদের সাহায্য করো।"
এতে নিজেদের সম্মান কমতো না। উল্টো সমস্যা এতটা বাড়তো না।
সহজ উদাহরণ দেই।
ধরুন আমার ছেলে ক্লাসে দুষ্টামি করে। টিচার বিচার দিয়েছেন। আমি যদি বলি, "আমার ছেলে দুষ্টামি করতে পারেই না" অথবা "ছেলেরাতো দুষ্টামি করবেই, এত বিচার দেন কেন?" - তাহলে এই ছেলে জীবনেও শুধরাবে না।
বরং আমি যদি বাড়িতে ওকে কঠিন ধমক দিয়ে বলি যে স্কুল থেকে কোন রকম বিচার যেন বাসায় না আসে, তাহলে এই ছেলের শুধরানোর সুযোগ বেশি।
অন্যায়কে কখনই প্রশ্রয় দিতে নেই। আমার শত্রুর বিরুদ্ধেও যদি করা হয়ে থাকে।
লজিক ফিট করেছে? এটাই ঐ দেশের জন্য প্রযোজ্য।
এইবার আসা যাক ভারত পাকিস্তান কাশ্মীর ইস্যুতে।
আগেই বলেছি, কাশ্মীরিদের যদি জিজ্ঞেস করা হয়, তোমরা ভারতের সাথে থাকবে, নাকি পাকিস্তানিদের সাথে - আমার ধারণা একটা বিরাট অংশ বলবে, "ভাইয়েরা, আমাদের আলাদা রাষ্ট্র দিয়ে দাও। অনেক ত্যক্ত করেছো, আর না। প্লিজ!"
একদল হয়তো ভারতের নাম নিবে, আরেকদল পাকিস্তানের।
সমস্যা এখানেই, কেউই তাঁদের সাথে কোনরকম কথা বলতে আগ্রহী নয়। কথা বললেই না সমস্যার সমাধান সম্ভব।
অথচ জীবনটা তাঁদের, ভূমিটাও তাঁদের। মরলে তাঁদেরই পরিবারের লোকজন মরে। দুনিয়ার জান্নাতকে জাহান্নাম বানিয়ে ছাড়লো প্রতিবেশি দুই দেশ।
আসলে দেশপ্রেম ট্রেম কিছু না। সবই লোভ। যদি আসলেই দুই দেশের সরকার কাশ্মীরিদের ভালবাসতো, তাহলে অবশ্যই তাঁদের সাথে আলোচনায় বসতো।
সুলাইমান (আঃ) নবীর বিচারের কাহিনী মনে আছে? ঐ যে দুই মহিলা একই শিশুর মাতৃত্বের দাবি করলে সুলাইমান (আঃ) বললেন শিশুটিকে দুই টুকরো করে দুই ভাগ দুইজনকে দিয়ে দাও।
সাথে সাথে এক মহিলা বললেন, "না, আমি ওর মা না। ওকে দিয়ে দাও।"
তখন সুলাইমান (আঃ) সেই মহিলাকেই সন্তান দিয়ে বললেন, "তুমিই ওর আসল মা। আসল মা কখনই চাইবে না তাঁর সন্তান দুই টুকরো হয়ে মরুক।"
কাশ্মীরিদের ছিন্নভিন্ন করা দেখে তাই বুঝতে বাকি নেই কোন দেশের প্রেম তাঁদের জন্য বেশি।
আরেকটা বিষয় অবশ্যই মাথা খাটিয়ে দেখা উচিৎ। জন্মের পর থেকেই এই কাশ্মীর ইস্যু নিয়ে ভারত পাকিস্তানের মধ্যে তিক্ততা বেড়েছে। এ অস্ত্র ছুঁড়েছে, তো সেও চুপ করে বসে থাকেনি। হাজারে হাজারে নিরীহ মানুষের রক্তে লাল হয়েছে চেনব নদীর পানি। ক্ষতি ছাড়া লাভের লাভ কিছুই হয়নি দুই দেশের কারোরই।
ভাল করে লক্ষ্য করুন, এ যুদ্ধে আসল "লাভ" কাদের হয়? অবশ্যই অস্ত্র ব্যবসায়ীদের। একটি বুলেটের দাম তিনশো রুপি (কমসে কম), একটি যুদ্ধে কয় রাউন্ড বুলেট খরচ হয় ধারণা করতে পারেন? আজকে ভারত পাকিস্তানের জঙ্গি আস্তানায় এক হাজার কেজির উপর বোমা বর্ষণ করেছে। কালকে পাকিস্তানও যদি হামলা করে, কত কেজি বোমা ফেলবে? তাহলে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা কার হবে? সে কেন চাইবে না দুই দল যুদ্ধে জড়াক? অবশ্যই সে তার সর্বোচ্চ শক্তি, নেটওয়ার্ক, ক্ষমতা ব্যবহার করবে যাতে দুই দল নিজেদের মধ্যে মারামারি কামড়া কামড়ি করে। আর সে নিজের ব্যাংক ব্যালেন্সের টাকা গুনতে গুনতে হাপিয়ে উঠে।
আমরা বাঙালিরা অনেকেই তালি বাজাচ্ছি। কিন্তু ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ বাঁধলে আমাদের কিছুই হবেনা, দুই রাষ্টের আর্থিক ক্ষতি কিছুটা হবে, মাঝে দিয়ে হাজার খানেক নিরীহ মানুষের রক্ত ঝরবে। বলা যায়, কেউ যদি পারমানবিক বোমা ফাটিয়ে দেয়, তাহলে মৃতের সংখ্যা লাখ ছাড়াবে। কে জানে, যেই কাশ্মীরি যুবকটির সাথে গল্প করছিলাম, তাঁরই পরিবার ধ্বংস হয়ে যেতে পারে কোন এক বোমা হামলায়।
কারোর মৃত্যুর ঘটনায় বগল বাজাবার কিছু নেই।
একাত্তুরে শহীদ এক পরিবারের ঘটনা বলি। শত্রুবাহিনীর বোমা হামলায় উড়ে গিয়েছিল তাঁদের বাড়ি, নিহত হয়েছিলেন পরিবারের প্রায় সবাই। যিনি অলৌকিকভাবে বেঁচে গিয়েছিলেন, তিনি সারাজীবন যুদ্ধের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে গেছেন। হোক সেটা পাক-ভারত যুদ্ধ, হোক সেটা ফিলিস্তিন-ইজরায়েল যুদ্ধ, বা আমেরিকা বনাম ইরাক, আফগানিস্তান বা অন্য যেকোন যুদ্ধ। কেন? তিনি জানেন যুদ্ধে আপনজন হারানোর কষ্ট কি। তিনি তাই চাননা পৃথিবীর কেউ, সেটা তাঁর শত্রু হলেও, এই কষ্টের মধ্য দিয়ে যাক। জীবন ধন্য এমন আলোকিত মানুষদের সাক্ষাৎ পেয়ে।
ভারত পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর শিশুদের জিজ্ঞেস করুন যুদ্ধের ময়দানে তাঁদের পিতারা লড়ছেন, তাঁদের মনে কী ঝড় বইছে। জীবনেও মিশেছেন কোন সেনা পরিবারের সদস্যদের সাথে? ওদের ঠাট বাটই শুধু নজরে পড়ে। জীবন বাজি রেখে যখন তাঁরা সীমান্তরক্ষায় যান, তাঁদের উৎকন্ঠা কারোর চোখে পড়েনা।
ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ বাঁধলে বাংলাদেশের বিশেষ করে দেশের ইকোনমির উপরও সেটা আঘাত হানবে। পাশের বাড়িতে আগুন লাগলে আমার বাড়িতে বসে তালি বাজানো বোকামি।
শেষ করি নিজের মতামত দিয়ে।
আজকে ভারত যে এয়ার স্ট্রাইক করলো - এইটার প্রয়োজন ছিল?
হ্যা ছিল।
কারন পাকিস্তান এখন পর্যন্ত কার্যত কোন পদক্ষেপ নেয়নি জঙ্গি দমনে। এর আগেও তারা ওসামা বিন লাদেনকে নিজের দেশে অতিথি সেবায় লালন পালন করছিল। ইমরানের "নয়া পাকিস্তান" এখনও কত সন্ত্রাসীর আস্তানা কে জানে? জঙ্গি দমনে ওরা বিশ্বাসযোগ্য কোন পদক্ষেপ এখনও নেয়নি। যদি নেয়ও, বছরের পর বছর চলে যাবে স্রেফ ভদ্রস্থ অবস্থায় আনতেই।
কাজেই ভারতের হাতে আর কী অপশন বাকি ছিল? হাত গুটিয়ে বসে থাকা যাতে তোমরা আবারও আক্রমন করো? ভাইরে, বোমা হামলায় নিজের মা বাপ মরলে কষ্টটা বুঝা যায়। সেটা যাতে না হয়, সেজন্যই এই হামলা।
আশা করি পাকিস্তান তার শিক্ষা পেয়ে গেছে। দুই রাষ্ট্র মিলে নিজেদের ঝামেলা মেটানোয় একযোগে কাজ করবে। আশা করি "বদলা" নিতে পাকিস্তান কোন ফাজলামি করবেনা। শুরুটা যেহেতু তারা করেছে, তাই "বদলা" আসলে ভারত নিয়েছে। এখন ঝামেলা মিটিয়ে ফেলাই বুদ্ধিমানের কাজ।
শুনেছি এরই মধ্যে মোদী সরকার নিজের নির্বাচনী প্রচারণায় এই এয়ারস্ট্রাইক ঘটনা জুড়ে দিয়েছেন। আসলেই কী তিনি দেশপ্রেম থেকে আক্রমনটা করেছেন, নাকি দলের প্রয়োজনে দেশের আর্মিকে ব্যবহার করেছেন? রাজনীতিবিদদের কিছু আচরণ বুকে শেল হয়ে বিঁধে।
কাশ্মীরিদের জন্য সমবেদনা।
স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মেও যারা স্বাধীনতার মূল্য উপলব্ধি করেনা, ওদের জন্য রেফারেন্স হচ্ছে কাশ্মীর। পারলে দুয়েকটা কাশ্মীরি বন্ধু খুঁজে বের করুন। কথা বলুন। বুঝবেন একটি স্বাধীন দেশে জন্মের সৌভাগ্য কী।
আফসোস। তারপরেও এরা বুঝবে না।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ভোর ৫:০৫