তখন কল সেন্টারে কাজ করতাম। লোকজনের ইন্টারনেট জাতীয় সমস্যা হলে কল দিত, ফোনে ফোনে সমস্যার সমাধান করতাম।
এমনই একদিন এক বৃদ্ধার ফোন এলো। হুমায়ূন আহমেদের কল্যানে আমাদের দেশের মানুষ আমেরিকান বুড়িদের স্বভাবের সাথে ভালই পরিচিত। জীবন সায়াহ্নে এসে এইসব নিঃসঙ্গ বৃদ্ধারা কোন কথা বলার সঙ্গী পেলে সহজে ছাড়তে চায় না। টুকটাক আলাপ শেষে তিনি বললেন, "তুমি কোন দেশ থেকে এসেছো?"
"বাংলাদেশ।"
এর পরের বাক্যটাই হয়, "আমরা ইন্ডিয়ার প্রতিবেশী।"
কারন এদেশের বেশিরভাগ মানুষই আমাদের দেশটাকে চিনতে পারেনা। এর বহু কারন আছে। ভারতীয় বা পাকিস্তানিদের মতন এত প্রবাসী সংখ্যা আমাদের ছিল না। তারচেয়ে বড় কথা, বিশ্বের সবাই আমাদের এক নামেই চিনে ফেলবে, এমন কীর্তি আমাদের খুবই কম আছে। তাই যেসব বাংলাদেশী খুবই বিরক্ত হন যে আমাদের দেশকে বিদেশিরা চিনতে পারেনা, আমার কাছে ব্যাপারটা খুবই অযৌক্তিক মনে হয়। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ে ইত্যাদি দেশগুলো ফুটবল না খেললে আমাদের দেশের প্রতিটা নাগরিক ওদের চিনতো? কোন দেশ বিশ্বের সেরা কফি বানায় আর কাদের গরুর মাংসের স্টেক মজা, সেসব জেনে আমাদের কি? আমরা নিজেরাও কি বিশ্বের প্রতিটা দেশের ভৌগলিক অবস্থান মুখস্ত করে থাকি?
কিন্তু বৃদ্ধা বললেন, "বাংলাদেশ? আমি এই দেশটা চিনি!"
আহা! এই অভিজ্ঞতাও আমার আছে। এর আগেও কিছু বিদেশী নাগরিক আমার দেশের নাম শুনেই বলেছিলেন, "চিনেছি! ভাল ক্রিকেট খেলে।"
"চিনেছি! তোমাদের দেশের "কটন" খুবই ভাল।"
"এইটা সেই দেশ যেখানে মাইক্রো ক্রেডিটের জন্ম হয়েছিল।"
ভাবলাম, এই বুড়িও নিশ্চই সেভাবেই চিনে থাকবেন।
কিন্তু তিনি বললেন, "কিছুদিন আগেই নিউজে পড়েছি, ওখানে এক ফ্যাক্টরিতে আগুন লেগেছিল, এবং একশোর বেশি মানুষ মারা গিয়েছিল!"
তখন তাজরীন ফ্যাশনসের ফ্যাক্টরিতে আগুন ধরার ঘটনার এক দুই সপ্তাহ হয়েছিল কেবল। ক্ষতটা একদম দগদগে।
ভদ্রমহিলা বললেন, "মালিকপক্ষ আগুন লাগার পরেও ওদেরকে তালাবন্দি করে রেখেছিল। কেন? ওরা কি বুঝে না যে ওরাও মানুষ, কোন ইঁদুর না!?"
শেষের দিকে এসে তাঁর গলা ধরে এসেছিল। তিনি বাক্য শেষ করতে পারেননি। ভিনদেশের একদল গরিব শ্রমিকের জন্য এক বিদেশী বৃদ্ধার হৃদয় তখন হাহাকার করছে। আর স্বদেশী মালিকপক্ষের লোভের কারনে এক বিদেশিনীর সামনে আমার মাথা হেঁট হয়েছিল।
আজকেও বাংলাদেশে আগুনে পুড়িয়ে প্রচুর মানুষ মারা হয়েছে। নিহতদের তালিকায় প্রচুর শিশুও আছে।
আমরা সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা সবাই কিছুদিন ফেসবুকে হাউকাউ করবো, এবং তারপরে সব ভুলেও যাব। খুনিদের কোনই বিচার হবেনা। নিহতদের পরিবার কোন ক্ষতিপূরণ পাবেনা।
"গরিব মানুষও মানুষ! তাঁদের প্রাণেরও দাম আছে।" - এই বোধ বাংলাদেশে নাই।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জুলাই, ২০২১ রাত ১১:৫৫