তারাবির নামাজ আট রাকাত নাকি বিশ রাকাত, এই নিয়ে দেখি বাংলাদেশের ইসলামী পন্ডিতরা দুইভাগে ভাগ হয়ে গেছেন। একদল আরেকদলকে মূর্খ ঘোষণা করছেন। ওয়াজনির্ভর সাধারণ মানুষগুলি একওয়াজ শুনে বলে "ঠিক ঠিক, বিশ রাকাতই ঠিক। এর নিচে পড়লে গুনাহ, নামাজ আদায় হয়না।"
এর পরের ওয়াজেই আবার নতুন হুজুরের যুক্তি শুনে বলে, "ঠিক ঠিক, আট রাকাতই ঠিক। বিশ রাকাত পড়া বেদাত।"
সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে, বেকুব লোকজন বইপত্র ঘাটাঘাটি না করে হুজুরের কথা শুনেই হাতাহাতি শুরু করে দেয়।
কথা হচ্ছে, কারোর মাথায় অতি সাধারণ যুক্তিটাই আসেনা যে, তারাবিহ নামাজটাইতো "নফল", বা খুব বেশি হলে "সুন্নত" বলতে পারেন, কিন্তু কোন অবস্থাতেই ফরজ বা ওয়াজিব না। কাজেই, নফল নামাজের আবার আট রাকাত, বিশ রাকাত, চল্লিশ রাকাত কি? আপনি আপনার মন ও ঈমান অনুযায়ী পড়তে থাকবেন। আট যদি আশিও হয়ে যায়, কোনই সমস্যা নাই। নবী (সঃ) নিজে পড়তেন আট রাকাত, এবং তিনিই উৎসাহ দিয়েছেন যত বেশি পড়তে পারবে, ততই ভাল। এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো কোয়ালিটি, কে কত উত্তমভাবে, তাকওয়ার মধ্যদিয়ে নামাজ পড়েছে, সেটাই আসল। কে কত বেশি বা কম রাকাত পড়েছে, সেটা মোটেই গুরুত্বপূর্ণ নয়।
ঘটনা সংক্ষেপে বলতে গেলে এমন, রমজান মাসের এক রাতে সাহাবীরা দেখলেন নবীজি (সঃ) মসজিদে নামাজ পড়ছেন। সামনে যদি মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সঃ) দাঁড়িয়ে নামাজ পড়েন, কে তখন তাঁর সাথে জামাতে শরিক হওয়া থেকে বিরত থাকতে চাইবে? কাজেই সাহাবীগণ তাঁর পেছনে দাঁড়িয়ে গেলেন।
পরের দিন আরও কিছু সাহাবী এসে দাঁড়িয়ে গেলেন। তাঁরা খবর পেয়েছেন নবীজি (সঃ) বিশেষ নামাজ আদায় করেন।
এর পরেরদিন গোটা মদিনা উপস্থিত হয়ে গেল। গোটা শহরেই খবর পৌঁছে গেছে "কিয়ামুল লাইলের" ব্যাপারে। কিন্তু সে রাতে নবীজি (সঃ) বাড়ি থেকে বের হলেন না। তিনি এলেন ফজরের সময়ে। এবং বললেন, আমি ভয় করছি আল্লাহ তোমাদের এই উৎসাহ দেখে এই নামাজ না তোমাদের উপর ফরজ করে দেন!
সেটাই ছিল তাঁর জীবনের শেষ রমজান। পরের রবিউল আউয়াল মাসেই তিনি ইন্তেকাল করেন।
আবু বকরের (রাঃ) সময়েও সাহাবীগণ নিজ নিজ মতন নামাজ আদায় করতেন। কেউ বাড়িতে, কেউ মসজিদে।
উমারের (রাঃ) সময়ের শুরুর দিকেও ছিল তাই।
একরাতে খলিফা উমার (রাঃ) দেখেন মসজিদ ভর্তি মানুষজন যে যার মতন নামাজ আদায় করছেন। তখন তিনি বলেন সবাই এক জামাতেই নামাজ আদায় করুক।
কেউ কেউ কুতর্ক তোলে যে উমার (রাঃ) বেদাত করেছেন। তারাবীহ জামাতে আদায় করেছেন। বাস্তবে যা ভুলই না, মূর্খতাও। কারন জামাতে নামাজ আদায় নবীর সময়েই তাঁরই নেতৃত্বে হয়েছিল। উমার (রাঃ) সেটাই ফিরিয়ে আনেন। নবীজি (সঃ) বন্ধ করেছিলেন এই আশংকায় যে আল্লাহ ফরজ করে দিতে পারেন, এবং যেহেতু এখন নবীজি (সঃ) চলে গেছেন, কাজেই আর ফরজ করার সুযোগ নেই।
তা শুরুর দিকে তারাবীহ আট রাকাতই পড়া হতো। কিন্তু আমাদের জামাতে নামাজ আদায়ের একটা নিয়ম হচ্ছে বৃদ্ধ, শিশু, নারী ও দুর্বলদের কথাও মাথায় রাখতে হয়। দীর্ঘক্ষণ একেক রাকাত নামাজ আদায় করাটা যথেষ্ট পরিশ্রমের বিষয়। বরং রাকাত সংখ্যা বাড়িয়ে কিছুক্ষন পরপর রুকু, সিজদাহ দিলে দাঁড়িয়ে থাকার মাঝে একটা বিরতি চলে আসে, যা নামাজে মনোনিবেশ করার জন্যও ফলপ্রসূ। কাজেই রাকাত সংখ্যা আট থেকে বাড়িয়ে বিশ করা হলো। কেন বিশ, কেন বাইশ, বা ষোল নয়, সেটা তাঁরাই ভাল বলতে পারবেন। অনুমান নির্ভর কিছু বলতে চাইছি না। তবে হজরত উমারের (রাঃ) সময়েই মসজিদে এত ভিড় হতো যে পুরুষদের জন্য দুইজন ইমাম এবং মহিলাদের জন্য একজন ইমামের ব্যবস্থা করতে হয়েছিল। সেই সময়ে মাইক্রোফোন না থাকায় স্বাভাবিকভাবেই একজনের কণ্ঠস্বর এত দূর পর্যন্ত শোনা যেত না।
ব্যস। এই হচ্ছে ঘটনা। এখানে কোথাও কোন সাহাবী বলেন নাই আট রাকাতের জায়গায় বিশ রাকাত পড়া যাবেনা, কিংবা বিশের নিচে পড়লে কারোর নামাজ অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। এই ক্যাঁচাল বাংলাদেশ সহ ইন্ডিয়া পাকিস্তানের পন্ডিতদেরই সৃষ্টি। কথায় কথায় একজন আরেকজন মূর্খ বলে, কাফের বলে, বেদাতি বলে। সবচেয়ে বিরক্তিকর হচ্ছে, এরা নিজেদের মতানৈক্যের উপর ভিত্তি করে একের পর এক মসজিদ বানিয়ে উম্মতকে বিভক্ত করে। নামাজে আমিন জোরে বলা আস্তে বলা, নাভির উপরে হাত বাঁধা বা বুকে বাঁধা বা হালের বিশ রাকাত বা আট রাকাত তারাবীহ ইত্যাদি ছোট ছোট বিষয় নিয়ে এরা বিভিন্ন দলে উপদলে বিভক্ত। আর এরাই বলে, "বিশ্বে মুসলিমদের মধ্যে কোন ঐক্য নেই।"
সবচেয়ে হাস্যকর ছিল কয়েক বছর আগে বিশ্ব ইজতেমার ঘটনা। দুই দল রাস্তার কুকুর বেড়ালের মতন মারামারি করে আখেরি মুনাজাতে মুসলিম বিশ্বের ঐক্য চেয়ে আল্লাহর দরবারে হাত তুলেছিল।
ফাজলামি দেখেছেন? বিশ্বের মুসলিমদের ঐক্য নিয়ে এদের দুশ্চিন্তা, সৌদি আরবের বাদশাহর ঈমান নিয়ে এদের দুশ্চিন্তা, অমুক দেশের এই আইন আর তমুক দেশের সেই সংস্কৃতি নিয়ে এদের টেনশনের শেষ নেই। এদিকে নিজেরা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ঘটনায় কামড়াকামড়ি করে মরে। এদিকে নিজেরা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ঘটনায় কামড়াকামড়ি করে মরে।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা এপ্রিল, ২০২২ রাত ৮:৫৪