ফেসবুকে ভিডিও দেখলাম, দেশের এক "আলেম" বলে বেড়ান কাগজের নোট ব্যবহার করা উচিৎ না। তিনি এটাকে "ইহুদি নাসারা ষড়যন্ত্র" থিওরির মধ্যে ফেলে দাজ্জালি ফেৎনা ঘোষণা করে দিয়েছেন। উনার মতে যেহেতু নবীজি (সঃ) সোনা রুপা লবণ খেজুর বার্লি ইত্যাদিতে লেনদেন করতেন, কাজেই আমাদেরও (মুসলিমদের) সেটাই করা উচিৎ।
কথাটা কতটা লজিক্যাল কিংবা ফাউল, সেটা কি কেউ ভেবে দেখেছে? খুবই অবাক হয়েছি দেখে যে কিছু বুদ্ধিমান মানুষও বলে বেড়ান সেটাই হওয়া উচিৎ। কারন কাগজের টাকারতো আসলেই মূল্য নেই, সোনা গলিয়ে আমরা বিক্রি করতে পারি। ভারতে ডিমনিটাইজেশনের ফলে যেমন পাঁচশো এবং হাজার রুপির নোট বন্ধ হয়ে গেল, সোনার ক্ষেত্রেতো এমনটা হবার কথা না।
বললাম, ভাই, বাড়ি ভাড়া কি আপনি খেজুরে পরিশোধ করবেন? আর বাচ্চার জন্য লজেন্স কি সোনা দিয়ে কিনবেন?
উনারা বলেন, "দ্রব্য বিনিময় প্রথাতো আগেও ছিল, এখন করলে সমস্যা কি?"
যারা এইসব লজিক শুনে ঠিক ঠিক বলেন, উনাদের জ্ঞাতার্থে, দ্রব্য বিনিময় প্রথার সমস্যা ছিল বলেই একে বাতিল করে আমরা আধুনিক যুগে এসেছি। আমার কাছে গরু আছে, বাড়িতে চাল লাগবে। যার দোকানে চাল আছে, তার বাড়িতে গরুর মাংস খায় না। আমি চাল কিনবো কিভাবে? আর এক কেজি চালের বিনিময়ে আমি আস্ত গরু দিয়ে দিব? আর যদি এক গরুর বিনিময়ে আমি কয়েক বস্তা চাল আনি, এত চাল দিয়ে আমি করবোই বা কি? তখন আমাকে খুঁজতে হবে অন্য কোন ক্রেতা যার চাল লাগবে, এবং আমারও সেটাই লাগবে যা সে বিনিময় করতে পারবে।
কত ফালতু সিস্টেম সেটা বুঝতে কি খুব বেশি বুদ্ধির প্রয়োজন?
তাছাড়া মনে করেন আপনি শহরের বাইরে কাজে যাবেন। লাখ খানেক টাকার লেনদেন করতে হবে। আপনাকে কয় বস্তা খেজুর নিয়ে যেতে হবে বলেন তো?
উনি বললেন কাগজের টাকার কোনই মূল্য নেই। সোনায় ট্রানজ্যাকশন করতে হবে। এবং দাবি করলেন উনি এই নিয়ে প্রচুর পড়াশোনা করেছেন। দুয়েকটা ইংলিশ শব্দ ছুড়ে মারা ছাড়া কতখানি পড়াশোনা করেছেন সেটা অবশ্য উনার কথায় বুঝা গেল না। কারন ম্যাট্রিক পাশ ছেলেও জানে একটা দেশ যত খুশি তত নোট ছাপতে পারেনা। সরকার চাইলেই টাকশালে টাকা ছাপিয়ে গরিবদের মধ্যে লাখে লাখে টাকা বিলিয়ে দেশকে ধনী বানিয়ে ফেলতে পারেনা। সেটা করলে ইনফ্লেশন আসে। উদাহরণ দেই।
ধরা যাক গুলশানে একটা এক একর প্লট বিক্রি হবে। জমির মালিক জানেন দেশের ধনীরা সেখানে জমি কিনতে চান, তাই তিনি দাম হাঁকলেন একশো কোটি টাকা। তিনি ইচ্ছা করলে এক হাজার টাকাতেও বিক্রি করতে পারেন। কিন্তু সেক্ষেত্রে কয়েক কোটি ক্রেতা পেয়ে যাবেন। তিনি সেই ঝামেলায় যেতে চাইছেন না। তিনি চাইছেন সিরিয়াস এবং যোগ্য ক্রেতার কাছে বেঁচতে। তারপরেও দেখা যাবে বহু ক্রেতা তিনি পেয়ে গেছেন।
এখন যদি দেশে সবাই কোটিপতি হতেন, তাহলে এই জমির দাম বিলিয়নে চলে যেত। কারণ একই, যে কেউ এইটা কিনতে পারলে এই জমির মূল্য কি থাকতো? শুধু জমিই না, সমাজের সবাই কোটিপতি হয়ে গেলে দোকানের পাউরুটির দাম পর্যন্ত কয়েকশোগুন বেড়ে যায়।
তাহলে কি কোটিপতি হওয়া খারাপ? দেশ চায় না তাঁর প্রতিটা নাগরিক কোটিপতি হোক? কেন চাইবে না? কাতার, সিঙ্গাপুর, কুয়েত ইত্যাদি দেশ কোটিপতিতে ভর্তি। ওদের দেশ প্রচুর ব্যয়বহুল হলেও সেটা সমস্যাই না। কারন ওদের দেশের সম্পদের পরিমান অনেক অনেক বেশি।
এটাই মূল বিষয়। সরকার নোট ছাপায় নিজের সম্পদ অনুযায়ী। আর সম্পদটা কি? "সোনা।" সরকারের রিজার্ভে কত সোনা আছে, সেটার উপর ভিত্তি করেই নোট ছাপানো হয়। নোট আসলে সরকারের সার্টিফিকেট। এর মানে হচ্ছে এত টাকার বিনিময়ে আপনি এতটুকু সোনার মালিক। রাষ্ট্রের ভাণ্ডারে সোনার পরিমান যত বাড়বে, নোটও তত বেশি ছাপানো হবে।
সরকার ইচ্ছা করলো আর নতুন নতুন নোট ছাপিয়ে দিল, এটা করলে সেই নোটের মূল্যই কমে যাবে। যেমন, ধরা যাক, সরকারের কাছে এক কেজি সোনা আছে, এবং এর বিপরীতে বাজারে পাঁচশো টাকার নোট চালাচালি হচ্ছে। যদি সোনার পরিমান না বাড়ে, এক কেজিই থেকে যায়, এবং সরকার বাজারে আরও পাঁচশো টাকার নোট ছেড়ে দেয়, তখন দেখা যাবে এক কেজি সোনার বিনিময়ে হাজার টাকার লেনদেন হচ্ছে। মানে জিনিসপত্রের দাম তখন দ্বিগুন হয়ে যাবে।
ঠিক এই কারণেই কোন দেশ ততটুকুই টাকা ছাপাতে পারবে, যতটুকু সোনা ওর কাছে মজুদ থাকবে। কারন, "এক ইউএস ডলার সমান বাংলাদেশে ছিয়াশি টাকা" - এর মানে হচ্ছে এক ডলারে যতটুকু সোনা পাওয়া যাবে, ছিয়াশি টাকায় ততটুকুই সোনা পাওয়া যাবে।
বুঝাতে পারছি?
তা এখন নিশ্চই বুঝতে পারছেন, এই যে ক্যাশ নোটে আপনি লেনদেন করেন, সেটা আসলে সোনাতেই করছেন, এবং এই কাগজের টুকরারও যথেষ্ট মূল্য আছে। এখানে "ইহুদি নাসারা বা দাজ্জালের ষড়যন্ত্রের" কিছু নাই। বিশ্বের বড় বড় আলেম ওলামারা এই নিয়ে কিছু বলেন না, কারন এতে বলার মতন কিছুই নাই। উনি নিজেকে পন্ডিত ভেবে আপনাদের বেকুব বানাচ্ছেন, আপনিও হচ্ছেন, এইটাই সমস্যা।
আপনি যেকোন কাগজের টুকরাকে নোট হিসেবে চালাতে পারবেন না। সরকার অনুমোদিতই হতে হবে। মানে যে নোট নিয়ে আমরা চলাফেরা করি, সেটা আসলে "দলিল," মানে সরকারের প্রতিশ্রুতি যে এই টাকার বিনিময়ে এতটুকু সম্পদের মালিক সে। ইন্ডিয়াতে ডিমনিটাইজেশনের মাধ্যমে সরকার ঘোষণা করলো পাঁচশো এবং হাজার রুপির মুদ্রা থেকে তারা তাদের প্রতিশ্রুতি ফিরিয়ে নিতে চলেছে। ঠিক এই কারণেই নোটগুলো কাগজের টুকরায় পরিণত হলো। এবং বাজারে নতুন নোট জায়গা করে নিল।
তা এই হুজুর উনার ওয়াজে বলেছিলেন, "আপনাদের কি ধারণা, ঈসা (আঃ) ডলারে লেনদেন করবেন?"
উনার কথানুযায়ী, ডলারে লেনদেন করাটা যেন বিরাট অপরাধ। এবং উনার বলার ভঙ্গিতেই উপস্থিত জনতা ঘাবড়ে গিয়ে জবাব দিল "না।"
"কেন ভাই, ডলারে, দিনারে বা টাকায় লেনদেন করলে সমস্যা কি?" - এই প্রশ্ন কেউ করলো না।
আমরা জানি, আন্তর্জাতিক বাজারে সবচেয়ে প্রচলিত মুদ্রা হচ্ছে ডলার। বিদেশে কোন কিছু লেনদেন করতে চান, আপনার সাথে ডলার থাকলে আপনাকে কিছু নিয়ে চিন্তা করতে হবেনা। একবার আমার সাথে একটা মজার ঘটনা ঘটেছিল।
দেশে গেছি সাত বছর পর। রিকশায় উঠে দুই গলি পরে গেলাম। ভাড়া আসলো দশ টাকা। আমি পকেট থেকে টাকা বের করে দিলাম। রিক্সাওয়ালা বললেন, "মামা, ভাংতি নাই।"
আমি ফিরায় নিলাম। আমার সহযাত্রী দশ টাকা বের করে দিলেন।
পরে ওয়ালেট খুলে দেখি ওটা একশো ডলারের নোট ছিল। বাংলাদেশী একশো টাকা এবং আমেরিকান একশো ডলারের চেহারা অনেকটা কাছাকাছি। ভাংতি না থাকায় বেচারা রিক্সাওয়ালা পেল না। বাংলাদেশী টাকায় সাড়ে আট হাজার টাকা ছিল। দুইগলি রিকশা টানার আয় হিসেবে খারাপ ছিল না।
যাই হোক, ডলারের এত চাহিদা বুঝতে হলে আরেকটু ডিটেইলে আলোচনা করতে হবে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে আমেরিকা অস্ত্র বিক্রেতা ছিল, এবং বিশ্বের মোটামুটি সব সুপারপাওয়ার দেশগুলি অস্ত্র কিনেছিল। ধনভাণ্ডার খালি করে হলেও যুদ্ধ লড়তে হবে, এমন আহাম্মকি সিদ্ধান্তের জন্য মাঝে দিয়ে দেখা গেল আমেরিকার হাতে বিশ্বের মোটামুটি সব দেশেরই সোনা চলে এসেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে অবস্থা আরও খারাপ হলো। ওটা আরও ব্যয়বহুল যুদ্ধ ছিল। ফলে আমেরিকা আরও ধনী হলো, এবং বাকি বিশ্ব ফকির। কারোর কাছেই উল্লেখযোগ্য সোনা নাই, এদিকে সোনা না থাকলে পয়সা ছাপাবে কিভাবে? বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাবে, প্রতিটা দেশ দেউলিয়া হবে। সিদ্ধান্ত হলো, ডলারই হবে সোনার বিকল্প। দেশগুলো এখন নিজেদের রিজার্ভে ডলার জমা করতে শুরু করলো। ঘুরায়ে ফিরায়ে ঐ একই কথা, ডলারই সোনা এবং সোনাই ডলার।
ভিয়েৎনাম যুদ্ধের সময়ে আমেরিকা ধরা খেল। নিজেদের প্রচুর সোনা ক্ষতি হলো তখন। অন্যদিকে অন্যান্য দেশের ইকোনোমি শুধরাতে শুরু করলো। তা ওরা করলো কি আমেরিকাকে ডলার ফেরত দিয়ে নিজেরা সোনা ফেরত আনতে শুরু করলো।
আমেরিকা সোনার মূল্যের চাইতে বেশি ডলার খরচ করে রেখেছিল। তাই আমেরিকার গোল্ড রিজার্ভ দ্রুতই কমে আসছিল। এই সময়ে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিক্সন ডলার এবং গোল্ডের মধ্যকার সম্পর্কের ইতি টেনে বসেন। এখন আর ডলারকে সোনায় এবং সোনাকে ডলারে কনভার্ট করার মাধ্যম রইলো না। যেহেতু সব দেশেরই রিজার্ভ ডলারে ছিল, তাই সব দেশ ডলারকেই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যম হিসেবে বেছে নিল।
এখন বুঝতে পারছেন? আশা করি "টাকায় লেনদেন হারাম" বা "দাজ্জালি ষড়যন্ত্র" - জাতীয় উদ্ভট কথাবার্তায় বেকুব হবেন না।
দুনিয়া এখন আরও আধুনিক হচ্ছে। ক্যাশলেস বিশ্বে আমরা প্রবেশ করেছি। কাজ করছি, নির্দিষ্ট দিনে দেখছি ব্যাংকে কিছু সংখ্যা জমা হচ্ছে। বিল দিচ্ছি, বাজার করছি, সব পরিশোধ করছি কার্ডের মাধ্যমে, সবই সংখ্যার খেলা। কচকচে নোট হাতে নিয়ে ডিল করতে হচ্ছে না। এর নিরাপত্তাটা চিন্তা করেন। আগের যুগে যেমন বেতন দেয়া হতো মাসের এক তারিখে। বাড়ি ফেরার সময়ে কেউ ছিনতাইকারীর খপ্পরে পড়লে পুরো মাসের টাকা চলে যেত। এই ঝামেলাই নাই। সব টাকা অটোমেটিক ব্যাংকে জমা হচ্ছে।
হ্যা, সাইবার ক্রিমিনালরা আপনার টাকা লুটে নিতে পারে। আপনার পিন, আপনার ব্যাংক একাউন্ট নাম্বার ইত্যাদি জানতে পারলে সহজেই লুটে সাফ করে দিবে আপনাকে। কিন্তু ক্যাশ হ্যান্ডলিং থেকে এটাই কি অনেক বেশি নিরাপদ মাধ্যম না?
দুনিয়া এগিয়ে যাচ্ছে রকেট গতিতে, আর কিছু মানুষ ধর্মের দোহাই দিয়ে পিছিয়ে রাখতে চায় উট বখরি পোষার যুগে।
এইবার যাই ইন্ডিয়ার একটি সংবাদে। আমরা সবাই জানি ইন্ডিয়াতে "বিজেপি" ক্ষমতায় আছে, যারা ধর্মীয় কট্টরপন্থী। এবং ওদের নেতাদের জ্ঞান কতটা হাস্যকর পর্যায়ের, সেটা নিয়েও নতুন করে বলার কিছু নেই।
কিছুদিন আগে হিজাব নিয়ে বাড়াবাড়ির পর এখন ওরা শুরু করেছে মুসলিমরা হালাল মাংস বিক্রি করতে পারবে না। রাজ্য জুড়ে প্রচার চালাচ্ছে, কেউ যেন হালাল মাংস না কিনে। শুধু প্রচারই না, জোর করে হালাল মাংসের দোকান বন্ধ করে দিচ্ছে মূর্খ গোঁয়ার গুন্ডাগুলি।
এদিকে মুম্বাইয়ে বিজেপি এবং শিবসেনা নতুন ফাত্রামি শুরু করেছে। ওরা দাবি করছে মসজিদে মাইকে আজান দেয়া যাবেনা। এর ফলে অসুস্থ রোগী এবং শিশুদের সমস্যা হয়। এবং ইসলামের শুরুর দিকেতো মাইক ছিল না, কাজেই মাইকে আজান দেয়াতো জরুরি না।
খুবই যৌক্তিক, ঠিক না? আমি নিজেও শব্দ দূষণের পক্ষে। আমেরিকায় বা বিশ্বের অনেক দেশেই মাইকে আজান দেয়া হয়না, এবং এতে আমাদের জামাতে নামাজ পড়তে সমস্যাও হয়না। এদেশে গির্জার ঘন্টা, কনসার্টের স্পিকার, গাড়ির হর্ন ইত্যাদি সব আওয়াজের উপরই এই নিয়ম চালু আছে। আমাদের দেশেও শব্দ দূষণ একটি বড় সমস্যা, এবং এই ব্যাপারে সরকারের কিছু পদক্ষেপ অবশ্যই নেয়া উচিৎ।
কিন্তু বিজেপি শিবসেনার মূর্খ নেতাদের নিজেদের আসল চেহারা বের করে ফেলেছে ওদের পরের বাক্যেই। "যদি ওরা আজান বন্ধ না করে, তাহলে আমিও মাইকে হনুমান চল্লিশা গাওয়া শুরু করবো। এবং যে যে গাইতে চাইবে, আমি ওদেরকে ফ্রী মাইক দিয়ে আসবো।" - এ থেকেই বুঝা যায় এই ছা-গ_লের মূল সমস্যা আজানে, শব্দ দূষণে নয়। অসুস্থ রোগী এবং শিশুদের জন্য ওর আসলেই আল্লাদ থাকলে সে নিজে মাইকিংয়ের হুমকি দিত না। হার্টের রোগীর হার্ট এমন না যে আজানের শব্দে খারাপ হয়ে যায় আর হনুমান চল্লিশ, পূজার ঢাক বা দিওয়ালির পটকা ফোটানোর শব্দে সুস্থ থাকবে।
সমস্যা এইটাই, এদের কথাই লোকে শোনে এবং মান্য করে। এইসব মূর্খরাই নেতা হয়ে দেশ চালায়।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই এপ্রিল, ২০২২ রাত ২:৩০