somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমাদের প্রত্যেকের মায়েরা হিরো। আর প্রতিটা স্পেশাল চাইল্ডের মায়েরা একেকজন সুপারহিরো।

০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ রাত ১০:৫৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এদেশে হোম ডিপো নামে একটি দোকান আছে, নাট বল্টু থেকে শুরু করে বড় বড় মেশিন - সব পাওয়া যায়। মাঝে মাঝেই যেতে হয়।
গেলাম।
আমার পাশে এক বাবা এসেছেন তাঁর ছেলেকে নিয়ে। ছেলেটির বয়স আমার ছোটছেলের সমান হবে, বা আরেকটু কম। কিন্তু সে হুইল চেয়ারে বসা। ওর একটি পা কাটা। হয়তো কোন অসুখের কারনে কেটে ফেলে দিতে হয়েছে। কিংবা হয়তো এভাবেই জন্মেছে।
আমার ছেলেরা ঐ বাচ্চার সাথে "রক-পেপার-সিজার" খেলতে শুরু করে দিল। তিন শিশুর খিলখিল হাসিতে পরিবেশটাই স্বর্গীয় হয়ে উঠলো।

মনটা এত খারাপ হলো সেদিন! আমরা শারীরিক সুস্থতাকে গ্রান্টেড হিসেবে নেই। আমরা বুঝতেই পারিনা লাখ লাখ কোটি টাকার বিনিময়েও মানুষ তাঁর হারানো অঙ্গ ফিরে পায় না।

আমাদের দেশেও শারীরিক প্রতিবন্ধীর অভাব নেই। কারোর হাত নেই, কারোর চোখ, কারোর বা অন্য কোন সমস্যা। এখানে একটা কথা বলি, গভীরভাবে চিন্তা করলেই বুঝতে পারবেন। আমরা যারা সাধারণভাবে জন্মেছি, আমরা দুই হাত, দুই পা, দুই চোখে অভ্যস্ত হয়েই বেড়ে উঠেছি। আমরা কিন্তু জানিনা চার পা, তিন চোখের সুবিধা/অসুবিধা। তেমনই, যখন কোন শিশুর কোন শারীরিক বিকলাঙ্গতা থাকে, এবং সে সেটা নিয়েই বেড়ে ওঠে, ও কিন্তু সেভাবেই অভ্যস্ত হয়ে যায়। আমি ডান হাত ছাড়া লিখতে পারিনা। কেউ বাঁহাতি। অথচ আমাদের দেশেই এমন ঘটনা ঘটেছে যে পা দিয়ে লিখে লিখে এসএসসি এইচএসসি পাশ করে ফেলেছে। কারন ওর দুই হাতই নেই। কেউ কেউ মুখ দিয়ে লেখেন। প্রয়োজনই মানুষকে দিয়ে এমনকিছু করায় যা সাধারণ অবস্থায় কেউ কল্পনাই করেনা।

যাদের প্রতিবন্ধকতা থাকে, তাঁরা কিন্তু তাঁদের জীবনকে গুছিয়ে আনেন, কিন্তু সমস্যা করি আমরা, আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশীরা। আমরা আমাদের কথার বানে ওদের এমনভাবে বিদ্ধস্ত করি যে এরচেয়ে ওদের খুন করে ফেললেও ওরা এতটা কষ্ট পেত না।

প্রথমআলোর এক ভিডিওতে তেমনই এক মায়ের ঘটনা শুনেছিলাম। উনার ছেলেটা শারীরিক প্রতিবন্ধী, হাটঁতে পারেনা। পাঁচতলা বিল্ডিং মায়ের কোলে করে উঠতে হয়। এতে প্রতিবেশী মহিলা (নামের আগে "ভদ্র" শব্দটা ব্যবহার করবো না, মহিলা না বলে "বেটি" বলা উচিত) একদিন বলেন, "আপা! আপনি এত কষ্ট করছেন কেন? ও তো জীবনে কিছু করতে পারবে না।"
এই ছেলেটাই পরে শাহজালাল ইউনিভার্সিটি থেকে কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মাস্টার্স পাশ করে বিদেশী কোম্পানিতে চাকরি করেছে।

আমাদের উপমহাদেশীদের এই আলগা আল্লাদি কথাবার্তা বলার স্বভাবটাই আমি দুই চোখে দেখতে পারিনা। তোর কাছে জানতে চেয়েছে এই ছেলে কিছু হতে পারবে কি পারবে না? তুই এর খরচ বহন করিস? তুই একে কোলে তুলে যাতায়াত করিস? তাহলে তোর পরামর্শ তোর কাছেই রাখ।

আমার বৌ প্রিম্যাচুর্ড বেবি ছিল। গর্ভে ছয়মাস থাকতেই একদিন আমার শ্বাশুড়ীকে হসপিটাল যেতে হয়। ডাক্তার জানায় উনার মিসক্যারেজ হয়ে গেছে। এবর্ট করতে হবে।
আমার শ্বাশুড়ি কান্নাকাটি করে বলতে থাকেন, তাঁর মনে হচ্ছে তাঁর বাচ্চা বেঁচে আছে। ওরা যেন আরেকটু চেষ্টা করেন।
ডাক্তার বলেই দিয়েছেন যে বাচ্চা শেষ। মায়ের বাড়তি আবেগকে তেমন পাত্তা দিতে রাজি না।
তবু পরিচিত ডাক্তার বলেই শেষ পর্যন্ত রাজি হলেন। এবং মিরাকেল! আমার বৌ জ্যান্ত বেরিয়ে আসলো।
তা ছয় মাসের প্রিম্যাচুর্ড বেবি কেমন হতে পারে সেটা সাধারণ মানুষ ধারণাও করতে পারবে না। বিড়ালের বাচ্চার সাইজের হবে। ওদের সার্ভাইভ করার চান্স খুবই কম থাকে। অর্গানগুলো তখনও ঠিক মতন গ্রোই করে না।
ডাক্তাররা জানিয়ে দিলেন, এ বাচ্চা বাঁচবে না।
আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি জীবন এদিক সেদিক করে দিলেন উনাদের বাচ্চাকে বাঁচাবার জন্য। ভিটামিন দিতে রোদের মধ্যে ফেলে রাখা হতো। চামড়া পুড়ে কালো হয়ে গিয়েছিল। দিনরাত বাচ্চাকে নিয়ে ব্যস্ত। ডাক্তার থেকে শুরু করে আত্মীয়, প্রতিবেশী ও স্বজনেরা, প্রত্যেকে বলে দিলেন, "শুধু শুধুই কষ্ট করছেন। এ শিশু বাঁচবে না।"
চিৎকার দিয়ে ওদের ধমকাতে ইচ্ছা করে, "তোরা কি আল্লাহ? তোরা কিভাবে জানিস?"
কিন্তু ভদ্রপল্লীতে থাকার সমস্যা হচ্ছে, মনের কষ্ট ব্যক্ত করা যায় না। বরং বুক ফেটে মরে যাও।

কিছু অধ্যবসায় আর পরিশ্রম আল্লাহকেও নিজের সিদ্ধান্ত পাল্টাতে উদ্বুদ্ধ করে। মিরাকেল আমাদের জীবনেই ঘটে।
সেদিনের সেই "মিসক্যারেজড হয়ে যাওয়া" ও পরে প্রিম্যাচুর্ড জন্মানো মেয়েটা আজকে দুই সন্তানের মা। ভাগ্যিস! নাহলে আমি কাকে না কাকে বিয়ে করতাম কে জানে!

সেদিনের সেই ডাক্তারই নিজের বৌকে নিয়ে যতবার আমার শ্বশুরবাড়িতে আসতেন, আমার বৌকে ডেকে এনে বলতেন, "তুমি আজকে তোমার মায়ের চেষ্টার কারণেই বেঁচে আছো। আমরা নিজেদের চোখে মিরাকেল দেখেছি!"

আমাদের প্রত্যেকের মায়েরা হিরো। আর প্রতিটা স্পেশাল চাইল্ডের মায়েরা একেকজন সুপারহিরো।

উনারা উনাদের জীবন নিংড়ে দেন নিজেদের সন্তানের জন্য। আমার আপনার কাছে কিন্তু তাঁরা কোন সাহায্য চাইছেন না। শুধু একটাই অনুরোধ তাঁরা করেন, সেটা হচ্ছে আমাদের মুখটা যেন আমরা বন্ধ রাখি। প্রশংসা না করতে পারি, তাঁদের কিচ্ছু যায় আসেনা, তবু এমন একটা শব্দও যেন না বলি যাতে তাঁদের মন থেকে অভিশাপ বর্ষিত হয়। যারা সাধারণ শিশুর বাবা মা, তাঁরা যেন তাঁদের বাচ্চাদের একটু ভদ্রতা শিক্ষা দেয়, কিভাবে শারীরিক বা মানসিকভাবে দুর্বল সহপাঠীদের প্রতি সহমর্মী হতে হয়।
স্কুলে ফার্স্ট সেকেন্ড হওয়াটাই জীবনের সবচেয়ে বড় সাকসেস না। দুনিয়াটাই এমন যে অনেক সাধারণ ব্যাকবেঞ্চারও কোটি কোটি টাকার পাহাড়ের নিচে পড়ে থাকে, আবার অনেক স্কুল/বোর্ড টপারও নানান বাহ্যিক কারনে ঝরে যায়। যা ম্যাটার করে, তা হচ্ছে মনুষত্ববোধ। আপনি মানুষ হিসেবে কেমন, সেটাই লোকে মনে রাখে।

নিজের সন্তানের প্রতিবন্ধকতায় কিছু বাবা মাকে ডিপ্রেস্ড হতে দেখি। উনারা বুঝেন না যে উনাদের দিকেই এই শিশুরা তাকিয়ে থাকে। ওরা যদি দেখে ওদের কারনে ওদের বাবা মা ডিপ্রেশনে আছে, সেটা ওদের জন্যই বাড়তি মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। আপনারা আপনাদের সন্তানের জন্য ঢাল হন। পুরা দুনিয়া ওদের বিপক্ষে থাকে, আপনারা ওদের শক্তি না দিলে কে দিবে? প্রতিদিন নিয়ম করে ওদের মনে করিয়ে দিন যে ওরাই পারবে। ওরা মোটেই ভিন্ন কিছু নয়, হাত পা ছাড়াও মানুষ বেঁচে থাকে, ওদেরও সমস্যা হবেনা। ওরা যেন ওদের কাজে মনোযোগী হয়। স্টিফেন হকিং সমস্ত জীবন হুইল চেয়ারেই কাটিয়ে দিয়েছে। ইলন মাস্ক অটিজম নিয়েও বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি, টেসলা ও স্পেস এক্সের সিইও। এইসব শুভাকাঙ্খীদের কথায় ওরা যেন ডিপ্রেসড না হয়।

কেউ কেউ বলেন, "স্রষ্টার এমন কেমন বিচার? একটি শিশুকে কেন তিনি বিকলাঙ্গ করে জন্ম দেন?"
সেই শিশুদেরই বাবা মায়েদের সাথে কখনও কথা বলেছেন? একবার ওদের যদি অপশন দেয়া হয় "সুযোগ পেলে তুমি এই বাচ্চারই বাবা/মা হবা?"
প্রত্যেকে বলবেন, "একবার না, যদি হাজারবারও অপশন দেয়া হয়, তবু আমি এই সন্তানেরই মা/বাবা হবো।"

আমি যদি ভুল বলে থাকি, কমেন্টে বলতে পারেন।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ রাত ১০:৫৪
৩টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। আমের খাট্টা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৪



তাতানো গরমে কাল দুপুরে কাচা আমের খাট্টা দেখে ব্যাপারটা স্বর্গীয় মনে হল । আহা কি স্বাদ তার । অন্যান্য জিনিসের মত কাচা আমের দাম বাড়াতে ভুল করেনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩



এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিসিএস শুধু দেশের রাজধানী মুখস্ত করার পরীক্ষা নয়।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:১৪

"আমার বিসিএস এক্সামের সিট পরেছিলো ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট এ, প্রিপারেশন তো ভালোনা, পড়াশুনাও করিনাই, ৭০০ টাকা খরচ করে এপ্লাই করেছি এই ভেবে এক্সাম দিতে যাওয়া। আমার সামনের সিটেই এক মেয়ে,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কে কাকে বিশ্বাস করবে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৩৯


করোনার সময় এক লোক ৯৯৯ এ ফোন করে সাহায্য চেয়েছিল। খবরটা স্থানীয় চেয়ারম্যানের কানে গেলে ওনি লোকটাকে ধরে এনে পিটিয়েছিলেন। কারণ, ৯৯৯ এ ফোন দেওয়ায় তার সম্মানহানি হয়েছে।

সমাজে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×