somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ব্রিটিশ আমল থেকে বর্তমান পর্যন্ত শিক্ষা ব্যবস্থা

১৩ ই জানুয়ারি, ২০১৯ রাত ৯:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় বিভিন্ন শিক্ষা কমিশনের ভূমিকা আলোচনা করতে গিয়ে ইংরেজ শাসন আমল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত যত শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়েছে তাদের কার্যকারিতা, শিক্ষা ক্ষেত্রে কমিশন কতটুকু অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছে তা আলোচনা করা প্রয়োজন। ইংরেজ আমল থেকে শুরু করে পাক-ভারত বাংলাদেশ আমল পর্যন্ত অনেক শিক্ষা কমিশন, শিক্ষা ব্যক্তিত্ব এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য সুচিন্তিত মতামত প্রদান করেছেন কিন্তু শাসক গোষ্ঠী অধিকাংশ সুপারিশই বাস্তবায়ন করতে পারে নাই। তবে কেন কি কারণে সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন হয় নাই তার কোনো সন্তোষজনক জবাব আমাাদের আদৌ জানা নাই? ইংরেজ আমলে এ দেশে শিক্ষা যত উন্নয়ন হয়েছে শুধু তাদের শিক্ষা সংস্কৃতি পাক-ভারত বাংলাদেশ তথা গোটা বিশ্বে প্রচার এবং ভিত রচনা করার জন্য। বাংলাদেশ বা ভারতীয়দের স্বার্থ ছিল এখানে গৌণ। তবে একটা কথা ঠিক যে এদেশে ইউরোপীয় সংস্কৃতি ঢোকার পর শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে শুরু করে প্রায় সকল ক্ষেত্রে আধুনিকায়নের সূচনা লেগেছে। ১৮২৮ সালে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংক এদেশে গভর্নর জেনারেল হয়ে আসার পর এদেশে শিক্ষা ব্যবস্থার অবস্থা দেখে তিনি শিক্ষা সমপ্রসারণ এবং উন্নয়ন কল্পে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। শিক্ষার উন্নয়নে কাজ করার আগে তিনি এদেশের প্রচলিত শিক্ষার অবস্থা জানতে কৌতুহলী হন। ১৮২৬ সালে মাদ্রাজ প্রদেশের গভর্নর স্যার টমাস মনরো এবং ১৮২৯ সালে বোম্বে প্রদেশের গভর্নর মাউন্ট স্টুয়ার্ট এলফিন স্টোন নিজ, নিজ প্রদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে যে রিপোর্ট তৈরি করেছিল তা ছিল অসম্পূর্ণ এবং এসব রিপোর্টের কোনো নির্ভর যোগ্যতা ছিল না। তাছাড়া, তৎকালিন বাংলাদেশ ভূ-খ-ে দেশীয় শিক্ষা সম্পর্কে যে তথ্য সংগৃহীত হয়েছিল তার পিছনে কোনো সরকারি প্রচেষ্টা ছিল না। তাই স্কটল্যান্ড প্রবাসী মিশনারী উইলিয়াম অ্যাডাম নিজ উদ্যোগে এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে তদন্ত করার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেন। অবশেষে ১৮৩৫ সালে বড় লাট অ্যাডাম-এর আবেদন মঞ্জুর করেন এবং বাংলা ও বিহার প্রদেশে দেশীয় শিক্ষা সম্পর্কে অনুসন্ধান চালিয়ে রিপোর্ট প্রণয়ন করার শিক্ষা কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেন। শিক্ষাব্রতী অ্যাডাম ১৮৩৫ সাল থেকে ১৮৩৮ সাল পর্যন্ত বাংলা ও বিহার প্রদেশে নিখুঁতভাবে জরিপ করে পৃথক, পৃথক তিনটি রিপোর্ট সরকারের নিকট পেশ করেন। বাংলা ও বিহারে দেশীয় শিক্ষা সম্পর্কে নির্ভুল একটি চিত্র তুলে ধরাই ছিল তার লক্ষ্য।

মিশনারী ধর্ম প্রচারক উইলিয়াম এ্যাডাম ভারতের তৎকালিন বড় লাট লর্ড বেন্টিংক এর নির্দেশে দেশীয় শিক্ষা সম্পর্কে যে তিনটি রিপোর্ট পেশ করেন এতে বাংলা ও বিহারে এক লক্ষ বিদ্যালয় ছিল বলে উল্লেখ করেন। অ্যাডামের এ রিপোর্ট কে কোন, কোন বিশেষজ্ঞ অতিরঞ্জিত আবার কেউ, কেউ সঠিক বলেছেন। এ্যাডামের রিপোর্টের মূল সাফল্য হলো যে, তিনি তার জরিপের মাধ্যমে তৎকালিন দেশীয় শিক্ষা ব্যবস্থার একটি গতি প্রকৃতি নির্ণয় করতে পেরেছেন। ভারতীয়দের উন্নয়নের জন্য দেশীয় শিক্ষা পদ্ধতিতে বেছে নেয়ার জন্য তৎকালিন বড় লাটের নিকট সুপারিশ করেছেন। কিন্তু বড় লাটের নির্বাহী পরিষদ সদস্য এবং জেনারেল কমিটি অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন-এর প্রধান লর্ড মেকলে দেশীয় শিক্ষা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। ফলে ইংরেজ সরকার দেশীয় শিক্ষা বাতিল করে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রচলন করেন। যদিও তৎকালিন শাসকগণ অ্যাডামের প্রস্তাবসমূহ গ্রহণযোগ্য মনে করেননি তথাপি পরবর্তীকালে প্রাথমিক শিক্ষা পরিকল্পনায় তার নীতিকে অস্বীকার করতে পারেনি। দেশীয় শিক্ষা পদ্ধতি সম্পর্কে বিদেশি শাসকগণ ছিল সম্পূর্ণ অজ্ঞ ও উদাসীন। এরা দেশীয় শিক্ষাকে অপ্রয়োজনীয় ও মূল্যহীন মনে করত। তারা চেষ্টা করতেন দেশীয় শিক্ষাকে কিভাবে এদেশের মাটি থেকে মুছে ফেলে তথাকথিত আধুনিক শিক্ষার নামে ইংরেজি শিক্ষাকে এদেশের মানুষের ওপর চাপিয়ে দেয়া যায়।

নিম্নগামী পরিস্রবন নীতি

১৮১৩ সালে সনদ আইনের মাধ্যমে ভারতের জনগণের শিক্ষার জন্য বরাদ্দকৃত এক লক্ষ টাকা কিভাবে শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যয় করা হবে এ সম্পর্কে লর্ড ম্যাকলের প্রদত্ত মতামতই নিম্নগামী পরিস্রবণ নীতি নামে অভিহিত। মেকলের মতে এমন এক শ্রেণির লোক গড়তে হবে যারা আমাদের দোভাষীর কাজ করবে। তারা হবে এমন একশ্রেণির লোক যারা রক্তের বর্ণে ভারতীয় কিন্তু রুচি, নীতি ও বুদ্ধিতে ইংরেজ। নিম্নগামী পরিস্রবণ নীতি দেশীয় শিক্ষা ব্যবস্থার ধ্বংস ডেকে এনেছিল। এতে দেশীয় ভাষা, সাহিত্য, প্রাথমিক বিদ্যালয় শক্তিহীন হয়ে পড়ে।

উডের ডেসপ্যাচ

ঔপনিবেশিক ভারতে শিক্ষা সংক্রান্ত যতগুলো নীতিমালা ঘোষণা করা হয়েছিল তন্মধ্যে উডের ডেসপ্যাচ ১৮৫৪ সর্বাপেক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ পরবর্তীকালে ভারতের শিক্ষাক্ষেত্রে তথা শিক্ষা প্রশাসন ও ব্যবস্থা পনায় যত পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করা হয়েছে সব কিছুর মূলে উডের ডেসপ্যাচের কিছু না কিছু প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। উডের শিক্ষানীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এটি শিক্ষার নিম্নগামী পরিস্রবণ নীতি ত্যাগ করে সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারে দায়িত্ব স্বীকার করে নেয়। এক কথায় বলা যায় যে, স্বাধীন ভারতে ঔপনিবেশিক পাকিস্তান আমলের পূর্বে বাংলায় এবং বাংলাদেশে যে শিক্ষা ব্যবস্থা চলে এসেছে তার ভিত্তি রচিত হয়েছিল ইতিহাস প্রসিদ্ধ এই শিক্ষা দলিলে। উডের ডেস প্যাচের লক্ষণীয় দিক হলো

১) ডেস প্যাচে ভারতীয়দের শিক্ষার ব্যাপারে ইংরেজ সরকারের দায়িত্ব স্বীকার ২) শিক্ষা প্রশাসন ও ব্যবস্থাপণার উন্নতি কল্পে প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষাদান কিভাবে চলবে এসম্বন্ধে চিন্তা প্রসূত সুপারিশ।

হান্টার কমিশন (১৮৮২)

বৃটিশ ভারতের প্রথম শিক্ষা কমিশন হলো হান্টার কমিশন (ভারতীয় শিক্ষা কমিশন)। ১৮৫৪ সালে ডেস প্যাচের পর ১৮৮২ সাল পর্যন্ত শিক্ষার অগ্রগতি পরিমাপ এবং শিক্ষা নীতিমালা পর্যালোচনার জন্য হান্টার কমিশন গঠিত হয়। উডের ডেস প্যাচে (১৮৫৪) সাল ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের জন্য যেসব উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল তন্মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারে সরকারি দায়িত্ব গ্রহণ। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরকারি অনুদান প্রদানের রীতি গ্রহণ এবং ধীরে, ধীরে শিক্ষা ক্ষেত্র থেকে সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহার প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। কিন্তু দীর্ঘদিন পরও পরিকল্পনাসমূহ সঠিকভাবে বাস্তবায়িত না হওয়ায় জনমনে অসন্তোষের সৃষ্টি হয়। ফলে, ১৮৮২ সালে লর্ড রিপন ভারতীয় শিক্ষা কমিশন বা হান্টার কমিশন নামে ভারতের প্রথম শিক্ষা কমিশন নিয়োগ করেন।

কমিশন সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ এবং অনুদান প্রথার উন্নততর ব্যবস্থা গ্রহণের উপর অধিক গুরুত্ব প্রদান করে দেশীয় শিক্ষা, প্রাথমিক শিক্ষা, মাধ্যমিক শিক্ষা, উচ্চ শিক্ষা ও নারী শিক্ষা প্রভৃতি বিস্তার কল্পে বিভিন্ন যুগোপযোগী পরিকল্পনাসহ অর্থ, অনুদান পাঠক্রম বিষয়ক সুপারিশ প্রদান পূর্বক ভারতে তথা বাংলাদেশে শিক্ষা প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনার ভিত্তি রচনা করেছিল।

হান্টার কমিশন ১৮৮৩ সালে ২২২টি প্রস্তাবনা সংবলিত সুদীর্ঘ ৬০০ পৃষ্ঠার একখনি প্রতিবেদন সরকারের নিকট পেশ করেন। কমিশনই সর্ব প্রথম প্রাথমিক শিক্ষাকে রাষ্ট্রীয় কর্তব্য বলে বর্ণনা করেন এবং এর ভবিষ্যৎ উন্নয়নের পথ সুপ্রশস্ত করেন। তবে একথা অস্বীকার করা যাবে না যে, প্রথম শিক্ষা কমিশন হিসেবে হান্টার কমিশন উপমহাদেশের শিক্ষা ক্ষেত্রে ও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।

লর্ড কার্জনের শিক্ষা সংস্কার

ভারতে ইংরেজ শাসনের ইতিহাসে লর্ড কার্জনের শাসনকাল নানাভাবে স্মরণীয়। ১৮৯৮ সালে ডিসেম্বর মাসে লর্ড কার্জন উপমহাদেশের শাসনভার গ্রহণ করেন। গভর্নর জেনারেলদের মধ্যে তিনি একজন প্রত্যুপন্নমতি সম্পন্ন এবং শক্তিশালী শাসক ছিলেন। ভারতীয়দের নিকট তিনি বিভিন্ন ভাবে সমালোচনার পাত্র হিসেবে বিবেচিত। তবে এ উপমহাদেশে তার শিক্ষা সংস্কার নানাভাবে প্রশংসনীয়। লর্ড কার্জন ১৯০১ সালে সিমলায় একটি শিক্ষা সম্মেলন আহ্বান করেন। এই সম্মেলনে প্রতিটি প্রদেশের জনশিক্ষা পরিচালক, উচ্চ পদস্থ সরকারী কর্মকর্তারা অংশগ্রহণ করেন। কোনো ভারতীয় শিক্ষাবিদকে এই সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানানো হয় নি। এই সম্মেলনে ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থায় সমস্যা সম্পর্কে আলাপ আলোচনা করে তার মতামত ব্যক্ত করেন। একপক্ষ কালব্যাপি আলাপ আলোচনা শেষে ১৬০টি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। এই প্রস্তাবের ভিত্তিতে লর্ড কার্জন তার শিক্ষা কর্মসূচি রচিত করেন। কার্জনের সময়ে বিভিন্ন শিক্ষা সংস্কার ও ১৯০৪ সালে ভারত সরকারের শিক্ষানীতি বিষয়ক প্রস্তাবসমূহ এই সম্মেলনে গৃহিত প্রস্তাবের উপর ভিত্তি করেই রচিত হয়। লর্ড কার্জন এদেশে শিক্ষা সংস্কারের যত চেষ্টাই করেছিলেন তাকে বিপুল বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। তবে এদেশের শিক্ষা উন্নয়নে তার আন্তরিকতা ছিল সর্বজন স্বীকৃত। সুতরাং একথা বিনা দ্বিধায় স্বীকার করা যায় যে, বর্তমান শতাব্দীর প্রচলিত শিক্ষা ধারার সূত্রপাত ঘটে তারই শাসনকালে এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে লর্ড কার্জনের সংস্কার ছিল সুদূর প্রসারী।

স্যাডলার কমিশন

প্রখ্যাত ইংরেজ শিক্ষাবিদ এবং লীডস বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মাইকেল স্যাডলারের নেতৃত্বে ১৯১৭ সালে একটি কমিশন গঠন করে। ১৯১৯ সালে শেষ দিকে এ রিপোর্ট পেশ করা হয়। এ কমিশনকে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন ও বলা হয়। এ কমিশনের রিপোর্ট পাঁচ খ-ে শেষ করা হয়েছে এবং আট খ-ে এর পরিশিষ্ট রয়েছে। ভারতীয় শিক্ষা পরিকল্পনায় এটি অত্যন্ত মূল্যবান দলিল। মাধ্যমিক শিক্ষা সংস্কার এবং পরিকল্পনার জন্য এ কমিশন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড স্থাপনসহ আরো অনেক সুপারিশ করেছেন।

স্যাডলার কমিশন ইন্টারমেডিয়েট পাসকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির যোগ্যতা বলে বিবেচিত করেন। এ কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এর ফলে পূর্ববঙ্গের মানুষের জন্য উচ্চ শিক্ষার বিশেষ সুযোগ সৃষ্টি হয়। এদেশের শিক্ষার ইতিহাসে এত মূল্যায়ন আর কোনো রিপোর্ট ইতিপূর্বে রচিত হয়নি। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষার এমন কোনো প্রয়োজনীয় দিক নেই যা এ কমিশন আলোচনা করেন নি। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে উপক্ষা করে কমিশন গঠন করা হলেও ভারতের সকল বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনের সুপারিশে উপকৃত হয়েছে।

সার্জেন্ট কমিশন

ভারতে বৃটিশ শাসনামলে যতগুলো শিক্ষা পরিকল্পনা প্রণীত হয়েছিল তন্মধ্যে সার্জেন্ট পরিকল্পনা গুণগত দিক থেকে অত্যন্ত উঁচু মানের ছিল। এ পরিকল্পনা ছিল ৪০ বছরের (১৯৪৪-১৯৮৪) এতে শিক্ষার জন্য বার্ষিক ৩১২৬ মিলিয়ন টাকা ব্যয়ের জন্য বলা হয়েছে। উৎস সম্পর্কে বলা হয়েছে ৩৫৬ মিলিয়ন টাকা বা ১১% (প্রায়) পাওয়া যাবে শিক্ষার্থীদের বেতন ও অন্যান্য উৎস থেকে। অবশিষ্ট ২৭৭০ মিলিয়ন টাকা বা ৮৯% (প্রায়) পাওয়া যাবে জনগণের সরকারি ট্যাঙ্/কর থেকে।

সার্জেন্ট পরিকল্পনার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ইংল্যান্ডে তৎকালে শিক্ষার মান যে পর্যায়ে আছে আগামী ৪০ বৎসরে মধ্যে ভারতবর্ষের শিক্ষার মান যেখানে পৌঁছে দেয়া। এ প্রসঙ্গে সার্জেন্ট রিপোর্ট উল্লেখ করা হয়েছে। ঞযব ড়নলবপঃ ড়ভ ঃযব ঢ়ষধহ ধিং ঃড় পৎবধঃব রহ ওহফরধ রহ ধ ঢ়বৎরড়ফ ড়ভ হড়ঃ ষবংং ঃযধহ ভড়ৎঃু ুবধৎং, ঃযব ংধসব ংঃধহফধৎফ ড়ভ বফঁপধঃরড়হধষ ধঃঃধরহসবহঃং ধং যধফ ধষৎবধফু নববহ ধফসরঃঃবফ রহ ঊহমষধহফচ্ বৃটিশ ভারতের জন্য যুদ্ধোত্তর একটি শিক্ষা পরিকল্পনা প্রণয়ন করাই ছিল সার্জেন্ট কমিটি গঠনের প্রকৃত উদ্দেশ্য। এতবড় ব্যয় বহুল শিক্ষা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সার্জেন্ট বলেছেন যুদ্ধের সময় প্রয়োজন হলে অর্থের যোগাড় করা যায়। কিন্তু শিক্ষাকে যদি আমরা মনেপ্রাণে উপলব্ধি করি তাহলে অর্থের অভাবে শিক্ষার অগ্রগতি রোধ করা সমীচীন নয়। বৃটিশ শাসনে ভারতের শিক্ষা যে সঠিক পথে পরিচালিত হয়নি। একথাটি সার্জেন্ট কমিটি বলতে পেরেছেন। শুধু ত্রুটি দেখিয়ে কমিটি তার বক্তব্য শেষ করেনি। পরীক্ষা নিরীক্ষার সাহায্যে তা মূল্যায়ন করার ও সুপারিশ ছিল। উডের ডেস প্যাচের পর এমন একটি পূর্ণাঙ্গ ও তথ্যবহুল শিক্ষা পরিকল্পনা আর রচিত হয়নি। ইংরেজ আমলে রচিত একটি শিক্ষা পরিকল্পনা রচনায় তিনি যে সাহসিকতা ও সংকীর্ণমুক্ত উদার সৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়ে ছিলেন সে যুগে তা দুর্লভ। তার খসড়া পরিকল্পনাকেই আদল বদল করে পরবর্তী জাতীয় শিক্ষা পরিকল্পনা সমূহ প্রণীত হয়েছে।

সার্জেন্ট পরিকল্পনায় প্রাথমিক শিক্ষা, বয়স্ক শিক্ষা, মাধ্যমিক শিক্ষা, উচ্চ শিক্ষা প্রভৃতির উপর গুরুত্বারোপ করা হয়। পরবর্তীতে এদেশের শিক্ষা পরিকল্পনার অনেক উপাদান সার্জেন্ট পরিকল্পনা থেকে নেয়া হয়েছিল।

পাকিস্তান আমলে শিক্ষা কমিশন

পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের জন্মের পর ১৯৪৭ সালের ২৭শে নভেম্বর থেকে পাঁচ দিন ব্যাপী করাচীতে পাকিস্তানের প্রথম শিক্ষা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে পাকিস্তানের শিক্ষা উপদেষ্টা বোর্ড গঠনসহ পাকিস্তানের শিক্ষা ব্যবস্থা ইসলামী আদর্শে গড়ে তোলার উপর গুরুত্বারোপ করে স্কুল পর্যায়ে বাধ্যতামূলকভাবে উর্দুপড়া স্কুল ও কলেজে ধর্মীয় শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা। পাঁচ বৎসরের প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করা, শিক্ষা গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে সামরিক প্রশিক্ষণ, আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় বোর্ড গঠন, কারিগরি শিক্ষা পরিষদ প্রতিষ্ঠান ও নারী শিক্ষার সমপ্রসারণ প্রভৃতি প্রস্তাব গ্রহণ করে। তবে পাকিস্তান আমলে সে সকল শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়েছিল এবং পাকিস্তানের শিক্ষা উন্নয়নের জন্য কাজ করেছিল তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নে আলোচনা করা হলো।

ক) মাওলানা মুহাম্মদ আকরম খান শিক্ষা কমিশন

১৯৪৯ সালে ১৬ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ও সাংবাদিক মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খানকে পূর্ব বঙ্গশিক্ষা ব্যবস্থা পুনর্গঠন নামে পরিচিত কমিটির প্রেসিডেন্ট নিয়োগ করা হয়। এই কমিটি ১৯৫২ সালে তার সুপারিশমালা তদানীন্তন সরকারের নিকট পেশ করে। এসব সুপারিশ প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক, মাধ্যমিক, মাদ্রাসা, নারী, সংখ্যালঘু, শিক্ষা ও পরীক্ষা পদ্ধতিকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছিল।

খ) আতাউর রহমান খান শিক্ষা কমিশন

আতাউর রহমান খান শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয় ১৯৫৭ সালের ৩ জানুয়ারি। এই কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশিক সরকারের মুখ্য মন্ত্রী এবং প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ জনাব, আতাউর রহমান খান। এই কমিশন মূলত পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারকে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষা পুনর্বিন্যাস ও সংস্কার সমন্ধে পরামর্শ দানের জন্য গঠন করা হয়। এই কমিশনের প্রথম সভা ৩ ফেব্রুয়ারী ১৯৫৭ সালে মুখ্যমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে অনুষ্ঠিত হয়। এই কমিশন সুপারিশ প্রণয়নের পূর্বে ব্রিটিশ আমলের সকল সুপারিশ পর্যালোচনা করেন। তাছাড়া, এ কমিশন ১৯৫২ সালের শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট ও পরীক্ষা নিরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। আতাউর রহমান শিক্ষা কমিশন তৎকালে প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক শিক্ষকদের গুণগত মান, ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করার জন্য সুপারিশ করেছিল। কিন্তু তৎকালিন সরকার তা বাস্তবায়ন করেনি।

গ) শরীফ ও হামিদুর রহমান কমিশন

পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলের জন্য যুগোপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়নের জন্য ১৯৫৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর তদানিন্তন পাকিস্তান সরকার জাতীয় শিক্ষা কমিশন নিয়োগ করেন। ১৯৫৯ সালের ৫ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান কমিশন উদ্বোধন করেন। এই শিক্ষা কমিশনের প্রধান ছিলেন পাকিস্তানের শিক্ষা সচিব এসএম শরীফ। তার নামানুসারে এ কমিশনের নাম রাখা হয় শরীফ কমিশন। এ কমিশন পূর্বের কমিশনের বিভিন্ন সুপারিশ পর্যালোচনা করে কিছু সুপারিশ বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করে। প্রকৃত পক্ষে পাকিস্তানের শিক্ষা সংস্কার ও পুনর্গঠনের জন্য প্রথম কমিশন হচ্ছে শরীফ শিক্ষা কমিশন। এ কমিশন ১৯৫৯ সালের আগস্টে রিপোর্ট প্রণয়নের কাজ শেষ করে ১৯৬০ সালে সরকারের নিকট রিপোর্ট পেশ করে। তাছাড়া, হামুদুর রহমান কমিশন ও আইউব খানের আমলে গঠিত হয়েছিল। শরীফ কমিশনের দায়িত্ব ছিল জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার রূপরেখা প্রণয়ন করা। আর হামুদুর রহমান কমিশনের দায়িত্ব ছিল ছাত্র/ছাত্রীদের সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করে তা দূর করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করা এবং ছাত্রদের কল্যাণে বিভিন্ন কর্ম পরিকল্পনার সুপারিশ করা।

বাংলাদেশ আমলে শিক্ষা কমিশন (১৯৭১-২০১০)

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে বিশ্ব মানের করার জন্য বিশিষ্ট বিজ্ঞানী। শিক্ষক ও শিক্ষাবিদ ড. কুদরাত-এ-খুদা কে প্রধান করে বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। এর আগে প্রায় দু'শ বছর বৃটিশ শাসন, চবি্বশ বছর পাকিস্তানি শোষণ ও বৈষম্যমূলক শিক্ষা পরিকল্পনা, মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে প্রচ-ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রভৃতি নিয়ে এদেশের শিক্ষা যাত্রা শুরু হয়। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সংবিধানে সকল শিশুকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা প্রদানের জন্য একই মান সম্পন্ন গনমুখী এবং সার্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনের ঘোষণা দেয়া হয়।

কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে ২৪ অক্টোবর কুদরাত-এ-খুদা কমিশনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। একটি বিজ্ঞান ভিত্তিক আধুনিক বিশ্ব মানের শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলাই ছিল এ কমিশনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। কুদরাত-এ-খুদাকে প্রধান করে ১৮ জন বিশিষ্ট্য শিক্ষাবিদের সমন্বয়ে এ কমিশন গঠন করা হয়। শিক্ষার নানাবিধ অভাব ও ত্রুটি বিচ্যুতি দূরীকরণ, শিক্ষার মাধ্যমে সুষ্ঠুজাতি গঠনের নির্দেশ দান এবং দেশকে ও কর্মশক্তিতে বলীয়ান করার পথ নির্দেশের উদ্দেশ্যেই সরকার এই কমিশন নিয়োগ করেন। ১৯৭৩ সালে ৩ জুন কমিশন তাদের অন্তর্বর্তীকালীন রিপোর্ট পেশ করে। প্রায় ৪০০ জন সদস্য সম্বলিত ৩০টি অনুধ্যান কমিটি ও বিশেষ কমিটির বিস্তৃত কাজের মাধ্যমে এই কমিশন শিক্ষার প্রতিটি ক্ষেত্রের জন্য সুপারিশ প্রণয়ন করেন। ১৯৭৪ সালের ৩০ মে কমিশন ৩৬টি অধ্যায়ে বিভক্ত ৪৩০ পৃষ্ঠার একটি চূড়ান্ত রিপোর্ট প্রকাশ করেন। এটা একটি মূল্যবান শিক্ষা দলিল হিসেবে বিবেচিত। এতে বাংলাদেশের শিক্ষার বাস্তব সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং এসব সমস্যার সমাধানের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছে। এতে শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল সংস্কার সাধনের পরিকল্পনা করা হয়েছে। শিক্ষা পরিকল্পনাকে বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষায় অর্থ সংস্থানের কথা সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে এবং প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ উৎসের সন্ধানের কথা বলা হয়েছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে স্বল্পমেয়াদী, মধ্যমেয়াদী, এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার মাধ্যমে অগ্রসর হওয়ার পরিকল্পনা যথাযথভাবে সুপারিশ করা হয়েছে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হলো ১৯৭৫ সালের পট পরিবর্তনের পর তৎকালিন শাসকগোষ্ঠী এই শিক্ষা দলিলটিকে জনগণের মধ্যে আর প্রচার করেনি। তবে বর্তমান সরকার কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনের আলোকে শিক্ষা কমিশন গঠন করে অনেক সুপারিশ বাস্তবায়ন করার পদক্ষেপ নিয়েছে।

অন্তর্বর্তীকালীন শিক্ষা কমিশন (১৯৭৯)

১৯৭৮ সালে ৫ আগস্ট এক সরকারি আদেশ বলে তৎকালিন শিক্ষামন্ত্রীর সভাপতিত্বে ৩২ সদস্য বিশিষ্ট্য এক জাতীয় শিক্ষা উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা হয়। পরে হয় ২৩ শে সেপ্টেম্বর অন্য এক আদেশ বলে আরও ৯ জন সদস্য অন্তর্ভূক্ত করা হয়। এই পরিষদ গঠনের মূল উদ্দেশ্য ছিল দু'টি- ক) একটি অন্তর্বর্তীকালীন শিক্ষানীতি প্রণয়নে সরকারকে সাহায্য করা খ) শিক্ষা ক্ষেত্রে সম্মুখীন সমস্যাবলী সম্পর্কে সাধারণভাবে সরকারকে অবহিত রাখা। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. আ.ম. শরফুদ্দিন পরিষদ সচিবালয়ে প্রধান সমন্বয়কারী হিসেবে কাজ করেন। উক্ত পরিষদ দীর্ঘ ছয় মাস অক্লান্ত পরিশ্রম ১৯৭৯ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি সরকারের নিকট রিপোর্ট পেশ করেন।

মফিজ উদ্দিন শিক্ষা কমিশন (১৯৮৮)

১৯৮৭ সালের ২৩ শে এপ্রিল শিক্ষামন্ত্রণালয় এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বাংলাদেশ জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠন করে। উক্ত কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন ড. মুফিজুল ইসলাম। মূল কমিটি ছিল ২৭ সদস্য বিশিষ্ট। ৩০০ জন সদস্য বিশিষ্ট ৩০টি অনুধ্যান ও বিশেষ কমিটির মাধ্যমে কমিশন তার কাজ করে। কমিটির উপর অর্পিত দায়িত্ব ছিল শিক্ষা ক্ষেত্রে বর্তমান অবস্থা ও বিরাজমান পরিস্থিতি বিচার বিশ্লেষণ করে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, মাদ্রাসা, কারিগরি, প্রকৌশল এবং চিকিৎসা সহ সকল স্তরের শিক্ষাকে যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ মালা প্রণয়ন করে সরকারের নিকট উপস্থাপন করা। মফিজ উদ্দিন শিক্ষা কমিশন শিক্ষা ক্ষেত্রে সকল স্তরের সমস্যাবলী চুলচেরা বিশ্লেষণ করে ১৯৮৮ সালে রিপোর্ট প্রকাশ করে।

জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি (১৯৯৭)

১৯৯৭ সালের ১৪ জানুয়ারি সরকারের এক নির্বাহী আদেশ বলে সাবেক উপদেষ্টা, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর এম. শামসুল হক কে চেয়ারম্যান করে ৫৬ সদস্য বিশিষ্ট একটি জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয়। ১৯৭৪ সালের কুদরাত-এ-খুদা কমিশনের আলোকে এবং অন্যান্য কমিশনের সুপারিশগুলো বিচার বিশ্লেষণ করে দীর্ঘ সময়ব্যাপী কাজ করে একটি পূর্ণাঙ্গ শিক্ষানীতির দলিল সরকারের নিকট পেশ করে। এটি জাতীয় শিক্ষানীতি ১৯৯৭ নামে পরিচিত। এতে শিক্ষার ১৪টি জাতীয় লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য রয়েছে। এই শিক্ষানীতিতে প্রাথমিক থেকে শুরু করে শিক্ষার সকল স্তরের সমস্যাবলী আলোচনা করে আধুনিক বাস্তবসম্মত বিজ্ঞান বিত্তিক শিক্ষা পরিকল্পনায় কথা উল্লেখ করা হয়েছে। প্রকাশিত এই শিক্ষা নীতিতে ২৫টি মূল অধ্যায় ও পরিশিষ্ট অংশে পাঁচটি উপাংশ রয়েছে।

জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০

জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ শিক্ষামন্ত্রণালয়ের এক নির্বাহী আদেশ বলে ৬ এপ্রিল ২০০৯ইং সনে বিশিষ্ট শিক্ষক ও শিক্ষাবিদ জাতীয় অধ্যাপক কবির চৌধুরীকে চেয়ারম্যান করে গঠন করা হয়। কো-চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজজামান আহম্মদ ও সদস্য সচিব করা হয় অধ্যাপক শেখ ইকরামুল কবিরকে। উক্ত শিক্ষা নীতিতে সর্ব মোট সদস্য সংখ্যা ছিল ১৮ জন এবং দু'টি সংযোজনীসহ আটাশটি অধ্যায় ও ত্রিশটি শিক্ষার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য বিদ্যমান আছে। শিক্ষার প্রত্যেকটি স্তর নিখোঁত ভাবে আলোচনা করে সমস্যা সমাধানের পথ বের করা হয়েছে। এই শিক্ষানীতির উল্লেখযোগ্য দিক হল এখানে ধর্ম, বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষাকে প্রাদান্য দেয়া হয়েছে। আঠার সদস্য বিশিষ্ট্য শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি মাত্র চার মাসের মধ্যে একটি খসড়া শিক্ষানীতি প্রণয়ন করার পর তা চূড়ান্ত না করে ব্যাপক জনগণের মতামত গ্রহণের জন্য ওয়েব সাইট এবং অন্যান্য প্রচার মাধ্যমে প্রচার করা হলে সকল মহলের বিপুল সাড়া পাওয়া যায়। প্রচার মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা পর্যালোচনা করা হয়। বিভিন্ন সেমিনার ও আলোচনা সভা করে সমাজের সকল স্তরের মানুষের দলমত নির্বিশেষ মতামত নেওয়া হয়। এই শিক্ষানীতি সম্পর্কে দু'টি বিষয় স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। ১) এটা কোন দলীয় শিক্ষা নীতি নয় জনগণ তথা জাতির আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটিয়ে তৈরি করা হয়েছে জাতীয় শিক্ষানীতি। ২) শিক্ষানীতি কোনো অপরিবর্তনীয় বিষয় নয়। এর পরিবর্তন ও উন্নয়নের পথ সব সময় উন্মুক্ত থাকবে। কোনো ভুল, ত্রুটি হলে তা সব সংশোধন করা যাবে। শিক্ষা একটি গতিশীল বিষয়। জ্ঞান বিজ্ঞানের উন্নয়নের সংগে সংগতি রেখে সব সময় এর পরিবর্তন, বা আধুনিকরণ অব্যাহত থাকবে। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ প্রণয়নে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে বিধৃত সংশ্লিষ্ট নির্দেশ সমূহ বিবেচনা রাখা হয়েছে। জাতি সংঘ শিশু অধিকার কনভেনশন যেখানে প্রত্যেক সদস্য দেশে সকল শিশুর শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করার তাগিদ রয়েছে। সেটিও বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। এই শিক্ষানীতি সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী দেশে গণমুখী, সুলভ, সুষম, সর্বজনীন, সুপরিকল্পিত বিজ্ঞান মনস্ক এবং মান সম্মত শিক্ষাদানে সক্ষম শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার ভিত্তি ও রণকৌশল হিসেবে কাজ করবে।

উপসংহার

পরিশেষে আমরা এ সিদ্ধান্ত আসতে পারি যে, বৃটিশ ভারত থেকে শুরু করে পাক বাংলাদেশ আমল পর্যন্ত যত গুলি শিক্ষা কমিশন বা নীতি প্রণয়ন করা হয়েছে সবগুলি কমিশন শিক্ষার উন্নতি, শিক্ষক শিক্ষার্থী সমস্যার এবং তার সমাধান, নারী-শিক্ষার উন্নয়ন, বৃত্তি মূলক ও কারিগরি শিক্ষা, বিজ্ঞান শিক্ষা প্রভৃতির ব্যাপারে কিভাবে উন্নয়ন করা যায় তার বিস্তারিত সুপারিশ প্রদান করেছেন। বৃটিশ আমলে শিক্ষায় লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল বৃটিশদের চিন্তা, চেতনা এবং তাদের স্বার্থ আগে হাসিল করা। ভারতীয়দের উন্নয়ন এখানে মুখ্য ব্যাপার ছিল না। তবে প্রত্যেক শিক্ষা কমিশন প্রাথমিক শিক্ষার উপর বেশি জোর দিয়েছে। এ শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক অবৈতনিক সরকারিকরণের সুপারিশ প্রদান করা হয়েছে। তবে মাধ্যমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা হবে কিনা তার কোন সুস্পষ্ট ইংগিত নেই। শিক্ষার ইতিহাস থেকে জানা যায় মাধ্যমিক শিক্ষাকে বৃটিশ আমল থেকে শুরু করে বেসরকরিকরণের সুপারিশ করা হয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশে তথা বাংলাদেশের শিক্ষা বিস্তারে প্রত্যেকটি শিক্ষা কমিশন যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে তেমনি প্রত্যেকটি শিক্ষা কমিশনের আলাদা বৈশিষ্ট্য ও পরিলক্ষিত হয়েছে যার জন্য সে সকল কমিশনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য সর্বজন বিধিত। ব্রিটিশ শিক্ষা কমিশনগুলো শিক্ষার বীজ বপন করে দিয়েছে আর পাক বাংলাদেশ কমিশনগুলো সেই বীজ থেকে ফল সংগ্রহ করে জনগণের নিকট পৌঁছে দিয়েছে। তবে বাংলাদেশ আমলে যত শিক্ষা কমিশন করা হয়েছে কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্টকে ভিত্তি করেই রচিত হয়েছে। সর্বশেষ জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ একটি যুগান্তরকারী পদক্ষেপ। এই শিক্ষানীতি সকল সুপারিশ বাস্তবায়ন করা গেলে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নত দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার মতো হবে বলে আশা করা যায়। সুতরাং এদেশে, যখন যে দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন প্রত্যেকটি শিক্ষানীতি বা কমিশনের ভাল দিকগুলো বাস্তবায়ন করে গঠনমূলক সমালোচনা করা উচিত। আমাদের মনে রাখতে হবে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা দলমত নির্বিশেষে সকল জণগণের। এর সফলতা এবং বিফলতার ভাগ সকলেই পাবে। আমাদের আরো গভীরভাবে চিন্তা করা উচিত যে, বিশ্বের প্রত্যেকটি উন্নত দেশের মতো আমাদের দেশেও একটি পূর্ণাঙ্গ জাতীয় শিক্ষানীতি থাকা অপরিহার্য। তাই, আমাদের দলমত নির্বিশেষে সকলেই শিক্ষার ব্যাপারে একমত পোষণ করে কাজ করে যাওয়া উচিত। যে শিক্ষার উপর নির্ভর করছে আমাদের আগামী দিনের প্রজন্ম এবং ভবিষ্যৎ।
সংগ্রহনেঃ গুগল
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জানুয়ারি, ২০১৯ রাত ৯:৩৪
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্মৃতিপুড়া ঘরে

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৩০



বাড়ির সামনে লম্বা বাঁধ
তবু চোখের কান্না থামেনি
বালিশ ভেজা নীরব রাত;
ওরা বুঝতেই পারেনি-
মা গো তোমার কথা, মনে পরেছে
এই কাঠফাটা বৈশাখে।

দাবদাহে পুড়ে যাচ্ছে
মা গো এই সময়ের ঘরে
তালপাতার পাখাটাও আজ ভিন্নসুর
খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×