বিচারপতিদের অভিশংসন ক্ষমতা সংসদের হাতে
বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা আইনপ্রণেতাদের হাতে ফিরিয়ে দিতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বিল গতকাল সন্ধ্যায় জাতীয় সংসদে উত্থাপন করা হয়। আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক 'সংবিধান (ষোড়শ সংশোধন) আইন-২০১৪' বিলটি উত্থাপন করেন। পরে বিলটি যাচাই-বাছাই করে সাত দিনের মধ্যে সংসদে রিপোর্ট দেওয়ার জন্য আইন বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়। উত্থাপিত বিলে ১৯৭২-এর সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ পুনঃস্থাপনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া বিলে বিচারকদের বয়স ৬৭ বছর পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। বিলটি আইনে পরিণত হলে ৩৬ বছর পর বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা ফিরে পাবে জাতীয় সংসদ। সংসদের বাইরে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, আইনজীবী সংগঠন, অভিজ্ঞ আইনবিদ ও সুশীল সমাজের তীব্র বিরোধিতার মুখে বহুল আলোচিত এই সংবিধান সংশোধনী সংসদে উত্থাপিত হলো। বিল উত্থাপনের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় '৭২-এর সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ড. কামাল হোসেন বলেন, বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে গেলে ঝুঁকির মুখে পড়বে বিচার বিভাগ। বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান ও সুপ্রিমকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, সংবিধানের এই সংশোধনী গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের জন্য শুভকর কিংবা ইতিবাচক হবে না। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব ও মুখপাত্র মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে গেলে বিচারপতিরা ন্যায়বিচার করতে পারবেন না। উল্লেখ্য, বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের ওপর। এদিকে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বিল স্থায়ী কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাব কণ্ঠভোটে গৃহীত হওয়ার সময় বিরোধী দল জাতীয় পার্টির উপস্থিত সদস্যরা হাত তুলে পূর্ণ সমর্থন জানান। তবে সে সময় বিরোধীদলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদ ও জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ উপস্থিত ছিলেন না। সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। উত্থাপিত বিলের উদ্দেশ্য ও কারণ সম্পর্কিত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বিলটি আইনে পরিণত হলে স্বাধীন বিচার বিভাগের প্রতি জনগণের আস্থা আরও বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির কাছে এর জবাবদিহিতা সংক্রান্ত সংবিধানের মৌলিক কাঠামো সমুন্নত থাকবে। বিলে ১৯৭২ সালের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৬ পুনঃপ্রবর্তনের মাধ্যমে সুপ্রিমকোর্টের বিচারকদের সংসদের মাধ্যমে অপসারণের বিধান পুনঃপ্রবর্তনের প্রস্তাব করা হয়েছে। বিলের উদ্দেশ্য ও কারণ সম্পর্কিত বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে, 'গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭ এর বিধান অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ এবং তাদের পক্ষে এ ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হবে। এর প্রতিফলনে ১৯৭২ সালে সংবিধানে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত রাষ্ট্রপতিকে সংসদ কর্তৃক অভিশংসনের মাধ্যমে অপসারণ (অনুচ্ছেদ ৫২), সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন হারালে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ (অনুচ্ছেদ ৫৭), সংসদ সদস্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে সমর্থিত প্রস্তাবের মাধ্যমে স্পিকারকে অপসারণ (অনুচ্ছেদ ৭৪) এবং সংসদের মোট সদস্য সংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার দ্বারা সমর্থিত প্রস্তাবের মাধ্যমে সুপ্রিমকোর্টের অপসারণের বিধান (অনুচ্ছেদ ৯৬) ছিল। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকারকে যথাক্রমে অভিশংসন, পদত্যাগ ও অপসারণ সম্পর্কিত পূর্ববর্তী বিধান অদ্যাবধি অপরিবর্তিত থাকলেও সামরিক শাসক কর্তৃক অসাংবিধানিক পন্থায় সামরিক ফরমান second proclamation (Fifteenth Amendment) order 1978 এর second schedule দ্বারা সুপ্রিমকোর্টের কোনো বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্যের অভিযোগে অপসারণের বিধান পরিবর্তনক্রমে সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি এবং অপর দুইজন প্রবীণ বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের উপর ন্যস্ত করা হয় যা সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭ এর চেতনার পরিপন্থী। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত সংসদে রাষ্ট্রের অন্যান্য অঙ্গের ন্যায় উচ্চ আদালতের বিচারকদের জবাবদিহিতার নীতি বিশ্বের অধিকাংশ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিদ্যমান রয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে ১৯৭২ সালের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৬ পুনঃপ্রবর্তনের মাধ্যমে সুপ্রিমকোর্টের বিচারকগণকে সংসদের মাধ্যমে অপসারণের বিধান পুনঃপ্রবর্তনের মধ্য দিয়ে অনুচ্ছেদ ৭ এর চেতনা পুনর্বহালের লক্ষ্যে সংবিধান (ষোড়শ সংশোধন) আইন-২০১৪ এর বিল উত্থাপন করা হয়েছে।' উল্লেখ্য, বিচারপতিদের অপসারণ বা অভিশংসনের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে ফিরিয়ে দিতে সংবিধানের ষষ্ঠদশ সংশোধন আইন-২০১৪ গত মাসের ১৮ তারিখ মন্ত্রিসভা অনুমোদন দেয়। বর্তমান সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের পরিবর্তে '৭২-এর সংবিধানের যে অংশ প্রতিস্থাপিত হবে তা হলো "(১) এই অনুচ্ছেদের বিধানাবলী সাপেক্ষে কোন বিচারক ৬৭ বৎসর বয়স পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত স্বীয় পদে বহাল থাকিবেন। (২) প্রমাণিত অসদাচরণ বা অসামর্থ্যের কারণে সংসদের মোট সদস্য সংখ্যার অনূ্যন দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতার দ্বারা সমর্থিত সংসদের প্রস্তাবক্রমে প্রদত্ত রাষ্ট্রপতির আদেশ ব্যতীত কোন বিচারককে অপসারিত করা যাইবে না। (৩) এই অনুচ্ছেদের (২) দফার অধীন প্রস্তাব সম্পর্কিত পদ্ধতি এবং কোন বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্য সম্পর্কে তদন্ত বা প্রমাণের পদ্ধতি সংসদ আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করিতে পারিবেন। (৪) কোন বিচারক রাষ্ট্রপতিকে উদ্দেশ্য করিয়া স্বাক্ষরযুক্ত পত্রযোগে স্বীয় পদত্যাগ করিতে পারিবেন।" উল্লেখ্য, '৭২-এর সংবিধানে বিচারকের বয়স ৬২ ছিল কিন্তু সংবিধানের ষষ্টদশ সংশোধনীতে বয়স বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী সাতষট্টিই রাখা হয়েছে। বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের ওপর। সংবিধানের ষষ্ঠ ভাগে বিচার বিভাগ সংশ্লিষ্ট ৯৬ অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে যে, ''(২) এই অনুচ্ছেদের নিম্নরূপ বিধানাবলী অনুযায়ী ব্যতীত কোন বিচারককে তাঁহার পদ হইতে অপসারিত করা যাইবে না। (৩) একটি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল থাকিবে যাহা এই অনুচ্ছেদে ''কাউন্সিল'' বলিয়া উল্লেখিত হইবে এবং বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারকের মধ্যে পরবর্তী যে দুইজন কর্মে প্রবীণ তাঁহাদের লইয়া গঠিত হইবে : তবে শর্ত থাকে যে, কাউন্সিল যদি কোন সময়ে কাউন্সিলের সদস্য এইরূপ কোন বিচারকের সামর্থ্য বা আচরণ সম্পর্কে তদন্ত করেন, অথবা কাউন্সিলের কোন সদস্য যদি অনুপস্থিত থাকেন অথবা অসুস্থতা কিংবা অন্য কোন কারণে কার্য করিতে অসমর্থ্য হন তাহা হইলে কাউন্সিলের যাঁহারা সদস্য আছেন তাঁহাদের পরবর্তী যে বিচারক কর্মে প্রবীণ তিনিই অনুরূপ সদস্য হিসাবে কার্য করিবেন। (৪) কাউন্সিলের দায়িত্ব হইবে- (ক) বিচারকগণের জন্য পালনীয় আচরণ বিধি নির্ধারণ করা; এবং (খ) কোন বিচারকের অথবা কোন বিচারক যেরূপ পদ্ধতিতে অপসারিত হইতে পারেন সেইরূপ পদ্ধতি ব্যতীত তাঁহার পদ হইতে অপসারণযোগ্য নহেন এইরূপ অন্য কোন পদে আসীন ব্যক্তির সামর্থ্য বা আচরণ সম্পর্কে তদন্ত করা। (৫) যে ক্ষেত্রে কাউন্সিল অথবা অন্য কোন সূত্র হইতে প্রাপ্ত তথ্যে রাষ্ট্রপতির এইরূপ বুঝিবার কারণ থাকে যে কোন বিচারক- (ক) শারীরিক বা মানসিক অসামর্থ্যের কারণে তাঁহার পদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করিতে অযোগ্য হইয়া পড়িতে পারেন, অথবা (খ) গুরুতর অসদাচরণের জন্য দোষী হইতে পারেন, সেইক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি কাউন্সিলকে বিষয়টি সম্পর্কে তদন্ত করিতে ও উহার তদন্ত ফল জ্ঞাপন করিবার জন্য নির্দেশ দিতে পারেন। (৬) কাউন্সিল তদন্ত করিবার পর রাষ্ট্রপতির নিকট যদি এইরূপ রিপোর্ট করেন যে, উহার মতে উক্ত বিচারক তাঁহার পদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনে অযোগ্য হইয়া পড়িয়াছেন অথবা গুরুতর অসদাচরণের জন্য দোষী হইয়াছেন তাহা হইলে রাষ্ট্রপতি আদেশের দ্বারা উক্ত বিচারককে তাঁহার পদ হইতে অপসারিত করিবেন। (৭) এই অনুচ্ছেদের অধীনে তদন্তের উদ্দেশ্যে কাউন্সিল স্বীয় কার্য-পদ্ধতি নিয়ন্ত্রণ করিবেন এবং পরওয়ানা জারী ও নির্বাহের ব্যাপারে সুপ্রিমকোর্টের ন্যায় উহার একই ক্ষমতা থাকিবে।''