হঠাৎ সে শিশুকালের মতো আমার কোলে মুখলুকিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলো। খানিকটা হকচকিয়ে গেলাম। মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে ওকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলাম। ভয় নেই মা আমরা তো তোর পাশে আছি। মুখে বললাম, কি হয়েছে খুলে বলতো শুনি।
-মুনাকে হয়তো আর বাঁচানো যাবে না। ওর পেটে ছুরি মারা হয়েছে। ও এখন হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে আছে। হাত-পা শরীর ফুলে গেছে। কিন্তু ওর আত্মীয় স্বজন একেক সময় একেক কথা বলছে। একবার বলছে, ওর লাঞ্চে পানি জমেছে। একবার বলছে ইন্টারনাল ব্লিডিং হয়েছে। একবার বলছে, ভিতরে ভিতরে যে সে এতো রোগ নিয়ে ঘুরে বেড়াত-তা আমরা কি করে জানবো বাপু। হাসপাতালে ভর্তি করার পর একে একে বেরিয়ে আসছে নানা রোগের কথা।
-ওর পেটে ছুরি মারা হয়েছে-সেটা তুই কি করে নিশ্চিত হলি। ওর বাবা-মা কোথায়? ওরা কি তা জানে? তারা কি থানায় জিডি করেছে?
-না। হাসপাতালে খালাম্মা (ওর মা) শুধু আমার কাছে জানতে চেয়েছিল, ওরা কি সুখী ছিল না মা? ওনার আশেপাশে ওর শ্বশুড় বাড়ির লোকজন ছিল বলে আমি কিছু বলিনি।
-ছুরি মারার বিষয়টি কিভাবে জানলি?
-নানাভাবে হাসপাতালের নার্সদের পটিয়ে জানলাম, ওর পেটে ছুরির আঘাত রয়েছে। এই আঘাতের কারণে ইন্টারনাল ব্লিডিং হয়েছে। কিন্তু আঘাতের বিষয়টি প্রাথমিক অবস্থায় লুকিয়ে রাখায় নানা জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। ডাক্তারের কাছে ওর শ্বশুড় পক্ষ বলেছে, ফল কাটার ছুরি দিয়ে সে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে। প্রথমে ওর স্বামী ওকে স্থানীয় ডাক্তারের কাছে নিয়ে পেটে ব্যান্ডেজ করিয়ে আনে। এরপর সে একদিন বাসায় ছিল। পরে পেটে ব্যথা শুরু হলে তাকে নাকি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়েছিল। সেখানে বেড না পেয়ে ওকে ফ্লোরে শুইয়ে রাখা হয়। পরে নাকি তাকে ধানমন্ডির কোন ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে একদিন রাখার পর অবস্থা আরো খারাপ হয়ে গেলে তাকে কাকরাইল ইসলামি ব্যাংক হাসাপাতালে ভর্তি করা হয়। এরমধ্যে পেরিয়ে যায় সাতটি দিন। ফলে লাঞ্চে পানি জমাসহ নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয় সে। ওকে দেখে চেনা যায়না আব্বু এই আমাদের বান্ধবী মুনা। ওর সারা শরীর ফুলে গেছে।
-ওর এই অবস্থার কথা কবে জানতে পারলি তুই?
-গতকাল। গত সাত দিন ধরে ওকে ফোনে পাচ্ছিলাম না। অথচ প্রতিদিন আমরা কথা বলতাম ফোনে। অগ্যতা গতকাল মিরপুরের কালশীতে ওদের বাসায় গিয়েছিলাম। ও বাসায় নেই বলে ওর নোনাস (জামাইয়ের বড় বোন) প্রথমে আমাদের বিদায় করে দিতে চেয়েছিল। পরে আমার পীড়াপীরির কারণে জানাল ও অসুস্থ। তাহলে কোথায় চিকিৎসা হচ্ছে-আমার সেখানেই দেখতে যাবো। এ কথাও বলতে চায়নি। পরে কান্নাকাটি শুরু করায় ওর ভাইযৈর (মুনার হাজবেন্ডের) ফোন নাম্বার দিল। ফোনে প্রথমে ওর জামাইও আমাকে চিনতে চাইলো না। মুনাকে নিয়ে আমাদর বাসায় এসেছিলেন-এসব বলে মুনার ট্রেস করলাম।
মুনার পুরো নাম সিত্তুন মুনা সৈয়দা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফুড এন্ড নিউট্রেশন ও পপুলেশনে ডাবল এমএসসি। ভালোবেসে বিয়ে করেছিল মিশুকে। ওদের দুই বছর বয়সি একটি ছেলেও আছে। স্বামী কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। তবে বড় কোন ফার্মে কাজ পায়নি। কালশীতে নিজেদের টিনশেড বাড়ি আছে। মিশুরা দুই ভাই দুই বোন। মিশু সবার ছোট। পারিবারিকভাবে জমি-জমার ভাগাভাগি নিয়ে বিরোধ আছে। এসব বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে মুনা ওর ভাশুড়েরর হাতে একবার নিগৃহীত হয়েছিল। স্বামী প্রতিবাদ করতে পারেনি। উল্টো তাকে নিজ ঘরে নিয়ে আটকে রাখা হয়েছিল।
মুনার দোষ সে মুখের ওপর সত্য কথা বলতে দ্বিধা করে না। সে সাহসী ও প্রতিবাদি। বানানী থেকে প্রকাশিত একটি লাইফ স্টাইল বিষয়ক ম্যাগাজিনে সে বিভাগীয় সম্পাদিকা হিসেবে কাজ করতো। তারা বাবা আয়াতুল্লাহ খান লাকসাম প্রেসক্লাবের সভাপতি ছিলেন। আমার মেয়ে তার সংগে যোগাযোগ করেছিল। মুনার সংগে আনওয়ানটেন্ড বা আন-ন্যচারাল ঘটনার বিষয়ে তিনি কিছু বলতে চাননি। তিনি শুধু দোয়া মুনার জন্য চেয়েছেন।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ বিকাল ৩:০৯