সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর জন্য জাতীয় সংসদে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন, ১৯৮৭ প্রণয়ন করার ১৮ বছর পরও উচ্চ শিক্ষা ও উচ্চ আদালতে কার্যকর হয়নি বাংলা ভাষা। ভাষাসৈনিক বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আহমদ রফিক এ বিষয়ে হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, ‘আমাদের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির চাওয়া-পাওয়া শেষ হয়ে গেছে। এখন আর তারা একুশের চেতনাকে বাস্তবায়ন করা দরকার মনে করছেন না।’ এর জন্য তিনি বাস্তবায়নকারীদের সদিচ্ছার অভাবকে দায়ী করেন।
হাইকোর্টের সাবেক রেজিস্ট্রার ইকতেদার আহমেদ বলেন, হাইকোর্ট ও সুপ্রিমকোর্টের রুল এবং দেওয়ানি ও ফৌজদারি কার্যবিধি আদালতে বাংলা ভাষা ব্যবহারের প্রধান অন্তরায়। ১৯৮৭ সালের আইনে বাধা থাকলেও বিধির কারণে বিদেশি ভাষায় আবেদন-নিবেদন, আপিল, ডিক্রি ও রায় দেওয়া হচ্ছে। তবে এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক। তিনি বহুল আলোচিত সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর রায় বাংলা ভাষায় লিখে উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষার প্রচলনের ক্ষেত্রে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করে গেছেন। হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট শফিকুর রহমান বলেন, আদালতের ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা কার্যকর না করায় রাষ্ট্রের নাগরিকরা সাংবিধানিকভাবে পাওয়া মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। স্বাধীন দেশের একজন নাগরিক হয়েও ন্যায়বিচারপ্রার্থী হিসেবে মানুষ আজ আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকে অসহায়ের মতো। যে ভাষায় বিচারকের সঙ্গে তার আইনজীবী কথা বলেন, তিনি তা বুঝতে অক্ষম। যে ভাষায় বিচারক রায় দিচ্ছেন, তিনি তা বুঝতেও অক্ষম। জানা যায়, ১৯৭০ সালের ১৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভের পর ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় বাংলা একাডেমির একুশে অনুষ্ঠানমালা উদ্বোধন করেছিলেন তৎকালীন পাকিস্তানের প্রাদেশিক ও জাতীয় পরিষদের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেখানে তিনি ঘোষণা করেছিলেন, ‘আমি ঘোষণা করছি, আমাদের হাতে যেদিন ক্ষমতা আসবে, সেদিন থেকেই দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হবে। বাংলা ভাষার পণ্ডিতরা পরিভাষা তৈরি করবেন, তারপর বাংলা ভাষা চালু হবে তা হবে না। পরিভাষাবিদরা যত খুশি গবেষণা করুন, আমরা ক্ষমতা হাতে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করে দেব। সে বাংলা যদি ভুল হয়, তবে ভুলই চালু হবে, পরে তা সংশোধন করা হবে।’ কিন্তু এর পরও মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের সর্বস্তরে রাষ্ট্রভাষা কার্যকর করতে নানা আইনি ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা সৃষ্টি করছে কতিপয় স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী। হাইকোর্ট বিভাগের সাবেক রেজিস্ট্রার ইকতেদার আহমেদ জানান, বাংলাদেশের সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদে স্পষ্ট বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’। সংবিধানের এই বিধান যথাযথভাবে কার্যকর করতে ১৯৮৭ সালের ৮ মার্চ বাংলা ভাষা প্রচলন আইন কার্যকর করা হয়। এই আইনের ৩(১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘এ আইন প্রবর্তনের পর বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারি অফিস-আদালত, আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশিদের সাথে যোগাযোগ ব্যতীত অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আইন আদালতের ছোয়াল জওয়াব এবং অন্যান্য আইনানুগত কার্যাবলী অবশ্যই বাংলায় লিখতে হবে।’ ৩(১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘উল্লেখিত কোন কর্মস্থলে যদি কোন ব্যক্তি বাংলা ভাষা ব্যতীত অন্য কোন ভাষায় আবেদন বা আপীল করেন, তাহলে উহা বেআইনী ও অকার্যকর বলে গণ্য হবে।’ এর পরও হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের রুল এবং দেওয়ানি ও ফৌজদারি কার্যবিধি এ ক্ষেত্রে অন্তরায় সৃষ্টি করেছে। ভাষাসৈনিক আহমদ রফিক বলেন, শুধু উচ্চ আদালত নয়, উচ্চ শিক্ষায়ও বাংলা ভাষা ব্যবহৃত হচ্ছে না। এটি খুবই পীড়াদায়ক। এসব ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা যারা কার্যকর করবেন, তাদের সদিচ্ছার অভাব রয়েছে।হাইকোর্টের আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হাইকোর্ট বিভাগের রুলে চতুর্থ অধ্যায়ের ১ নং বিধিতে বলা হয়েছে, হাইকোর্টে দাখিলকৃত দরখাস্তগুলোর ভাষা হবে ইংরেজি। তবে পঞ্চম অধ্যায়ের ৬৯ নম্বর বিধিতে বলা হয়েছে, হাইকোর্ট কর্তৃক প্রদত্ত আদেশ এবং ডিক্রি আদালতের ভাষায় প্রস্তুত করতে হবে। সেই সুবাদে আদালত দরখাস্তের ভাষার অনুরূপ ইংরেজি ভাষা ব্যবহারের সুবিধা লাভ করছেন। একইভাবে দেওয়ানি কার্যবিধির ১৩৭ ধারায় আদালতের ভাষা নির্ধারণ করতে গিয়ে ১৩৭(৩) অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘কোন আদালতে সাক্ষ্য লিপিবদ্ধ করা ব্যতীত অন্য কিছু লিখিতভাবে সম্পাদন করার জন্য অত্র কোর্ট আদেশ যা অনুমোদন করে তা ইংরেজীতে লেখা যাবে।’ ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৬৬(১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘যে কোন ফৌজদারি আদালতের বিচারিক রায় আদালতের ভাষায় অথবা অন্য কোন ভাষায়- যা আসামী অথবা তার আইনজীবী বুঝতে সক্ষম সে ভাষায় ঘোষণা অথবা উক্ত রায়ের বিষয়বস্তু লিপিবদ্ধ করতে হবে।’ সুপ্রিম কোর্টের রায়েও বাংলা ভাষায় রায় দেওয়ার সুযোগ বিবৃত হয়েছে।
- See more at: Click This Link