পরিশিষ্টঃ ছবি আমাদের ইতিহাসের পদচিহ্ন। আমরা কি করেছি তা জানার সবচেয়ে ভাল মাধ্যম হচ্ছে ছবি- জো ম্যাকনালি
জ্বালানী সংকট বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান সমস্যা। ২০৩০ সালের মধ্যেই মজুদকৃত গ্যাস-কয়লা নিঃশেষিত হয়ে যাবার ভবিষ্যৎ শংকা আর আমদানীনির্ভর জ্বালানী ভিত্তিক স্বল্পমেয়াদী রেন্টাল পদ্ধতির বর্তমান চাপে আমরা সংকটকালীন সময় পার করছি।
জ্বালানী ব্যবস্থাপনার নড়বড়ে এ চিত্র নিশ্চিতভাবেই ভবিষ্যৎ উন্নতী নিশ্চিত করণে বিকল্প উৎস অন্বেষণের ইঙ্গিত দিচ্ছে। আধুনিক বিশ্বে উন্নয়নের সূচক এখন জ্বালানী স্বয়ংসম্পূর্ণতার হার। আর ভবিষ্যৎ আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে নানা মেরুকরণে যে জ্বালানী উৎপাদন সক্ষমতাই প্রধান হয়ে উঠবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
জ্বালানী উৎপাদন সক্ষমতা বলতে এখন বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতাই বুঝায়। আর ২০৪২ সালের মধ্যে পুরো বিশ্বে শেষ হতে যাওয়া তেল-গ্যাসের রিজার্ভ দিয়ে যে আগামীর চাহিদা মিটবে না তা এখন স্পষ্ট। আর তাইতো বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানী যোগান বহুমুখীকরণের এ প্রচেষ্টা বাংলাদেশের জন্য অল্পদিনের হলেও উন্নত রাষ্ট্রগুলো ইতোমধ্যেই এ মহাযজ্ঞে বেশ অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে।
জ্বালানী খাতে সক্ষমতা অর্জনে পারমাণবিক শক্তিই একমাত্র অবলম্বন- এই ধ্যান ধারণা গত শতাব্দীর অলংকার। এই অলংকারে অলংকৃত প্রায় সকল দেশই এই শক্তি থেকে এখন মুক্তি চাচ্ছে। হিসাবের খাতায় সেসব দেশের লাভের চেয়ে ক্ষতির পাল্লা ভারী। সুখ ভোগের চেয়ে হারানোর শোক বেশী। আর তাইতো পরমাণু বিদ্যুতে সবচেয়ে অগ্রগামী দেশ ফ্রান্স পরমাণু শক্তিকে ধীরে ধীরে পরিবেশবান্ধব জ্বালানী দিয়ে প্রতিস্থাপন করছে। জার্মানী ২০২২ সালের মধ্যে পরমাণু ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। ফুকুশিমা দূর্ঘটনার পর তীব্র জন বিক্ষোভের মুখে জাপান সরকার পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়েছে। অথচ বাংলাদেশ তথাকথিত আধুনিকতার এই বিপদজনক উপকরণটি আপন করে পেতে রাশিয়ার সাথে সম্প্রতি চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। এই চুক্তি অনুযায়ী রূপপূরে দুটি পারমাণবিক চুল্লি স্থাপিত হবে যার প্রতিটির ক্ষমতা হবে ১০০০ মেগাওয়াট। প্রথম চুল্লিটি উৎপাদনে আসবে ২০১৮ সালে, অপরটি ২০২০ সালে। বাংলাদেশের দৈনন্দিন ‘উত্তেজক’ ঘটনা প্রবাহের অড়ালে চাপা পড়া ভবিষ্যতের এই মহাপরিকল্পনা নিয়ে তেমন কোন আলোচনা হচ্ছে না। তাই এখনও পর্যন্ত এটি রাশিয়ার সাথে নানা ধরণের চুক্তি সইয়ের আনুষ্ঠানিকতা আর মন্ত্রী-আমলা-উপদেষ্টাদের বিদেশ ভ্রমনের মাঝেই সীমাবদ্ধ।
২০১৮ যতই এগিয়ে আসতে থাকবে ততই এ নিয়ে বৃদ্ধি পাবে আলাপ-আলোচনা-টক শো। নীতিনির্ধারণী নানা কর্মকান্ডে তৈরী হবে প্রশ্ন। তথ্য গোপনের সংস্কৃতিতে সৃষ্টি হবে সন্দেহ। এরই পরিপ্রেক্ষিতে নিচের অনুচ্ছেদগুলোতে পরমাণু বিদ্যুৎ নিয়ে কিছু প্রশ্নের যুক্তিভিত্তিক উত্তর খোজার চেষ্টা করা হলঃ
পরমাণু বিদ্যুৎ কি সাশ্রয়ী?
সম পরিমাণ সেবাদানে সক্ষম তুলনামূলক কম খরচের জিনিসকেই আমরা বলি সাশ্রয়ী। কিন্তু এই হিসাবের ক্ষেত্রটা হতে হবে সামগ্রিক, আংশিক নয়। কেন্দ্র স্থাপনের পর থেকে শুধুমাত্র উৎপাদন খরচ বিবেচনা করলে পরমাণু বিদ্যুৎ তেল-গ্যাস ভিত্তিক বিদ্যুতের চেয়ে সাশ্রয়ী। কিন্তু বিশাল অবকাঠামো উন্নয়ন ব্যয়, উচ্চ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ব্যয়, পারমাণবিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ব্যয়, ইনসুরেন্স আর ঋণ পরিশোধের খরচ হিসাবে আনলে পরমাণু বিদ্যুৎ কোনভাবেই সাশ্রয়ী নয়। বরং তা অতিরিক্ত ব্যয়বহুল এবং অর্থনীতির উপর চাপ সৃষ্টিকারী। তাইতো এমআইটি’র (ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি) গবেষণায় পরমাণু বিদ্যুৎ সবচেয়ে খরুচে হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। আর যে কোন একটি অনভিপ্রেত দূর্ঘটনা একটি দেশের অথনৈতিক অবকাঠামোয় ডেকে আনতে পারে মারাত্নক বিপর্যয়। যেমনটি ঘটেছিল ইউক্রেনের চেরনোবিল দূর্ঘটনার সময়। ওই দূর্ঘটনায় সামগ্রিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৬ লক্ষ কোটি টাকা যা বাংলাদেশের বর্তমান বাজেটের ১৮ গুণ।
পরমাণু বিদ্যুৎ কি পরিবেশবান্ধব?
প্রায় শূন্য কার্বন নিঃসরণের পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন আপাত দৃষ্টিতে পরিবেশ বান্ধব বলেই মনে হয়। তেল-গ্যাস-কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ফলে দীর্ঘদিনের কার্বন নিঃসরণে বর্তমান বিশ্বে যেসব প্রকট প্রাকৃতিক দূর্যোগ দেখা দিচ্ছে তার পরিপ্রেক্ষিতে পরমাণু বিদ্যুতের পক্ষের লবিস্ট’রা এ বিদ্যুতকে সমস্যা উত্তরণের একমাত্র অবলম্বন হিসেবে জাহির করার চেষ্টা করেন। কিন্তু পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী এক একটি চুল্লি উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন হয় এবং প্রযুক্তিগতভাবেই তা বাহ্যিক পরিবর্তিত চাহিদার সাথে এর উৎপাদন পরিবর্তন করতে পারে না। আর বিশাল উৎপাদন ক্ষমতার এই সিস্টেমে সামান্য কোন ত্রুটি ধরা পড়লে বড় দূর্ঘটনার আশংকায় একই প্রযুক্তির সকল সিস্টেম বন্ধ করে দেয়া হয়। আর সেই সংকটকালীন সময়ে বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণে ‘ব্যাকআপ’ হিসেবে প্রায় সমান ক্ষমতার বিকল্প জ্বালানী ভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হয় এবং তা হরহামেশাই ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দেয়। আর তাইতো জাপানের পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত উপাত্ত হতে দেখা যায় যে পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের এরূপ অনিয়মিত উৎপাদনের ফলে ২০০৩ এবং ২০০৪ সালে গ্রীণ হাউজ গ্যাস নির্গমণ বৃদ্ধি পায় যথাক্রমে শতকরা ৪.৮ এবং ২.৮ ভাগ। তাই পরমাণু বিদ্যুৎ বৈশ্বিক উষ্ণতার অন্যতম সমাধান বলে যে প্রচারণা চালানো হয় তা আদৌ বাস্তব সম্মত নয়। আন্তর্জাতিক শক্তি সংস্থার হিসাব অনুযায়ী বর্তমান পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন যদি ২০৫০ সালের মধ্যে চারগুণ করে ফেলা হয় তবুও কার্বন নিঃসরণ কমবে মাত্র চার ভাগ।
‘কিয়োটো প্রটৌকলে’ ভবিষ্যৎ উন্নয়নে পরিবেশবান্ধব যেসব উপায়ের কথা ‘ক্লিন ডেভেলোপমেন্ট মেকানিজম’এ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে সেটির মধ্যেও পারমাণবিক বিদ্যুৎ নেই। সামগ্রিক বিবেচনায় তাই পরমাণু বিদ্যুতকে পরিবেশবান্ধব হিসেবে জাহির করার কোন সুযোগ নেই।
পারমাণবিক বিদ্যুৎ কি অনিঃশেষ শক্তির আধার?
সামান্য পরিমাণ ইউরেনিয়াম ব্যবহার করে প্রচুর শক্তি উৎপাদন করা যায় বিধায় অনেকে একে বলেন অনিঃশেষ শক্তির আধার। কিন্তু ইউরেনিয়ামের খনিতে মাত্র ০.১% ব্যবহার্য ইউরেনিয়াম পাওয়া যায়। আর বিদ্যুৎ উৎপাদনে যে বিশেষ ইউরেনিয়াম (ইউরেনিয়াম-২৩৫) ব্যবহার হয় তা পাওয়া যায় মাত্র ০.৭%। এই ইউরেনিয়াম আবার তৈরী হয় সুপারনোভায় তারার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। আমাদের সৌরজগত যেহেতু পরিবর্তিত তারকামন্ডলীর কোন অংশ হতে সৃষ্ট সেহেতু পৃথিবীতে পাওয়া ইউরেনিয়ামও এই প্রক্রিয়াতেই সৃষ্টি হয়েছে। তেল-গ্যাস-কয়লার লক্ষ কোটি বছরের আবর্তনে পুনরায় তৈরী হবার সম্ভাবনা থাকলেও পৃথিবীতে ইউরেনিয়ামের যোগান বৃদ্ধির কোনই সম্ভাবনা নেই। এটি যখন শেষ হবে তখন নিশ্চিতভাবে চিরদিনের জন্যই শেষ হবে। তাই পারমাণবিক শক্তি কোনভাবেই অনিঃশেষ নয়।
বাংলাদেশে কোন ইউরেনিয়ামের রিজার্ভ নেই। বলে রাখা ভাল যে পৃথিবীতে ইউরেনিয়ামের রিজার্ভ অস্ট্রেলিয়ায় সবচেয়ে বেশী। কিন্তু ঝুকি বিবেচনায় সেখানে একটিও পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে উঠেনি।
পারমাণবিক বিদ্যুৎ কি ঝুকিহীন?
পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্পে আধুনিক সকল প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে, কাজেই এতে আর কোন ঝুকি নেই- কথাটি আজকাল প্রায়ই শোনা যায়। কিন্তু প্রযুক্তির আধুনিকায়ন ঘটে অতীত অবস্থা বিবেচনায়, ভবিষ্যতের অজানা কোন শংকার ঝুকি নিরসন প্রযুক্তির আধুনিকায়নের মাধ্যমে করা যায় না। সুনামি হবার পূর্বে আমরা সুনামির ভয়াবহতা আচ করতে পারিনি। ফুকুশিমা ট্র্যাজেডির পূর্বে এত বিশাল পরিমাণ ধবংসযজ্ঞের কোন ধারণাই আমাদের ছিল না। তাইতো ১৯৮৬ সালে চেরনোবিল পারমাণবিক দূর্ঘটনার পর সকল পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র ভবিষ্যৎ যে কোন ধরণের ঝুকি মোকাবেলায় প্রস্তুত বলা হলেও ২০১১ তে এসে জাপানের মত প্রযুক্তিতে উৎকর্ষতা অর্জনকারী দেশে বিপর্যয়কারী ফুকুশিমা দূর্ঘটনা ঘটে।
কাজেই নিয়ত পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে ১০০% নিরাপদ এবং বিপদমুক্ত নিউক্লিয়ার রি-অ্যাক্টর বলে কোন কথা নেই। পারমাণবিক প্রযুক্তির মত এত জটিল একটা প্রক্রিয়ায় ‘১০০% নিরাপদ’ কথাটি বৈজ্ঞানিকভাবে অসত্য। সকল প্রযুক্তিই সীমীত ঝুকি বহন করে। আর সেটা যত জটিল, জ্বালানীকেন্দ্রিক আর উচ্চ তাপ ও চাপ নির্ভর হয় বিপদের ঝুকি ততই বাড়ে। যদি নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টগুলোকে আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায় ১০০% নিরাপদ করেই গড়ে তোলা যায় তবে কেন ভারতের তামিলনাড়ুর কুদাঙ্কুলাম নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টের নির্মাণ সহযোগী প্রতিষ্ঠান রাশিয়ার ‘অ্যাটমস্ট্রোক্সপোর্ট’কে যে কোন ধরণের ভবিষ্যৎ দূর্ঘটনায় দায়মুক্তি না দিয়ে চুক্তি করা হল। বলে রাখা ভাল যে, এই একই প্রতিষ্ঠানের সাথে বাংলাদেশ সরকার চুক্তিবদ্ধ।
বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত?
কোন বিষয়ে প্রস্তুতির প্রশ্ন তখনই আসে যখন পারিপার্শ্বিক অবস্থা অনুকূলে থাকে। আর সে হিসেবে বাংলাদেশ পরমাণু বিদ্যুতের জন্য প্রস্তুত নয়। মারাত্নক দূর্ঘটনা প্রবণ পরমাণু বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপনের উপযোগী জায়গা হচ্ছে আপাত জনমানবহীন দূরবর্তী অঞ্চল। কিন্তু দেড় লক্ষ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের বাংলাদেশে এমন জায়গা কোথায়? এদেশে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে গড়ে বাস করে প্রায় ১২০০ জন। যে কোন পারমাণবিক দূর্ঘটনার প্রথম ধাক্কাতেই কয়েক হাজার মানুষ মারা যাবার সম্ভাবনা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অমূলক নয়। ১৯৮৬ সালের চেরনোবিল দূর্ঘটনার সময় প্রতি বর্গ কিলোমিটারে স্থানীয় জনসংখ্যার ঘনত্ব ছিল মাত্র ৬৩ জন। দূর্ঘটনা পরবর্তী পরিস্থিতিতে প্রাইপাট নগরীকে ঘিরে আশেপাশের ৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত দূর্গত অঞ্চল ঘোষণা দিয়ে প্রায় আড়াই লক্ষ বাসিন্দাকে অন্যত্র স্থানান্তর করা হয়। সেই দূর্গত অঞ্চল আজও পরিত্যক্ত, জনমানবহীন। তেমন কোন দূর্ঘটনা যদি ঘটেই যায় তবে বাংলাদেশের পক্ষে কি সম্ভব হবে ইউক্রেনের মত ২ লক্ষ উদ্ধারকর্মী নিযুক্ত করা? বাংলাদেশের পক্ষে কি সম্ভব হবে দূর্ঘটনাস্থলের আশেপাশের ৩০ কিলোমিটার এলাকা দূর্গত ঘোষণা দিয়ে ৩০ লক্ষ মানুষকে স্থায়ীভাবে অন্যত্র পুনর্বাসন করা?
পারমাণবিক দূর্ঘটনার ভয়াবহতা শুধুমাত্র তাৎক্ষণিক মৃতদেহ গণনা করেই নিরূপন করা যায় না। কেননা এটি ছড়ায় বিকিরণের মাধ্যমে, এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে। আর তাইতো বারটেল এর গবেষণা অনুসারে চেরনোবিল দূর্ঘটনায় ভবিষ্যতের সাম্ভাব্য মৃত্যু হিসাবে আনলে বিকিরণের প্রভাবে মৃত্যু হবে ৯ থেকে ১৭ লক্ষ মানুষের।
যে কোন পারমাণবিক দূর্ঘটনায় বিকিরিত কণা পরিবেশ ও জীববৈচিত্রের জন্য মারাত্নক হুমকি। এরূপ দূর্ঘটনায় যে বিষাক্ত সিজিয়াম নির্গত হয় তা আশ্রয় পায় মাটিতে এবং মূলের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে ফসলে। এমনিভাবে এটি ঢুকে পড়ে আমাদের খাদ্য শৃঙ্খলে, বীজের মাধ্যমে ছড়াতে থাকে এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে। এমনি কোন অনভিপ্রেত পারমাণবিক দূর্ঘটনায় কৃষিপ্রধান বাংলাদেশ যে কতটা ভয়াবহ সংকটে পড়বে তা অকল্পনীয়। তাছাড়া বিকিরিত প্লুটোনিয়াম ছড়িয়ে পড়ে পানিতে। জলজ জীববৈচিত্রের উপর এর ধবংসযজ্ঞ চলতে থেকে ধীরে ধীরে কিন্তু নিশ্চিতভাবে। নদীমাতৃক বাংলাদেশের অনেক নদীই আমাদের অজ্ঞতায় বর্জ্যবাহী নালায় পরিণত হয়েছে। ভবিষ্যৎ বিকিরণের দূষণে যে সেটি বিষভান্ডার হয়ে উঠবে না তা কে বলতে পারে!
‘হেভী মেটাল’ শিল্পে বাংলাদেশ নিতান্তই শিশু। আধুনিক বিশ্বের তুলনায় যান্ত্রিক প্রকৌশলভিত্তিক এ শিল্প এদেশে কুটির শিল্পের পর্যায়েই পড়ে। কিন্তু তবু কেন জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পে বাংলাদেশ এত প্রসিদ্ধ? জাহাজ ভাঙ্গা দক্ষতায় কেন বাংলাদেশের এত কদর? কেন এ শিল্পে বাংলাদেশ অপ্রতিদ্বন্দী? কারণ এদেশে এটা শিল্প হলেও বহির্বিশ্বে এর পৃষ্ঠপোষকতা গুরুতর অপরাধ। আন্তর্জাতিক রুটের বাতিল হয়ে যাওয়া জাহাজগুলো টন টন আবর্জনা নিয়ে চলে আসে বাংলাদেশে। পরিবেশের জন্য মারাত্নক হুমকিস্বরূপ বিবেচিত হওয়া হাজার হাজার টনী জাহাজগুলোর বৃদ্ধ নিবাস হয় বাংলাদেশ। আর মুনাফালোভী অসাধু ব্যবসায়ী-রাজনীতিবিদদের যোগ সাজসে বাতিল জাহাজের ভাগাড় বাংলাদেশে পরিচিতি পায় শিল্প হিসেবে। ভাগাড় শিল্পের এরূপ আধুনিকতাই ‘আরোপিত আধুনিকতা’। প্রকৃত উন্নতী অর্জনে বিদেশী সাহায্যের অভাব হলেও ভাগাড় রক্ষায় সাহায্যের কমতি নেই। সত্যিই তো, এই ভাগাড় বন্ধ হয়ে গেলে উন্নত রাষ্ট্রগুলোর বাতিল জাহাজের কী হবে?
পারমাণবিক বিদ্যুতের আগামীর এ আধুনিকতাও কি কোন আরোপিত আধুনিকতা কিনা তা নিয়ে শংকা থেকেই যায়। পরমাণু বিদ্যুত প্রকল্পধারী সকল দেশ পারমাণবিক বর্জ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন। কয়েক শত বছর এই বর্জ্য সুরক্ষা প্রাচীরের ভেতর রাখতে হয়। এগুলোকে কোনভাবে মহাকাশে ফেলে আসা যায় কিনা তা নিয়ে বিজ্ঞানীদের ভেতর চলছে আলাপ-আলোচনা। আর ঠিক সেই মূহুর্তে রাশিয়া চলে এসেছে বাংলাদেশে ২ হাজার মেগাওয়াটের পরমাণু বিদ্যুৎ অবকাঠামো তৈরী করে দিতে। নানান দেন-দরবার, অনুনয়-বিনয় করেও যেখানে পদ্মা সেতু প্রকল্পের দুই বিলিয়ন ডলার জোগাড় হচ্ছে না সেখানে এই মেগা প্রজেক্টে নড়বড়ে অর্থনীতির রাশিয়া বলতে গেলে প্রায় যেচে পড়েই দিচ্ছে তিন বিলিয়ন ডলার।
রাশিয়াও কিন্তু তার পারমাণবিক বর্জ্য নিয়ে শঙ্কিত। অসংখ্য পারমাণবিক রি-অ্যাক্টরের পুরনো যন্ত্রাংশগুলো নিয়েও রাশিয়া চিন্তিত। রাশিয়া কি আরোপিত আধুনিকতার লেবাসে সাহায্য দেবার ছুতোয় কোন ডাম্পিং স্টেশন খুঁজছে? স্বপ্নিল আধুনিকতায় ইতোমধ্যেই গা ভাসিয়ে দেয়া বিজ্ঞজনেরা নিশ্চয়ই আমাকে বলবেন, দূর হ হতভাগা! কিন্তু বিষের বিজ্ঞাপনে কি কখনো ‘ভেজালমুক্ত’ কথাটি ব্যবহার করা যায়? নিশ্চয়ই না। ‘ভেজালমুক্ত’ বিষ সাথে সাথে মৃত্যু নিশ্চিত করলে ‘ভেজালযুক্ত’ বিষে হয়তোবা মৃত্যু আসবে ধীরে ধীরে। পরমাণু বিদ্যুতে ‘১০০ ভাগ নিরাপদ’ তকমাটি আসলে ‘১০০ ভাগ বিশুদ্ধ’ বিষ কথাটিরই নামান্তর। সেই বিষপেয়ালা চুমুকে আমাদের মৃত্যু কতটা ত্বরিত হবে- আমরা কি সেই আশায় থাকব?
লেখকঃ -দেওয়ান মওদুদুর রহমান
তথ্যসূত্রঃ
[1] Alexey Jablokov, “Chernobyl Deaths.”
[2] Dirk Bannink, “Nuclear Monitor,” November 2011, ISSN: 1570-4629.
[3] Frank Barnaby, Shaun Burnie, “Thinking the Unthinkable,” OXFORD · RESEARCH · GROUP and CITIZENS’ NUCLEAR INFORMATION CENTER, August, 2005.
[4] International Atomic Energy Agency, “Environmental Consequences of The Chernobyl Accident,” Vienna, 2006.
[5] Citizens’ Nuclear Information Centre, “Nuke Info,” March/April, 2008.
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১২ রাত ১:৫৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




