১.
মামুন ঢাকার একটি স্বনামধন্য স্কুলে ক্লাস সিক্সে পড়ে। তার স্কুলের যে অংক শিক্ষক তিনি সম্প্রতি চাকুরী ছেড়ে চলে যাওয়ায় তাদের স্কুলে একজন নতুন অংক শিক্ষক প্রয়োজন।
মামুনের স্কুলের প্রধান শিক্ষক আকবর চৌধুরী দারুনভাবে ডেমোক্রেসি বা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। গণতন্ত্রের আদর্শ যেন ছাত্রদের অল্প বয়সেই শেখানো যায় তার জন্য সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে ছাত্রদের ভোটের মাধ্যমেই তাদের অংক শিক্ষক নিবার্চন হবে। হাজার হলেও নির্বাচনের মাধ্যমে সব কিছু নির্ধারন করার যে পদ্ধতি গণতন্ত্রে রয়েছে নিশ্চই সেটাই সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ। এর থেকে উন্নত পদ্ধতি আর কিছু হতে পারে না এবং তিনি তার স্কুলের মাধ্যমেই একটা উদাহরন সৃষ্টি করতে চান।
২.
অংক শিক্ষক পদে নমিনেশন কেনার জন্য আকবর সাহেব তার স্কুলের দেওয়ালে নোটিশ টানিয়ে দিয়েছেন। ত্রিশ হাজার টাকা করে তিনি নমিনেশন ফর্ম বিক্রি করছেন। যেহেতু স্বনামধন্য স্কুল, তাই ফর্মের ডিমান্ড হাই। ইতিমধ্যেই নমিনেশন কিনেছেন ক্রিকেটার তামিম আহমদ, মডেল ও সিনেমা অভিনেত্রী শম্পা খালিফা, ব্যান্ডের সঙ্গীত শিল্পী শুভ্র নাথ দেব, ফুটবলার কায়সার হামিদ, একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অংকে মাস্টার্স ও মেধাবী শিক্ষক ফয়সাল ইসলাম, ম্যাজিশিয়ান ডায়মন্ড আইচ।
আকবর সাহেব ঠিক করেছেন অংশ শিক্ষক পদপ্রার্থী সবাইকে ক্লাসের সামনে আধা ঘন্টা করে পারফর্ম করতে দেবেন। তারপরে একটা ভোটাভুটি হবে এবং যার পক্ষে বেশি ভোট হবে তাকেই অংক শিক্ষক হিসেবে পদ দেওয়া হবে।
৩.
মামুনদের স্কুল ক্যাম্পাসে আজকে ভোট। চারিদিকে ব্যাপক উৎসব মুখর পরিবেশ।
ক্লাসে সবাই ভিষন উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষা করছে। একজন জোকার এসে সবাইকে আনন্দ দিয়ে গেলো প্রথমেই। এরপরে একে একে একেকজন প্রার্থি প্রবেশ করবে সবার উদ্দেশ্যে তাদের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করতে, তাকে কেন সবাই নির্বাচন করবে সে বিষয়ে বক্তব্য ও পার্ফমেন্স প্রদান করতে।
প্রথমে মঞ্চে আসলো সঙ্গীত শিল্পী শুভ্র দেব নাথ। সে এসেই ছোটদের উপযোগী দুটো গান গেয়ে সবাইকে মাত করে দিলো। তারপর তার ভলান্টিয়াররা লটারী করে ক্লাসের তিনজনকে তিনটা গিটার উপহার দিলো। তার প্রতিশ্রুতি, তাকে অংকের শিক্ষক করলে তিনি সবার জন্য গিটার সহজলভ্য করবে। ছাত্ররা তুমুল করতালিতে ফেটে পড়লো!
এরপরে আটোসাটো পোশাকে মঞ্চে হাজির মডেল ও সিনেমা অভিনেত্রী শম্পা খালিফা। শম্পা মুখ খোলার আগেই ছাত্ররা আবারও করতাালি, কেউ কেউ শিষও দিয়ে ফেললো। স্মার্ট মডেল শম্পা জানে কিভাবে কোথায় মনোযোগ টানতে হয়। সে তার মিউজিক শুরু করলো, পুর্ব থেকে রেকর্ড করা মিউজিকে লিপ সিংগিং এবং ব্যাপক অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে তার গান শেষ হলো। ওয়ান মোর, ওয়ান মোর — মঞ্চ থেকে রিকোয়েস্ট। হেড মাস্টার ইশারায় অনুমতি দিলে শম্পাকে আরেকটা পারফর্ম করতে হলো। সে মঞ্চ ছেড়ে যাওয়ার আগে গলায় প্রচন্ড আবেগ দিয়ে ছাত্রদের অনুরোধ করলো তাকে ভোট দিতে। সে অংকের শিক্ষক হলে প্রতি সেমিস্টারে অন্তত দুটো করে কনসার্ট হবে স্কুলে। তাকে যেন সবাই ভোট দেয়।
এরপর ক্রিকেটার তামিম আসলো মঞ্চে আলো ছড়াতে। সে জাতীয় দলের জার্সি পড়ে হাতে ব্যাট ও মাথায় হেলমেট পড়ে নাটকিয় ভাবে মঞ্চে আগমন করলো। সরাসরি প্রতিশ্রুতিতে চলে গেলো সে, তার একটাই কথা অংকের শিক্ষক যদি সে হতে পারে তা হলো স্কুলে একটা ক্রিকেট একাডেমি হবে যেখানে ব্রেট লি বোলিং শিখাতে আসবে, তেন্ডুলকার, শেওয়াগ আসবে গেস্ট ব্যটিং কোচ হিসেবে, সেরা প্রতিভাবান ক্রিকেটাররা এই স্কুলকে সারা পৃথিবীর কাছে মডেল হিসেবে তুলে ধরবে। ছাত্রদের মধ্যে ইউফোরিয়া। অন্যান্য শিক্ষকরাও ভিষন অনুপ্রাণিত। না! তামিমকেই তাদের দরকার।
এরপর মেধাবী শিক্ষক ফয়সাল এলো। সে কিভাবে অংক আনন্দের সাথে শেখা যায়, সে কিভাবে অংককে সহজ করে সবার সামনে তুলে ধরবে এগুলো নিয়ে বলতে গিয়ে ‘দুয়ো’ খেলো। ছাত্ররা এসব কথা শোনার আগ্রহে আর নেই। তারা পরবর্তি প্রার্থী ও যাদুকর ডায়মন্ড আইচের যাদু দেখতে চায়। মঞ্চ ত্যাগ করলেন সম্ভবত অংক শিক্ষক হওয়ার সবচেয়ে উপযোগী ব্যক্তিটি।
অত:পর যাদুকরের যাদু দেখানোর পালা। তার যাদুতে সবাই মুদ্ধ। যাওয়ার আগে সে প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেলো যদি নির্বাচিত হতে পারে তবে পৃথিবীর সেরা যাদুর ট্রিকসগুলো সে সবাইকে শেখাবে।
ভোটে যে কে জিতবে বলা যাচ্ছে না! সবার মধ্যে টান টান উত্তেজনা।
৪.
সবশেষে প্রধান শিক্ষক মঞ্চে আসলো এবং সবার মধ্যে প্রার্থি লিস্ট বিতরন করা হলো। সবাইকে একজন করে প্রার্থি নির্বাচন করতে বলা হলো। দুইদিন পরে ভোটের রেজাল্ট দেওয়া হবে বলে জানানো হলো।
দুইদিন পরে জানা গেলো স্বনামধন্য এই স্কুলের অংকের শিক্ষক হিসেবে ছাত্ররা তাদের গণতন্ত্রের চর্চার মাধ্যমে মডেল ও সিনেমা অভিনেত্রি শম্পা খালিফাকে নির্বাচিত করেছেন। মাত্র কয়েকটি ভোটের ব্যবধানে হেরে গেছে ক্রিকটোর তামিম। সবচেয়ে কম ভোট পেয়েছে মেধাবী শিক্ষক ফয়সাল।
সবাইকে ভোটের ফলাফল মেনে নেওয়ার আহবান জানিয়ে শম্পার হাতে নিয়োগ পত্র তুলে ধরলেন প্রধান শিক্ষক। স্কুলে আজ গণতন্ত্রের জয় হয়েছে।
৫.
বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের নামে নমিনেশণ পদ্ধতি থেকে শুরু করে এমপি নির্বাচন ও কেবিনেটে কারা মন্ত্রী হবে, সেই পদ্ধতিটাও অনেকটা উপরের গল্পের মতো।
একটা স্কুলে যখন অংকের শিক্ষক প্রয়োজন, তখন আসলে কি হয় বা হওয়া উচিত।
অংক যে শেখাতে পারবে তার কোয়ালিফিকেশন যাচাই করার জন্য কিছু মানুষের প্রয়োজন যাদের ঐ বিষয়টি পড়ানোর লোকটিকে যাচাই করার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা আছে।
এজন্য হয়তো অভিজ্ঞ শিক্ষকদের নিয়ে একটি কমিটি হয় এবং তারাই অংকের শিক্ষকের জন্য আবেদন করতে পারে যাদের ঐ বিষয়ে যোগ্যতা আছে, যাদের পাঠ দানের অভিজ্ঞতা ও মেধাভিত্তিক যোগ্যতা আছে। এছাড়া কেউ কি অংকের শিক্ষকের জন্য আবেদন করতে পারে নাকি পারা উচিত?
যারা ভোট দিবে বা নির্বাচন করবে (এই গল্পে ক্লাস সিক্সের ছাত্র) তারা যদি ঐ যোগ্য ব্যক্তির যোগ্যতা পরিমাপ করার যোগ্যতা না থাকে তাহলে সেই গোপন ভোটের কি আসলে কোন মূল্য আছে? এক্ষেত্রে ম্যানিপুলেশনের সম্ভাবনাই পুরোটা ।
এবার আশা যাক গোপন ভোটের বিষয়।
যদি যোগ্য লোকের একটি কমিটি থকে যারা ধরে নেওয়া যাক অভিজ্ঞ শিক্ষকদের সমন্ময়ে তৈরী। এরা যদি গোপনে ভোট দেয় এবং জানা না যায় কে কাকে ভোট দিলো, তাহলেও কিন্তু ম্যানিপুলেশন, বিহাইন্ড দা সিন ইনফ্লুয়েন্স বা প্রভাবের সম্ভাবনা থাকে। এই কমিটি ভোট দিবে ওপেন ভাবে, যেন তারা ডিফেন্ড করতে পারে কেন তারা অমুক ক্যান্ডিডেট বাদ দিয়ে তমুক ক্যান্ডিডেটকে ভোট দিয়েছেন। কেউ হয়তো ক্যান্ডিডেটের একাডেমিক কোয়ালিফিকেশনের কারনে তাকে যোগ্য মনে করে, কেউ হয়তো প্রেজেন্টেশন স্কিলকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে, কেউ হয়তো পূর্বে পড়ানোর যোগ্যতাকে। কিন্তু যেটাকেই তারা ফ্যাক্টর মনে করছে, জনগনের (ছাত্র ও ছাত্রদের অভিভাবকদের) সেটা জানার অধিকার আছে।
ওপেন ভোটিং হলে এই যে কমিটি সেটার জবাবদিহিতা পরিস্কার থাকবে। নইলে সিলেকশনের আগের রাতে কোন প্রার্থী তার টাকার গরমে যে কমিটিকে ইনফ্লুয়েন্স করবে না, তার কোন চেক এন্ড ব্যালেনস থাকবে না। ওপেন ভোটিংয়ের এটাই সুবিধা যে সবাই জানবে কে কাকে ভোট দিয়েছে এবং এই সিলেকশন হবে মেধার ভিত্তিতে।
৬.
বর্তমান প্রচলিত গণতন্ত্রের মডেলে ঐ স্কুলের ছাত্রদের মতো যখন অবুঝ জনগন না বুঝে, ক্যান্ডিডেটের যোগ্যতার বাছবিছার করতে যারা অপারগ, আর তারচেয়েও বড় সমস্যা এই নমিনেশন যারা নিচ্ছে তারা আসলে কোন ধরনের মেরিট বা যোগ্যতার মাপকাঠি পার হয়েই আসছে না। একজন চোর ব্যবসায়ী, টাকাওয়ালা সন্ত্রাসী, দেহব্যবসা আর ইয়াবা কিং যেকেউ নমিনেশন নিচ্ছে, টাকার গরমে প্রচারণা করে মাঠ গরম করে রাখছে এবং যারা ভোট দেবে সেই পুরো সিস্টেমকে রিগিং করা কোন বিষয় না।
এই গণতন্ত্র আসলে আপাদমস্তক ভুলে ভরা এবং জনগনকে একটা ইলিউশন অফ চয়েস ছাড়া আর কিছুই দেয় না। যারা এই পদ্ধতির ধ্বংজ্জাধারী তারা বাকিদের বুঝতেও দেয়না যে সিস্টেমটা কতটা অলীক!
৭.
জানতে চাইতে পারেন তাহলে বিকল্প কি?
ঐ স্কুলের উপমা গল্পে ফিরে যান। ওখানেই হিন্টস আছে।
স্কুলের বাচ্চারা ঠিক যেভাবে মোটেও রাইট ফিট না তাদের অংক শিক্ষক নির্বাচনের জন্য। ইনফ্যাক্ট তাদের নির্বাচন করতে দিলে তারা অবশ্যই ভুল সিদ্ধান্ত নিবে। তাদের কাছে একজন ক্রিকেটার বা এন্টারটেইনারের আবেদন বেশি হবে।
আজকের দিনের নির্বাচনের ট্রেন্ডেও দেখবেন মুখে রঙ মাখা অভিনেতা অভিনেত্রি এবং টাকার বিনিময়ে লোককে আনন্দ বিনোদন দেওয়া নাচ, গান, পেশাজীবি খেলোয়ার — এরাই ভোটে দাড়াবে আরো বেশি করে।
অথচ একটা স্কুলে একজন প্রধান শিক্ষক বা কোন বিষয়ে নিয়োগ দিতে হলে একটা বুদ্ধিসম্পন্ন গ্রুপ অফ পিপল লাগে যারা সঠিক লোকদের মধ্যে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে একজনকে সিলেকশন করবে।
দেশের অর্থনীতি তুলে দিবেন যার হাতে, তার ইকোনমিক্সের পোর্টফোলিও কি? দেশের শিক্ষানীতি যে দেখভাল করতে বা পরিকল্পনা মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব পাবে এবং দেশের পুরো ভবিষ্যত প্রজন্মের উন্নয়ন যাদের হাতে, তাদের যোগ্যতা মাপবনে কি কে কত লোক হাসাইছে, কার চেহারা কত সুন্দর বা ক্যামেরার সামনে কে কত ইমোশনাল পোজ দিছে তার উপরে।
বর্তমানের গণতন্ত্র আসলে ইলিউশন অফ চয়েস ছাড়া কিছু না, সঠিক মেধার লোকের কমিটির মাধ্যমে সিলেকশনই হওয়া উচিত সঠিক পদ্ধতি। নাইলে শুধু মার্কা চেইঞ্চ হবে, লুটপাট ও আখের গুছানো কিন্তু অব্যহতই থাকবে। জনগন বা ঐ ক্লাসের ছাত্ররা যতই তৃপ্তির ঢেকুর তুলুক না কেন।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে নভেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৩:৩২