somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইন্ডিয়া ট্যুর ৩: যেদিন আগে রেডি হইলাম, সেই দিনই ধরা!

২০ শে আগস্ট, ২০০৮ রাত ১২:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ইন্ডিয়া ট্যুর ২ : রমণীগণ.. ইন্ডিয়া ট্যুর - ১ : ভিনদেশে হিজড়ার খপ্পরে
পুরো ইন্ডিয়া ট্যুরে আমি ছিলাম লেটেস্ট। উহু, আধুনিকতায় না, বিলম্বের চোখ ধাঁধানো দৃষ্টান্ত স্থাপনে। অর্থাৎ কিনা লেট- এ আসার টেস্ট- এ ফার্স্ট ছিলাম। সবার খাওয়া-দাওয়া প্রায় শেষ, থালা-বাটি গুছানো শুরু হবে, এমন সময় রুম থেকে ছুটতে ছুটতে আমি বের হয়ে কেবল খেতে আসব, এটাই ছিল নিত্য দৃশ্য। গাড়ি ছাড়বে ছাড়বে, এই সময় কাঁধে সবুজের আভা মাখা পুরনো ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে ছুটতে ছুটতে হোটেল গেট দিয়ে বের হব, এটাই যেন ছিল স্বাভাবিক। আমাদের ব্যাচে একটা ছেলে ছিল (ধরি তার নাম নাসিম), ক্লাসে তার বিলম্বিত উপস্থিতি কালজয়ী ‘মিথ’-এ পরিণত হয়। স্যার আসারও ১৫-২০ মিনিট পর নির্বিকার মুখে সে ক্লাসরুমে প্রবেশ করবে। এবং পুরো কলেজ লাইফে তার চেয়ে পরে ক্লাসে ঢুকতে পেরেছে কেউ, এমন রেকর্ড বিরল-প্রায়। কোনদিন হয়তো টিচার আসতে দেরী করছেন, ১২-১৫ মিনিট পেরিয়ে গেছে, এমন সময় নাসিম রুমে ঢুকলো। অমনি আমরা সবাই দাঁড়িয়ে গেলাম - আজকে আর ক্লাস হবে না। কারণ, নাসিমের পরে ক্লাসে কেউ ঢুকবে,এটা হতেই পারে না; প্রকৃতির সে-ই চিরন্তন নিয়মে স্যারেরও আজ আসার সম্ভাবনা সুদূর-পরাহত। এমনই নিশ্চিত ভবিষ্যতের ইঙ্গিতবাহী ছিল সে। ওর সে-ই বিরলপ্রজ অবস্থানের ধারে-কাছে যেতে না পারলেও ইন্ডিয়া ট্যুরে ওরই এক ছোট সংস্করণ হিসেবে (কু)খ্যাতি পেয়ে যাই আমি।
প্রথম প্রথম বন্ধুরা বিরক্ত হতো। বাসে ওঠার সময় তাদের সম্মিলিত বাক্যবাণের আক্রমণ সামলে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থেকেই নিজেকে বিশাল বীর যোদ্ধা বলে মনে হতো। আগের রাতে কি কাজ করলে আমার এত দেরী হওয়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে, এই নিয়ে সোল্লাসে ও জনসম্মুখে তাদের উর্বর-মস্তিষ্কের গবেষণালব্ধ তথ্য জাহির করতো। আমি নির্বিকার মুখে ও বিনা প্রতিবাদে তাদের ব্যাখ্যা শুনে যেতাম। তবে, পরবর্তীতে তারা ব্যাপারটা উদার ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতেই গ্রহণ করে। শুধু তা-ই নয়, তারা আমার প্রতি বিশেষ সহানুভূতিপ্রবণও হয়ে ওঠে। কারণ, ততদিনে এই বিলম্বের নেপথ্যের হৃদয়-বিদারক সত্যটুকু তাদের সামনে উন্মোচিত হয়।
হোটেলে একেক রুমে তিনজন করে থাকা হবে এটা পূর্ব নির্ধারিতই ছিল। (অবশ্যই ছেলে-মেয়ে আলাদা থাকবে, জুটিরাও)। কিন্তু শুধু দুটো রুমে চারজন করে। একটা রুমে চারটা ছেলে, আরেকটা রুমে চারটা মেয়ে। হিসাবটা বুঝিয়ে দিচ্ছি। ট্যুরে মেয়ে ছিল ৩৪ জন, ছেলে ৪০ জন। ৩ টা মেয়ে এক রুমে থাকলে ১১ টা রুমে ৩ গুণন ১১ = ৩৩ জন, একজন বাড়তি। সুতরাং, একটা রুমে চারজন থাকতে হবে। ছেলেদের ক্ষেত্রেও ১৩ টা রুমে ৩ গুন ১৩ = ৩৯। আমি সেই অভাগা অতিরিক্ত এক। সুতরাং ঐ একটি মাত্র রুমের চার ছেলের একজন আমি।
সমস্যাটা এই সংখ্যা-তত্ত্বে না, অন্য জায়গায়। আমার রুমমেট তিনজন ছিল সে আমলের (মানে আমাদের ব্যাচের ) সুদর্শন ব্যক্তিদের অন্যতম। মোটেও বাড়িয়ে বলছি না, আমাদের ব্যাচে একদা হয়ে যাওয়া সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় পাবলিক ভোটিংয়ে দ্বিতীয় ও তৃতীয় নির্বাচিত হওয়া দুজন ছিল আমার রুমমেট (প্রথম হওয়া সহপাঠীটি ট্যুরেই যায়নি)। এবং তারা নিজেদের সৌন্দর্য সম্পর্কে ছিল পূর্ণ মাত্রায় সচেতন। এই সচেতনতার প্রকাশ ঘটতো তাদের ত্বকের ঔজ্জ্বল্য রক্ষা ও সাজ-সজ্জা কর্মসূচিতে। এই কর্মসূচিতে কে কত দীর্ঘ সময় নিতে পারে তার-ই এক অলিখিত প্রতিযোগিতা ছিল তিনজনের মধ্যে। ফলে, তাদের তিনজনের যাবতীয় কর্ম শেষে আমি যখন গোসলখানায় প্রবেশের সুযোগ পেতাম, তখন সময় পেরিয়ে গেছে অনেকখানি। শক্তিসামর্থে তাদের তুলনায় পিছিয়ে থাকায় তিনজনের মাঝখানে আমি সিরিয়াল পেতাম না। প্রকৃতি ডাক দিলেও সাড়া না দিয়ে চোখ-মুখ বুজে থাকতে হতো। ঐ দীর্ঘ সময় যে আরামে নিদ্রা দিব, তারও উপায় নাই। বাকী দুজন রুমটা এমনই সরগরম করে রাখে, কোন মৃতদেহও ঐ রুমে রাখা হলে সে উঠে বলবে, বাবা আমারে অন্য রুমে রাইখা আসো, মৃত্যুর পরে অন্তত একটু শান্তি লাভ করি।
যা-ই হোক, এবংবিধ কারণে, সবার আগে নাহোক, দুর্নাম ঘুচাতে অন্তত ৫-৬ জনের আগে গাড়ির কাছে পৌঁছার আশাও আমার অপূর্ণ থেকে যায়।
কিন্তু বিস্ময়করভাবে, সে সুযোগটা আসে দিল্লীতে। দিল্লীর হোটেল তাজ-এ উঠি আমরা। কি কারণে যেন আমরা চারজনেই সকালে যাত্রার সময়টা ভুল শুনি। এবং ভুল শোনার ফলাফল হচ্ছে, আমি পর্যন্ত যখন রেডি হয়ে খাওয়ার টেবিলে যাই, তখন পর্যন্ত মাত্র দশ জন খেতে এসেছে। আমি যখন খাওয়া শেষ করি, তখন অর্ধেক লোকজনও খাওয়ার টেবিল পর্যন্তই পৌঁছায় নি। সময় যখন আছে, তখন বিছানায় গা এলিয়ে দেয়া যাক - ভেবে আমি, নাদিম আর আকাশ চলে এলাম রুমে। সজীব এলো না। আমার তিনজন একা (আলাদা আলাদাভাবে) হলে সজীব আবার দোকা। ব্যাচের নিশুর সাথে তার ঘোষিত বন্ধন। তা-ই সে রুমে না এসে নিশুর সাথে গল্পে মশুগুল হয়ে গেল। আমরা তিনজন রুমে ফিরে টিভি ছেড়ে দিলাম। নাদিম আর আকাশ ওর মধ্যেই ঘুমিয়েও গেল।
আমি বেকুব টিভিই দেখতে থাকলাম। ঘড়ির দিকে কেন তাকালাম না কে জানে? হঠাৎ আকাশ ঘুম ভেঙ্গে উঠে জিজ্ঞেস করলো, ‘কি হইলো? এখনও রওয়ানা দেয় নাই।’ আমি বললাম, ‘নাহ কেউ তো ডাকতে আসে নাই।’ ডাকতে যে কেউ আসবে সে সম্পর্কে আমি নিশ্চিতই ছিলাম। সজীব তো ডাক দেবে! সজীব না ডাক দিক, সারা ইন্ডিয়া ট্যুর যার ব্যাগ বইতে হলো আমাকে, সে মেয়েটা তো আমার কথা ভুলে যাবে না! কিন্তু হা হতোম্মি! আমি নগণ্য মানবমাত্র, রমণীকূলকে চিনতে পারি - সে সাধ্য কি আছে আমার? দেবতাকূলই যখন চিনতে পারেনি তাদের।
নাদিমের ঘুম ভাঙিয়ে আকাশ গেল খোঁজ নিতে। সবাই চলে গেছে। দুই বাসে করে ৭১ টা ছেলে মেয়ে, ট্যুর গাইড এবং আমাদের সঙ্গে থাকা একমাত্র শিক্ষক আমাদের বেমালুম ভুলে গিয়ে দিল্লীর দর্শনীয় স্থান দর্শন করতে বেরিয়ে গেছে। আমরা তিনজন হতভম্ব হয়ে বসে রইলাম রুমের ভেতর। ব্যাপারটা আমাদের তিনজনের কাছেই পুরোপুরি অবিশ্বাস্য মনে হতে থাকলো। আমাদের তিনজনকে ফেলে সবাই ঘুরতে বেরিয়ে যাবে, তা কিভাবে হয়? কারো কি একবারের জন্যও মনে পড়বে না আমাদের কথা? আমার তিনজন তো এক বাসে, ঐ বাসে তিনজন আসেনি, কেউ লক্ষ্য করবে না? আমার কথা না হয় বাদ-ই দিলাম, ব্যাচের বাকী দুই ‘হার্টথ্রব’কে ভুলে যাবে ওরা। এমন তো না যে, ওদের উপস্থিতি আর অনুপস্থিতি সমান কথা। যেখানে থাকে চুপটি মেরে রামগরুড়ের ছানা হয়ে তো বসে থাকে না ওরা, চারদিক তো মাতিয়েই রাখে। তাহলে?

আমরা গভীর দুঃখে নিপতিত হলাম। এই বিশাল ব্রক্ষান্ডের মাঝে নিজেদের অতি ক্ষুদ্র ,তুচ্ছ, দীন-হীন মনে হতে লাগলো।
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×