মানুষের অন্তস্থলে বিভিন্নভাবে চিত্তকম্পন হতে পারে। নিজের ভেতরে প্রথম এই কম্পন অনুভব করেছিলাম ২০০৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে। সেটা ছিল ময়মনসিংহের একটা গণ আত্মহত্যার ঘঠনা। একই পরিবারের নয়জন মানুষ পায়ে পা মিলিয়ে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়ে হাটতে শুরু করেছে রেললাইনের দিকে। একই পরিবারের এই সদস্যরা চলন্ত ট্রেনের নীচে ঝাপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে। এই সংবাদটা বিহ্বল করেছিল আমাকে। শরীরের সমস্ত যন্ত্রপাতি কেঁপে উঠেছিল, অসার মনে হয়েছিল মানবজীবনকে। কী এমন অব্যক্ত শক্তিমান বেদনা তারা লালন করেছিল। পুরা পরিবার! দিনের পর দিন একটি পরিবারের সব মানুষ আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্তের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। যে সমস্যা নিয়ে তারা আতংকিত,অপমানিত, জীবনের সমস্ত চাহিদা বিসর্জন দিয়ে যার সমাধান করতে হয়। তা নিশ্চয়ই একদিনে হয়নি। তারা দিনের পর দিন সমস্যাটার মুখোমুখি হয়েছে। সমাধানের চেষ্টা করেছে। মানষিকভাবে বিভ্রান্ত হয়েছে। নিকটজনদের কাছে সমাধান চেয়েছে। এলাকাবাসির কাছে সমাধান চেয়েছে। রাষ্ট্রের কাছে সমাধান চেয়েছে। অবশেষে সব জায়গায় ব্যর্থ হবার পর তারা বুঝেছে তাদের জীবনই পারে এই সমস্যার সমাধান করতে। তাই বলে একই পরিবারের নয়জন মানুষ! বড় বেদনাদায়ক এই ঘঠনা। দূর্ভাগ্যবশত খুব বেশি কিছু জানতে পারিনি এই ঘঠনার। সংবাদ মাধ্যমগুলোর খুব বেশি আগ্রহ নাই এসব ব্যাপারে। দয়া করে একদিন যে এই ঘঠনা ছেপেছিল তাতেই আমাদের ধন্য হয়ে যাওয়া উচিত ছিল। আত্মহত্যা অথবা হত্যাকা- এখন আমাদের দেশে ডালভাতের মত সহজ। চারিদিকে এত অপমৃত্যু জীবনের এত অপচয়, আত্মহত্যা, হত্যা, অগ্নিদাহ, ভবন হেলে পড়ে মৃত্যু যেন দেশে এখন মৃত্যুর উৎসব চলছে।
সারাজীবন আত্মহননকারী কবি সাহিত্যিকদের শ্রদ্ধা করে এসেছি। কেননা আত্মহত্যা করতে যে মানষিক শক্তির দরকার তা গণমানুষের থাকে না। একজন মানুষ তার সমস্ত শক্তিকে স্বনিয়ন্ত্রনে এনে চুড়ান্তভাবে ব্যবহার করে। তাকে সহযোগীতা করে তার সততা, আবেগ আর অবিচলতা। সক্রাতেস, এসেনিন, মায়াকোভস্কি, সিলভিয়া প্লাথ, হেমিংওয়ে অনেকের নাম করা যায় যারা আত্মহত্যাকে গ্রহণ করেছিলেন।
কিছুদিন আগে বাংলাদেশের প্রায় সব পত্রিকায় একটা খবর ছাপা হয় মা ও দুইসন্তান একত্রে আত্মহত্যা করেছে। আত্মহত্যার আগে দুই সন্তান আর মা মিলে ঘরের দেয়ালে দেয়ালে লিখে গেছে তাদের অভিযোগ। সকালে তাদের একত্রে একই বিছানায় মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। তাদের এই অন্তিম শয়নের ছবি প্রায় সব পত্রিকাতেই ছাপা হয়। খবরটি পড়ে আমার ভেতর দ্বীতিয়বার চিত্তকম্পন অনুভুত হয়। জীবন যাপন রাষ্ট্র সমাজ মানুষ সবকিছু অর্থহীন, অমানবিক মনে হতে থাকে। বেঁচে থাকাটা অসার মনে হয়। নিজেকে মনে হয় পৃথিবীর চাইতে ভারি।
মৃতরা হলেন ইত্তেফাকের বিশেষ সংবাদদাতা জনাব শফিকুল কবিরের পুত্র জনাব রাশেদুল কবিরের স্ত্রী ফারজানা কবির রীতা (৩৭) ও তার দুই শিশুসন্তান পাবন(১৩) ও রাইসা রাশমীন পায়েল (১০)।
রীতা আর তার দুই ছেলেমেয়ে পাবনও পায়েল মিলে দেয়ালে দেয়ালে যা লিখেছে পত্রিকা মারফত যা জানা গেছে তা হল।
*‘আব্বু তুমি বলছিলা যে, ৫০ বছরেও তুমি স্মৃতিকে বিয়ে করবে। মাকে তুমি এটাও বলছিলা যে পাবন ও পায়েল তোমার পেটে আসছে বলে ঘৃণা হয়। আসলেই ঘৃণা লাগে যে তোমার মত বাবা আমরা পাইছি। আর তুমি তো তোমার কমিটমেন্ট রাখছো। তুমি ৪৪ বছরেই স্মৃতিকে বিয়ে করে দেখাইছো। ... *তোমার জন্য একটা মেয়ে এত ইমপরটেন্ট যে তুমি তোমার ছেলেমেয়ের দিকে একবার তাকাইয়া দেখ নাই। তোমরা সবাই স্বার্থপর যে তিন জীবন নষ্ট করে ফেলছো।’
*আব্বু তোমার বাবা তোমার অপরাধ থেকে বাঁচানোর জন্য যা করছে তাতে আমরা মরে যাচ্ছি। কারণ ৬মে তোমরা সবাই মিলে যা করছ... আমি তোমাকে ঘৃণা করি।
*আমাদের জীবনের কিছু মানুষ আছে যারা আমাদের জীবন নষ্ট করেছে, তারা হচ্ছে শফিকুল কবির (দাদা),রাশেদুল কবির(বাবা),সুখন কবির (ফুফু), নুর বানু কবির (দাদি)। লেখার নীচে পায়েলের নাম।
আমি হয়তো বলতাম যদি আমার চেহারা ও রক্ত বলতে পারতাম। মানুষ যেমন বলে রক্ত কথা বলে, তাইতো আমি তোমাদের মত কারো সাথে বেঈমানি বা মিথ্যা বলতে চাইনি। মরতে মরতে একটা আফসোস হচ্ছে যে আমি তোমাদের বংশে জন্মেছি। আর তোদের রক্ত নিয়ে মরতেছি।
*সুখন কবির তোর আর তোর মেয়ের মেঘনার বাড়ী দরকার তো? বাচিয়ে দিয়ে গেলাম। আমাদের দুই ভাইবোনের রক্ত খাইয়ে বড় করে দেখ শান্তি নাকি। তুই বলেছিস না তুই মরলে তোর মেয়ে আমাদের খাওন শেখাবে। তোর বাড়ী দরকার তোকে বাড়ী দিয়ে গেলাম।
*এই দাদু তুমি না সাংবাদিক। নেও তোমার বাসায় পত্রিকা ছাপাই দিয়ে গেলাম।... তুমি কেন ভাল শ্বশুর হতে পারলা না। তুমি কেন ভাল দাদা হতে পারলা না। ১৮ বছর আগের কথা নিয়ে তোমরা কেন কথা বলছ। বর্তমান আমার বাপ যা বলছে তা নিয়ে কেন কথা বলস নাই। আমার ভাবতেই খারাপ লাগে। তোকে খুন করতে ইচ্ছে করে।
*মাথা নীচু করে বাঁচার চেয়ে মরে যাওয়া ভাল।
এই লেখাগুলো যদি সত্যি সত্যি আত্মহত্যাকারিদের হয়ে থাকে। তাহলে এই সামান্য লেখাগুলো থেকেই বুঝা যায় আত্মহত্যার কারণ। সম্প্রতি সব ভিকটিমকেই পুলিশ গ্রেফতার করেছে। ড্রাইভারকে গ্রেফতার করেছে। ড্রাইভারের কথাবার্তা অসংলগ্ন। তবে সাংবাদিক শফিকুল কবির নিজের মুখে স্বীকার করেছে যে তিনি তাদের বাসা ছাড়তে বলেছেন। কিন্তু কেন? কেন তারা বাসা ছাড়বে? রীতা না হোক তার সন্তানাদি কি জনাব শফিকুল সাহেবের বংশধর নয়? তার একমাত্র ছেলের লাম্পট্যের দায় কেন বহন করতে হবে দুটি শিশুকে? এটা স্পষ্ট যে তার মেয়ে সুখন কবির ও ছেলের নতুন বউ স্মৃতিকে দেয়ার জন্যই রীতাকে সন্তানাদি সহ বাড়ী ছাড়ার তাগাদা দেন তিনি। হায় স্বার্থের সাথে বিবেকের এত দূরত্ব!
পাপি পথভ্রষ্ট লম্পট লোলুপ রাশিদুল কবির স্বীকার করেছে সে রীতার ওপর নির্যাতন করেছে। শারিরিক ও মানষিক উভয়ভাবেই। স্মৃতিও তার লালসার শিকার। এই বদমাশ রাশিদুল একটা দানব। রীতা যে কারো কাছে আশ্রয় বা শালিস বিচার চায়নি তাতো না। কিন্তু বাংলাদেশের মত দূর্ণীতি পরায়ণ একটা দেশে শালিস বিচার সবইতো টাকাওয়ালা পুরুষতন্ত্রের। স্বার্থপর সামন্ত শফিকুল আর তার লম্পট সন্তান রাশিদুলের পক্ষ হয়ে শালিসবিচার ওল্টা রীতার কাছ থেকে স্ট্যাম্প নেয়। কি ছিল সেই স্ট্যাম্পে? বাড়ী ছাড়ার স্বীকারোক্তি? তার ব্যাপারে কোন অভিযোগ না করবার বা কোন টাকা পয়সা দাবি না করবার মুচলেকা? ব্যাংকে রীতার সন্তানদের জন্য রাখা বিশ লক্ষ টাকা ও দেড়শ ভরি স্বর্ণের হস্তান্তর করার দাবি?
পত্রপত্রিকাগুলো যে ভাবে স্মৃতি নাম্নি মেয়েটার পেছনে লেগেছে তা মনে হয় তারা স্মৃতিকে দিয়ে এই হত্যাকা- ঘটিয়েই ছাড়বে। মূলত স্মৃতিও একটা শিকার বৈ তো নয়।
রীতা না হয় কোনো উপায় না দেখে আত্মহত্যা করল কিন্তু শিশুদুটি যারা আত্মহত্যা কি বুঝে কিনা সন্দেহ। তারা কিভাবে কি বুঝে আত্মহত্যা করবে? এই কারণেই ধুয়াশাটা বাড়ে বৈ কমে না। হত্যাকা- হলে দোষিরা সাজা পাবে। ভিসেরা রিপোর্টসহ সঠিক তথ্যউপাত্তের ভিত্তিতে তা হবে। কিন্তু যদি আত্মহত্যা হয় তাহলে শুধু শফিকুলের পরিবার এজন্য দায়ি নয়। পুরা ঘুমন্ত জাতি দূর্ণীতি পরায়ণ ক্ষমতাবানরা জনগণের দায়িত্ব নিয়ে তা ডিমেতালে পালনকারি সরকার এমনকি পুরা রাষ্ট্রই দায়ি এই গণ আত্মহত্যার। এদের সবাইকে এ দায় বহন করতে হবে।