somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পরিযায়ী পাখী

১২ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ বিকাল ৪:৫৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমি এ ঘাসের বুকে শুয়ে থাকি-শালিক নিয়েছে নিঙরায়ে
নরম হলুদ পায়ে এই ঘাস; এ সবুজ ঘাসের উপর
সোঁদা ধুলো শুয়ে আছে-কাঁচের মতন সাদা ঘাসের গায়ে
ভেরেন্ডা ফুলের নীল ভোমরেরা ঝুলিতেছে-সাদ স্তন ঝরে
করবীর; কোনো এক কিশোরী এসে ছিঁড়ে নিয়ে চলে গেছে ফুল,
তাই দুধ ঝরিতেছে করবীর ঘাসে ঘাসে; নরম ব্যাকুল।

স্কুলের বয়সে বইয়ের পাতায় জীবনানন্দের কোনো কবিতা পড়লেই মনে হতো কতো আপন কতো পরিচিত এর প্রতিটি পংক্তিমালা। এই যে হিজল, তমাল, ঘাসফুল, নদী, ধূসর গোধূলী কিংবা নীল নীল রৌদ্দুরকে নিয়ে কথামালা এসব যেন শুধু আমাকে উদ্দেশ্য করেই লেখা। আমার হাত, পা, চোখ, মন, ভাবনা সবকিছুই যেন জড়িয়ে আছে তার প্রতিটি শব্দচয়নে। পড়তে পড়তে মনে হতো নিজেরই গভীরে লুকিয়ে থাকা অব্যক্ত অনুভূতিগুলি কেমন করে জানি উৎসরিত হয়ে আসছে প্রবল, মোহময়, শ্রান্ত এক আবেগে জীবনানন্দের আঙুল ছুঁযে ছুঁযে।

আমার শৈশবের উদ্দাম-উচ্ছল অনেকটা সময় কেটেছে গ্রামের পরিবেশে-আমার মামাবাড়ীতে। প্রায় প্রতি বছরই স্কুলছুটির দিনগুলো একটানা কাটিয়েছি সেখানে। শান্ত, স্নিগ্ধ, নিতান্তই আটপৌরে এক পল্লী পরিবেশে। আপন খুশীতে, স্বাধীন পায়ে আমি ঘুরে ঘুরে বেড়িয়েছি প্রকৃতির কোমল ভাঁজে ভাঁজে। কখনো দল বেঁধে, কখনো দলছুট দস্যি হয়ে। মামার সাইকেল চুরি করে পালিয়ে গেছি ভিন গাঁয়ে-যেখানে দুপুর বেলা বাঁশবাগানের অন্ধকারে বাতাসের এক অদ্ভুত শিরশির খেলা করে, খালের জলে ঝরা ডালপালা আর সুপুরিগাছের আধপঁচা খোলের আবডালে লুকিয়ে থাকে কই আর শিং মাছ। নদীর তীর ধরে পালতোলা পানসী কিংবা নাইওরী নৌকার সাথে চলে গেছি মাইলের পর মাইল। কোনোদিন কাঠফাটা রোদে মেঠোপথের ধার ধরে ছুটে ছুটে খেলা করেছি 'লজ্জাবতী'দের সাথে। ন্য়তো শর্ষেক্ষেতের আল ধরে অবিরাম ছুটেছি বাঘা ফড়িঙের পেছন পেছন। ধানক্ষেতে শালিকের ঝাঁক জড়ো হলে প্রশ্রয় দিয়েছি প্রাণখুলে। ইচ্ছে করে সবার চোখ এড়িয়ে ঢিল ছুড়ে মাথা ভেঙে দিয়েছি বেহায়া কাকতাড়ুয়ার। আরও সাংঘাতিক কান্ড করেছি যেদিন বাঁশী-হাতে রাখাল দেখে পড়ন্তবেলা তার সাথে চলে গিয়েছিলাম অনেক দূর অজানা কোনো এক প্রান্তরে - কখন সে বাঁশীতে ঠোঁট ছোঁয়াবে সেই আশায়। কি অসম্ভব উদ্দামতা ছিল সেই দিনগুলোর। কত অনায়াসে, অবলীলায় প্রতিদিন মিশে গেছি প্রকৃতির পরতে পরতে। এসবই জায়গা করে আছে আমার বড় হয়ে উঠার দিনগুলোয়।

জীবনানন্দের অনেকগুলো কবিতা আছে যেগুলো পড়লেই তাই কেবল মনে হতো এগুলো আমারই কবিতা। কোনো এক ঐশ্বরিক শক্তি কোথা হতে এসে যেন লিখে দিয়ে গেছে আমারই অজান্তে, আমার শৈশব-কৈশোরকে আলগোছে নাড়া দিয়ে। বড় নিস্তব্ধ আপন, বড় নিবিড় মনে হতো কবিতার সব কথাগুলি। তারপরও কেন জানি পড়তে পড়তে কোনো একদিন হঠাৎ মনে প্রশ্ন জাগতো- এ কি এক মোহের মায়াজাল নয়? যদি কোনোদিন এইখান থেকে দূরে চলে যাই-ব্রহ্মচারী হয়ে কিংবা নেহায়েৎ বেঁচে থাকার তাগিদে- তাহলে কি এই স্মৃতি, এই কবিতা একদিন ফিকে হয়ে আসবেনা? আমার স্নায়ুমূলে লেগে থাকা প্রকৃতির অন্তরঙ্গ আলিঙ্গনের সব নির্যাস কি একদিন শুকিয়ে যাবেনা? কোনো উত্তরই ঠিকঠাক পাইনা। আমার কেবলই মনে হ্য় সময়ের চক্রান্তে নশ্বর মস্তিষ্ক আর তার বুদ্ধিরেণুগুলো একদিন ঠিকই প্রতারণা করবে। আমাকে আটকে রাখবে আমার অসহায়ত্বে, নয়তো অহংকারে। ধ্যানী বুদ্ধের মতো কাঙালপনায় তারপর কাটবে আমার বাকিটা জীবন।

বহুদিন পর আজ হঠাৎ করেই সুনীলের গল্পে জীবনানন্দের কয়েকছত্র কবিতা পড়ে মনটা অনেক খারাপ হয়ে গেলো। যা ভেবেছিলাম, যা মনে করে অনেক অনেক দিন লুকিয়ে লুকিয়ে কষ্ট পেতাম তাই যেনো হয়ে গেলো আমার জীবনে। কোথায় পড়ে রইলো আমার সেই দুপুর রোদের ফড়িঙের ঝাঁক, শিমুল ফুল, কাদামাটি, বেতঝাড়, ঘুঘুডাক, কালবোশেখী, বিন্নি ধানের ক্ষেত। কোথায়! কোথায়! আমি পড়ে আছি এক নর্দমায়। বিশাল নগরীর অতুল ঐশ্বর্য্য এখানে প্রতিদিন আমাকে তুলে নিয়ে আসে সভ্যতার উঁচুতলে। আমি পথ চলি নিরাপদে, বেঁচে থাকি স্বস্তিতে। তবু আমার দেহ ছোট হয়ে আসে। চোখে নোনা ধরে। আমার মন পরিযায়ী পাখীর বেশে বুদ্ধের দেশ খোঁজে।

১০ সেপ্টেম্বর ২০১৩
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে ডিসেম্বর, ২০১৩ বিকাল ৫:৩৬
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

সিকান্দার রাজার চেয়ে একজন পতিতাও ভালো।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৭

সিকান্দার রাজা কোকের বোতল সামনে থেকে সরিয়ে রাতারাতি হিরো বনে গেছেন! কিন্তু তাকে যারা হিরো বানিয়েছেন, তারা কেউ দেখছেন না তিনি কত বড় নেমকহারামি করেছেন। তারা নিজেদেরকে ধার্মিক বলে দাবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

...এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না

লিখেছেন নতুন নকিব, ০৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৫৬

...এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ অন্তর্জাল।

ছোটবেলায় মুরব্বিদের মুখে শোনা গুরুত্বপূর্ণ অনেক ছড়া কবিতার মত নিচের এই লাইন দুইটাকে আজও অনেক প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×