
চরিত্র- অনির্বাণ (৬৫) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, যিনি সমাজের পুরনো মূল্যবোধের পতনে গভীরভাবে হতাশ।
প্রত্যয়: (২৫) উচ্চশিক্ষিত তরুণ, যে বর্তমান সমাজের নৈরাজ্য দেখে অস্থির এবং ক্ষুব্ধ।
স্থান: একটি জীর্ণ পাবলিক পার্কের ভাঙা রেলিংয়ের পাশে। সামনেই একটি পুরাতন, শ্যাওলা-ধরা স্মৃতিস্তম্ভ। বিকেল গড়িয়ে আসছে।
(দৃশ্যের শুরু: অনির্বাণ ধীর গতিতে স্মৃতিস্তম্ভের দিকে তাকিয়ে আছেন। প্রত্যয় দ্রুত পায়ে হেঁটে এসে তার পাশে দাঁড়ায়।)
প্রত্যয়: স্যার, আপনি প্রতিদিন এখানে আসেন কেন? এই ভাঙা রেলিং, এই আবর্জনার স্তূপ... এটা কি আপনাকে শান্তি দেয়?
অনির্বাণ: (স্মৃতিস্তম্ভের দিকে তাকিয়ে) শান্তি? না, প্রত্যয়। আমি এখানে আসি ক্ষয় দেখতে। এই রেলিংয়ের মতো আমাদের সমাজও জীর্ণ। এর ইস্পাত পচে গেছে, পেরেকগুলোয় মরচে। ভাঙতে ভাঙতে এমন জায়গায় এসেছে যে এখন মেরামতের আর উপায় নেই।
প্রত্যয়: মেরামত নয়, স্যার। উপড়ে ফেলতে হবে। আর এই ক্ষয়ের জন্য আপনারা দায়ী। আপনারা, যারা নিজেদের আদর্শবাদী বলতেন, আপনারা চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়েছিলেন যখন মরচেটা ধরছিল।
অনির্বাণ: (ঘুরে প্রত্যয়ের দিকে তাকান, চোখে তীব্র বিষাদ) তোমার প্রজন্মের মতো আমরা রাতারাতি আকাশ ছুঁতে চাইনি, প্রত্যয়। আমরা ধীরগতিতে বিশ্বাসী ছিলাম। আমরা জানতাম, একটি দেয়াল তৈরি করতে একশ’ বছর লাগে, ভাঙতে লাগে মাত্র এক রাত। কিন্তু এই পচন রাতারাতি আসেনি। এটা আমাদের আত্মার ভেতর থেকে শুরু হয়েছিল।
প্রত্যয়: আত্মা? যখন শিক্ষার দরজা টাকার কাছে বিক্রি হলো, আপনারা নীরব ছিলেন। যখন সততার দাম হলো নিছক বোকামি, তখন আপনারা 'বাস্তবতা'র নাম দিলেন। এখন সবার হাতে তথ্য আছে, কিন্তু সবাই অন্ধ। আমরা সেই শূন্যতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি, যা আপনারা রেখে গেছেন। আপনারা আমাদের শেখালেন স্বপ্ন দেখতে, কিন্তু স্বপ্ন পূরণের রাস্তাটা তৈরি করে গেলেন লোভ আর মিথ্যা দিয়ে!
অনির্বাণ: তুমি আমাদের শুধু ব্যর্থতা দেখছো। আমরাও লড়াই করেছিলাম, চিৎকার করেছিলাম! কিন্তু ক্ষমতা আর অর্থ যখন একে অপরের সঙ্গে মিশে যায়, তখন সাধারণ মানুষের চিৎকার নিছক ফিসফিসানি হয়ে যায়। এই যে তুমি আজ ক্ষুব্ধ, কাল তুমিও দেখবে তোমার প্রতিবাদের ধার কমে যাচ্ছে। এটাই সমাজের অনিবার্য নিয়ম। এ এক চিরন্তন বিশ্বাসঘাতকতা—তোমার আদর্শ তোমার সঙ্গেই করে।
প্রত্যয়: (আচমকা উত্তেজিত হয়ে) না! আমি মানি না! ক্ষয়টা অনিবার্য নয়, এটা অভ্যাস। আর এই অভ্যাস ভাঙা সম্ভব। আমি দেখতে চাই না যে আমার সন্তানেরা এই পচা মাটির ওপর দাঁড়িয়ে একই হতাশায় ভুগুক। যদি সবাই এই 'অনিবার্য ক্ষয়'-কে মেনে নেয়, তাহলে কেন আমরা এখনো নিঃশ্বাস নিচ্ছি? কেন এখনো কিছু মানুষ রাস্তায় নামে?
অনির্বাণ: (দীর্ঘ, ঠান্ডা হাসি) তারা নামে, কারণ তাদের এখনো শেষ আশাটুকু মরেনি। কিন্তু আশা এক বিপজ্জনক প্রতারণা, প্রত্যয়। সে তোমাকে আরও বেশি কষ্ট দেয় যখন সে মরে যায়। এই সমাজ আর প্রতিষ্ঠানগুলো এখন কেবলই ছদ্মবেশ, ভেতরের সব কাঠামো ভেঙে গেছে। তুমি কাকে মেরামত করবে? জীর্ণতা এখন আমাদের সংস্কৃতি।
প্রত্যয়: আমি সংস্কৃতি বদলাবো। আমি এই ভাঙা দেয়ালের পাশে নতুন বীজ পুঁতব, যা ধীরে হলেও এই পচনকে ঢেকে দেবে। আপনারা শুধু অভিযোগ করলেন, কিন্তু আমরা কাজ শুরু করব। আমি জানি এটা বিপজ্জনক, কিন্তু নীরব দর্শকের চেয়ে পরাজিত যোদ্ধা হওয়া অনেক ভালো।
অনির্বাণ: (মাথা নেড়ে) তুমি যুদ্ধ করো, প্রত্যয়। কিন্তু মনে রেখো, তুমি যে মাটির ওপর দাঁড়িয়ে লড়ছো, সেই মাটিটাই পচে গেছে। তুমি লড়ছো সময় আর প্রকৃতির বিরুদ্ধে। (স্মৃতিস্তম্ভের দিকে ইশারা করে) এর নাম ছিল 'অটুট শপথ'। আজ শুধু শ্যাওলা আর ভাঙা পাথর। তুমিও একদিন এইখানে দাঁড়িয়ে ক্ষয়ের হিসাব করবে।
(অনির্বাণ ধীর পায়ে হেঁটে পার্কের ভেতরের অন্ধকারে মিশে যেতে শুরু করেন। প্রত্যয় সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। তার চোখ কখনো অনির্বাণের চলে যাওয়া পথের দিকে, আবার কখনো সেই জীর্ণ স্মৃতিস্তম্ভের দিকে। তার মুখে হতাশা এবং এক কঠিন প্রতিজ্ঞার মিশ্রণ।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:০১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



