বাংলাদেশে বা বিশ্বজুড়েও দেখা যায় কুরআন অবমাননার ঘটনা। আমি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেই লিখছি।
কুরআন ফেলে দেয়া, বা ভুলক্রমে পড়ে যাওয়া, ফটোশপে এডিটেড ছবি, ছিঁড়ে ফেলা পুড়িয়ে ফেলা ইত্যাদি নানা ভাবে কুরআন অবমাননা হয়।
এই অভিযোগ একবার আসলে দেশের "মোল্লান্ধ" (ধর্মান্ধ বললাম না কারণ প্রকৃত ধার্মিক এরকম করতে পারে না, এগুলো clergy বা যাজক/পুরোহিত/মোল্লা পন্থীদের আচরণ) কথিত তৌহিদী জনগোষ্ঠী এর তদন্ত না করেই বা সরকারের আইনশৃঙ্খলা ও বিচার ব্যবস্থার তোয়াক্কা না করেই দলবল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে অভিযুক্তদের মুণ্ডুপাত করতঃ দোজাহানের অশেষ নেকি হাসিল এবং জান্নাতের আটটি দরজা একযোগে খুলে ফেলতে !
আচ্ছা, আল্লাহর কিতাবের অবমাননা কি এতোই সোজা ? এইসব করলেই কিতাবের অবমাননা হয়ে যায় ? কিতাবের অবমাননা আসলে কি ?
চলুন কুরআন থেকে দেখি, যে সত্যিটা কোন মসজিদে বা ওয়াজে আপনি শোনেননি কখনো।
কুরআনে যতজন রাসূলের কথা আছে তন্মধ্যে সবচাইতে বেশিবার আছে সালামুন আলা মুসার কথা। তিনি বনী ইজরাইলদের মাঝে প্রেরিত রাসূল।ছিলেন, তার আপন ভাই সালামুন আলা হারুনও ছিলেন রাসূল। তো উনাদের একটা ঘটনা বিবৃত হয়েছে আল কুরআনে:
মুসা নবী ফেরাউনের সাথে যুদ্ধের পরে যখন ফেরাউন নীল নদে ডুবে মরলো এরপরে মুসা আ. তুর পাহাড়ে যেয়ে ধ্যান করে তাওরাত প্রাপ্ত হলেন। এই তাওরাত কতগুলো ফলকে লিখা ছিল যা স্বয়ং আল্লাহ তাকে দিয়েছেন। আল্লাহ তাওরাত কিতাব সম্বলিত ফলক সালামুন আলা মুসাকে দেয়ার ঘটনা:
//(পরওয়ারদেগার) বললেন, হে মূসা, আমি তোমাকে আমার বার্তা পাঠানোর এবং কথা বলার মাধ্যমে লোকদের উপর বিশিষ্টতা দান করেছি। সুতরাং যা কিছু আমি তোমাকে দান করলাম, গ্রহণ কর এবং কৃতজ্ঞ থাক। আর আমি তোমাকে পটে লিখে দিয়েছি সর্বপ্রকার উপদেশ ও বিস্তারিত সব বিষয়। অতএব, এগুলোকে দৃঢ়ভাবে ধারণ কর এবং স্বজাতিকে এর কল্যাণকর বিষয়সমূহ দৃঢ়তার সাথে পালনের নির্দেশ দাও। [সুরা আরাফ - ৭:১৪৪-১৪৫]//
উনি যখন উনার কওমের কাছে ফেরত এলেন তখন দেখলেন তার কওমের লোকেরা সব "সামেরি" নামের এক ব্যক্তির প্ররোচনায় মুশরিক হয়ে গরুর বাছুর পূজা শুরু করেছে। তখন তাদের কাছে যেয়ে তাদেরকে এই মুশরিক অবস্থায় দেখতে পেয়ে উনি রেগে যেয়ে হাত থেকে তাওরাতের ফলক ছুঁড়ে ফেলে দিলেন যা স্বয়ং আল্লাহর তরফ থেকে প্রাপ্ত ছিল !!!
সালামুন আলা মুসার আল্লাহর থেকে প্রাপ্ত তাওরাত ছুঁড়ে ফেলার কাহিনী
//তারপর যখন মূসা নিজ সম্প্রদায়ে ফিরে এলেন রাগাম্বিত ও অনুতপ্ত অবস্থায়, তখন বললেন, আমার অনুপস্থিতিতে তোমরা আমার কি নিকৃষ্ট প্রতিনিধিত্বটাই না করেছ। তোমরা নিজ পরওয়ারদেগারের হুকুম থেকে কি তাড়াহুড়া করে ফেললে এবং সে তখতীগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিলেন এবং নিজের ভাইয়ের মাথার চুল চেপে ধরে নিজের দিকে টানতে লাগলেন। ভাই বললেন, হে আমার মায়ের পুত্র, লোকগুলো যে আমাকে দুর্বল মনে করল এবং আমাকে যে মেরে ফেলার উপক্রম করেছিল। সুতরাং আমার উপর আর শত্রুদের হাসিও না। আর আমাকে জালিমদের সারিতে গন্য করো না। [সুরা আরাফ - ৭:১৫০]//
পরে রাগ কমলে তিনি এগুলো তুলেও নেন।
//তারপর যখন মূসার রাগ পড়ে গেল, তখন তিনি তখতীগুলো তুলে নিলেন। আর যা কিছু তাতে লেখা ছিল, তা ছিল সে সমস্ত লোকের জন্য হেদায়েত ও রহমত যারা নিজেদের পরওয়ারদেগারকে ভয় করে। [সুরা আরাফ - ৭:১৫৪]//
ভাবুন তো একবার, আল্লাহর একজন রাসূল স্বয়ং আল্লাহর থেকে প্রাপ্ত এই ফলকে লিখিত কিতাব রেগে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন অথচ এই কাজে আল্লাহর কিতাবের অবমাননা হয়নি, আল্লাহ রাসূল সালামুন আলা মুসা কোন শাস্তিও দেননি !! যদি এতই সস্তা হতো আল্লাহর কিতাব তো ওই অবস্থায়ই আল্লাহ তার রাসূল মুসাকে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি করতেন তার কিতাব "অবমাননার" জন্য ! তার কিছুই হয়নি !
আর এদিকে বাংলাদেশের মোল্লারা কিছুর থেকে কিছু হলেই চারপাশ একাকার করে ফেলে দাঙ্গা হাঙ্গামা করে ! ভাগ্যিস মুসা নবীর জন্ম বাংলাদেশে এই সময়ে হয়নি, তাইলে কি যে করতো মোল্লারা !
এদেশে ঘটনা না শুনেই ঝাঁপিয়ে পড়ে। লালমনিরহাটে একজনকে তো পুড়িয়ে মারলো বছরের শুরুতে কুরআন অবমাননার অভিযোগে। তাও অভিযোগটা কি ? তিনি নাকি তাক থেকে কুরআন ফেলে দিয়েছেন (এটা ইচ্ছাকৃত না অনিচ্ছাকৃত তাও শোনার সময় নাই পর্যন্ত !)
এই উগ্রবাদীদের আল্লাহ হেদায়েত করুক।
এবার দেখাবো এই কথিত মোল্লাদের ও তাদের অন্ধ অনুসরণকারী কথিত তৌহিদী জনতার দ্বিচারিতা !
ভাই ও বোনেরা আপনারা সবাই "মুয়াবিয়ার" নাম নিশ্চয়ই শুনেছেন। সুন্নি ধর্মের প্রবর্তক মুয়াবিয়া, ইসলামের নামে সুন্নী ধর্ম তৈরি করে যোগ্যতাভিত্তিক খিলাফত উৎখাত করে পরিবারতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ইসলামের পঞ্চম খলিফা (অবৈধ) !
এই মুয়াবিয়া ইসলামের চতুর্থ খলিফা ও নবীর চাচাতো ভাই প্লাস মেয়ের জামাই হজরত আলীর বিরুদ্ধে সিফফিনের যুদ্ধ করতে যেয়ে যখন পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে তখন সে যুদ্ধে ব্যবহৃত বর্শার মাথায় পবিত্র কুরআন গেঁথে "অনুভুতির" খেলা শুরু করলো। অর্থাৎ মুয়াবিয়ার সৈন্যরা তাদের অস্ত্রে কুরআনের আয়াত ছেড়া অবস্থায় লাগিয়ে রাখলো যেন প্রতিপক্ষ (হজরত আলীর বাহীনি) কুরআন দেখে আর আক্রমণ করতে না পারে, ইতস্তত বোধ করে।
এই জঘন্য কাজ করার পরেও মুয়াবিয়ার পূজা করে আজকে তথাকথিত সুন্নী ধর্মের অনুসারীরা (যদিও তারা নিজেদের মুসলিম বলে)।
কুরআন বিরোধী বা অবমাননাকারীদের শাস্তি চাইলে সবার আগে মুয়াবিয়ার প্রতি সম্মান ও সুন্নী ধর্ম ত্যাগ করে মুসলিম হতে হবে।
একই কথা শিয়া ধর্মের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। শিয়া শব্দের অর্থ দল, মুয়াবিয়ার সাথে হজরত আলীর যুদ্ধে যারা আলীর পক্ষে ছিল তাদের বলা হতো শিয়ানে আলী বা শিয়াতো আলী যার অর্থ আলীর দল।
মুয়াবিয়া হজরত আলীর সাথে যুদ্ধে যখন পরাজয় বরণ করার অবস্থা তখন সে ঘোড়ার গায়ে, উটের গায়ে, সৈন্যদের গায়ে, বল্লম, বর্শা এসবে কুরআনের পাতা ফিট করে যুদ্ধে নামে ফলে আলীর সৈন্যরা যুদ্ধ করতে ইতস্তত বোধ করে। এই সুযোগে মুয়াবিয়ার সৈন্যরা আবার হামলা চালিয়ে কচু কাটা করে আলীর বাহিনীকে।
এই সিফফিনের যুদ্ধে প্রায় ৭০ হাজার মুসলিম নিহত হয় !
এতকিছুর পরেও মুয়াবিয়ার নামের পরে রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু(আল্লাহ মুয়াবিয়ার প্রতি খুশি), মুয়াবিয়া দুনিয়াতেই জান্নাতের টিকেট প্রাপ্তদের একজন(আশারায় মুবাশ্বারাহ), মুয়াবিয়া একজন সহীহ সাহাবী বলে আজকের ভন্ড মুসলিমরা !
**আশারা শব্দের অর্থ দশ। অতএব, আশারায়ে মুবাশশারা অর্থ সুসংবাদপ্রাপ্ত দশজন। অর্থাৎ লাহওয়াল হাদীস মতে এরা দুনিয়াতে থাকতেই জান্নাতের টিকেট/সুসংবাদ প্রাপ্ত ! যদিও এরকম কথাবার্তা কুরআনে নাই।
কুরআন অবমাননাকারী ও ৭০ হাজার মানুষ হত্যার কারিগর এবং অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী এই মুয়াবিয়া ও উমাইয়াদের নিয়ে তাদের কোনই আওয়াজ নাই। তার মানে কি ?
কুরআন অবমাননাকারী দেখে সিলেকটিভ আচরণ করতে হবে?
নাস্তিক বা হিন্দুদের নামে অভিযোগ আসলে কোপাতে হবে আর আরবীয় নামধারীদের নামে আসলে চেপে যেতে হবে আর সময় সুযোগ বুঝে রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু বলতে হবে !
বাংলাদেশের জজকোর্ট, হাইকোর্ট বা সুপ্রিমকোর্টের আদেশ লঙ্ঘন করলে বা পালন করতে গড়িমসি করলে আদালত অবমাননা হয়, অন্যদিকে কথিত মুসলিমরা কোরআনের ধারের কাছেও না ঘেঁষে, এর বিধান উপেক্ষা করে বানোয়াট লাহোয়াল হাদিস নিয়ে পড়ে থাকলেও কুরআন অবমাননা হয় না !
কুরআন অবমাননা হলো এর বিধানকে না মানা। আল্লাহর কিতাবের সাথে অংশীদার স্থাপন করা !
কথায় কথায় ৯০% মুসলিমের দেশ এইটা !! এখানে এটা করা যাবে না ওটা করা যাবে না ! অথচ এই দেশ চুরি চামারি, দুর্নীতি, চাপাবাজি, মিথ্যাবাদী, ভেজালকারী, মজুদতার, হত্যাকারী, গালিবাজ, অহংকারী, লোভী, কৃপণ, এতিমদের হক লুণ্ঠননকারী, ওয়াদা ভঙ্গকারী ইত্যাদিতে ভর্তি ! রোজার মাসে কে কত বেশি।প্রফিট আর ভেজাল করতে পারে সে প্রতিযোগিতা শুরু হয় ! অথচ এসব কুরআনের বিভিন্ন নির্দেশনার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন !
কুরআনে একবারও টাখনুর উপরে প্যান্ট পরার ইত্যাদির নির্দেশ নাই কিন্তু বারবার এগুলোর কথা বলা।
আমরা একজনকে একটা টাইম দিয়ে সেই টাইমে উপস্থিত হই না, এভাবে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করাকে কোন অপরাধই ভাবি না অথচ আল্লাহ বার বার ওয়াদা রক্ষার কথা বলেছেন ! কুরআনে একবারও দাঁড়ি রাখার নির্দেশ দেননি আল্লাহ অথচ কঠোর ভাষায় গীবত বা পরনিন্দা না করতে নির্দেশ আছে, পরনিন্দা করাকে আল্লাহ মৃত ভাইয়ের মাংস খাওয়ার সাথে তুলনা করেছে অথচ আমরা এই কাজটাই সানন্দে করি সার্বক্ষণিক। দাঁড়ি টুপি জোব্বা পরা লোক অহরহ পাবেন, কিন্তু নিন্দা করে না, পরচর্চা করে না কিংবা মিথ্যা বলে না এরকম মানুষ বাটি চালান দিয়েও খুঁজে পাওয়া যাবে না !
অথচ এসব কাজই হলো কুরআন অমান্য করার বা অবমাননা করার প্রকৃত রূপ।
কুরআনে অনোন্যপায় হলে শুকর খাওয়ারও বৈধতা আছে কিন্তু অনোন্যপায় হয়ে মিথ্যা বলা, চুরি করা, ডাকাতি করা, আমানতের খিয়নত করার বৈধতা নাই
আমরা আসলে কিসের ইসলাম মানি ?
এখন এদেশে ইসলাম বলতে আরবীয়করণ ছাড়া আর কিছুই না !
প্রকৃত অর্থে কিসে কুরআন অবমাননা হয় সেটা যদি মানুষ বুঝতো তাহলে ইসলাম প্রচারের স্বার্থে গভীর রাত অবধি হল্লা করা লাগতো না, এই নৈতিকতার পূর্ণ সমাজ দেখে সবাই ইসলাম গ্রহণ করতো।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই নভেম্বর, ২০২১ দুপুর ১:২৭