somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সম্পত্তিতে নারীর অধিকার: কোরআন কি সত্যিই নারীকে বঞ্চিত করেছে? অসিয়ত ও ফারায়েজের আলোকে একটি বিশ্লেষণ। কোরআনিক ইসলাম পর্ব-৫

০৬ ই জুন, ২০২৫ দুপুর ১২:৪৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বর্তমানে বাংলাদেশে সহ বিশ্বজুড়ে মুসলিম নারীদের সম্পত্তির অধিকার নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে। প্রায়শই অভিযোগ করা হয় যে, ইসলামে নারীকে সম্পত্তিতে বঞ্চিত করা হয়েছে এবং পুরুষদের তুলনায় তাদের অর্ধেক অংশ দেওয়া হয়েছে। এই ধারণার প্রেক্ষিতে অনেক নারী সংগঠন সম্পত্তিতে পুরুষের সমান অধিকারের দাবিতে আন্দোলন করছে। কিন্তু কোরআন আসলে কি বলে? কোরআনের নির্দেশনা কি সত্যিই নারীকে বঞ্চিত করে, নাকি এর পেছনে গভীর প্রজ্ঞা ও ন্যায়বিচারের এক ভিন্ন চিত্র লুকিয়ে আছে? এই পোস্টের উদ্দেশ্য হলো কোরআনের আয়াতসমূহ এবং এর আলোকে অসিয়ত (উইল) ও ফারায়েজ (উত্তরাধিকার আইন) এর প্রকৃত তাৎপর্য বিশ্লেষণ করা।


এক নজরে কোরআনে সম্পত্তি বণ্টনের আয়াতসমূহ

কোরআনে সম্পত্তি বণ্টনের মূল নির্দেশনাগুলো সূরা নিসাতে বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে। এই আয়াতগুলো মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি তার উত্তরাধিকারীদের মধ্যে নির্দিষ্ট অংশ অনুযায়ী বণ্টনের নির্দেশ দেয়, তবে এই বণ্টন প্রক্রিয়া মৃত ব্যক্তির ঋণ পরিশোধ এবং তার কৃত অসিয়ত কার্যকর করার পরেই সম্পন্ন হবে।

১. সূরা নিসা, আয়াত ১১ (সন্তান ও পিতামাতার অংশ):
يُوصِيكُمُ اللَّهُ فِي أَوْلاَدِكُمْ لِلذَّكَرِ مِثْلُ حَظِّ الأُنثَيَيْنِ فَإِن كُنَّ نِسَاء فَوْقَ اثْنَتَيْنِ فَلَهُنَّ ثُلُثَا مَا تَرَكَ وَإِن كَانَتْ وَاحِدَةً فَلَهَا النِّصْفُ وَلأَبَوَيْهِ لِكُلِّ وَاحِدٍ مِّنْهُمَا السُّدُسُ مِمَّا تَرَكَ إِن1 كَانَ لَهُ وَلَدٌ فَإِن لَّمْ يَكُن لَّهُ وَوَرِثَهُ أَبَوَاهُ فَلأُمِّهِ الثُّلُثُ فَإِن كَانَ لَهُ إِخْوَةٌ فَلأُمِّهِ السُّدُسُ مِن بَعْدِ وَصِيَّةٍ يُوصِي بِهَا أَوْ دَيْنٍ آبَاؤُكُمْ2 وَأَبْنَآؤُكُمْ لاَ تَدْرُونَ أَيُّهُمْ أَقْرَبُ لَكُمْ نَفْعًا فَرِيضَةً مِّنَ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلِيمًا حَكِيمًا
অর্থ: "আল্লাহ তোমাদেরকে তোমাদের সন্তানদের সম্পর্কে নির্দেশ দিচ্ছেন: এক ছেলের জন্য দুই মেয়ের অংশের সমপরিমাণ। তবে যদি তারা দুইয়ের অধিক মেয়ে হয়, তাহলে তাদের জন্য মৃত ব্যক্তির পরিত্যক্ত সম্পত্তির দুই-তৃতীয়াংশ। আর যদি মাত্র একজন মেয়ে হয়, তবে তার জন্য অর্ধেক। মৃত ব্যক্তির পিতামাতার প্রত্যেকের জন্য পরিত্যক্ত সম্পত্তির ছয় ভাগের এক ভাগ, যদি তার সন্তান থাকে। যদি তার সন্তান না থাকে এবং পিতা-মাতাই তার ওয়ারিশ হয়, তবে তার মায়ের জন্য তিন ভাগের এক ভাগ। যদি তার ভাই-বোন থাকে, তবে মায়ের জন্য ছয় ভাগের এক ভাগ। (এসবই) যে অসিয়ত সে করেছে তা কার্যকর ও তার ঋণ পরিশোধ করার পর। তোমাদের পিতা ও পুত্রদের মধ্যে কে তোমাদের উপকারের দিক দিয়ে অধিক নিকটবর্তী, তা তোমরা জান না। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত বিধান। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।"

২. সূরা নিসা, আয়াত ১২ (স্বামী-স্ত্রী ও কালালার অংশ):
وَلَكُمْ نِصْفُ مَا تَرَكَ أَزْوَاجُكُمْ إِن لَّمْ يَكُن لَّهُنَّ وَلَدٌ فَإِن كَانَ لَهُنَّ وَلَدٌ فَلَكُمُ الرُّبُعُ مِمَّا تَرَكْنَ مِن بَعْدِ وَصِيَّةٍ يُوصِينَ بِهَا أَوْ دَيْنٍ وَلَهُنَّ الرُّبُعُ مِمَّا تَرَكْتُمْ إِن لَّمْ يَكُن لَّكُمْ وَلَدٌ فَإِن3 كَانَ لَكُمْ وَلَدٌ فَلَهُنَّ الثُّمُنُ مِمَّا تَرَكْتُم مِّن بَعْدِ وَصِيَّةٍ تُوصُونَ بِهَا أَوْ دَيْنٍ وَإِن كَانَ رَجُلٌ يُورَثُ كَلاَلَةً أَوِ4 امْرَأَةٌ وَلَهُ أَخٌ أَوْ أُخْتٌ فَلِكُلِّ وَاحِدٍ مِّنْهُمَا السُّدُسُ فَإِن كَانُواْ أَكْثَرَ مِن ذَلِكَ فَهُمْ شُرَكَاء فِي الثُّلُثِ مِن بَعْدِ وَصِيَّةٍ يُوصَى بِهَآ5 أَوْ دَيْنٍ غَيْرَ مُضَآرٍّ وَصِيَّةً مِّنَ اللَّهِ وَاللَّهُ عَلِيمٌ حَلِيمٌ
অর্থ: "আর তোমাদের স্ত্রীদের পরিত্যক্ত সম্পত্তির অর্ধাংশ তোমাদের জন্য, যদি তাদের কোনো সন্তান না থাকে। কিন্তু যদি তাদের সন্তান থাকে, তবে তাদের পরিত্যক্ত সম্পত্তির এক-চতুর্থাংশ তোমাদের জন্য। (এসবই) তারা যে অসিয়ত করেছে তা কার্যকর ও ঋণ পরিশোধ করার পর। আর তোমাদের পরিত্যক্ত সম্পত্তির এক-চতুর্থাংশ তাদের (স্ত্রীদের) জন্য, যদি তোমাদের কোনো সন্তান না থাকে। আর যদি তোমাদের সন্তান থাকে, তবে তাদের জন্য তোমাদের পরিত্যক্ত সম্পত্তির আট ভাগের এক ভাগ। (এসবই) তোমরা যে অসিয়ত করেছ তা কার্যকর ও ঋণ পরিশোধ করার পর। আর যদি কোনো পুরুষ বা মহিলার 'কালালা' (যার পিতা-মাতা ও সন্তান নেই) ওয়ারিশ হয় এবং তার এক ভাই বা এক বোন থাকে, তবে তাদের প্রত্যেকের জন্য ছয় ভাগের এক ভাগ। যদি তারা এর চেয়ে বেশি হয়, তবে তারা এক-তৃতীয়াংশের অংশীদার হবে। (এসবই) অসিয়ত কার্যকর ও ঋণ পরিশোধ করার পর, যাতে কোনো ক্ষতি না হয়। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশ। আর আল্লাহ সর্বজ্ঞ, পরম সহনশীল।"

৩. সূরা নিসা, আয়াত ১৭৬ (কালালা সম্পর্কিত অতিরিক্ত নির্দেশ):
يَسْتَفْتُونَكَ قُلِ اللَّهُ يُفْتِيكُمْ فِي الْكَلاَلَةِ إِنِ امْرُؤٌ هَلَكَ لَيْسَ لَهُ وَلَدٌ وَلَهُ أُخْتٌ فَلَهَا نِصْفُ مَا تَرَكَ وَهُوَ يَرِثُهَا إِن6 لَّمْ يَكُن لَّهَا وَلَدٌ فَإِن كَانَتَا اثْنَتَيْنِ فَلَهُمَا الثُّلُثَانِ مِمَّا تَرَكَ وَإِن كَانُواْ7 إِخْوَةً رِّجَالاً وَنِسَاء فَلِلذَّكَرِ مِثْلُ حَظِّ الأُنثَيَيْنِ يُبَيِّنُ اللَّهُ لَكُمْ أَن تَضِلُّواْ وَاللَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ8
অর্থ: "তারা তোমাকে ফতোয়া জিজ্ঞাসা করে। বলো, আল্লাহ তোমাদেরকে 'কালালা' (পিতা-মাতা ও সন্তানহীন) সম্পর্কে ফতোয়া দিচ্ছেন: যদি কোনো পুরুষ মারা যায়, যার কোনো সন্তান নেই এবং তার একটি বোন থাকে, তবে তার (বোনের) জন্য তার পরিত্যক্ত সম্পত্তির অর্ধেক। আর যদি সে (বোন) নিঃসন্তান হয়, তবে পুরুষটি তার (বোনের) উত্তরাধিকারী হবে। যদি তারা দুজন বোন হয়, তবে তাদের জন্য পরিত্যক্ত সম্পত্তির দুই-তৃতীয়াংশ। আর যদি তারা ভাই-বোন উভয়ই হয়, তবে পুরুষের জন্য দুই নারীর অংশের সমপরিমাণ। আল্লাহ তোমাদের জন্য সুস্পষ্ট বর্ণনা দিচ্ছেন, যাতে তোমরা পথভ্রষ্ট না হও। আর আল্লাহ সব বিষয়ে জ্ঞানী।"


কোরআনের নির্দেশনার অগ্রাধিকার: অসিয়ত ও ঋণ পরিশোধের পর উত্তরাধিকার বণ্টন

উপরিউক্ত আয়াতসমূহের গভীর পর্যালোচনা করলে একটি সুস্পষ্ট নির্দেশনা পাওয়া যায়: কোরআন সর্বাগ্রে মৃত ব্যক্তির কৃত অসিয়ত বা উইল বাস্তবায়নের এবং তার ঋণ পরিশোধের নির্দেশ দিচ্ছে। শুধু এই দুটি কাজ সুচারুরূপে সম্পন্ন করার পরই, মৃত ব্যক্তির অবশিষ্ট সম্পত্তি উল্লিখিত ফারায়েজ আইন অনুযায়ী তার উত্তরাধিকারীদের মধ্যে ভাগ হবে। যদি মৃত ব্যক্তির সমুদয় সম্পত্তি অসিয়ত ও ঋণ পরিশোধে নিঃশেষ হয়ে যায়, তাহলে উত্তরাধিকারীদের জন্য আর কিছু নাও থাকতে পারে এবং সেক্ষেত্রেই অসিয়তটিই সম্পূর্ণ সম্পত্তি বণ্টনের ভিত্তি হবে। পক্ষান্তরে, যদি অসিয়ত ও ঋণ পরিশোধের পরও সম্পত্তি অবশিষ্ট থাকে, তবে সেই অবশিষ্ট অংশ ফারায়েজের বিধান অনুযায়ী বণ্টিত হবে।

অসিয়ত কী? অসিয়ত হলো মৃত ব্যক্তির মৃত্যুর পূর্বে তার সম্পত্তির বণ্টন ও ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে একটি লিখিত বা মৌখিক নির্দেশ। এটি তার ঋণ পরিশোধ এবং পরিবারের বিশেষ প্রয়োজন মেটানোর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।


সিয়াম ও অসিয়তের নির্দেশনায় কোরআনের সমান্তরাল ব্যবহার: অসিয়তের তাৎপর্য

কোরআনে দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে একই শব্দ, "কুতিবা" ব্যবহার করা হয়েছে: সিয়াম (রোজা) এবং অসিয়ত (উইল)। এই সমান্তরাল ব্যবহার অসিয়তের অপরিহার্যতা ও গুরুত্বকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করে।

সূরা বাকারার ১৮৩ নম্বর আয়াতে সিয়াম সম্পর্কে বলা হয়েছে:
كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِن قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ
অর্থ: "হে মুমিনগণ! তোমাদের উপর সিয়াম বিধিবদ্ধ করা হলো, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর বিধিবদ্ধ করা হয়েছিল, যেন তোমরা তাক্বওয়া অর্জন করতে পারো।" (সূরা বাকারা ২:১৮৩)

এই আয়াতে "কুতিবা" শব্দটির ব্যবহার সিয়ামকে মুসলিমদের জন্য ফরজ বা অবশ্য পালনীয় করে তুলেছে, যা নিয়ে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে কোনো মতভেদ নেই।

এর ঠিক দুই আয়াত পূর্বেই, সূরা বাকারার ১৮০ নম্বর আয়াতে অসিয়ত সম্পর্কে বলা হয়েছে:
كُتِبَ عَلَيْكُمْ إِذَا حَضَرَ أَحَدَكُمُ الْمَوْتُ إِن تَرَكَ خَيْرًا الْوَصِيَّةُ لِلْوَالِدَيْنِ وَالأَقْرَبِينَ بِالْمَعْرُوفِ حَقًّا عَلَى الْمُتَّقِينَ9
অর্থ: "তোমাদের উপর বিধিবদ্ধ করা হলো যে, যখন তোমাদের কারো মৃত্যু উপস্থিত হবে এবং সে ধন-সম্পত্তি রেখে যাবে, তখন পিতামাতা ও নিকটাত্মীয়দের জন্য ন্যায়সঙ্গত অসিয়ত করবে। এটি মুত্তাকিদের উপর অবশ্য কর্তব্য।" (সূরা বাকারা ২:১৮০)

এই আয়াতেও অসিয়তের জন্য একই "কুতিবা" শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে এবং এটিকে "হাক্বান আলাল মুত্তাকিন" (মুত্তাকিদের উপর অবশ্য কর্তব্য) বলা হয়েছে। সিয়াম যদি "কুতিবা" হওয়ার কারণে ফরজ হয়, তবে অসিয়তও একই শব্দ ব্যবহারের কারণে ফরজ বা অবশ্য পালনীয় হওয়া উচিত। কোরআনের এই সুস্পষ্ট ও সমান্তরাল নির্দেশনার পরও মুসলিম সমাজে অসিয়তের প্রতি উদাসীনতা সত্যিই বিস্ময়কর। রোজার জন্য যেমন আড়ম্বর ও গুরুত্ব দেখা যায়, অসিয়তের ক্ষেত্রে তার ছিটেফোঁটাও নেই, অথচ কোরআনের ভাষায় দুটিই একই স্তরের নির্দেশনা।



সম্পত্তি বণ্টনে অসিয়তের গুরুত্ব: উদাহরণসহ ব্যাখ্যা

অসিয়ত শুধু একটি ধর্মীয় বিধান নয়, এটি একটি দূরদর্শী সামাজিক পরিকল্পনা এবং পরিবারের প্রকৃত কল্যাণের চাবিকাঠি। এর গুরুত্ব নিচের উদাহরণগুলো থেকে আরও স্পষ্ট হবে:

বিভিন্ন উত্তরাধিকারীর ভিন্ন ভিন্ন অবস্থা: ধরুন, একজন ব্যক্তির চারটি সন্তান রয়েছে। একজন সন্তান বিদেশে বসবাস করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছে এবং সচ্ছল। অন্য একজন সন্তান স্থানীয়ভাবে একটি ছোট ব্যবসা চালায় এবং তার আর্থিক অবস্থা মোটামুটি। তৃতীয় সন্তানটি গুরুতর অসুস্থ এবং চিকিৎসার জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। চতুর্থ সন্তানটি মাদকাসক্ত এবং তার হাতে সরাসরি অর্থ দিলে তা অপচয় হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এমতাবস্থায়, যদি শুধু ফারায়েজের নির্দিষ্ট অনুপাত অনুযায়ী সম্পত্তি বণ্টন করা হয়, তাহলে অসুস্থ সন্তানটি তার চিকিৎসার জন্য পর্যাপ্ত অর্থ নাও পেতে পারে, এবং মাদকাসক্ত সন্তানের হাতে সম্পদ গেলে তা নষ্ট হতে পারে। কিন্তু অসিয়তের মাধ্যমে মৃত ব্যক্তি তার জীবদ্দশায় অর্জিত সম্পদ থেকে অসুস্থ সন্তানের চিকিৎসার জন্য একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করতে পারেন, বা মাদকাসক্ত সন্তানের অংশটি কোনো বিশ্বস্ত ব্যক্তির তত্ত্বাবধানে রেখে তার প্রয়োজনীয় ব্যয়ভার বহন করার নির্দেশ দিতে পারেন। এর ফলে, প্রতিটি সন্তানের প্রকৃত প্রয়োজন ও অবস্থার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়।

অপাত্রে সম্পত্তি যাওয়ার আশঙ্কা রোধ: সমাজে এমন অনেক পরিবার দেখা যায় যেখানে একজন উত্তরাধিকারী বা একাধিক উত্তরাধিকারী এমন কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকেন যা সম্পত্তির জন্য ক্ষতিকর। যেমন, জুয়া খেলা, অতিরিক্ত বিলাসিতা, বা অর্থ উপার্জনে অনীহা। যদি এমন ব্যক্তিকে সরাসরি ফারায়েজের মাধ্যমে বিপুল সম্পত্তি দেওয়া হয়, তাহলে সেই সম্পদ দ্রুত নষ্ট হয়ে যেতে পারে। অসিয়ত মৃত ব্যক্তিকে এই ক্ষমতা দেয় যে, তিনি এমন উত্তরাধিকারীর জন্য নির্দিষ্ট শর্ত আরোপ করতে পারেন, যেমন: সম্পত্তি ট্রাস্টের মাধ্যমে পরিচালনা করা, বা নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি অর্থ একবারে না দেওয়া। এটি কেবল সম্পত্তি রক্ষার জন্যই নয়, বরং সেই উত্তরাধিকারীর ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য একটি সঠিক পথ প্রদর্শনেও সহায়ক হতে পারে।

সম্পত্তির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও সুরক্ষা: কখনো কখনো উত্তরাধিকারীদের মধ্যে এমন ব্যক্তি থাকেন যারা সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণে উদাসীন। তারা হয়ত সম্পত্তির মালিকানা পেয়েও এর সঠিক যত্ন নিতে বা এর থেকে লাভবান হতে আগ্রহী নন। এর ফলে মূল্যবান সম্পত্তি বেহাত হয়ে যাওয়া বা তার মূল্য হ্রাস পাওয়ার ঝুঁকি থাকে। অসিয়তের মাধ্যমে মৃত ব্যক্তি যোগ্য ও দায়িত্বশীল উত্তরাধিকারীর হাতে সম্পত্তি ব্যবস্থাপনার ভার অর্পণ করতে পারেন, বা কোনো নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠানকে তার সম্পত্তি জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যবহারের জন্য নির্দিষ্ট শর্তে দান করার নির্দেশ দিতে পারেন।

ন্যায়বিচার ও প্রজ্ঞা প্রয়োগ: যদিও ফারায়েজ একটি সুনির্দিষ্ট ও নির্ধারিত বণ্টন পদ্ধতি, এটি সমাজের সকল পরিস্থিতি ও পারিবারিক গতিশীলতাকে কভার করতে পারে না। অসিয়ত মৃত ব্যক্তিকে বিচার বুদ্ধি প্রয়োগ করে তার সম্পদ এমনভাবে বিন্যাস করার সুযোগ দেয়, যাতে পরিবারের প্রতিটি সদস্যের প্রয়োজন, যোগ্যতা এবং পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে সর্বোত্তম সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। এটি মৃত ব্যক্তির প্রতি তার পরিবারের সদস্যদের দায়িত্ব এবং তাদের প্রতি তার ভালোবাসার একটি চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ। যেমন, কোনো নিকটাত্মীয়কে যদি আইনত উত্তরাধিকারী নাও ধরা হয়, কিন্তু তারা অভাবে থাকে, কোরআন সূরা নিসার ৮ নম্বর আয়াতে তাদেরও কিছু অংশ দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে:
وَإِذَا حَضَرَ ٱلْقِسْمَةَ أُوْلُواْ ٱلْقُرْبَىٰ وَٱلْيَتَٰمَىٰ وَٱلْمَسَٰكِينُ فَٱرْزُقُوهُم مِّنْهُ وَقُولُواْ لَهُم قَوْلًا مَّعْرُوفًا
অর্থ: "আর সম্পত্তি বণ্টনকালে (ওয়ারিশ নয় এমন) নিকটাত্মীয়, ইয়াতীম এবং অভাবগ্রস্ত লোক উপস্থিত থাকলে তাদেরকে তা থেকে কিছু দিবে এবং তাদের সাথে সদালাপ করবে।" (সূরা নিসা ৪:৮)

অসিয়ত এই ধরনের মানবিক ও নৈতিক দায়িত্ব পালনের একটি সুযোগ করে দেয়, যেখানে ফারায়েজের সরাসরি প্রয়োগ নাও থাকতে পারে।


প্রচলিত হাদিসের আপত্তি ও কোরআনের প্রাধান্য: অসিয়তের অবশ্যম্ভাবিতা

কোরআনের সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ অসিয়তকে ঋণ পরিশোধের মতোই একটি পূর্বশর্ত হিসেবে উত্তরাধিকার বণ্টনের পূর্বে স্থাপন করেছে। কোরআনে অসিয়ত কাকে করা যাবে বা কাকে করা যাবে না, সে সম্পর্কে কোনো বিধিনিষেধ আরোপিত হয়নি। অর্থাৎ, কোরআন অনুযায়ী ওয়ারিশদের জন্যও অসিয়ত করা যায়, যদি মৃত ব্যক্তি তা প্রয়োজন মনে করেন।

তবে, প্রচলিত হাদিসে একটি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পাওয়া যায়:

অনেক হাদিসে বলা হয়েছে যে, ওয়ারিশদের জন্য কোনো অসিয়ত নেই (لا وصية لوارث)। এই মর্মে একটি প্রসিদ্ধ হাদিস হলো, রাসূলুল্লাহ (সা.) বিদায় হজের সময় বলেছেন: "নিশ্চয়ই আল্লাহ প্রত্যেক হকদারকে তার হক দিয়েছেন। সুতরাং কোনো ওয়ারিশের জন্য কোনো অসিয়ত নেই।" (তিরমিজি, আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ)। এই হাদিসটি মুসলিম আইনশাস্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হিসেবে গৃহীত হয়েছে, যেখানে বলা হয় যে, মৃত ব্যক্তি তার সম্পত্তির এক-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত ওয়ারিশ নন এমন ব্যক্তিকে অসিয়ত করতে পারবেন, কিন্তু ওয়ারিশদের জন্য আলাদা করে অসিয়ত করতে পারবেন না; তারা কেবল ফারায়েজের নির্ধারিত অংশই পাবেন।


কোরআনের প্রাধান্য ও কথিত হাদিসের ভূমিকা:

এখানে কোরআনের সুস্পষ্ট নির্দেশনার সাথে প্রচলিত হাদিসের এই বক্তব্যের একটি সুষ্পষ্ট বৈপরীত্য দেখা যায়। কোরআনে "ن بَعْدِ وَصِيَّةٍ يُوصِي بِهَا أَوْ دَيْنٍ" (যে অসিয়ত সে করেছে তা কার্যকর ও তার ঋণ পরিশোধ করার পর) বারবার উল্লেখ করা হয়েছে, কিন্তু কোনো আয়াতে ওয়ারিশদের জন্য অসিয়ত নিষিদ্ধ করার কথা বলা হয়নি। কোরআন তার প্রতিটি নির্দেশনায় স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং সুস্পষ্ট। কোরআনের নির্দেশ কোনো হাদিস দ্বারা পরিবর্তন, বাতিল বা সীমিত হতে পারে না, কারণ কোরআন নিজেই আল্লাহর কিতাব এবং এর বিধান চূড়ান্ত।

যদি হাদিসের বক্তব্যটি কোরআনের বিপরীত হয়, তবে কোরআনের সার্বভৌমত্ব এবং পূর্ণতার ধারণার সাথে তা সাংঘর্ষিক। কোরআন নিজেই তার বিধানকে বিস্তারিত ও পূর্ণাঙ্গ বলে ঘোষণা করেছে। এই কারণে, অনেক চিন্তাবিদ ও গবেষক মনে করেন যে, কোরআনের সুস্পষ্ট নির্দেশনাকে হাদিসের দ্বারা সীমিত করা যায় না। বরং, হাদিসের এই বক্তব্যের একটি বিশেষ প্রেক্ষাপট বা ভিন্ন ব্যাখ্যা থাকতে পারে, যা কোরআনের মূলনীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।


হাদিসের বিধানের কারণে সৃষ্ট সমস্যা:

"ওয়ারিশের জন্য অসিয়ত নেই" – এই হাদিসটির প্রচলিত ব্যাখ্যার কারণে সমাজে কিছু জটিলতা দেখা যায়:

অন্যায়ের শিকার হওয়া: এটি এমন পরিস্থিতির জন্ম দিতে পারে যেখানে একজন অত্যন্ত অভাবী বা অসুস্থ উত্তরাধিকারী, যিনি মৃত ব্যক্তির বিশেষ সাহায্যের উপর নির্ভরশীল ছিলেন, ফারায়েজের নির্দিষ্ট অংশের বাইরে কোনো সহায়তা পান না। এতে পরিবারে অন্যায় ও অসন্তোষ সৃষ্টি হতে পারে।

সম্পত্তির অপচয়: যদি কোনো অযোগ্য বা দায়িত্বজ্ঞানহীন উত্তরাধিকারী ফারায়েজের মাধ্যমে বিপুল সম্পত্তি পায় এবং মৃত ব্যক্তি তাকে অসিয়তের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারেন, তবে সেই সম্পত্তি অপচয়ের শিকার হতে পারে।

ইসলামের সুনাম ক্ষুণ্ন হওয়া: যখন ফারায়েজের কঠোর প্রয়োগের কারণে পরিবারের দুর্বল সদস্যরা বঞ্চিত হন, তখন outsiders (অমুসলিমরা) ইসলামকে "অনমনীয়" বা "অমানবিক" বলে চিত্রিত করতে পারে, যা ইসলামের উদার ও ন্যায়ভিত্তিক চরিত্রকে ভুলভাবে উপস্থাপন করে।


কোরআনের সম্পত্তি বণ্টনের নির্দেশনা মানলে কেন তা উপকারী:

কোরআনের নির্দেশিত পথে অসিয়তকে যদি ফারায়েজের পূর্বশর্ত হিসেবে যথাযথভাবে পালন করা হয়, তবে তা সমাজের জন্য অত্যন্ত উপকারী হবে:

সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে: প্রয়োজন অনুযায়ী সম্পদ বণ্টনের সুযোগ থাকায় পরিবারের প্রতিটি সদস্যের হক সুষমভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে।

দুর্বলদের সুরক্ষা: অসহায়, অসুস্থ, বা অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল আত্মীয়-স্বজনরা বঞ্চিত হবেন না, বরং মৃত ব্যক্তির প্রজ্ঞাপূর্ণ অসিয়তের মাধ্যমে তাদের প্রয়োজন মেটানো সম্ভব হবে।

সম্পত্তির সঠিক ব্যবস্থাপনা: সম্পদের অপচয় রোধ হবে এবং তা যোগ্য হাতে পরিচালিত হয়ে দীর্ঘমেয়াদী সুফল বয়ে আনবে।

ইসলামের প্রকৃত চিত্র উন্মোচন: কোরআন যে একটি সামগ্রিক, মানবিক ও ন্যায়বিচারভিত্তিক জীবনবিধান, তা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হবে।


সমাপ্তি

কোরআনের বিধান যে সমাজের সবার জন্য হিতকর, তা তার সম্পত্তি বণ্টনের নীতিমালায় স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়। অসিয়ত (উইল) এবং ফারায়েজ (উত্তরাধিকার আইন) দুটিই কোরআনের অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা একত্রিতভাবে একটি সুষম ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনে সহায়ক। "কুতিবা" শব্দের মাধ্যমে অসিয়তকে রোজার মতোই আবশ্যকীয় ঘোষণা করে কোরআন মুসলিমদেরকে এক মহান দায়িত্ব অর্পণ করেছে। এই দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে শুধু মৃত ব্যক্তির আত্মাই শান্তি পাবে না, বরং তার রেখে যাওয়া পরিবারও একটি সুসংগঠিত ও কল্যাণকর জীবনের অধিকারী হবে। আসুন, আমরা কোরআনের এই পূর্ণাঙ্গ নির্দেশনাকে যথাযথভাবে বুঝি এবং তা মেনে চলি, যাতে সমাজে ন্যায়বিচার ও সুসম্পর্কের ভিত্তি আরও মজবুত হয়।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুন, ২০২৫ দুপুর ১২:৪৭
৬টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×