"শিরোনামখানি ধার করলাম প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের কাছ থেকে তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্যস্বরূপ"
আলম সাহেবের মেজাজ এখন সপ্তমে। রশীদা মেয়েকে স্কুল থেকে আনতে গেছে, এখনো ফিরেনি। স্কুল ছুটি হয়েছে অনেক আগেই। নিশ্চই আসরে বসে গেছে। ঘরে তিনি আর তার দুই ছেলে। আবীর-সাব্বির আড়াই বছরের বড় ছোট। আবীর ক্লাস ফাইভ আর সাব্বির থ্রীতে। এরা পড়ালেখায় মন্দ না। কিন্তু অসম্ভব ডানপিঠে। একদণ্ড শান্তিতে বসবেনা কোথাও। রুমা, আলম সাহেবের বড় মেয়ে। আবীরের একবছরের বড়। ভাইদের ঠিক উলটো। আলম সাহেবের মনে হয় মেয়েটা হয়েছে বোকার হদ্দ। ঠিক মায়ের মতো। ছেলে দু’টো আজ তাড়াতাড়ি ফিরেছে। কোন শিক্ষক নাকি মারা গেছে তাই স্কুল ছুটি। আরে মানুষ হয়ে জন্মেছে তো মরবেই। তাতে কি স্কুল ছুটি দিতে হবে নাকি। রশীদা এদের খাইয়ে বের হয়েছে। আর বজ্জাত গুলো খেয়ে মাত্র বারান্দায় গিয়ে দাপাদাপি শুরু করেছে।
সকাল থেকে দাতেঁর ব্যথায় অস্থির। তাই আজ দোকানেও যাওয়া হয়নি। বারোয়ারি দোকান একদিন বন্ধ থাকলেও অনেক ক্ষতি। খিদেও পেয়েছে খুব। রশীদা যাওয়ার আগে হাতের কাছে পাতলা সুজি দিয়ে গেছে। একচামচ মুখে দিয়েছিলেন, চিনি হয়নি। এই মহিলার চুলে পাক ধরলো তাও আন্দাজ ঠিক হলোনা। বিরক্তি কাটানোর জন্য পত্রিকাটা হাতে নিলেন। পত্রিকা পড়াও আরেক জ্বালা। দু’লাইন লিখে বাকি অংশ অমুক পাতায় তমুক কলামে। আজকের মূল খবর বিরোধী দলগুলোর হুমকি – সরকার নাকি উপড়ে ফেলা হবে। সরকার কি আম-কাঠাঁলের গাছ যে উপড়াতে হবে।
পত্রিকায় মন বসাতে পারছেন না। আজ মনে হয় গরম একটু বেশি পড়েছে। ফ্যানের বাতাসেও কাজ হচ্ছেনা। ছেলে দু’টোর চেঁচামেচি কানে লাগছে খুব। একবার ভাবলেন ধমক দিয়ে আসবেন নাকি। আবার ভাবলেন, না থাক। ছেলেগুলো চার দেয়ালের বাইরে কোথাও তো যেতে পারেনা। এই বয়সে তাকে তো ঘরেই পাওয়া যেতোনা। বিরোধী দলের হুমকির বাকি অংশ সাত নম্বর পাতায়। তিনি সাত নম্বর পাতাটাই খুঁজে পাচ্ছেন না। কি অদ্ভুত ব্যাপার।
এই সময় সাব্বিরের গগনবিদারী চিতকার শোনা গেল। চট করে রক্ত চড়ে গেল আলম সাহেবের মাথায়। এদিক-ওদিক তাকিয়ে যুতসই একটা লাঠি পেয়ে গেলেন। ছুটে বারান্দায় বের হয়ে আসলেন। আবীর দেয়ালের সাথে ঠেঁসে ধরেছে সাব্বিরকে। আর সাব্বির ষাঁড়ের মত চেচাঁচ্ছে। দিশেহারার মতো পেটানো শুরু করলেন আবীরকে। আবীর দু’হাত দিয়ে ঠেকানোর চেষ্টা করছে আর কি যেনো বলছে। আলম সাহেব পাগলের মত লাঠি চালাচ্ছেন। তার কানে কিছু ঢুকছেনা। সাব্বির দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে চোখ বড় বড় করে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। আলম সাহেব একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেছেন। হঠাত ঘোর কেটে গেলো। আবীর মাটিতে বসে পড়েছে। হাত-পা থেকে রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে। আলম সাহেবের চোখ গেল হাতের লাঠির দিকে। লাঠির একপাশে ছোট ছোট অনেকগুলো পেরেক।
কি আজব দৃশ্য! ভরদুপুরে মধ্যবয়স্ক এক লোক রাস্তায় পাগলের মত দৌড়াচ্ছেন। তার কোলে দশ-এগারো বছরের এক বালক। পেছন পেছন ছুটছে সাত-আট বছরের আরেক বালক। আলম সাহেব ছুটছেন। তিনি জানেন না কোথায় যাচ্ছেন। একজন ডাক্তার খুব দরকার তার। তার চোখ জলে ঝাপসা হয়ে আসছে। কিছু দেখতে পাচ্ছেন না তিনি।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জানুয়ারি, ২০১৩ সকাল ১১:৫১