somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দিগবিদিক-২ @ মুন্সীগঞ্জ

২৬ শে মার্চ, ২০১৩ রাত ১২:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

গতবার ছিলাম টেম্পোর হেলপার। আজ হেলপারকেই হেল্প করতে হল। অর্ধচন্দ্রের জোৎস্নানাতে হেডলাইটবিহীন টেম্পো আর উন্মুক্ত আকাশের নিচে বাসের ছাদে চেপে ঢাকায় ফেরা পুরো ভ্রমণটায় বোনাস আনন্দ যোগ করল।

কথায় আছে শেষ ভালো যার সব ভালো তার। তাই শুরুটা বোধহয় ইচ্ছে করেই ভালো হলো না। ইতিহাসের ধারা বজায় রেখে কয়েক জনের মিষ্টি ঘুম ত্যাগ করা সম্ভব হয়নি। অতএব গুলিস্তানে যখন রাজধানী হোটেলে সকালের নাস্তা শেষ করলাম ঠিক তখনই চতুর্থ ও শেষ যাত্রাসঙ্গী হয়ে যোগ দিলো হাসান সাহেব। এর আগেই হাতিরপুল থেকে রিজু এসে পৌঁছে গেছে। আর সকালবেলার পাখি হয়ে রকিব বাড্ডা থেকে রওনা দিলে, আবুল হোটেল থেকে আমরা একসাথে গুলিস্তান পৌঁছে গেছি সবার আগে।
এরপর আমাদের গাইড একটুকরো কাগজ, যাতে লেখা সব তথ্যের উৎস ইন্টারনেটের কয়েকটা ট্রাভেল সাইট আর ব্লগ। লোকজনের কাছে মহাউৎসাহে ও আত্মবিশ্বাসের সাথে যতবারই গাইড অনুসারে বাসরুটের নাম বলি সকলেই গন্তব্য আর বাসরুটের নাম শুনে থ। কেউ কেউ আবার বেশ দু’কথাও শুনিয়ে দিলো। বুঝলাম হয় পোস্ট মিসটেক নতুবা আমার কপি মিসটেক। তবে যাই হোক যেহেতু মুন্সীগঞ্জই যাবো, তাই সর্বাধিক ভোটে নির্বাচিত কুসুমপুর পরিবহনে চেপে রওনা হলাম। গাইডে উল্লিখিত তথ্যের সাথে বাস রুট ও ভাড়ার বিপুল গরমিল তখন ইন্টারনেট-এর তথ্যসংগ্রহকারীকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিয়েছিলো। তবে আমি তাকে ক্ষমা করে দিতে বাকি সঙ্গীদের অনুরোধ করব। কারণ ইন্টারনেট এ প্রকাশিত তথ্যের দায়িত্ব প্রকাশকারীর, আমার কেনো হবে? বুঝতে পারলে কারো দ্বিমত থাকার কথা নয়।
গাইড অনুযায়ী মুক্তারপুরব্রীজ পার হওয়ার সাথে সাথেই বাস থেকে নেমে গেলাম। শনিবার থাকা সত্ত্বেও রাস্তার পরিস্থিতি আর বাসের অবস্থা বাস ভ্রমণে বেশীক্ষণ আগ্রহী করলো না। কিন্তু আমরা যেমন নুতন, কেনো জানি মুক্তারপুরের দোকানদার আর রিকশাওয়ালারাও আশ্চর্যজনকভাবে নুতন। বাস থেকে নেমে যারেই বলি সেই ইদ্রাকপুর কেল্লা বা দুর্গ চিনে না। মাঝে ইদ্রাকপুর ফোর্ট বলে ফেলায় কয়েকজনকে বিশাল ঝামেলায় ফেলে দিচ্ছিলাম। শেষমেষ এক ব্যাটারীচালিত অটোতে উঠে বসলাম। ক্ষীণ আশা সে আমাদের ইদ্রাকপুর পৌঁছিয়ে দেবে। কিন্তু ইদ্রাকপুর পেরিয়ে নামলাম মুন্সীগঞ্জ সদরে। কয়েকজনকে জিজ্ঞ্যেস করে বুঝলাম শহরে কেল্লা একটাই, তার নাম মুন্সীগঞ্জ কেল্লা। কি করা, এ-লোক ও-লোক ধরে যখন কেল্লায় পোঁছালাম তখন থতমত খেলাম। বুঝলাম না হঠাৎ এর নাম পরিবর্তন হলো কেমন করে।



গেট দিয়ে ঢুকতেই ছোট্ট একটা পুকুর। তার পাড় দিয়ে হেঁটে সিঁড়ির সামনে দাঁড়ালাম। গাইডের ভরসায় বিজ্ঞের মতন বাকিদের বলছিলাম আমরা একটা দীর্ঘ সিঁড়িতে উঠতে যাচ্ছি। কিন্তু সিঁড়ির সামনে দাঁড়িয়ে মনে হলো আধুনিক ক্যামেরার জন্য বিজ্ঞানকে আবার বাহবা দেই। যেই সিঁড়ি ছবিতে দেখতে ৫০/৬০ ফিট উঁচু মনে হচ্ছিলো তা আসলে ২০ ফিট। তবে সিঁড়ির অবাস্তব উচ্চতা বর্তমান দুর্গের সৌন্দর্য্যের উপর কোনো প্রভাব ফেলে না। ষষ্ঠ মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে বাংলার শাসক ও সেনাপতি মীর জুমলা ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে এই দুর্গটি নির্মাণ করেন। ঢাকার নৌপ্রবেশ পথের মুখে ইছামতি ও মেঘনা নদীর সঙ্গমস্থলে এই দুর্গটি গুরুত্বপুর্ণ ছিলো। অথন সব মোঘল অভিযাত্রীরা রাজমহল থেকে পাবনার শাহজাদপুর হয়ে ইছামতী নৌপথে মেঘনা দিয়ে ঢাকা আসত। মগ, পর্তুগীজ ও অহোম আক্রমণকারীরাও এই পথ ব্যবহার করত। দুর্গের সিঁড়ি বেয়ে উপড়ে উঠেই টাশকি। চৌচালা বাড়ি, তার আবার প্লাস্টার করা দেয়াল। পরে জানলাম ব্রিটিশ শাসনামলে দুর্গের উপরের অংশে নিরাপদে থাকার ঠাঁই করে নিয়েছে ইংরেজরা। তারই অবশেষ এই দেয়াল আর চৌচালা। ভেরী আকৃতির কেল্লার চারপাশে ফটকের পর বৃত্তাকারে ৬৬ টি খিলান আকৃতির প্রতিবন্ধক দেয়াল। যার প্রতিটিতে সৈন্যদের বন্দুক রাখার জন্য খোপ আছে। প্রত্যেকটি খোপ আবার চারভাগে ভাগ করা। ডান দিক দিয়ে একটি সিঁড়ি নেমে গেছে ভেরীর ভেতরের ব্যসার্ধ দিয়ে। শুনেছি আগে দুপাশে দুটো সিঁড়ি ছিলো। বাম পাশেরটা দেখতে পেলাম না। ইংরেজ বাবুরা সেটাকে বাড়ির তলায় নিয়ে নিয়েছেন বোধহয়। যাই হোক, ক্যামেরা যেহেতু আছে তাই তার সদ্ব্যবহারও করতে হবে। খিলানের উপর দাঁড়িয়ে, বসে ছবি তোলা শুরু হলো। হাসান ভাই তথা সাসিসের আবার উচ্চতা ভীতি। তাকে ছবি তোলার জন্য খিলানের উপর দাঁড় করাতে কম বেগ পেতে হলো না।
সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসে বাম দিকে দেখলাম একটি স্তুপ। এটা নাকি আগে দুর্গের সুড়ঙ্গ পথের মুখ ছিলো। ইট সুরকি দিয়ে বুজে দেয়ায় এখন স্তুপ আকৃতি ধারণ করেছে। জেলখানার পুরোনো দালান দেখতে পেলেও সেখান প্রবেশের অনুমতি পেলাম না।
দুর্গ আর জেলখানার চতুর্ভুজাকৃতির বলয় থেকে বেরিয়ে এসে সিপাহীপাড়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। সিপাহীপাড়া যাবার পথে প্রায় বাড়ির উঠোনে দেখলাম সুতো’র কাজ হচ্ছে। রঙ্গিন সুতো গুলো এদিক হতে ওদিক টানা দিয়ে অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য তৈরী করেছে।



আমাদের অটো চালক নিজ উদ্যোগে রিকাবীবাজারে হযরত বাবা আদম শহীদ (রঃ) এর মসজিদে পৌঁছে দিলেন। মাজার দালানের পুনঃসংস্কার কাজ চলছে। তাই মসজিদেই চলে গেলাম।
হযরত বাবা আদম ১১৭৩ খৃষ্টাব্দে মুন্সীগঞ্জে আসেন। তিনি শহীদ হন ১১৭৮ খৃষ্টাব্দে। অনেকে বলেন, বল্লাল সেনের হাতে তিনি শহীদ হন। গরুর মাংস মন্দিরের সম্মুখে ফেলার কারণে নাকি তিনি হিন্দুদের কোপানলে পড়েন। তারা বল্লাল সেনের কাছে অভিযোগ আনলে বল্লাল সেন তাঁকে হত্যার আদেশ দেন। তিনি নামাজ পড়া অবস্থায় তখন বল্লাল সেনের সৈন্যরা তার শিরচ্ছেদ করে। কথিত এই কথার সত্যতা কতটুকু তা জানি না।
মসজিদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল এর ছয়টি গম্বুজ। তাই এটি ছয়গম্বুজ মসজিদ নামেও পরিচিত। সুলতান জামালউদ্দিন ফতেহ শাহ-এর শাসনামলে মালিক কাফুর কর্তৃক ৮৮৮ হিজরি মোতাবেক ১৪৮৩ খৃষ্টাব্দে মসজিদটি নির্মিত হয়। মসজিদটি দেখতে ছোট সোনা মসজিদ এর আদল পাওয়া যায়। তবে ছোট সোনা মসজিদ এর মত বড় নয়। পিছনের দোতালা বাড়ির ছাদে উঠে দেখলাম গম্বুজ ছয়টি অক্ষত আছে। ভিতরের মিরহাব এর চারপাশে অনেক সুন্দর ও যত্ন করে কারুকাজ করা। নামাজের সময় হয়ে যাওয়ার সুবাদে ভ্রমণসঙ্গীরা নামাজ পড়ে নিলো। আর আমি বাইরের চারপাশ ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম। দেখলাম প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর মসজিদের চারপাশে নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরী করেছেন, কিন্তু নান্দনিকতার বেষ্টনী রক্ষা করতে পারেন নি। মসজিদের বেষ্টনীতে আসেপাশের বাসিন্দাদের নারীপুরুষ নির্বিশেষে প্রয়োজনীয় ও অতি প্রয়োজনীয়, প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত পোশাকের রোদ্রস্নান করতে দেখে একই সঙ্গে লজ্জা ও সঙ্কোচ বোধ হচ্ছিল। যাই হোক, মসজিদের স্থাপত্যশৈলীতে মনোনিবেশ করি।



নামাজ শেষে মসজিদের ভেতরে কিছু ছবি তোলা হলো। মসজিদের ভেতরে কেবল দুইটি পাথরের স্তম্ভ। পাথর দুটি কিভাবে কোত্থেকে আনা হয়েছিলো তা এক বিস্ময়। বাইরের চা দোকানদার যার বয়স বেশী হলে ১৫ বছর, তার মতে এই স্তম্ভ দুটির একটি গরম, অপরটি ঠান্ডা ছিলো। ঠান্ডা স্তম্ভটির গা বেয়ে পানি পড়ত। এবং পরে বিভিন্ন পর্যটক আসার কারণে তা বন্ধ হয়ে গেছে।


মালাই চা খেতে খেতে আমরা গল্প শুনছি আর মুচকি মুচকি হাসছি। পর্যটক আসার কারণেই কর্তৃপক্ষ সংস্কারের উদ্যোগ নেয়। তখনই হয়ত স্তম্ভের উপরে সংস্কার করে ছাদ থেকে পানি পড়া বন্ধ করা হয়। তবে যতটুকু জেনেছি ব্রিটিশ আমলেই মসজিদটি কেবল একবার সংস্কার করা হয় যখন এর দুটি গম্বুজ ভেঙ্গে পড়ে।

এরপর গন্তব্য পন্ডিতের ভিটা, বজ্রযোগিনী গ্রাম। কিন্তু সিপাহীপাড়া এসেই মনে হলো দুপুরের খাবার খেয়ে নেয়া দরকার। উপরন্তু সরকার তার ক্ষিদের কথায় সকলের মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন। পাশাপাশি দুটো দোকান থেকে মাছের তরকারি বিশিষ্ট একটা দোকান বেছে নিলাম। তাছাড়া দোকান পছন্দ হওয়ার আরেকটি বিশেষ কারন ভর্তা। খাবার মেনু- সাসিস এর জন্য গরুর গোশত আর আমাদের জন্য চাপিলা মাছ। ভর্তা বোনাস। খাবার খুবই ভালো লাগার কারণে হয়তো ছাপড়া দোকানদার তার দোকানের ৭২ টা শাখা থাকার দাবি তুললেও সরকার কোনো উচ্চবাচ্য করেন নি। তৃপ্তি করে খাওয়ার পর ভোজন রসিক হবার কারণে মিষ্টি খেতে চাওয়াটা কোনো অপরাধ হতে পারে না। কিন্তু সাটুরিয়া ঘটনার পর এই ইচ্ছেটায় আমার বাকি ভ্রমণ সঙ্গীরা আমায় টেনে অটোতে তুলে নিলো।
অটো থেকে নেমে রিকশায় চেপে পন্ডিতের ভিটা। পন্ডিতের ভিটা’র পথে যেতে যেতে হরিশচন্দ্রের দীঘি আর রামপালের দীঘি’র বর্ণনা শুনলাম। কিন্তু সময় আর পিছনে ফিরে যেতে হবে বলে ঐ দুটো আরেকদিনের জন্য রেখে দিলাম।



বজ্রযোগিনী গ্রামে এখনো অনেক পুরোনো ভিটে বাড়ি দেখলাম। অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞান বজ্রযোগিনী গ্রামে পিতা কমলশ্রী ও মা প্রভাবনীর আদর যত্নে বড় হয়েছিলেন। বর্তমানে জনৈক লতিফ শেখ পরিবারবর্গ নিয়ে সেখানে থাকেন। অতীশ দীপংকর বাংলাদেশের বৌদ্ধ শাস্ত্রের বড় পন্ডিত ছিলেন। তিনি প্রথম মহীপালের শাসনামলে বিক্রমশীলা (বর্তমান ভাগলপুর, বিহার) বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ ছিলেন। চীনে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারে তার অনেক অবদান ছিলো। পাশেই তাঁর নামানুসারে অডিটোরিয়াম। ইতিহাসের এই কাঠখোট্টা জিনিস আমাদের স্পর্শ করলেও আমাদের রিকশাওয়ালা কিন্তু মহা বিরক্ত। তার বক্তব্য “দেখতে আসছেন দেখবেন সুন্দর জিনিস, এইসব পুরান জিনিস দেখার কি দরকার।”

এই এলাকায় যানবাহনের নিশ্চয়তা কম। রিকশাওয়ালা ছেড়ে গেলে বেশ কিছুদুর হাঁটতে হবে। আর আমাদের পরবর্তী গন্তব্যে যেতে হলে হয় সিপাহীপাড়া ফিরে যেতে হবে নুতবা এই রিকশা চেপেই এগিয়ে যেতে হবে।

অতএব রিকশাওয়ালার আগ্রহে চলে এলাম এক এম পির বাড়ি। ধারণা ছিলো “লাল নীল বেগুনী, বাঘ সিংহ দেখিনি” টাইপের এক দালান দেখবো। কিন্তু বাড়ির ভেতর ঢুকে বেশ অবাক হলাম। তার রুচিবোধের প্রশংসা করতেই হবে। ছিমছাম বাড়ি, পেছনে বেশ কিছু জায়গা ছেড়ে দেয়া। পুকুরপারটাই সবচে সুন্দর। ঘাটে বসে পানকৌড়ি আর মাছরাঙার মাছধরা দেখতে দেখতে সরকারও খালি হাতে মাছ ধরতে হাঁটূ পানিতে নেমে গেলো। বেশ কিছুক্ষন শান্ত পানির ধারে সময় কাটালাম।

রিকশাওয়ালারা আমাদের ছেড়ে চলে গেছে বহূ আগেই। পুকুর পার থেকে মাঝে মাঝে লোকাল অটো চলে যাওয়ার শব্দ পাচ্ছিলাম। একটা যায় আর আমার সাথে সরকার সাহেবের তর্ক- এটা তিন নম্বর না, এর আগে ছয়টা গেছে, এটা সাত নম্বর। বাকিরা নীরবে হাসতে থাকে।

এখান থেকে আমরা যাবো সোনারং জোড়া মঠ। তারপর বি. বাড়িয়া ভিটা। কিন্তু এম. পি-এর বাড়ির সামনে থেকে যানবাহন পাওয়া সহজ হবে না ধারণা ছিলো। তাই আমরা হাঁটা শুরু করলাম। হঠাৎ ভটভটির আওয়াজ। পেছনে ফিরে দেখি ফসলবহনকারী লম্বা ভটভটি আসছে। মীনার বুদ্ধি নামে একটা কার্টুনে এই ধরনের ট্রাক্টর দেখানো হয়েছিলো। আমাদের আর পায় কে? চারজন হুড়মুড় করে তাতে চেপে বসলাম।
গ্রামের পথে এই ভটভটি ভ্রমণ অনেকটা স্বপ্নপুরণের মতন। এই ধরণের যাত্রা এটাই প্রথম নয়, তবে এই ছোটখাট অংশগুলোই একটা ভ্রমণকে সম্পুর্ণ করে তোলে। তখনো তো জানতাম না আরো কি অপেক্ষা করে আছে।

টঙ্গীবাড়ী নেমে লোকাল অটোতে চেপে জোড়া মঠে পৌঁছালাম। এর ইতিহাস তেমন কিছু জানি না। তবে বর্তমান বর্ণনা, তা তো দিবোই। খালি পাখি আর পাখি। এই মঠের গায়ে অসংখ্য খোপ, আর তাতে পাখি।



প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে নেই বলেই আশেপাশে ঝোপঝাড়। অনেক পুরোনো ও সংস্কার কাজের অভাবে বেশ কিছু অংশ ভেঙ্গে পরেছে। কিছুদিন আগে একসাথে চারজন ছেলে উপরে উঠে ছবি তোলার সময় ছাদের এক অংশ ভেঙ্গে পড়ে। এই তথ্য পেলাম এক তরুণের কাছে, সরকার (রিজু সরকার নয়) নাকি তাকে দায়িত্ব দিয়েছেন এর দেখাশোনা করার জন্য। তবে তরুণটি এই পুরাকীর্তি দেখা ছাড়াও যে এর বাসিন্দা পাখিদের ধরে বিক্রি করে তাও জানতে পারলাম। বেটার পাখিধরা দেখতে পারলে বেশ হতো। আমরা অবশ্য ততক্ষনে প্রয়োজন মোতাবেক ক্যামেরায় ক্লিক দিয়ে নিয়েছি।

তার পরামর্শে আমরা আউটশাহীর মঠ দেখবো মনঃস্থির করলাম। পেছনে গিয়ে বি. বাড়িয়া ভিটে দেখার সময় হবে কিনা সন্দিহান। উপরন্তু আলো থাকতে থাকতে আমদের সিরাজদিখান হয়ে মাওয়া যাবার ইচ্ছে। ইলিশ খাবো।

পাখিচোর তরুণের পরামর্শে আমরা গেঁয়োপথে হাঁটা ধরলাম। হাঁটছি আর হাঁটছি। পথিমধ্যে মনেও হলো ধাপ্পা খেলাম নাতো। কিন্তু প্রায় বিশ মিনিটের মাথায় সেগুনতলা সড়ক দেখে নিশ্চিত হলাম। সেখান থেকে আবার লোকালে চেপে আউটশাহীর উদ্দেশ্যে যাত্রা। পথিমধ্যে সানেমান্দা পুকুর দেখলাম। কোন রাজার আমলে তা জানতে না পারলেও এর কিছু আঞ্চলিক গুরুত্ব ছিলো বটে। ঘাটে নুতন বর বা কনের জন্য পানি নেয়া হত। কিন্তু কেনো তা বুঝলাম না। গাড়ির চালক অবশ্য রাজ্জাক ও সুচরিতা(সম্ভবত) অভিনীত এক সিনেমার দৃশ্যের বর্ণনা দিলেন। তারসাথে এই সানেমান্দা পুকুরের সম্পর্ক আরেকদিন বের করব।
আউটশাহীর মঠের চুড়া দূর থেকে সোনারং জোড়া মঠ-এর মতনই। তবে সোনারং-এ জোড়া মঠ। আর মুন্সীগঞ্জে অন্য কোনো জোড়া মঠ নেই। আউটশাহী মঠও পাখিদের আড্ডাখানা। দ্বীপের মধ্যে জেগে থাকা মঠে পৌঁছাতে কয়েক বাড়ির দাওয়ার উপরেও হাঁটতে হলো। এ মঠের কোনো ভিত বা মঞ্চ নেই। স্থাপত্যের অভিধানে ইংরেজিতে যাকে বলি পোডিয়াম। সোনারং এর জোড়া মঠ এ কিন্তু দুটোরই পৃথক ভিত ছিলো। দুঃখজনক এখানেই আমাদের ক্যামেরা হঠাৎ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল।



আউটশাহী থেকে বেরোতে হলে আমাদের কুন্ডের বাজার যেতে হবে। সেখান থেকে আমরা ঢাকার বাস পাবো। অটোতে চেপে রওনা দিলাম। জীবনে মনে হয় এর বেশি কোনোদিন অটোতে চাপতে দেখিনি, নিজে যাত্রী হয়ে তো নয়ই। চালক সহ ১১ জন। একটু পরিষ্কার করে বলি, ব্যাটারী চালিত যেসকল অটো আমরা দেখি যাতে সর্বসাকুল্যে ৯ জন চাপলেই গাড়ির দম বেড়িয়ে আসে তাতে আমরা ছিলাম ১১ জন। হিন্দী সিনেমা “ভাগম ভাগ” এর একটি দৃশ্যের কথা মনে পড়ছিলো। যখন নায়িকা খুঁজতে ট্যাক্সীতে পুরো একটা মাতাল গ্যাং উঠে পরে।

কুন্ডের বাজার যেতে যেতে খবর নিলাম সেখানেও একটা মঠ আছে। সুর্য তখন নিভু নিভু, তবে শেষ আলোটুকুও নষ্ট না করে বিল পাড় হয়ে চলে গেলাম মঠে। এই একটা মঠ যা এখনো পরিত্যক্ত হয় নি। আমরা যখন পৌঁছালাম গ্রামের একজন উপাসিকা ঠিক তখনি তার প্রার্থনা শেষ করে লোহার গেট বন্ধ করছেন। ভিতরে সাদা রঙ করা হয়েছে সম্প্রতি। মঠের ভেতরে আছে একটি শিবলিঙ্গ ও ত্রিশূল। দেয়ালে কৃষ্ণের ছবি। এই মঠটাই সবচেয়ে ঝুঁকিপুর্ণ। ভগবান আর কয়দিন এর দায়িত্ব নিবেন, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরেরই বোধহয় সময় এসে গেছে। কুন্ডের বাজার রাস্তায় উঠে হয় ট্রাক নতুবা বাসের ছাদে উঠবো এই প্রতিজ্ঞায় একের পর এক ট্রাক থামাবার চেষ্টা করতে লাগলাম। ততক্ষনে আকাশে চাঁদের রাজত্ব। কিন্তু কোনো ট্রাক চালককেই বশে আনতে পারলাম না। আর বাসের ছাদে বা ভিতরে তিলমাত্র জায়গা নাই। উপায় না দেখে এক সি.এন.জি এর সহায়তায় নিমতলা পৌছালাম। এখানেও একই অবস্থা। কিন্তু মৌমাছি ঠিক মধুর খোঁজ পায়। আমি আর রকিব মিষ্টির দোকান খুঁজে বের করলাম। দুপুরের অপুর্ণ ইচ্ছাটাও অপুর্ণ রইলো না।
কিন্তু ইচ্ছাপুরণের সাথে সাথে ঢাকাও ফিরতে হবে। সিরাজদিখান যাবে শুনে একটা টেম্পোতে উঠে গেলাম। জানতাম না জীবনের ভয়াবহ এক যানে চড়ছি।

টেম্পোর হেডলাইট নেই। চালক হাতের টর্চলাইটটা জ্বালিয়ে মাঝে মাঝে রাস্তা দেখছে, আর অর্ধ গোলাকৃতির চাঁদমামা হাসছেন আমাদের দুরঃবস্থা দেখে। টেম্পোর ছাদের কাপড়খানাতে কয়েকটি ছিদ্র। যা দিয়ে চাঁদের ক্ষীণ আলো আমার হাতের তালুতে পড়ছে। অন্ধকারে চাঁদের আলো, আমি আর টেম্পোর শব্দ। দৃষ্টির সীমানায় কেউ নেই। ১৫ থেকে ২০ মিনিট পর সিরাজদিখান এসে নামলাম। এখানে কিছু দোকান পাট আছে, আছে কিছু সিএনজিও। ঢাকায় যাবার জন্য এক সিএনজি চালককে জিজ্ঞেস করতেই সে ভাড়া চেয়ে বসলো ৪০০ টাকা। শিরদাঁড়ায় ঠান্ডা স্রোত বেয়ে নেমে এলো। বুঝার চেষ্টা করলাম “কতদূর, ঢাকা কতদূর”।

হঠাৎ স্বর্গের রথের মতন উড়ে এলো এক বাস। ভেতরে স্বর্গগামী যাত্রীরা ঠেসে দাঁড়িয়ে। আমাদের সাথেই কয়েকজন যাত্রী ছিলেন। তারাও ঢাকা যাবেন। তারা যেই বলল ছাদে চেপে ঢাকা যাব, ভাড়া দিব ত্রিশ। সেকথা শুনেই সিঁড়ি বেয়ে তড়তড় করে রথের ছাদে সরকার আর রকিব উঠে গেলো। সাসিসকে বাসের ভিতরে ঠেসে দিয়ে আমিও উঠে গেলাম ছাদে। ষোলকলা পুর্ণ। আকাশে চাঁদ, বাসের ছাদ, অনুভুতিটাই রোমাঞ্চকর।
কিন্তু মফস্বল শহরে প্রায় ১৫ফিট উঁচু বাসের ছাদেই গাছের ডালপালা বাড়ি খায়। আর আমার অর্ধ উচ্চতা মিলে প্রায় ১৮ ফিট। বাসওয়ালার চালনা দেখে হ্যারি পটারের নাইট বাস সার্ভিসের দৃশ্য চোখে ভেসে উঠল। কিছুক্ষন পর পর সাবধান বলেই সকলে মাথা নিচু করছি। কেউ কেউ আগ্রহে কিংবা উৎসুক হয়ে একটু আগে মাথা তুললেই গাছের ডালের বাড়ি খাচ্ছে। ভয়ানক যাত্রা। এক মফস্বল শহরের মাঝ দিয়ে যাবার সময় রাস্তার উপর একটা ব্যানার। ব্যানারের দৈর্ঘ্যের আওতায় আমি নেই দেখে সকলকে সাবধান করলাম। সকলে মাথা নিচু করলেও আমি তেমন আমলে নিলাম না। একটা ব্যানারের চারটা কোনাই দড়ি দিয়ে আটকানো থাকে। নিচের দড়িটা ঠিক চোখের সামনে আসার পর টের পেলাম সেটা। মুহুর্তের মধ্যে একটা ঝাঁকি খেয়ে বুঝতে পেলাম চশমা ছিলো তাই রক্ষে। নুতবা চোখটাই হারাতাম, বাস থেকে পড়ে যাওয়াও অসম্ভব ছিলো না। এরপর বিশ্বরোডে উঠা পর্যন্ত যত গাছের ডাল, নুয়ে পড়া বাঁশঝাড় দেখলেই কাঁধের ব্যাগটা ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছি। জীবনে এই যাত্রায় একটা পরম বন্ধু হিসেবে ব্যাগটাকে পেলাম। ব্যাগের কারণে আর তেমন কোনো ভয়াবহ আঘাত লাগেনি। তবে বাঁশঝাড়ের প্রদত্ত সুড়সুড়ি আমার ব্যবহৃত ঢালের আকার স্বল্পতার অবদান নাকি অপারগতা তা এখনো ভেবে চলেছি। তবে এরপর সন্ধ্যার পর আর বাসের ছাদে চাপছি না এটা নিশ্চিত।
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জেনারেল রাও ফরমান আলী ছিল ইন্ডিয়ান 'র'-এর এজেন্ট

লিখেছেন ধূসর সন্ধ্যা, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:২২



জেনারেল রাও ফরমান আলী ছিল ইন্ডিয়ান 'র'-এর একজন এজেন্ট। এই তথ্য কেউ জানতো না। তার ফ্যামিলিও জানতো না। ১৯৪১ সালে বর্ডার ক্রস করে সে ঢুকেছিল পাকিস্তান। তারপর আস্তে আস্তে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বন্ডাইর মত হত্যাকাণ্ড বন্ধে নেতানিয়াহুদের থামানো জরুরি...

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:২৫

বন্ডাইর মত হত্যাকাণ্ড বন্ধে নেতানিয়াহুদের থামানো জরুরি...

বন্ডাই সৈকতের হামলাস্থল। ছবি: রয়টার্স

অস্ট্রেলিয়ার সিডনির বন্ডাই সৈকত এলাকায় ইহুদিদের একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সমবেত মানুষের ওপর দুই অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী অতর্কিতে গুলি চালিয়েছে। এতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমাণ নন বলা কুফুরী

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১৪



সূরাঃ ২ বাকারা, ২৫৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৫৫। আল্লাহ, তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই।তিনি চিরঞ্জীব চির বিদ্যমাণ।তাঁকে তন্দ্রা অথবা নিদ্রা স্পর্শ করে না।আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সমস্তই... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিজয়ের আগে রাজাকারের গুলিতে নিহত আফজাল

লিখেছেন প্রামানিক, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:১৩


ঘটনা স্থল গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি থানার উড়িয়া ইউনিয়নের গুণভরি ওয়াপদা বাঁধ।

১৯৭১সালের ১৬ই ডিসেম্বরের কয়েক দিন আগের ঘটনা। আফজাল নামের ভদ্রলোক এসেছিলেন শ্বশুর বাড়ি বেড়াতে। আমাদের পাশের গ্রামেই তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫৫ বছর আগে কি ঘটেছে, উহা কি ইডিয়টদের মনে থাকে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:৫৮




ব্লগের অনেক প্রশ্নফাঁস ( Gen-F ) ১ দিন আগে পড়া নিউটনের ২য় সুত্রের প্রমাণ মনে করতে পারে না বলেই ফাঁসকরা প্রশ্নপত্র কিনে, বইয়ের পাতা কেটে পরীক্ষার হলে নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×