
গত কয়েকদিনের টানা বর্ষণে সদা সিক্ত ঢাকা শহরের পথঘাটে বের হওয়াটাই দুরুহ ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে। বিজয়নগরের রাস্তার পাশে অসহায়ের মতন দাঁড়িয়ে ছাতা ছাড়া পথে বেড়িয়ে নিজের নির্বুদ্ধিতার ফল ভোগ করছি। মেঘ ঠিকই আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছিলো বটে। শান্তিনগরের মোড়ে দাঁড়িয়ে যখন বন্ধু কানিজের জন্য অপেক্ষা করছিলাম তখনও হঠাৎ রোদ এসে একটা রৌদ্রজ্জল দিনের নিশ্চয়তা দিয়েছিলো। কিন্তু যখন তিনজনে গুলিস্তানের উদ্দেশ্যে রিকশায় চেপে কাকরাইল মোড় পার হলাম সহসা ক্রোধান্বিত আকাশ রঙ বদলাতে শুরু করলো। মুহুর্তের মধ্যে নীল আকাশটা ছাইরঙা হয়ে কালো হতে শুরু করলো। দ্রুত রিকশা থামিয়ে রাস্তার ধারে এক বন্ধ দোকানের ছাদের নিচে আশ্রয় নিলাম। কখন যে বৃষ্টি থামবে, আর আদৌ কি আজ কোথাও যাওয়া হবে?
চলতি সেমিস্টারের ঈদের বন্ধের ডাক পেয়েই পুরোনো দিকবিদিকের নেশাটা শেষ সপ্তাহের দৈনন্দিন রুটিনের ফাঁকফোকরে উঁকি দিয়ে যাচ্ছিলো। বৃহস্পতিবার, পেশাজীবীদের জন্য সপ্তাহের চাঁদরাত, আমার জন্য এক মোসায়েবী সেমিস্টারের মাঝামাঝি দম ফেলানোর অতি উত্তম সুযোগ, ছুটি কাটানোর প্রস্তুতি নিচ্ছি। এমন সময়ে ফোন এলো বন্ধু কানিজের। তিনি তার ঈদের দিনটাকে ( যাহা শুক্রবার) পুরোন ঢাকা ভ্রমণে উৎসর্গ করতে চান। বলাই বাহুল্ল্য যতই প্রিয় হোক না কেনো, এই বর্ষনে পুরান ঢাকার কর্দমাক্ত রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়ানোর ইচ্ছে আমার কোনোমতেই হলো না। কিন্তু তার আহসান মঞ্জিলে যাবার ইচ্ছে। আলোচনা সাপেক্ষে জানা গেলো বিকেল ৩টার আগে আহসান মঞ্জিলে গিয়ে কোনো লাভ হবে না। কিন্তু আমরা চাই যত ভোরে সম্ভব ভ্রমণে বেড়িয়ে পরতে।
তখন চিন্তা এলো সোনারগাঁও যাবো। মধ্যখানে অবশ্য মুন্সীগঞ্জ যাবার প্রস্তাব এমনকি মিরপুর চিড়িয়াখানার বাঘের সাথে সাক্ষাতের সম্ভাবনাও উঠে এসেছিলো। কিন্তু সব ছাপিয়ে সোনারগাঁও স্থির করে সম্ভাব্য বাকিদের সাথে যোগাযোগ করা হলো। যাদের কেউ সকালে মিঠাঘুম সুসম্পন্ন না করে নিশ্চিত করতে পারবেন না। প্রাক্তন দিকবিদিকের ভ্রমণসঙ্গীদের স্মরণ করলাম। বিবাহিত সরকার তার কাছের জনগণের জন্য নির্বাচিত দিনটিকে আমাদের সাথে ব্যয় করবেন কিনা সে সন্দেহে তার সাথে যোগাযোগ করা হলো না। শাহরিয়ার ভাই তার তারাবির নামায হাতছাড়া হতে পারে, আর রকিবের ব্যস্ততা ভ্রমণসঙ্গী তালিকা হতে তাদের বাদ করল। সম্ভাব্য তালিকায় যুক্ত হলো মুক্তাদির সাহেব, আকিভ ও মারজুক। যাদের মধ্যে আবার পারিবারিক ইফতার পার্টির জন্য মারজুক আর মিরপুর স্টেডিয়ামে সশরীরে খেলা দেখার জন্য আকিভ নিজেদের নাম কেটে নিলেন। সকালে যখন সুর্য উঠি উঠি করে প্রায় মাথার উপরে চলেই এসেছেন আমি আর মুক্তাদির সাহেব বেড়িয়ে পড়লাম। শান্তিনগর হতে কানিজসহ তিনজনে রওনা দিয়েই এই বৃষ্টির কবলে। অতি বর্ষণে এই রাস্তার ধারে আমরা একসময় আমাদের চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললাম। যাই হোক, সোনারগাঁও আজ যাবই। তাই বৃষ্টি একটু কমে এলেই আমরা গুলিস্তান পৌছে গেলাম।
কোন বাসে উঠলে সঠিক জায়গায় পৌছুবো সেকথা ভাবার সময়ও ছিলো না। তাই বাসের কন্ডাক্টরকে বিশ্বাস করে একটা বাসে চেপে বসলাম। বাসভাড়া নিলো মাথা প্রতি ২০টাকা। মনে সন্দেহ জাগলো আসলেই কি সঠিক জায়গায় পৌছুতে পারবো? কোনো ভাবেই বাসস্ট্যান্ড এর নামটা মনে আসছিলো না। তাই শাহরিয়ার ভাইকে ফোন করে মোগড়াপাড়া বাসস্ট্যান্ড এর নামটা নিশ্চিত হতেই বুঝতে পারলাম আমাদের পরিবহন তার সর্বোচ্চটুকু দিয়ে চিটাগং রোড এর মাথায় পৌঁছে দিয়েছে। গাড়ি আর যাবে না। আমাদের পরিবহন পাল্টাতে হবে। এদিকে ঝুম বৃষ্টি। বাস থেকে নেমে কোনোরকমে একটা টং এর ছায়ায় আশ্রয় নিয়ে নতুন পরিবহনের খোঁজ করতে করতে দ্রুত একটা সিএনজি পেয়ে তাতে চেপেই রওনা দিলাম সোনারগাঁও এর দিকে।
যখন পৌছুলাম তখন ঘড়িতে সাড়ে বারটা আর অবিশ্রান্ত গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। জাদুঘরের সামনে নেমেই একটা দোকানে লাল কাপড়ে মোড়া হাঁড়ি দেখতে পেয়ে হঠাৎ ভোজনের কথা মনে পড়লো। প্রসঙ্গত, অনিবার্য কারণঃবশত তিনজনের কেউই রোজা ছিলাম না। অতএব পুকুরের উপর ঝুলন্ত রেস্টুরেন্টে তিনজনই বিরিয়ানী দিয়ে ভুড়িভোজন করলাম।
আহার শেষে জাদুঘরের টিকেট কাউন্টারে গিয়ে একটা ব্যপার নিশ্চিত হলাম যে এই বর্ষণে কেবল আমরাই না, আরো গুটি কয়েক বোকা মানুষ আছেন, যারাও ছাতা ছাড়াই ভ্রমণে এসেছেন।
আমাদের ভ্রমণের মূল উদ্দেশ্য প্রাচীন স্থাপত্য ও ঐতিহ্যের সাথে এর সম্পর্ক ইত্যাদি, ইত্যাদি বুঝার চেষ্টা করা। কিন্তু আমি যাই বঙ্গে, পোড়া কপাল সঙ্গে। পুনঃনির্মানের জন্য জাদুঘর প্রাঙ্গণের প্রাচীন দালানটি দর্শনার্থীদের জন্য বন্ধ রাখা হয়েছে। আমরা হতাশ হয়ে জাদুঘরের শরনাপন্ন হলাম। একতলায় বিভিন্ন লোকজ সংস্কৃতি আর ব্যবহার্য আসবাব দেখছিলাম। সঠিক তথ্যের অভাবে জাদুঘরটা খুব একটা আকর্ষনীয় মনে হচ্ছিল না। তার উপরে যতটুকু তথ্য ছিলো তাও অবিন্যস্ত হওয়ায় অল্প কিছুক্ষণেই হাপিয়ে উঠছিলাম। কোনো এক জমিদারের সিন্দুকের গঠন এবং তার ব্যবহার নিয়ে তাও নিজেদের মধ্যে কিছুক্ষন কথা বার্তা হলো।

এক পুরোনো বাড়ির সামনের কাঠ নির্মিত দেয়াল ও তাতে বসানো জানলা বেশ কিছুক্ষন আকর্ষণ করেছিল। দোতলায় ছিলো পাথর আর ধাতব দ্রব্য সামগ্রী। পাথরের আর পোড়ামাটির মুর্তিগুলো বেশ কিছুটা আকর্ষনীয়। তখনকার ধাতব অলংকার সামগ্রী ততকালীন সমাজ ব্যবস্থার ইতিহাস বর্ণণা দিচ্ছিলো। তৃতীয় তলায় ছিলো আমাদের কারুশিল্প নকশীকাঁথা আর বিভিন্ন বাঁশ-বেতের ব্যবহার্য দ্রব্যের প্রদশর্নী।

বিরীয়ানীতে পেটের ক্ষুধা মিটলেও জাদুঘরে মনের ক্ষুধা মিটলো না। তাই একপ্রকার তাড়াহুড়া করেই জাদুঘর থেকে বের হয়ে আসলাম। উদ্দেশ্য পুরোন দালানটিতে যদি একবার ঢুঁ মারা যায়।
বছর দুয়েক আগে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একবার ঘুরতে আসার কারণে এলাকাটা পরিচিত ছিল। ময়ূরপঙ্খী স্টেজ দেখবো বলে ব্রীজ পার হবার জন্য যেই এগোলাম তখন লেকের পানিতে সচল কিছু একটা প্রানী নজর কাড়ল। লেকের পাড়ে ছুটে গিয়ে প্রানীটাকে ভালোভাবে দেখে কিছুটা শিহরণ জাগলো।

প্রথম দর্শনে যদিও মনে হলো বিশাল কোনো অজগর কিংবা জলবোড়া সাপ মাথা তুলে ঘুড়ে বেড়াচ্ছে, কিন্তু পরক্ষণেই এর চলাচল দেখে ভুল ভাঙলো। জলের এই প্রানীটাকে আমরা বড় গুইসাপ বা রামগদি ইংরেজিতে যাকে Water Monitor নামেই চিনি। বেশ খানিকক্ষণ দেখে যখন সে ঝোঁপের মাঝে হারিয়ে গেলো আমরা আমাদের জাদুঘর পরিদর্শনে মনযোগ দিলাম। বৃষ্টির কারণে ময়ূরপঙ্খী স্টেজ কিংবা লাইব্রেরী কোনোটাই খুব একটা আমলে আসলো না। দ্রুত ঘুরে এসে প্রাঙ্গণের ভেতরের দোকান পাট গুলো থেকে দুটো জিনিস কেনা হলো। একটি পিতার জন্য পরিধেয় বস্ত্র আর একটি খেলনার সাপ। আমার দুই স্থপতি বন্ধুর দুটি ভিন্ন ভিন্ন ভ্রমণ স্মারক বলাই বাহুল্য আমাদের তিনজনকেই অভিভুত করলো।

ধীরে ধীরে আমরা পুনঃনির্মানাধীন শ্রী গোপীনাথ সর্দার বাড়ির কাছাকাছি চলে আসি। যদিও পুনঃনির্মানাধীন(কাজ চলছে) তাই বাকি দর্শনার্থীদের আগ্রহ না থাকলেও আমরা ভেতরে ঢুকবার সুযোগটা হাতছাড়া করলাম না। সর্দার বাড়ির চারদিকের ঘেরাটোপের ভিতর আছে দুটো উন্মুক্ত উঠান। ভেতরের উঠোনটি অন্দরবাড়ীর, ও আয়তাকার। উঠোনের চারপাশে বারান্দা আর সাথে লাগানো কক্ষ গুলো প্রতিসম।

আমরা অল্প সময়ের মধ্যে দোতলায় উঠার সিঁড়িটা খুজে পেলাম না। সম্ভবত সিঁড়িটা এখন আর নেইও। বহির্বাড়ীর উঠোনটা একটু বড়, এটাও আয়তাকার, খুব সম্ভবত পুঁজো-পার্বণ কিংবা পঞ্চায়েতের জন্য ব্যবহার হত। এখানে সিঁড়িটা খঁজতে বেগ পেতে হলো না। তাই দোতলায় উঠবার লোভও সামলাতে পারলাম না।

আয়তাকার উঠোনটির দু'প্রান্তে দালানের ছাদে দুটো ত্রিভুজাকার খিলান আছে। একটা ইতিমধ্যেই পুননির্মিত আরেকটির ভগ্নদশা এখনো দৃশ্যমান।


পোড়ামাটির ইটের তৈরী দালানটির স্থাপত্যশৈলী আর ঢালাই-লোহার তৈরি ব্র্যাকেট নির্মিত কাঠামোগত বৈশিষ্ট্য বেশ "কৌতূহলোদ্দীপক"। অন্ততঃ এর বর্ণনায় আমাকে এমন শব্দই ব্যবহার করতে বাধ্য করলো।
ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষভাগে হিন্দু আমলের রাজধানী এখানেই অবস্থিত ছিল বলে ধারণা করা হয়। স্থানীয় হিন্দু রাজা দনুজমাধব দশরথদেব (দনুজ রায়) সম্ভবত ঐ শতাব্দীর মাঝামাঝি কোন এক সময়ে বিক্রমপুর থেকে সুবর্ণগ্রামে তাঁর রাজধানী স্থানান্তর করেন। পরবর্তীকালে মুসলিম শাসকদের পুর্ববঙ্গের প্রাদেশিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছিল। প্রাচীন সুবর্ণগ্রাম থেকে সোনারগাঁও নামের উদ্ভব বলে কারো কারো ধারণা রয়েছে। ১৩২৪ খ্রিষ্টাব্দে গিয়াসউদ্দীন তুঘলক বাংলা অধিকার করে লখনৌতি, সাতগাঁও ও সোনারগাঁও- এ তিনটি প্রশাসনিক ইউনিটে বিভক্ত করেন। ফলে সোনারগাঁও বাংলার পূর্বাঞ্চলের প্রশাসনিক কেন্দ্রে পরিণত হয়। ১৩৩৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এই ব্যবস্থা অব্যাহত থাকে। ১৩৩৮ থেকে ১৩৫২ পর্যন্ত সোনারগাঁও ফখরুদ্দীন মোবারক শাহ প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন রাজ্যের রাজধানীর মর্যাদা লাভ করে। ১৩৫২ খ্রিষ্টাব্দে শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ সোনারগাঁও দখল করেন এবং সেখান থেকে মুদ্রা জারি করেন। ঈশা খাঁ ও তাঁর বংশধরদের শাসনামলে সোনারগাঁও তাদের রাজধানী ছিল। অন্য ধারণামতে বারো ভূঁইয়া প্রধান ঈশা খাঁ’র স্ত্রী সোনাবিবি’র নামানুসারে সোনারগাঁও নামকরণ করা হয়। মুসা খান এর পতনের পর (১৬১১) সোনারগাঁও মুঘল সুবাহ বাংলার একটি সরকারে পরিণত হয়। ঢাকায় মুগল রাজধানী স্থাপনের (১৬১০) পর থেকেই দ্রূত সোনারগাঁও-এর পতন শুরু হয়। মধ্যযুগীয় সোনারগাঁও-এর একটি অংশে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ থেকে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে গড়ে উঠেছিল পানাম নগর।
জাদুঘর প্রাঙ্গণ থেকে বের হয়ে আমাদের যাত্রা পানাম নগর। মটর চালিত রিকশা যে কেবল দ্রুতই ছোটে তাই নয় বরং আধুনিক মটরযানের অন্যতম আমোদকারী বৈশিষ্ট্য হিসেবে সঙ্গীতের মুর্ছনায় আমাদের বাধিত করলো। পানাম আমি শেষবার যা দেখেছিলাম এবার তা থেকে বেশ কিছুটা ভিন্নরুপে দেখলাম। গতবার পানামে কেউ ছিলো না। শুধু আমরা ৩০-৩৫ জন ছাত্র-শিক্ষক আর পানাম নগরীর নিঃস্ব ইতিহাস। কিন্তু আজ যা দেখলাম পানামের সেই নিশ্চুপ রাস্তায় কিছু শিশুদের ছন্নছাড়া ফুটবল খেলা, মানুষের চলাচল, একটা বাড়ীর দাওয়ার বসে বন্ধুদের আড্ডা, সামনে মটরবাইক, সবকিছু মিলিয়ে ইতিহাস আর বর্তমান সংস্কৃতির এক অবিমিশ্রিত রুপ।
গেরিলা চলচিত্রটি দেখার জন্যই বোধহয় মনের অজান্তে কিছুটা রদবদল করে জোরপুর্বক পুরোন ঢাকার অলিগলির সাথে আজকের পানামকে মিলিয়ে ফেলছিলাম।

আমরা কাশীনাথ ভবন থেকে পেছনে ফেরা শুরু করলাম। প্রতিটা দালানের এক ইঞ্চির ইটের স্থাপত্যে ঔপনিবেশিকতা ছাড়াও মোঘল, গ্রিক এবং গান্ধারা স্থাপত্যশৈলীর সাথে স্থানীয় কারিগরদের শিল্পকুশলতার অপূর্ব সংমিশ্রণ দেখা যায়। প্রতিটি বাড়িই ব্যবহারোপযোগিতা, কারুকাজ, রঙের ব্যবহার, এবং নির্মাণকৌশলের দিক দিয়ে উদ্ভাবনী কুশলতায় ভরপুর।


পোড়া মাটির ইটের সঙ্গে ব্যবহার করা হয়েছে ঢালাই-লোহার তৈরি ব্র্যাকেট, ভেন্টিলেটর আর জানালার গ্রিল। মেঝেতে রয়েছে লাল, সাদা, কালো মোজাইকের কারুকাজ। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই খিলান ও ছাদের মধ্যবর্তি স্থানে নীল ও সাদা ছাপ দেখা যায়। এছাড়া বাড়িগুলোতে নকশা ও কাস্ট আয়রনের কাজ নিখুঁত। কাস্ট আয়রনের এই কাজগুলো ইউরোপের কাজের সমতূল্য বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। প্রায় প্রতিটি বাড়িই অন্দরবাটি এবং বহির্বাটি -এই দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। বেশিরভাগ বাড়ির চারদিকের ঘেরাটোপের ভিতর আছে উন্মুক্ত উঠান।

বৃষ্টিতে ভেজা পানামের দালানগুলোর চারপাশে ঘুরে বেড়ানোটা খুব একটা প্রীতিকর ছিলো না। তাই আমরা পথের ধারেই ইতিহাসের স্বাদ নিয়ে ক্ষান্ত হব সিদ্ধান্ত নিলাম।

বেশ কিছু বাড়ীতে রাস্তার ধারেই সিঁড়ি আছে, যার অধিকাংশই বন্ধ কিংবা ইট দিয়ে বুজে দেয়া। কিন্তু গতবারের অভিজ্ঞতা থেকে পানামে ঢোকার অভিমুখে একটা বাড়ীর দোতলায় উঠবো ভেবে সিঁড়ির কাছে গেলাম। বাড়িটির আজ আরো বেহাল দশা, সিঁড়িটিও ইট দিয়ে বুজে দেয়া হয়েছে। তাই আমাদের আর দোতলায় উঠা হলো না।
ইতিহাস অনুসারে সমুদ্রপথে পশ্চিম এশীয় ও দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশ থেকে বাণিজ্য তরী সহজেই সোনারগাঁও-এ পৌঁছতে পারত। ইবনে বতুতা (১৩৪৬) সোনারগাঁওকে একটি গুরূত্বপূর্ণ বন্দর নগরীরুপে বর্ণনা করেন এবং চীন, ইন্দোনেশিয়া (জাভা) ও মালয় দ্বীপপুঞ্জের সঙ্গে এর সরাসরি বাণিজ্যিক সম্পর্কের কথা উল্লেখ করেন। চীনের পরিব্রাজক মা হৃয়ান (১৪০৬) সোনারগাঁওকে একটি বিরাট বাণিজ্যিক শহররুপে প্রত্যক্ষ করেন। ঊনবিংশ শতাব্দীতে সুতিবস্ত্রের, প্রধানত বিলাতি থান কাপড়ের ব্যবসাকেন্দ্র হিসেবে পানাম নগরের অভ্যুদয়ের ফলে সোনারগাঁও বাণিজ্য ক্ষেত্রে কিছুটা প্রাধান্যলাভ করে। পানাম নগরের বর্তমান ভগ্নপ্রায় এসব দালানকোঠা হচ্ছে হিন্দু ব্যবসায়ীদের তৈরি আবাসিক ভবন।

সারাটা দিন মেঘলা থাকায় বেলা নেমে এলেও কোনো পরিবর্তন বোঝা যাচ্ছিলো না। মুঠোফোনের সময় দেখে ঘরে ফেরার তাড়া এলো। আসলে মানুষের ভীড়ে পানাম নগরীকে ইতিহাসের পাতা থেকেও বর্তমান স্থানীয় এলাকাবাসীর উপযোগিতা আমার মত ভ্রমণকারীর মনসংযোগে বারবার বিঘ্ন ঘটাচ্ছিলো। যেমন করে বছরের পর বছর নিশ্চুপ নিস্তব্ধ দালানগুলো নীরবে ইতিহাসের সাক্ষীবহন করে আসছে তা অনুভব করার মুহুর্তটা মানুষের আনাগোণার ভীড়ে হারিয়ে ফেললাম।

মোগরাপাড়ায় এসে গুলিস্তানের বাসে উঠলাম। ঠিক ইফতারের ১০-১২ মিনিট আগে বাস থেকে নেমে শাহরিয়ার আর মারজুক এর কথা মনে হলো। বেচারারা রাজি হলে বোধহয় ভ্রমণ আর ইফতার দুটোই পেতো।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জুলাই, ২০১৫ ভোর ৪:৫৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




